আমি কোনো একটা লেখায় লিখেছিলাম, 'ডাক্তার হচ্ছেন, দ্বিতীয় ঈশ্বর- আসলে মিছামিছি ঈশ্বর'। আসল ঈশ্বরের, এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিকের মুখোমুখি হয়ে মাথায় সব জট পাকিয়ে যায়। সেই জট খোলার ব্যর্থ চেষ্টা, সবিরাম।
সেই ম্যাজিশিয়ানের লাইভ শো-এর এক দর্শক আদিল আবীর লিখছেন:
"কি বলে সম্বোধন করা যায় তাকে?
অনুপ্রাণ, না ফোটা ফুল?
আমার অবশ্য অনুপ্রাণই ভাল লাগে বলতে।
এই অনুপ্রাণটি মাতৃজঠরে কাটিয়েছে ১১টি সপ্তাহ!
মায়ের রক্তের প্রবাহে মিশে থাকা নির্যাস থেকে
একটু একটু করে জমে বিন্দু থেকে অবয়বে।
প্রাণের যাবতীয় স্পন্দন বুভুক্ষের মত
কাতর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় গিলেছে সে গোগ্রাসে।
আদিতে যে অনুবৃত্তে তার ঠাই হয়
চরম অনুগত হয়ে শক্ত খুঁটি গেড়ে সেখানেই
একমনে একধ্যানে গড়ে তোলে সুরক্ষার বসত।
তার মস্তিস্ক অনুক্ষণ প্রস্তুত হতে থাকে আগামীর
স্মৃতি ধারণের শূণ্যতায়, মননের তৃষায়।
আহা, আর মাত্র ২৫/৩০টি সপ্তাহ-ই তো।
অজানা এক বিশ্ব তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে,
অচেনা সব বিস্ময় চিনে নেয়ার দুর্নিবার এক
আকাঙ্ক্ষা তাকে মুহুর্মুহু শিহরিত করেছে।
বড় হতে হতে, বেড়ে উঠে উঠে ক্রমশ
অজানা এক আশংকাও দুঃস্বপ্ন হয়ে তাকে
কি যেন বলেও গেছে ইশারায়- অবুঝ কচি অনুপ্রাণ
সব ভ্রুকুটি আর ইঙ্গিত উপেক্ষা করে অপেক্ষায় থাকে।
কিন্তু একদিন সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই
হাঁসফাঁস করতে থাকে, কি যেন চেপে আসছে!
কি যেন তাকে সমূলে উৎখাত করবে বলে দানবিক
শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে, আসছে, আসছেই।
সে বুঝতে পারে না কি করবে, কাকে ডাকবে
কোথায়ই বা যাবে! সে তার আশ্রয় দাত্রীর মুখখানা
স্মরণ করার চেষ্টা করে, শুধু বিস্মৃতি আর
সীমাহীন অন্ধকার ছাড়া তার সঙ্গী যে কেউ নেই।
উষ্ণ আঁধারের সান্দ্র প্রবাহে প্লাবিত হতে হতে
যখন যে স্বপ্নের হাতছোঁয়া দূরত্বে এসে দাঁড়ায়।
সুতীব্র আলোর ঝড় তাকে প্রায় বিবশ করে দেয়।
এত দ্রুত গতির স্বপ্ন পুরণ তার আর সহ্য হতে চায় না।
এই এগারটি সপ্তাহের সব কিছু সে ভুলে
যেতে চেয়েছিল, তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাবার আগে।
এই আরাধ্য পৃথিবীর আলোবাতাসের মাঝে এসে
হৃদযন্ত্রের ভাষায় আর ক্ষীণ অবয়ব নেড়েচেড়ে
অবোধ্য কি যেন বলে যেতে চেয়েছিল।
অনুপ্রাণের সেই অভিমানী অনুরণন
সারাটি জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে আমায়।
আহা তার কষ্টটা আর কোনো ভাবেই
জানা গেলনা, জানা গেল না, জানা যাবে না।
এই নিরর্থকতাকে তাই অভিশাপ
দিয়ে যেতে চাই, দিয়ে যেতে চাই।
আমি কবি-সাহিত্যিক নই যে গুছিয়ে লিখতে পারব, ডাক্তার হিসেবে আমার সেই ক্ষমতা কই! তবে এটা যে আমার উপর এরকম প্রভাব ফেলবে সেটা আগে বুঝতে পারিনি!
একটা বাচ্চা গর্ভে এলেও নানা রকম সম্ভাবনা থাকে প্রস্ফুটিত না-হবার। তার একটা হল, জরায়ুর বাইরে কোথাও তা থাকলে, যেমন ডিম্বাশয় বা ডিম্বনালিতে। ২/৩ মাস পর এরা এমনিতেই স্থান সংকুলান করতে না-পেরে ফেটে যায়, রক্ত সঞ্চালন না-থাকলে এমনিতেই মরে যায়।
এমনই এক ঘটনা ঘটল। এভাবে এক্টপিক প্রেগ্নেন্সিতে ফেটে যাওয়াটা দারুণ এক জরুরি অবস্থা। আভ্যন্তরীণ রক্ত ক্ষরণে মা মরে যেতে পারেন। তাই অপারেশন অতি জরুরি। তো, তেমনই এক অপারেশনে এটেন্ড করি। যথারীতি ৮/৯ ঘণ্টা আগে ডিম্বাশয় ফেটে যায় পেশেন্ট শকে। ভ্রুণ মরে যায় সঙ্গে সঙ্গে, কেননা রক্ত সঞ্চালনের নালী ফেটে সঞ্চালন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কিন্তু এখন এর ব্যতিক্রম হল! আল্ট্রাসনোগ্রাফি বলছে, হার্ট ইজ বিটিং অর্থাৎ ভ্রুণ বেঁচে আছে। ৭/৮ ঘণ্টা আগে করা বলে আমরা রিপোর্ট পাত্তা দেইনি। কিন্তু দলা দলা রক্তের চাকার সঙ্গে ভ্রুণের যে স্যাকটি বেরিয়ে এল তা দেখে আমরা হতভম্ব। ভ্রূণটি বেঁচে আছে!
স্যাক ভাঙ্গেনি বলে বেজ বল আকারের স্যাকটির ভেতরে বাচ্চাটি নড়ছিল। স্বচ্ছ দেহ, সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। হাত-পা, এমনকি হৃৎপিণ্ডটিও বিট করছিল। ৩/৪ মিনিট পর ছটফট করতে করতে সেটি নিস্তেজ হয়ে গেল।
আমার বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, প্রাণ দেবেই যখন তখন ভ্রুণের জন্মটা যথাস্থানে দিলে না কেন? মরাই যখন নিয়তি তখন এই ৭/৮ ঘন্টা কেন প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখলে? আর হে পরম করুণাময় আমাকেই কেন এই অনুপ্রাণটির অর্থহীন মৃত্যু দেখালে, কেন-কেন-কেন...?" আদিল আবীর
*নীচে, সেই ভ্রণটির ছবি যোগ করা হচ্ছে। দুর্বল চিত্তের লোকজনের সেটা না-দেখাটাই ভাল...
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
সেই ম্যাজিশিয়ানের লাইভ শো-এর এক দর্শক আদিল আবীর লিখছেন:
"কি বলে সম্বোধন করা যায় তাকে?
অনুপ্রাণ, না ফোটা ফুল?
আমার অবশ্য অনুপ্রাণই ভাল লাগে বলতে।
এই অনুপ্রাণটি মাতৃজঠরে কাটিয়েছে ১১টি সপ্তাহ!
মায়ের রক্তের প্রবাহে মিশে থাকা নির্যাস থেকে
একটু একটু করে জমে বিন্দু থেকে অবয়বে।
প্রাণের যাবতীয় স্পন্দন বুভুক্ষের মত
কাতর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় গিলেছে সে গোগ্রাসে।
আদিতে যে অনুবৃত্তে তার ঠাই হয়
চরম অনুগত হয়ে শক্ত খুঁটি গেড়ে সেখানেই
একমনে একধ্যানে গড়ে তোলে সুরক্ষার বসত।
তার মস্তিস্ক অনুক্ষণ প্রস্তুত হতে থাকে আগামীর
স্মৃতি ধারণের শূণ্যতায়, মননের তৃষায়।
আহা, আর মাত্র ২৫/৩০টি সপ্তাহ-ই তো।
অজানা এক বিশ্ব তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে,
অচেনা সব বিস্ময় চিনে নেয়ার দুর্নিবার এক
আকাঙ্ক্ষা তাকে মুহুর্মুহু শিহরিত করেছে।
বড় হতে হতে, বেড়ে উঠে উঠে ক্রমশ
অজানা এক আশংকাও দুঃস্বপ্ন হয়ে তাকে
কি যেন বলেও গেছে ইশারায়- অবুঝ কচি অনুপ্রাণ
সব ভ্রুকুটি আর ইঙ্গিত উপেক্ষা করে অপেক্ষায় থাকে।
কিন্তু একদিন সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই
হাঁসফাঁস করতে থাকে, কি যেন চেপে আসছে!
কি যেন তাকে সমূলে উৎখাত করবে বলে দানবিক
শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে, আসছে, আসছেই।
সে বুঝতে পারে না কি করবে, কাকে ডাকবে
কোথায়ই বা যাবে! সে তার আশ্রয় দাত্রীর মুখখানা
স্মরণ করার চেষ্টা করে, শুধু বিস্মৃতি আর
সীমাহীন অন্ধকার ছাড়া তার সঙ্গী যে কেউ নেই।
উষ্ণ আঁধারের সান্দ্র প্রবাহে প্লাবিত হতে হতে
যখন যে স্বপ্নের হাতছোঁয়া দূরত্বে এসে দাঁড়ায়।
সুতীব্র আলোর ঝড় তাকে প্রায় বিবশ করে দেয়।
এত দ্রুত গতির স্বপ্ন পুরণ তার আর সহ্য হতে চায় না।
এই এগারটি সপ্তাহের সব কিছু সে ভুলে
যেতে চেয়েছিল, তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাবার আগে।
এই আরাধ্য পৃথিবীর আলোবাতাসের মাঝে এসে
হৃদযন্ত্রের ভাষায় আর ক্ষীণ অবয়ব নেড়েচেড়ে
অবোধ্য কি যেন বলে যেতে চেয়েছিল।
অনুপ্রাণের সেই অভিমানী অনুরণন
সারাটি জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে আমায়।
আহা তার কষ্টটা আর কোনো ভাবেই
জানা গেলনা, জানা গেল না, জানা যাবে না।
এই নিরর্থকতাকে তাই অভিশাপ
দিয়ে যেতে চাই, দিয়ে যেতে চাই।
আমি কবি-সাহিত্যিক নই যে গুছিয়ে লিখতে পারব, ডাক্তার হিসেবে আমার সেই ক্ষমতা কই! তবে এটা যে আমার উপর এরকম প্রভাব ফেলবে সেটা আগে বুঝতে পারিনি!
একটা বাচ্চা গর্ভে এলেও নানা রকম সম্ভাবনা থাকে প্রস্ফুটিত না-হবার। তার একটা হল, জরায়ুর বাইরে কোথাও তা থাকলে, যেমন ডিম্বাশয় বা ডিম্বনালিতে। ২/৩ মাস পর এরা এমনিতেই স্থান সংকুলান করতে না-পেরে ফেটে যায়, রক্ত সঞ্চালন না-থাকলে এমনিতেই মরে যায়।
এমনই এক ঘটনা ঘটল। এভাবে এক্টপিক প্রেগ্নেন্সিতে ফেটে যাওয়াটা দারুণ এক জরুরি অবস্থা। আভ্যন্তরীণ রক্ত ক্ষরণে মা মরে যেতে পারেন। তাই অপারেশন অতি জরুরি। তো, তেমনই এক অপারেশনে এটেন্ড করি। যথারীতি ৮/৯ ঘণ্টা আগে ডিম্বাশয় ফেটে যায় পেশেন্ট শকে। ভ্রুণ মরে যায় সঙ্গে সঙ্গে, কেননা রক্ত সঞ্চালনের নালী ফেটে সঞ্চালন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কিন্তু এখন এর ব্যতিক্রম হল! আল্ট্রাসনোগ্রাফি বলছে, হার্ট ইজ বিটিং অর্থাৎ ভ্রুণ বেঁচে আছে। ৭/৮ ঘণ্টা আগে করা বলে আমরা রিপোর্ট পাত্তা দেইনি। কিন্তু দলা দলা রক্তের চাকার সঙ্গে ভ্রুণের যে স্যাকটি বেরিয়ে এল তা দেখে আমরা হতভম্ব। ভ্রূণটি বেঁচে আছে!
স্যাক ভাঙ্গেনি বলে বেজ বল আকারের স্যাকটির ভেতরে বাচ্চাটি নড়ছিল। স্বচ্ছ দেহ, সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। হাত-পা, এমনকি হৃৎপিণ্ডটিও বিট করছিল। ৩/৪ মিনিট পর ছটফট করতে করতে সেটি নিস্তেজ হয়ে গেল।
আমার বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, প্রাণ দেবেই যখন তখন ভ্রুণের জন্মটা যথাস্থানে দিলে না কেন? মরাই যখন নিয়তি তখন এই ৭/৮ ঘন্টা কেন প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখলে? আর হে পরম করুণাময় আমাকেই কেন এই অনুপ্রাণটির অর্থহীন মৃত্যু দেখালে, কেন-কেন-কেন...?" আদিল আবীর
*নীচে, সেই ভ্রণটির ছবি যোগ করা হচ্ছে। দুর্বল চিত্তের লোকজনের সেটা না-দেখাটাই ভাল...
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.