“ 'মা-মা, অ মা, দেখো তোমায় কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছি'।
হাসিখুশি মা-টার মনটা কি কারণে যেন আজ ভারী বিষণ্ন। অন্য সময় খোকার এই চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়া এবং ছুঁয়ে দেয়ার খেলাটা কী উপভোগ্যই না মনে হয়। কিন্তু আজ মোটেও ভাল লাগছে না, বিরক্ত লাগছে।
মা’র বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে। আহ, খোকাটা এমন অবুঝ হয়েছে কেন! খোকারই বা কি দোষ, কীই বা বয়স ওর, ক-দিনইবা হলো এই পৃথিবীর মুখ দেখেছে! মা কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, 'বাবু, যাও, অন্যদের সাথে গিয়ে খেলা করো'।
খোকা চক্রাকারে ঘুরপাক থামিয়ে ঝলমলে মুখে বলল, 'উহুঁ, আমার যে তোমার সাথে খেলতেই ভাল লাগে, তুমি যে আমার লক্ষী মামইন্যা'।
খোকা এবার তার স্বরচিত ছড়া ক্রমাগত সুর করে বলতে থাকল, 'মামইন্না-মামইন্না, পিঁড়ি থেকে নামেইন্না'।
খোকা আজকাল বড়ো ছড়াকার হয়েছে। তার এই সব স্বরচিত ছড়ার কোন আগামাথা নাই। অন্য সময় হলে মা হাঁ করে খোকার এই সব ছড়া শোনেন। আজ মোটেও এসব টানছে না।
মা রাগ-রাগ গলায় বললেন, 'বাবু, তোমাকে একবার একটা কথা বললে কানে যায় না, বললাম না অন্যদের সঙ্গে গিয়ে খেলা করো। আর শোনো, ঘসাঘসি করবে না, বিরক্ত লাগছে'।
খোকার এতক্ষণে হুঁশ হলো। মার বিবর্ণ মুখটা ভাল করে লক্ষ করল। আহা-আহা, মার কীসের কষ্ট! ইশ, কি করলে মার কষ্ট কমে এটা জানলে বেশ হতো কিন্তু খোকা তো এটা জানেই না ছাই! কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, দৈত্যরা তো আমাদের ধরতে পারলে মেরে খেয়ে ফেলে, না'?
মা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, 'হুঁ'।
খোকা শিউরে উঠে বলল, 'ইশ, দৈত্যরা কী নিষ্ঠুর, না'?
মা বললেন, 'হুঁ'।
'মা, আমাকে ধরলেও খেয়ে ফেলবে'?
মা হাহাকার করে উঠলেন, 'বালাই ষাট, তোকে খাওয়ার আগে যেন আমাকে খায়। খোকা, আর কক্ষণও এমন কথা মুখেও আনবি না। এইটুকুন ছেলে, কীসব কথা! খোকা, বুকে থুতু দে'।
'আচ্ছা মা, আমাদের তো দৈত্যরা ধরবে না, না? আমাদের এই জায়গাটা তো পবিত্র, তাই না? দৈত্যরা নাকি আমাদেরকে খেতেই পারবে না'?
মা খোকার চোখে চোখ রেখে বললেন, 'হুঁ'।
খোকা এবার মুখ ঝলমল করে বলল, 'আমাদেরকে খেলে নাকি দৈত্যরা নিজেরাই মরে যাবে? সত্যি নাকি, মা'?
'হুঁ, সত্যি'।
খোকা এবার লাফিয়ে উঠল, 'কী মজা-কী মজা। দৈত্যরা আমাদের খেতে পারবে না-পারবে না'। খোকা এবার কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, তোমার কি মন খারাপ'?
মা বললেন, 'হুঁ'।
'বেশি খারাপ'?
'হুঁ'।
'তোমায় একটা ছড়া বলি'?
'আহ, না। যাও গিয়ে খেলা করো গিয়ে'।
খোকা চলে যাচ্ছে। দেখো দেখি ছেলেটার কান্ড, পাগলুটা কেমন বারবার ফিরে তাকাচ্ছে, এই বুঝি মা পিছু ডাকল। খোকাটা একদম একটা পাগলু হয়েছে!
খোকা একসময় চোখের আড়াল হয়ে গেল। মা খোকাকে এটা বলতে পারেননি, তাদের মাথার উপর বিপদ, ভয়াবহ বিপদ। ইশ, খোকা যদি বুঝত বড়দের কত সমস্যা, সমস্যার কূলকিনারা নাই!
দৈত্য নামের মানুষরা তাদের খেতে পারবে না এটা সত্য কিন্তু খেতে পারবে না বলেই তাদের সবাইকে মেরে ফেলার জন্য বুদ্ধি করা হচ্ছে। কালই শুনছিলেন, দৈত্যরা বিচিত্র ভাষায় কথা বলছিল, শলা করছিল: সবাইকে মেরে ফেল, সব্বাইকে। ওষুধ ছড়িয়ে দাও। সবাইকে মেরে ফেল, একজনও যেন না বাঁচতে পারে।
এক্ষণ মার বুকে কেমন চাপ চাপ ব্যথা। দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে আসছে। এটা কী চোখের ভুল, পানির রঙ কী বদলে গেছে খানিকটা? এমন হচ্ছে কেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? মা নিমিষেই বুঝে ফেললেন, বোঝার আর বাকি রইল না। তাদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে। চারদিক থেকে অন্যরা ভুসভুস করে ভেসে উঠছে, পেট উল্টে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুখ হাঁ করে আটকে রাখা দম ফেলার চেষ্টা করছে, আপ্রাণ চেষ্টায় নীচে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে, লাভ হচ্ছে না।
মা-টা তেমন কোন চেষ্টাই করছেন না। কেবল পাগলের মতো তার সন্তানকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। কোথায় পাবেন তার সন্তানকে? চারদিকে আর্তনাদ, হাহাকার।
মা বুঝতে পারছেন ক্রমশ তার সময় ফুরিয়ে আসছে।
তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল, একই শব্দ বারবার আউড়ে যাচ্ছেন। অ খোকা, অ পাগলু, ফিরে আয়-ফিরে আয়, তোর মাথার দিব্যি আর কক্ষণও তোকে যেতে বলব না, কক্ষণও না...।"
* এটা অনেক পুরনো লেখা (সম্ভবত ২০০৫-এর)। এই ফিকশন-লেখার উৎস পত্রিকার যে খবরটা সেটা হচ্ছে:
"ঢাকা ওয়াসার পয়োপরিশোধন কেন্দ্রের লেগুনের সব মাছ বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়। ভেসে ওঠে কয়েক টন মৃত মাছ।“
এই সামান্য খবরটা যখন আমি পড়ি তখন আমার বড়ো অস্থির লাগছিল। গলায় কী যেন দলা পাকাচ্ছিল। কেন? আমি কী মাছ খাই না? খাই। তাহলে? এর উত্তর আমার কাছে নাই। সব প্রশ্নের উত্তর কী আমি জানি, ছাই!
** সে এক বড়ো সুখের সময়! তখন অবলীলায় লিখে ফেলা যেত আনন্দ-বেদনার কথা। তখন মাথায় এটা খেলা করত না যে লেখার কোনও অংশ নিয়ে সরকার বাহাদুরের গাত্রদাহ হবে আর সরকার বাহাদুরের কোনও মন্ত্রী বলে বসবেন, লাশের লেখালেখি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভাগ্যিস, বলে বসেননি, লাশটা তোতলা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেন লাশটা তোতলা হলে তার মরে যাওয়া নিয়ে বিকার হওয়ার কিছু নেই।
ধর্মের দোহাই দিয়ে যে খুনগুলো হয়েছে সবই 'দিন দাহাড়ে'-প্রকাশ্যে কিন্তু কোনও খুনিরই পুলিশ টিকিটি দূরের কথা টিকির আগাও স্পর্শ করতে পারেনি! আমাদের চৌকশ পুলিশ বাহিনী!
কেবল একটি ঘটনায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (হিজড়া)। এরপর? এরপর আর কী- বাংলাদেশে যা হয় আর কী! সেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ 'লাবণ্য হিজড়াকে' কি প্রকারে মূল্যায়ন করা হলো বা ওই খুনিদের বিচারের কী হলো সেটা অন্তত আমি জানি না!
আর তখন লেখক(!) নামের ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চাদেরও এমন উৎপাতও ছিল না। যারা ফেসবুকের কল্যাণে একেকটা স্টার হয়ে বসে আছে। স্ট্যাটাসের নামে লেখার নমুনা এমন, দুইটা ধর্মগ্রন্থের নাম দিয়ে ‘দেখি কে জিতে?’ শিরোনাম দিয়ে লিখেছে, 'শরিরে এক ফুটা রক্ত থাকলে উত্তর দিবা কেউ এড়িয়ে যাবেনা'।
বানান এবং ভাষার কী ছিরি! ওই লেখায় মাত্র একদিনেই মন্তব্য ২৫৩২, লাইক ২১২৭। ছাগল উৎপাদনে এই দেশ যে পৃথিবীর মধ্যে এক নাম্বার এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
না, ভুল বললাম। আই, এস ইসলামিক স্টেট আছে না! আমাদের দেশে এই কাপুরুষেরা পেছন থেকে গলা কাটে আর ইসলামী স্টেট এর দায় স্বীকার করে। ইসলামী স্টেট নামের পশুরা গুয়ে ভাসতে থাকা কৃমিকেও ছাড়িয়ে যায় যখন আপন সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করে নিজের মাকে গুলি করে মেরে ফেলতে।
এই সেই ২০ বছর বয়সী বীরপুঙ্গব যে জনসমক্ষে আপন মাকে গুলি করে হত্যা করে। মার অপরাধ তিনি ছেলেতে আই, এস-ইসলামিক স্টেট ছেড়ে দিতে বলেছিলেন।
যাই হোক, পুরনো লেখাটার প্রসঙ্গ এলো এই কারণে আমার জাগতিক জটিলতা এবং ব্যস্ততার কারণে অনেক দিন ধরে লেখালেখি হচ্ছে না। তো, একজন অতি পরিচিত মানুষ ইনবক্সে জানতে চাইলে আমি এই কারণটাই বললাম। এবং এটাও বললাম এই দেখেন না পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে নিয়ে জরুরি লেখাটাও লেখা হয়ে উঠছে না। তিনি ফট করে লিখে বসলেন, এই মহিলা তো হিজাব পরতেন, ইত্যাদি…।
আমি হতভম্ব হলাম কারণ এই মানুষটিকে প্রজ্ঞাবান মানুষ হিসাবেই জানি। অথচ এই মানুষটা এই সব কী বলে! আমি মা-মাছকে নিয়ে লিখতে পারব কিন্তু মানুষ-মাকে নিয়ে লিখতে পারব না, আজব! কে জানে, আগামীতে হয়ত মা-মাছকে নিয়ে লেখারও ব্যবচ্ছেদ হবে!
এরিমধ্যে এই খুনের প্রসঙ্গ ধরে কিছু লেখা আমার চোখে পড়েছে এরমধ্যে একজন আছেন যিনি আবার সেলিব্রেটি(!) টাইপের মানুষ যিনি মুক্তচিন্তার নামে গালাগালিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন।
সন্তানের সামনে তার মাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। যে খুনি হচ্ছে চরম কাপুরুষ এবং এই গ্রহের অতি নিকৃষ্ট সৃষ্টি- গা ঘিনঘিনে কৃমির চেয়েও। যে রাজনীতির কৌশল হিসাবে বেছে নিয়েছে একজন নারীকে, একজন মাকে! একটা শিশুর সামনে তার মাকে কোপানো হচ্ছে সেই মাটা পড়ে থাকেন থই থই রক্তের মাঝে অার সব ছাপিয়ে আমাদের চোখে ভেসে উঠে মার পরিধানের হিজাব! শ্লা, একদিন অন্য কেউ রক্তের মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে আর আমরা গোল হয়ে তামাশা দেখতে দেখতে বলব, দেখ-দেখ, ব্যাটা বেল্লিক, মোজা ছাড়া জুতো পরেছে...।
আমার মনে পড়ছে কিশোরবেলায় পড়া সেই লেখাটা। এক সাধু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পয়দলে যাচ্ছেন। খরস্রোতা এক নদী যখন পার হবেন তখন লক্ষ করলেন এক মেয়ে আটকে আছে পার হতে পারছে না। তিনি অবলীলায় মেয়েটিকে তুলে পার করে দিলেন। কয়েকদিন পর সাধুর এক চ্যালা বলছে: গুরুদেব, আমাদের তো নারীস্পর্শ নিষেধ আর আপনি কিনা...! সাধু ভারী অবাক হয়ে বললেন, কী আশ্চর্য, আমি যে মেয়েটিকে সেই কবেই নদীর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে এসেছি আর তুমি কিনা এখনও তাকে বয়ে বেড়াচ্ছ!
এই সব ইতর মানুষদের(!) জন্য সংক্ষিপ্ত বাক্য, মাই ফুট!
*** 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম', শিরোনামের বাক্যটি নেওয়া হয়েছে শাহ আবদুল করিমের গানের কথা থেকে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
**** ভিডিও সূত্র: www.bdnews24.com