করিম শেখ।
প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক। কিছু জমি জিরেত আছে। চাষবাস করে যৎসামান্য টাকা আসত। সে বছরটা প্রচন্ড খরা গেল, ফসল সব পুড়ে ছাই। স্কুলের বেতন কি আর নিয়মিত পাওয়া যায়! তার স্ত্রী একটা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। এই ব্যাংকে আবার মহিলাদের সদস্য হতে হয় এবং সেই সদস্যের নামেই ঋণ পাওয়া যায়।
করিম শেখের ধারণা ছিল, ফসল উঠলে কিস্তির টাকাসহ জমা দিয়ে দেবেন। করিম শেখ ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে লম্বা -লম্বা শ্বাস ফেলেন! ব্যাংক থেকে লোক এসে বেশ ক-বার হুমকী দিয়ে গেছে, সময়মতো টাকা শোধ না দিলে এর পরিণাম ভালো হবে না।
করিম শেখ হুমকীর ভয়ে কাবু নন। ব্যাংকের লোকজনরাও নিশ্চয়ই খোঁজখবর রাখে, তিনি একজন শিক্ষক। ৭ গ্রামে তাঁকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত হয় না। কিন্তু তিনি নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন, মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে! গ্রামে, স্কুলে জানাজানি হলে কি উপায় হবে! বাচ্চার মায়ের গায়েই বা ক-ফোঁটা গহনা! অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন জমি বিক্রি করে দেবেন, এ ছাড়া আর গতি নেই।
সেদিন ছিল হাটবার। করিম শেখ হাটে গিয়েছিলেন। ব্যাংকের লোকজনরা পুলিশসহ এসেছিল। করিম শেখের স্ত্রী বারংবার কাতর অনুরোধ করছিলেন, 'বাচ্চার বাপ বাড়ীতে নাই, হাটে গেছে; ফিরা আসুক, নিশ্চয়ই কোন-একটা ব্যবস্থা হবে'।
এরা কান দিল না। ব্যাংকের লোকদের এক কথা: 'টাকা তো আমরা বাচ্চার বাপকে ধার দেই নাই তোমাকে দিয়েছি, তুমি পরিশোধ করবা'।
করিম শেখের স্ত্রী এক্ষণ টাকা পাবেন কোথায়? সমস্ত গ্রামের মহিলারা এ বাড়ীতে জড়ো হয়েছেন; পুরুষরা বেশীরভাগই হাটে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মহিলাদের হা হুতাশে কান দেয় কে! এরা করিম শেখের একটা গরু, কয়েক বস্তা ধান, করিম শেখের স্ত্রীর হাতের সরু তারের মত দুইটা সোনার রুলি নিয়ে নিল।
ঝমঝম শব্দ। করিম শেখের ৬ষ্ট শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা দৌড়ে এলো। ঝমঝম শব্দের উৎস তার পায়ের রূপার নূপুর। বাবা বড়ো শখ করে খেয়ে না-খেয়ে গড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেদিন বাজান এটা নিয়ে এসেছিলেন, সে দিন বাজান সুর করে বলছিলেন:
কই রে আমার টুনটুনি, কই রে আমার ঝুনঝুনি, কই রে আমার মুনমুনি; দেখ লো মা, তোর লিগ্যা কি আনছি।
সেদিন তার চোখে তীব্র আনন্দে পানি চলে এসেছিল! বিড়বিড় করে বলছিল, 'আল্লা-আল্লা, আল্লা গো, আমার বাপজানের লাহান বাপজান এই দুনিয়াত আর একটাও নাই'!
নষ্ট হবার ভয়ে কিছু দিন তুলে রেখেছিল। বাবা ছদ্মরাগে বলেছিলেন: 'আমার মা হাঁটে আওয়াজ পাই না ক্যা'?
এরপর থেকে আবার পায়ে দেওয়া শুরু করল'।
মার কান্না দেখে করিম শেখের কন্যা ব্যাংকের লোকের পা জড়িয়ে ধরলো। এতে ব্যাংকের লোকদের ভাবান্তর হলো না। এত কিছু দেখলে ব্যাংক চলে না, মাসিক টার্গেটেরই বা কি হবে? এদের নিজেদেরর মধ্যে চোখাচোখি হলো।
একজন বলেছিল: 'খুকি তোমার পায়ের নূপুরটা তো খুব সুন্দর, দেখি একটু'।
করিম শেখের কন্যা সরল মনে খুলে দিল। কিন্তু ওরা যখন অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এটাও নিয়ে গেল তখন সে কেবল ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
ভিড়ের মধ্যে তার স্কুলের মুখরা এক বান্ধবী বলেছিল: 'ভালা হইছে, স্কুলে এইটা পইরা গিয়া খুব রঙ্গ করতি, অহন রঙ্গ বাইর হইবো'!
করিম শেখ সন্ধ্যায় ফিরে এলে, অনেক কিছুর সঙ্গে পাননি জমিতে দেয়ার জন্য একটা কীটনাশক বোতল আর তার কন্যাকে।
গরমকাল।
রাতের মধ্যেই কন্যার জানাজা পড়ে কবর দিয়েছিলেন। মানুষটা শান্তই ছিলেন, চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করেননি! শুধু তাঁর কন্যাকে কবরে নামাবার সময় একবার কাতর গলায় বলেছিলেন:
'আহা, একটু আস্তে কইরা নামাও না, মায়াডা দুকখু পায় না বুঝি'!
করিম শেখ নামের শান্ত মানুষটা আরও শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। জমি বিক্রি করে সমুদয় টাকা শোধ করে শুধু নূপুরটা নিয়ে এসেছিলেন, আর কিচ্ছু আনেননি!
ব্যাংকের লোকজনরা অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল। করিম শেখ অবিচল। এমন কি একবার লোক দিয়ে এরা গরু, ধানের বস্তা করিম শেখের বাড়ীতেও নিয়ে এসেছিল। জোর করে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলে, করিম শেখের মতো শান্ত মানুষটা বটি দা নিয়ে হিংস্রভঙ্গিতে বলেছিলেন: 'আমার চোকখের সামনে থিক্যা দূর হ, নাইলে একটা কোপ দিমু, কুত্তার বাচ্চা'!
ছোট একটা পত্রিকার সাংবাদিক এসেছিল। করিম শেখ দেখা করতে, কথা বলতে রাজী হননি। অন্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, ওই পত্রিকার মফঃস্বল বিভাগে খুব ছোট্ট করে এ খবরটা ছাপা হয়েছিল। গ্রামের ছেলেপুরেরা, তার ছাত্ররা বলেছিল, 'আপনে খালি একবার কন, ব্যাংক জ্বালায়া দিমু'।
করিম শেখ মাথা নেড়ে না করেছিলেন।
...প্রায় ২০ বছর পর।
নামী এক পত্রিকার দুঁদে সাংবাদিক ঢাকা থেকে এসেছেন করিম শেখের সঙ্গে দেখা করতে। করিম শেখ দেখা করতেন না কিন্তু সঙ্গে এসেছে তার অতি প্রিয় ছাত্র, যে এখন ওই পত্রিকাতেই চাকরি করে। এই সাংবাদিক অসম্ভব বুদ্ধিমান। তিনি জানেন, এই নিউজের এই মুহূর্তে কী অপরিসীম মূল্য!
সাংবাদিক বললেন, ‘আপনার প্রতি ভয়াবহ অন্যায় হয়েছে। আমি আবার নতুন করে আপনার ওই খবরটা প্রথম পাতায় ছাপাতে চাই। আপনার মেয়ের ছবি থাকবে, সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎকার এবং আপনার ছবি'।
করিম শেখ বললেন, ‘এত্তো বছর পর আপনে এইটা নিয়া নাড়াচাড়া করতে চাইতাছেন ক্যান?’
সাংবাদিক খানিকটা থমকালেন, ‘অনেক বছর আপনি ন্যায় পান নাই… তাছাড়া টাকাও আপনি পাবেন'।
করিম শেখ তার ভারী চশমাটা মুছতে-মুছতে বললেন, ‘বাবা, আমি একজন শিক্ষক, সামান্য লেখাপড়া জানি। বিষয় এইটা না, বিষয়টা হইলো গিয়া যে ব্যাংক আমার প্রতি মহা অন্যায় করছিল ওই ব্যাংকের 'পরতিষ্ঠাতা' অনেক বড়ো সম্মান, নোবেল পাইছেন। দুনিয়ায় আমাগো দেশের নাম আলোচনা হইতাছে। আমাদের মাথা অনেক উঁচা হইছে। আপনের পরতিকা চাইতাছে, ওই মানুষটারে কেমনে ছোড করা যায়! কি বাবা, ভুল বললাম?’
সাংবাদিক তো-তো করে বললেন, ‘আপনি কি আপনার মেয়ের কথা ভুলে গেছে, তার কথা ভেবে অন্তত…'।
করিম শেখ এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। উঠে গিয়ে ভেতর থেকে গিট দেয়া একটা রুমাল নিয়ে এলেন। নিমিষেই ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো ন্যাপথলিনের সৌরভ। তিনি খুব যত্ন করে রুমালের গিট খুললেন। বেরিয়ে এলো কালচে রুপার একটা নূপুর। করিম শেখ রুমাল দিয়ে অযথাই ঘসে-ঘসে নূপুরটা চকচক করার চেষ্টা করছেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে নুপুরটা ভিজে যাচ্ছে।
করিম শেখ এবার ভাঙ্গা গলায় বললেন, ‘দেশের সম্মানের থিক্যা বড়ো কিছু আর নাই। দেশের লাইগ্যা আমার একটা মাইয়া কুরবানী দিলেই কী’!”
* সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই লেখাটি লেখা হয়েছিল। মূল ঘটনা সত্য, মেয়েটি দুর্দান্ত অভিমানে আত্মহত্যা করেছিল। পত্রিকার ভেতরের পাতায় খুব অবহেলা ভরে মেয়েটির আত্মহত্যার খবরটা ছাপা হয়েছিল। ক-রাত ঘুমের খুব সমস্যা হয়েছিল আমার!
ফিকশনের জন্ম রিপোটিং-এর গর্ভে। তাই এ লেখাতেও খানিকটা ফিকশন আছে বৈকি, তবে ঘটনা সত্য।
2 comments:
আমার একটি ব্লগ আছে আমি আপনার এই লেখা টি আমার ব্লগ এ POST করতে চাই
http:johnscl.blogspot.com
"আমার একটি ব্লগ আছে আমি আপনার এই লেখা টি আমার ব্লগ এ POST করতে চাই"
চাই এবং করেছি, এই দুয়ের মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য! আপনি আমার অনুমতি দেয়ার পূর্বেই লেখাটা আপনার সাইটে পোস্ট করে দিয়েছেন! বিষয়টা আমার পছন্দ হওয়ার কথা না।
আপনি সম্ভবত লক্ষ করেননি, আমার সাইটে সতর্কতা দেয়া আছে, আমার লিখিত অনুমতি ব্যতীত কোন লেখা অন্যত্র ছাপানো যাবে না।
এর মধ্যে আপনার আবেগ কাজ করেছে বলে বিষয়টা ভুলে যাচ্ছি।
এই পোস্টের লেখাটা পোস্ট করার জন্য আপনাকে লিখিত অনুমতি দিলাম।
আরেকটা কথা, আপনার পোস্টে আমার নামটা ভুল লিখেছেন, ঠিক করলে সুখী হই।
ভাল থাকুন।
Post a Comment