Search

Friday, September 6, 2013

কেন-কেন-কেন!

আমি কোনো একটা লেখায় লিখেছিলাম, 'ডাক্তার হচ্ছেন, দ্বিতীয় ঈশ্বর- আসলে মিছামিছি ঈশ্বর'। আসল ঈশ্বরের, এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিকের মুখোমুখি হয়ে মাথায় সব জট পাকিয়ে যায়। সেই জট খোলার ব্যর্থ চেষ্টা, সবিরাম।
সেই ম্যাজিশিয়ানের লাইভ শো-এর এক দর্শক আদিল আবীর লিখছেন:
"কি বলে সম্বোধন করা যায় তাকে?
অনুপ্রাণ, না ফোটা ফুল?
আমার অবশ্য অনুপ্রাণই ভাল লাগে বলতে।
এই অনুপ্রাণটি মাতৃজঠরে কাটিয়েছে ১১টি সপ্তাহ!
মায়ের রক্তের প্রবাহে মিশে থাকা নির্যাস থেকে
একটু একটু করে জমে বিন্দু থেকে অবয়বে।
প্রাণের যাবতীয় স্পন্দন বুভুক্ষের মত
কাতর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় গিলেছে সে গোগ্রাসে।

আদিতে যে অনুবৃত্তে তার ঠাই হয়
চরম অনুগত হয়ে শক্ত খুঁটি গেড়ে সেখানেই
একমনে একধ্যানে গড়ে তোলে সুরক্ষার বসত।
তার মস্তিস্ক অনুক্ষণ প্রস্তুত হতে থাকে আগামীর
স্মৃতি ধারণের শূণ্যতায়, মননের তৃষায়।
আহা, আর মাত্র ২৫/৩০টি সপ্তাহ-ই তো।

অজানা এক বিশ্ব তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে,
অচেনা সব বিস্ময় চিনে নেয়ার দুর্নিবার এক
আকাঙ্ক্ষা তাকে মুহুর্মুহু শিহরিত করেছে।
বড় হতে হতে, বেড়ে উঠে উঠে ক্রমশ
অজানা এক আশংকাও দুঃস্বপ্ন হয়ে তাকে
কি যেন বলেও গেছে ইশারায়- অবুঝ কচি অনুপ্রাণ
সব ভ্রুকুটি আর ইঙ্গিত উপেক্ষা করে অপেক্ষায় থাকে।

কিন্তু একদিন সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই
হাঁসফাঁস করতে থাকে, কি যেন চেপে আসছে!
কি যেন তাকে সমূলে উৎখাত করবে বলে দানবিক
শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে, আসছে, আসছেই।
সে বুঝতে পারে না কি করবে, কাকে ডাকবে
কোথায়ই বা যাবে! সে তার আশ্রয় দাত্রীর মুখখানা
স্মরণ করার চেষ্টা করে, শুধু বিস্মৃতি আর
সীমাহীন অন্ধকার ছাড়া তার সঙ্গী যে কেউ নেই।

উষ্ণ আঁধারের সান্দ্র প্রবাহে প্লাবিত হতে হতে
যখন যে স্বপ্নের হাতছোঁয়া দূরত্বে এসে দাঁড়ায়।
সুতীব্র আলোর ঝড় তাকে প্রায় বিবশ করে দেয়।
এত দ্রুত গতির স্বপ্ন পুরণ তার আর সহ্য হতে চায় না।
এই এগারটি সপ্তাহের সব কিছু সে ভুলে
যেতে চেয়েছিল, তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাবার আগে।
এই আরাধ্য পৃথিবীর আলোবাতাসের মাঝে এসে
হৃদযন্ত্রের ভাষায় আর ক্ষীণ অবয়ব নেড়েচেড়ে
অবোধ্য কি যেন বলে যেতে চেয়েছিল।

অনুপ্রাণের সেই অভিমানী অনুরণন
সারাটি জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে আমায়।
আহা তার কষ্টটা আর কোনো ভাবেই
জানা গেলনা, জানা গেল না, জানা যাবে না।
এই নিরর্থকতাকে তাই অভিশাপ
দিয়ে যেতে চাই, দিয়ে যেতে চাই।

আমি কবি-সাহিত্যিক নই যে গুছিয়ে লিখতে পারব, ডাক্তার হিসেবে আমার সেই ক্ষমতা কই! তবে এটা যে আমার উপর এরকম প্রভাব ফেলবে সেটা আগে বুঝতে পারিনি!
একটা বাচ্চা গর্ভে এলেও নানা রকম সম্ভাবনা থাকে প্রস্ফুটিত না-হবার। তার একটা হল, জরায়ুর বাইরে কোথাও তা থাকলে, যেমন ডিম্বাশয় বা ডিম্বনালিতে। ২/৩ মাস পর এরা এমনিতেই স্থান সংকুলান করতে না-পেরে ফেটে যায়, রক্ত সঞ্চালন না-থাকলে এমনিতেই মরে যায়।

এমনই এক ঘটনা ঘটল। এভাবে এক্টপিক প্রেগ্নেন্সিতে ফেটে যাওয়াটা দারুণ এক জরুরি অবস্থা। আভ্যন্তরীণ রক্ত ক্ষরণে মা মরে যেতে পারেন। তাই অপারেশন অতি জরুরি। তো, তেমনই এক অপারেশনে এটেন্ড করি। যথারীতি ৮/৯ ঘণ্টা আগে ডিম্বাশয় ফেটে যায় পেশেন্ট শকে। ভ্রুণ মরে যায় সঙ্গে সঙ্গে, কেননা রক্ত সঞ্চালনের নালী ফেটে সঞ্চালন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
 

কিন্তু এখন এর ব্যতিক্রম হল! আল্ট্রাসনোগ্রাফি বলছে, হার্ট ইজ বিটিং অর্থাৎ ভ্রুণ বেঁচে আছে। ৭/৮ ঘণ্টা আগে করা বলে আমরা রিপোর্ট পাত্তা দেইনি। কিন্তু দলা দলা রক্তের চাকার সঙ্গে ভ্রুণের যে স্যাকটি বেরিয়ে এল তা দেখে আমরা হতভম্ব। ভ্রূণটি বেঁচে আছে!

স্যাক ভাঙ্গেনি বলে বেজ বল আকারের স্যাকটির ভেতরে বাচ্চাটি নড়ছিল। স্বচ্ছ দেহ, সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। হাত-পা, এমনকি হৃৎপিণ্ডটিও বিট করছিল। ৩/৪ মিনিট পর ছটফট করতে করতে সেটি নিস্তেজ হয়ে গেল।

আমার বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, প্রাণ দেবেই যখন তখন ভ্রুণের জন্মটা যথাস্থানে দিলে না কেন? মরাই যখন নিয়তি তখন এই ৭/৮ ঘন্টা কেন প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখলে? আর হে পরম করুণাময় আমাকেই কেন এই অনুপ্রাণটির অর্থহীন মৃত্যু দেখালে, কেন-কেন-কেন...?" আদিল আবীর

*নীচে, সেই ভ্রণটির ছবি যোগ করা হচ্ছে। দুর্বল চিত্তের লোকজনের সেটা না-দেখাটাই ভাল...
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.


Tuesday, September 3, 2013

বিচার- প্রহসনের নামে খুন!

(সূত্র: আনোয়ার কবিরের 'সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা' থেকে)
১৯৭৭ সালে ঢাকা কারাগারে বন্দি ছিলেন রইসউদ্দিন আরিফ। তিনি গণফাঁসির প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়:
"...'ওখান থেকে, যেমন করে ছাগল বেঁধে নিয়ে বধ্যভূমিতে জবাই করার জন্য , এমন করে নয়-দশ জনকে হাত এবং বুক বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে! এদের চিৎকার, এদর গোঙানি, এদের আহাজারির শব্দটিই- এতো বিকট একটা শব্দ, এই শব্দ আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত!

তাৎক্ষণিক ভাবে জানতে পারলাম, এই লোকগুলোর জন্য জেলঅফিসে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এদের বিচার কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। যাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকেই ফাঁসি দেওয়া হবে। তারপরেই তাদেরকে বধ্যভূমিতে যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে তাদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। এখন তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য! টলতে টলতে গেল তারা আমাদের চোখের সামনেই।

...এভাবে ফাঁসি হলো। এটা হলো প্রথম রাতের ঘটনা। এই ঘটনাটি প্রতি রাতেই ঘটতে থাকল। ...একই অবস্থা, একই দৃশ্য, কখনও হয়তো ছয়জন, কখনও সাতজন, কখনও সাতজন একসাথে, নয়জন একসাথে। তখন আর আমাদের ঘুমই হতো না। দিনের বেলায়ও আমরা সতর্ক থাকতাম, দিনের বেলায়ও এরকম ফাঁসি দেয় কিনা...।

এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা যেটা মনে হয়েছে। একজন ফাঁসির আসামীকে যখন টেনে ঝোলানো হচ্ছিল সে সবচেয়ে বেশী প্রতিবাদী ছিল। তার যে চিৎকার তা সম্ভবত জেলখানার বাইরেও পৌঁছে গিয়েছিল। জোর-জবরদস্তি করে তাকে যখন ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় তখনও সে ধস্তাধস্তি করছিল। যখন ফাঁসির রশি তার গলায় দিয়ে নীচের পাদানিতে ফেলে দেওয়া হয় তখন সে এতো জোরে পড়ে গিয়েছিল যে তার গলা ছিঁড়ে গিয়েছিল। নৃশংসতার মধ্যেও এখানে আরো অনেক নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছিল।
এভাবে অবিরাম গণফাঁসি চলছিল।

বিচার নামের এই পর্বের নমুনা ছিল এমন। ৩০ জনের বিচার শেষ হতে ১৫ মিনিটও লাগেনি! একজন মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে, ফাঁসিতে ঝোলানো হবে অথচ আধা মিনিটও লাগেনি! জাস্ট অর্ডার এবং আগে থেকেই অর্ডার হয়ে আছে- ব্যস, ঘোষণা দেওয়া হলো, তোমার ফাঁসি হবে।
...এই যে গণফাঁসি, এটি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দু'শ বছর ইতিহাসে বিরল ঘটনা এবং এটি নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা।'

কর্পোরাল নূরুল ইসলাম, ১৯৭৭ সালের ঘটনায় চার বছরের কারাদন্ড প্রাপ্ত। তাঁর বর্ণনা:
...'প্রত্যেক দিনই ধরে ধরে নিয়ে ফাঁসি দিতে লাগল।...এরকম হাজারও লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ফাঁসি দিতে গিয়ে গলা ছিঁড়ে পড়ে গেছে এরকম ঘটনাও আছে। লিপির আব্বার গলা ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। ফাঁসি বাদে কত লোক যে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে এটিরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি'!

কর্পোরাল খায়রুল আনোয়ার। ১৮৭৭ সালের ঘটনায় ৮ বছর কারাদন্ড প্রাপ্ত। তাঁর বর্ণনা:
...'কর্পোরাল আকবারের ২ বছরের সাজা হয়েছিল, আর আর্মির একই নামের, তার নামও আকবর, সেই সৈনিকের মৃত্যুদন্ড হয়েছিল। সে রাতে আর্মির আকবরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার কথা। সে কনডেম সেলে বসে আল্লাহকে ডাকছিল, তাই তারা যখন আকবরের নাম ধরে ডাকে তখন হয়তো শোনেনি বলে উত্তর দেয়নি।
এদিকে যারা ফাঁসি দিত তাদের হাতে সময় কম থাকত। তো, আকবর বলে যখন ডাকছিল তখন অন্যজন কর্পোরাল আকবর উত্তর দেয়ার পরই তাকে ধরে নিয়ে গেল। সে বারবার বলছিল আমার তো ২ বছরের জেল হয়েছে, আমার তো ফাঁসির আদেশ হয়নি। তারা সেই আকবরের কোনো কথাই শুনছিল না। তাকে শেষ গোসল করিয়ে যমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গেল। তার গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে দিল।
শেষ ইচ্ছা জানার সময় সে বলল, ঠিক আছে আপনারা আমাকে অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিচ্ছেন, দেন, আমার কোনো কথাই শুনছেন না, আমার বাবার নাম, কোথায় চাকরি করি তাও শুনছেন না! এয়ারফোর্সের নাম্বার এবং আর্মির নাম্বারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে। আপনারা অন্তত এই নাম্বারটা মিলিয়ে দেখেন।
যাই হোক, নাম্বার মিলিয়ে দেখা গেল, নাম্বার মিলছে না।
পরে জেলার তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনলেন।

,,,কর্পোরাল আরজু তখন বিমানবাহিনীর চিফ অভ এয়ার স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদের বডিগার্ড। এই আরজুই সেই টালমাটাল অবস্থার সময় এজি মাহমুদকে নিরাপদে পার করে দেয়। অথচ ফাঁসির আগে বারবার বলছিলেন, আপনারা এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদকে জিজ্ঞেস করুন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম কি না বা আমি এই বিদ্রেহের সঙ্গে জড়িত ছিলাম কি না। কিন্তু কেউ কর্পোরাল আরজুর কথায় কান দেয়নি! একবারও কেউ এজি মাহমুদকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করেনি! কর্পোরাল আরজুর ফাঁসি হয়ে যায়...'।"          

*১৯৭৭ সালে যে রহস্যময় সেনা অভ্যুত্থান হয় [১] তখনই অনেককেই মেরে ফেলা হয়। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের বিচারের নামে স্রেফ খুন করা হয়। যার অসংখ্য নমুনা থেকে সামান্যই এখানে উল্লেখ করা হলো।

১. ঢাকায় রহস্যময় বিমান-সেনা হামলা (অভ্যুত্থান)!: https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151605687217335