Search

Wednesday, February 10, 2010

মা এবং তাঁর অদেখা সন্তান।

রেলওয়ে স্টেশনে মা-টা বসে ছিল পা ছড়িয়ে। সাদা মুখ। লাশ ব্যতীত এমন পান্ডুর মুখ আমি আর কখনও দেখিনি! আমি ডাক্তার না হয়েও বুঝতে পারছি মাটা প্রচন্ড রক্তশূন্যতায় ভুগছে। আয়রনের তীব্র অভাব  
 
আহা, আমি ডাক্তার হতে পারলে বেশ হতো। ডাক্তার হতে পারলে অন্তত আজ এই মাটাকে ন্যূনতম চিকিৎসাটা দিতে পারতাম। ডাক্তার- দ্বিতীয় ঈশ্বর, কেবল এই একটা পেশাকে আমি ঈর্ষা করি। মুমূর্ষু কারও কাছে কখনও কখনও মনে হয় এমন, উপরে প্রথম ঈশ্বর নীচে দ্বিতীয় ঈশ্বর-ডাক্তার; মাঝে আর কিছু নাই, কিচ্ছু নাই! 
 
আমি আমার অল্প পড়াশোনা নিয়ে কখনই বিব্রত হইনি। কিন্তু আজ কেবল মনে হচ্ছে, আহা, জীবনটাকে তাচ্ছিল্য না করলেও পারতাম। কেন ভাল করে লেখাপড়াটা করলাম না। কস্তাকস্তি করে ডাক্তার হতে পারতাম যদি। আহা! 
আফসোস, সবাই যখন ইশকুলে যায় তখন আমি ইশকুলের নাম করে গোয়াল ঘরে বসে বই পড়ি[click]  ইশকুলে সবাই পরীক্ষার খাতায় লেখে, ইঞ্জিনিয়ার হবো, ডাক্তার হবো। আমি লিখেছিলাম, রাখাল হব। কসম, আমার তো রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। মাস্টার মশাই খুবই আনন্দিত(!) হয়ে বিরাট একটা গোল্লা দিয়েছিলেন যার চালু নাম 'লাডডু' বা 'খাতালাড্ডু'। এই করে-করে কালে-কালে হয়ে গেলাম জিরো [click]! ক্রমশ জিরো থেকে আ বিগ জিরো [click]! সেসব হাবিজাবি কথা থাক।
 
আজ এই মা-টার ছবি উঠাতে ইচ্ছা করছিল না। পরাজিত বীরের ছবি যেমন উঠানো যায় না তেমনি এই মার এমন অসহায় ছবিও উঠানো চলে না। তাঁর এই অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করারও কিছু নেই। নিম্নবিত্ত পুরুষদের বাড়তি এই একটা সুবিধা আছে, বউ-বাচ্চা ফেলে সময়মতো উধাও হয়ে গেলেই হয়। নারী পড়ে থাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা। তাঁর অনাগত সন্তানের অপেক্ষায়।
আমাদের এই মা বিখ্যাত ওরিয়ানা ফালাচী না যে ফালাচীর মত বলবেন:
"হে অনাগত সন্তান, তুমি কি আসতে চাও এই নির্দয় পৃথিবীতে'? তার ভ্রুণ বলবে, 'তুমি নরকে যাও, মা, আমি আর আসছি না'।
ওরিয়ানা ফালাচীদের সঙ্গে আমাদের মার এখানেই ফারাক। আমরা নারকেল গাছ, আমাদের শেকড় ছড়িয়ে থাকে অনেক দূর। মায়ায় জড়াজড়ি করে। তাই কি আমরা মার কাছে ফিরে আসতে ব্যাকুল হয়ে থাকি?

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ধার করে বলি: "পেটে তার উপোসী ছেলেটা কিচ্ছু বলে না-শুধু দিন গোনে।"
না, সুভাষ বাবু, আপনি কিন্তু ভুল। ভুল! কে বলেছে উপোসী ছেলেটা কিচ্ছু বলে না? আমি আমার মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এই মার অদেখা সন্তানটা গাল ফুলিয়ে বলছে: 'অ, মানুষ, তোমরা এমন নিষ্ঠুর কেন গো! জানো, আমি না কাল থেকে কিচ্ছু খাইনি। ইহ, আমার মা না খেলে আমি খেতে পারি বুঝি! এক চুমুক গরম দুধ আমার মাকে খেতে দিলে কি হয়? বলো না কী হয়? এই মানুষ, বলো না কি হয়! এই মানুষ...এই...এই...'।
গোটা বিশ্বটা আমার আধার হয়ে আসে। আমি আকাশপানে তাকিয়ে থাকি। ঝকঝকে আকাশটা আজ এমন ঝাপসা কেন? ঝাপসা কেন! জানি না...জানি না আমি...জানি না...।

* এটা সত্য এটি একটি অতি সাধারণ স্কেচ। আঁকার কায়দাটাও
অতি সাধারণ- কেবল তিনটা টান। যখন এটা আঁকি, মাথায় যেটা কাজ করছিল, মা এবং তাঁর অনাগত সন্তানের অবয়বটা কত অল্প রেখায় করা যায়। অবশেষে ফিগারটা দাঁড় করিয়েছি কেবল ৩টা রেখায়।
 
** প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে পরে জানতে পেরেছিলাম এক রাতে স্টেশনে পুলিশ মা-টাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল। মা-টার একটাই চেষ্টা ছিল অনাগত সন্তানকে রক্ষা করা। সে তাঁর সন্তানকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পেরেছিল কি না সেটা জানার অবকাশ কোথায় আমাদের। গণতন্ত্র, মানবতা,  এই-সেই কত বড় বড় কাজ আমাদের...!
 
***কেবল মাদের বড় কোন কাজ নেই- একটাই কাজ তাঁর সন্তানকে যে-কোন মূল্যে রক্ষা করা। এই মা হরিণটার মত। অবলীলায় নিজের জীবনটা ময়লা কাপড়ের ন্যায় ছুড়ে ফেলা...!

1 comment:

Anonymous said...

ভাইয়া,আমি কাদতেছি আমি কাদতেছি