কল্লোলের চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে।
ওপাশ থেকে জামির উৎফুল্ল গলা, ‘আচ্ছা শোন, যে জন্য ইনফ্যাক্ট ফোন করেছি। মহা সমস্যায় পড়েছি। রুমে দাঁত মাজছি। বুঝলি! রাত তখন পৌনে-।’
‘আ, জিলাপী বানাচ্ছিস কেন!’
‘কী মুশকিল, বলতে দিবি তো! বেসিনে বেশ কটা পিঁপড়া ডিনার সেরে হাঁটাহাঁটি করছে, পায়চারী-টায়চারী গোছের কিছু একটা আর কী! শালার পিঁপড়ারা সম্ভবত রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা-টবিতা পড়ে...ওয়াকস আ ন্যানো মাইল বিফোর আ স্লীপ।
‘আচ্ছা-আচ্ছা, বুঝলাম, রবার্ট ফ্রস্ট এদের কবিতা পড়ার জন্য পাঠিয়েছে। হুঁ, তারপর,’ ঘুমে কল্লোলের চোখ ভারী হয়ে আসছে। নিঃশব্দে হাই তুলল। পাগলটা কতক্ষণ জ্বালাবে কে জানে! অসাধারণ লোকগুলো আধপাগলা হয় কেন কে জানে!
জামি মহা উৎসাহে আবারও শুরু করল, ‘তুই ব্যাটা দেখি থ্রি স্টুজেসকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিস। তো, পিঁপড়াদের সরাতে বেশ ক’বার চেষ্টা করেছি। এরা গা করছে না। এদের কাছে আমি কি, বল কি, দৈত্য না? কান্ড দেখ, আমার মত দৈত্যকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছে না। শালা সব আহাম্মক তো, শরীরের চেয়ে চল্লিশ গুণ বেশি ওজন অনায়াসে হাসতে হাসতে টেনে নিয়ে যায়। কুলি করতে পারছি না, পেস্ট শুকিয়ে চটচট করছে। কী অবস্থা, বল দেখি।’
‘বিরাট সমস্যা,’ ঘুমে কল্লোলের দু'চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে, হাত থেকে রিসিভার গড়িয়ে পড়তে চাইছে। চোখের পাতা জোর করে সিকিভাগ খুলে বলল, ‘এক কাজ কর, টানাটানি করে বেসিনটা খুলে ফেল। সমস্যা হলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুড়িয়ে দে। এইবার বেসিনের পাইপে মুখ লাগিয়ে কুলি কর, আরাম পাবি।’
এই প্রথম জামি খানিকটা রেগে গেল, ‘আমি সিরিয়াস, আর তুই কী না ফাজলামো করছিস!’
‘আচ্ছা, তুই সিরিয়াস তাহলে, আই সী! এক কাজ কর, পানি ঢেলে দে।’
‘কী বলছিস, সব ভেসে যাবে যে।’
‘ভেসে গেলে ভেসে যাবে, পিঁপড়াই তো! পিঁপড়া খাওয়ার চল এদেশে এখনও চালু হয়নি। চল থাকলে, কোটি কোটি পিঁপড়া ভাজি করে খেয়ে ফেলতি, মচ্ছব হয়ে যেত। অথবা ধর, ভাতের বদলে পিঁপড়া সেদ্ধ করে খাওয়া শুরু হল। নাম হল, 'পিঁপড়া ভাত'।’
‘এই, এই সব কী বলছিস,’ জামির আহত গলা।
‘জেনেশুনেই বলছি। মিঞা রসিক লাল, রস করার আর জায়গা পাও না! কুলি করার জায়গা পাচ্ছ না, হুপ। দুর্গের মত বাড়িতে আর বেসিন-টয়লেট নেই, নিদেনপক্ষে একটা ডিব্বাও নেই!’
জামি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমার রুমে এ্যাটাচ বাথ নাই। এটা তুই জানিস, জানিস না? সরি, তোকে ডিস্টার্ব করলাম। বাই।’
কল্লোল কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল, ওপাশ থেকে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ও কী রাগ করল? আধ ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল! ওপাশ থেকে কেউ টেলিফোন উঠাল না! সম্ভবত টেলিফোনের প্লাগ খুলে ফেলেছে। এই আধ ঘন্টায় কল্লোল জামির তিন চৌদ্দ বেয়াল্লিশ গুষ্টি উদ্ধার করল।
কল্লোল নিজের রুমে ঢুকে অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কাছাকাছি কোথাও ওয়াজ হচ্ছে। নিশুতি এ রাতে কিসের ওয়াজ! ফুল ভল্যুমে মাইক। ওর প্রচন্ড ইচ্ছা করছে, উঠে দেখে আসে, এই মধ্য রাতে ক’জনের ধর্ম উদ্ধার হচ্ছে। সংখ্যা গরিষ্ট এই ধর্মের লোকজনের কথা উপেক্ষা করলেও অন্য ধর্মের লোকজনকে যন্ত্রণা দেয়া কেন?
পূর্বে ওরা যে বাসায় থাকত, পাশেই মসজিদ ছিল। মসজিদের ছাদের সমস্ত পানি ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাস্তার উপর, মসজিদের অন্য পাশগুলো ফাঁকা। বর্ষাকালে রাস্তায় পানি পড়ে প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে যেত। লোকজন ভিজে জবজবা। বৃষ্টি থামার অনেকক্ষণ পরও চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ত।
ওই মসজিদের চারপাশে জানালা ছিল। অধিকাংশ সময় রাস্তার দিকে জানালাগুলো খোলা থাকত। মুসুল্লী সাহেবানগণ প্রচুর সময় নিয়ে গলা পরিস্কার করে, কফসহ থুথু সজোরে রাস্তার উপর ফেলতেন। একবার কল্লোলের উপর থুথু পড়ল। সর্তক হয়ে থুথু ফেলার জন্য ও কেন বলল, এ নিয়ে মুসল্লীরা বাজার জমিয়ে ফেললেন। প্রায় সবারই বক্তব্য অভিন্ন। মসজিদ থাকলে জানালা থাকবে, জানালা থাকলে থুথু ফেলা হবেই, থুথু ফেললে কারও না কারও গায়ে পড়বে, এ তো বিচিত্র কিছু না।
পরে একসময় এ মসজিদের ইমাম সাহেবকে ব্যাপারটা জানাল। ইমাম সাহেব অমায়িক ভঙ্গিতে জানালেন, নামাজীদের মত থুথুও পবিত্র। এইসব নিয়ে হইচই করায় খানিকটা ভৎর্সনাও করলেন। কল্লোল কেবল নির্বোধ চোখে তাকিয়ে ছিল, একটা কথও না-বলে ওখান থেকে সরে এসেছিল।
আগুনে সিগারেটের ছ্যাকা লাগতেই তাড়াহুড়ো করে এ্যাসট্রেতে সিগারেট ফেলল। উঠে জানালা বন্ধ করেও খুব একটা লাভ হল না। এ ঘরের ফ্যানটা নস্ট, গরমে সেদ্ধ হতে হবে। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে জামির কথা ভাবল, ছেলেটা হুটহাট করে এমন সব পাগলামী করে। বেশ ক’বছর আগের কথা। বই মেলায় এক লেখিকাকে দেখে ফট করে বলে বসল: ম্যাডাম, আপনার কি জ্যাক দ্য রিপার-এর সঙ্গে পরিচয় আছে?
ঐ ভদ্রমহিলা সম্ভবত কোন বান্ধবী-টান্ধবীর সঙ্গে গল্প করছিলেন। থতমত খেয়ে গেলেন: কি বলছেন, কে আপনি?
ম্যাম, আমি কে এটা তো আপনার জেনে কাজ নেই। আপনার গদ্য লেখার হাত পছন্দ করি, অবশ্য সব লেখা না। ওদিন লিখলেন, আপনার প্রতিভা বুঝতে পারে এমন কোন পুরুষ এ শহরে নেই। আপনার যোগ্য কোন পুরুষ নেই। ঘুরিয়ে বললে, কোন পুরুষ আপনার নখের যোগ্য না, এইসব আজেবাজে কথা। এই জন্যই জানতে চাইছিলাম, জ্যাক দ্য রিপারের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে কি না, ওই ভদ্রলোক পরম যত্নে নেইল কাটার দিয়ে আপনার পায়ের নখগুলো কেটে দিত।
লেখিকার ডাগর চোখে আগুন, শাটআপ, ইয়্যু রাস্কেল!
ইজি ম্যাম। লেখেন তো শুধু এইসব অথচ তুচ্ছ, অমানুষ পুরুষদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মাখামাখি করতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচবোধ করেন না। কী অসাধারণ একটা উপায়ই না বের করেছেন। অসংখ্য মূর্খ লোকজন, সরকার আপনাকে নিয়ে লাফাতে থাকবে, অজান্তেই অসম্ভব নাম করে ফেলবেন। নোবেল-টোবেল পেয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু না।
কল্লোল জামিকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল। জামি অসহ্য রাগে ওকে খামচে দিয়েছিল। চোখ লাল করে বলেছিল: আহাম্মক, আগ বাড়িয়ে দিলি তো পন্ড করে।
কল্লোলও সমান তেজে বলেছিল: এনাফ, যথেষ্ট পাগলামী হয়েছে।
হোয়াইট ডু য়্যু মীন বাই পাগলামী, জামি দুর্দান্ত রাগে কাঁপছিল বলেই ওর কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। সমানে চেঁচাচ্ছিল, নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা এইসব নিয়ে এত হল্লা করার কী প্রয়োজন। নারীরা আজ পাইলট হচ্ছে, মহাশূন্যে যাচ্ছে, বডি বিল্ডিং করছে। কাজের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে ওদের একাগ্রতা বেশি, অনেক ক্ষেত্রে আই কিউও বেশি। নারী পুরুষে পার্থক্যটা কী? নারীদের গর্ভধারন করতে হয়, মাসের বিশেষ কিছু দিনে অনেকে কাবু হয়ে পড়ে, এই-ই তো! এটা তো কাঠামোগত পার্থক্য। একজন প্রাচীন লোকের শরীলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, যুবকের বেশি, সো। লড়াই করা উচিত মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে। নারী স্বাধীনতা কি আবার , বা...।
কল্লোল ভারী বিব্রত হচ্ছিল। কী লজ্জা, চারপাশে লোকজন জমে গিয়েছিল। আসলে জামি রেখে ঢেকে কথা বলতে জানে না। ভান জিনিসটা ওর মধ্যে একেবারেই নেই। ওদের এক বন্ধু সুবির, মহা গল্পবাজ। দুনিয়ার যতসব গায়ে জ্বালা ধরানো কথা কল্লোলরা সহ্য করে যেত। কিন্তু জামি থাকলেই সেরেছে, মহা ভজঘট। একদিন সুবির চোখ মুখ আলো করে বলছিল: জানিস, আমার মামার না ডেইলি দশ হাজার টাকার ফ্রুটস লাগে।
জামি তক্কে তক্কে ছিল, কথাটা মাটিতে পড়তে দিল না। দু’কান লম্বা হাসি নিয়ে বলল: তোর কোন মামা?
আরে ওই যে, চিনিস না, গোল্ড মার্চেন্ট।
ওয়াও, ওদের টয়লেট কটা রে, জামির নিরীহ মুখ।
সুবির চোখ ছোট করে বলল: ওদের টয়লেট কটা এ খবর জানতে চাচ্ছিস কেন!
জামি গৃহপালিত জন্তুর মত মুখ করে বলল: না মানে জানতে চাচ্ছিলাম এজন্যে, ডেইলি দশ হাজার টাকার ফ্রুটস, আঙ্গুরই পাওয়া যাবে আনুমানিক দেড় মণ। তা, দু-চারটা টয়লেটে তো কুলাবে না।
জামি, খবরদার, খবরদার বলছি, সুবির রাগে দিশেহারা।
আরে যা-যা, মামদোবাজি আর কী। শালা চাপাবাজ, আমরা ডুডু খাই না।
কল্লোলের চোখের পাতা ভারী হয়ে গেল। জামির কথা, ওয়াজের কথা সব মিলিয়ে গেল।
সহায়ক লিংক:
*ফিরে দেখা, ১: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_24.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Friday, November 26, 2010
ফিরে দেখা: ২
বিভাগ
তিতলি তুমিও
Subscribe to:
Posts (Atom)