Search

Monday, June 30, 2008

শাসক!

বাংগুরাদেশের এক শাসক। এই শাসক সাহেব ছিলেন আবার খুবই পীর ভক্ত। তিনি আটরশির পীরের দরবারেই গেছেন ১০০ বার, ফল কি পেয়েছেন, তিনিই ভাল বলতে পারবেন!

একসময় মনের দুঃখে খানিকটা পাগলা পানি খাওয়া শুরু করলেন। আটরশিকে বাদ দিয়ে দশরশি নামের একজন পীরের কাছে যাতায়ত শুরু করলেন। দশরশির পায়ে আছড়ে পড়লেন।


শাসক: বাবা, মনে শান্তি নাই!
দশরশি: থাকব কেমনে, তোরে আটরশি খাইছে! বেটা, তুই কি পিসাব খায়া আইছস, পিসাবের গন্ধ পাইতাছি!

শাসক: বাবা, পিসাব না একটু পাগলা পানি দিয়া কুলি করছিলাম। হইছে কি সকালে তো ওঠছি দেরীতে। চোখে জানি কি সমস্যা হইছে রাতে খালি ব্লু  দেখি- সবই নীল, ছবিও নীল! হা হা হা, কী তামশা ছবিও ব্লু  হয়া যায়! তো, রাতে ঘুমাইতে ঘুমাইতে দেরী হয়া গেল। সকালে তো ওঠছি দেরীতে, তাড়াহুড়া কইরা রুটি খাইতে গিয়া গলায় আটকায়া গেছিল। কী করি-কী করি, পাগলা পানি দিয়া একটু, হে হে হে।
দশরশি: বেটারে, বুজছি-বুজছি, আর কইতে হইব না, ইতা কইরা কুনু লাভ নাই! তুই ইয়ের মধ্যে মান্ডার তেল মালিশ করিস, ফল পাইবি। ইনশাল্লাহ, তোর পুলাপাইন হইব।

শাসক: বাবা, আচানক কথা, আপনি জানেন না? আমার এক ছেলে আছে (দ্বিতীয়টির কথা তিনি বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন)।
দশরশি (দাড়িতে হাত বুলিয়ে অমায়িক হাসলেন ): নারে, বেটা, তোর কুনু পোলাপাইন নাই।

শাসক: বাবা, এইটা কি কন! ইয়ে মানে আসলে...আসলে আপনার কাছে গোপন করছিলাম, আমার একটা না দুইটা ছেলে ।
দশরশি: ওইটা তুই ভাবতাছস, আসলে তোর কুনু সন্তান নাই! কারণ...।

সদয় অবগতি: এই পোস্টের সঙ্গে ভুল ছবি চলে গেছে বলে অমায়িক দুঃখ প্রকাশ করি।

*শুভ'র ব্লগিং বই থেকে

Sunday, June 29, 2008

নব্য মুক্তিযোদ্ধা বনাম নব্য রাজাকার।

মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে হৃদপিন্ড- সবিরাম না, অবিরাম ধুকধুক করবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগ থাকাটা অতীব জরুরি কিন্তু এই আবেগ যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন আবেগে ছাপাছাপি মস্তিষ্ক যুক্তিহীন হয়ে পড়ে। ক্রমশ মস্তিষ্ক এবং ...দ্বারের তফাত কমে আসে। তখন ওই মানুষটা পরিণত হয় গলাবাজ, গালিবাজ একটা মানুষে, তখন তার লেবেল কোন পর্যায়ে নেমে আসে এটা থাকে তার বোধগম্যের বাইরে। অনেকটা বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত একটা ফার্নিচার।

ওয়েব-সাইটে এই বিষয়টার ছাপ প্রবল। ‘বাংলার ওয়েবাকাশ রাখিব রাজাকারমুক্ত’। অনেককে দেখেছি, পড়াশোনার প্রয়োজন নাই, জেনে না জেনে অযথা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লাফালাফি। ছাদে মাথা ঠুকে যাওয়ার দশা!
এমনিতে কারও যদি এমন মনে হয়, মাঠ কাঁপাবার সহজ উপায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং ইসলাম ধর্ম তাইলে বলার কিছুই নাই।
কিন্তু গোলাম আজম যে এ দেশের নাগরিক, মান্যবর আপনারা এটা কি ভুলে যান? বাহ্যদৃষ্টিতে নাগরিক অধিকারে ড, ইউনুস আর গো আজমের মধ্যে তফাতটা কী? সরকার দু-জনেরই নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য।

অকাট্য প্রমাণ থাকার পরও আজ পর্যন্ত একজন গোলাম আজমকে (Link) যুদ্ধাপরাধি বলে ১দিনের জন্য শাস্তি দেয়া যায়নি। কেন যায়নি? সামান্য মুরগি চুরি করলে এর জন্য শাস্তি পেতে হয় অথচ ভয়াবহসব অন্যায় করেও একজন মানুষ পার পেয়ে যায় কেমন করে? তখন বিচারের বাণী কার কাছে কাঁদে? বিচিত্র এ দেশ, প্রমাণ থাকার পরও একজন অন্যায় করে পার পেয়ে যায়, এই দেশের জন্য যার বিন্দুমাত্র দরদ-আবেগ নাই তাইলে এই দেশের নাগরিক হওয়ার এত লালচ কেন? কেন আপনি, আপনারা এই দেশ আঁকড়ে পড়ে থাকতে চাইছেন? গো আজমের এই দেশের প্রতি অন্যায় বক্তব্যগুলো (Link) ৩৭ বছর কেন ৩৭০ বছরেও মুছে ফেলা যাবে না- রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না।


এমনিতে প্রবাসিরা আরও এককাঠি সরেস। স্যাররা বৈদেশে বসে যেসব ওহী নাজিল করেন তা অতুলনীয়। ব্যাটল-ফিল্ডে থাকা আর নিরাপদ দূরত্বে বসে যুদ্ধের ছবি দেখায় যে যোজন তফাত তা এদের কে বোঝাবে! দেশ থেকে হাজার হাজার মাইলে দূরে থেকে ধর্ম নিয়ে লম্বা লম্বা বাতচিত করা সহজ বটে। আহা, এই লম্বা বাতচিত পাড়ার কোন মসজিদে জুম্মার নামাজে করে দেখুন না, সযতনে রাখা আপনাদের ২টা বলস জায়গায় আছে কিনা, পুনরায় নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা দেখা দেবে?
আপনারা অবলীলায় বলতে পারেন বটে রাজাকার ভাবাপন্ন কারও ছায়া মাড়াব না। আফসোস, আমাদের সে উপায় নেই। ট্রেন ছাড়ার পূর্বে যাত্রীদের লিস্ট চেক করা সম্ভব হয়ে উঠে না, যে যাত্রীদের মধ্যে কেউ রাজাকার ভাবাপন্ন আছে কি না?

এমনিতে কেউ কেউ রাজাকার, কাচ্চা-বাচ্চা রাজাকার, ছানাপোনা রাজাকারের প্রকাশ্যে কোতলে বদ্ধপরিকর। ৯২ সালে ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলনের চেয়ারম্যান মওলানা শামসুল হক জেহাদী বলেছিলেন, "গোলাম আজমসহ ৩০ লাখ জামাত-শিবির কর্মীকে জনসমক্ষে কতল করতে হবে"(ভোরের কাগজ, ৩০/১১/৯২)।
এমন মানুষের হাতে এই দেশ পরিচালনার ভার থাকলে দেশের গতি কী হবে এটা ভেবে শিউরে উঠি! যেমন শিউরে উঠি বানরের হাতে ক্ষুর থাকলে!
বেশ-বেশ, তর্কের খাতিরে না-হয় মেনেই নিলাম। ওহে
নির্বোধ মহোদয়, এত বিপুল রক্ত কোথায়, কোন সাগরে ফেলা হবে তা ঠিক করেছেন কি? ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার পর অন্তত ৩ কোটি মানুষ যে মারা যাবে মড়ক লেগে এতে সন্দেহ আছে কী! রাস্তায় হাঁটাহাঁটি তো আর বন্ধ রাখা যাবে না।
নব্য মুক্তিযোদ্ধা হওয়াটা মনে হয় একটা ফ্যাশানের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিশেষ বিশেষ দিনে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে চোখের জল নাকের জল মিশিয়ে ফেলা আর অহেতুক গলাবাজি-গালিবাজি করা। বাংলার ব্লগাকাশ রাখিব নব্য রাজাকারমুক্ত।

একজন দুর্ধর্ষ কমান্ডো ঠেলাগাড়ি চালান, এতে আমাদের কোন লাজ নাই, দায় নাই? হায়, কোথায় ১০বছরের মুক্তিযোদ্ধা লালু (Link) , কে রাখে তাঁর খোঁজ? ক-বছর পূর্বে জানা গেল তিনি মিরপুরে রাস্তায় একটা চা’র দোকান চালান। আজ তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চই এতদিনে উন্নতি হয়েছ, নির্ঘাত হাত পেতে ভিক্ষা করছেন।

আমরা বিস্মৃত হই ভাগীরথীর (Link) কথা। এদের নিয়ে জানার অবকাশ কই? আমরা তো বড় হয়েছি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অবদানের কথা জেনে। কে কোন তেলের ড্রামে উঠে কোন ঘোষণা দিয়েছেন, এইসব। বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজনও সিভিলিয়ান নাই, কেন? এই প্রশ্ন রাজাকার হওয়ার ভয়ে কে উত্থাপন করবে?

আমাদের দেশে ক-টা শহীদ মিনার বা ক-টা কালভার্ট, সেতুর নামকরণ হয়েছে বীরাঙ্গনার নামে। বীরাঙ্গনা রিনা (Link) এই প্রজন্মের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে নিতলে হারিয়ে যাবেন, খোঁজ করার সময় কই আমাদের? সুরুজ মিয়া (Link) যে আমাদের মুখে জুতা মেরে চলে গেলেন। আমাদের গালে এই জুতার দাগ কী শুকিয়ে গেছে?

এবার আসি নব্য রাজাকারদের কথায়। কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলল বা খানিকটা সন্দেহ পোষণ করল, ব্যস আর যায় কোথায়! তাকে অবলীলায় রাজাকার ঘোষণা দিয়ে গায়ে রাজাকারের তকমা এঁটে দেয়া হলো। খেলা থেকে বাদ।
ইশশ, অতীতে যেন আমরা এই প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মালকোচা মেরে দুর্দান্ত কাজ করেছি আর কী! বিভিন্ন সময়ে, ক্ষমতাবাজদের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য সত্যের অবিরাম ধর্ষণ ব্যতীত আর দিয়েছি কী!

আর এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়বে কি ঘন্টা! মাশাল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলোর যে লাগামছাড়া মূল্য! শালার দেশ, মদের জন্য ছাড় আছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের জন্য কোন ছাড় নাই! বলিহারি আমাদের বুদ্ধির ঢেঁকিরা, কাউকে দেখলাম না মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের দাম কমাবার জন্য আদাজল খেয়ে লাগতে।
টাকার বস্তায় শুয়ে থাকা মান্যবর হুমায়ূন আহমেদ, তিনি প্রকাশককে যদি বলেন চিনি (পদ্ধতিটা আমি বলব না, যার দায় সে খুজেঁ নিক) কালেক্ট করার জন্য তার পেছন পেছন পট নিয়ে ঘুরতে, অনেক প্রকাশক বিমলানন্দে রাজি হবেন। মহিষের দুধের দইয়ের ভাঁড় নিয়ে হাজির হতে পারলে, খানিকটা কষ্ট করে ছেঁকে চিনি বের করতে পারবেন না, এও কি বিশ্বাসযোগ্য?
তো, এই হুমায়ূন আহমেদেরও মুক্তিযুদ্ধের একটা বইয়ের দাম ছিল ৪০০ টাকা। এই প্রজন্মের অনেকের পক্ষে (ঘুষখোর, দু-নম্বরির সন্তান ব্যতীত) চট করে ৪০০ টাকা দিয়ে একটা বই কেনার কথা ভাবা যায়! অথচ এই বই নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কী কান্না- চোখের জলে ভেসে যায় কপাল! হায়, গায়ে যে তার লোভের ছাল!

যাক গে, যা বলছিলাম, ইচ্ছা হল দুম করে কাউকে রাজাকার বলে দিলাম। ওহে নব্য মুক্তিযোদ্ধা , ওদের রাজাকার না বলে রাজাকার ভাবাপন্ন বলুন, নইলে নব্য রাজাকার বলুন। এই প্রজম্মের রাজাকার হওয়ার সুযোগ কই- বয়সে কুলাবে না!

পাশাপাশি জামাত-ই-ইসলামির যে উদাত্ত আহ্বান, আহা, গলা কী সুললিত-মধুর! জামাত ফ্রি-ফাও দিচ্ছে ধর্মের চিনির প্রলেপ। এদের খপ্পরে না পড়ে উপায় কী- কিই বা বয়স এদের? মগজ ধোলাই করার আদর্শ সময়।
পাশাপাশি আমরা কঠিন হাতে এদের দূরে ঠেলে দিচ্ছি। রোপণ করছি একেকটা বিষবৃক্ষ। তাকে শেখানো হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধ একটা গন্ডগোল, তখন গুটিকয়েক লোক, বিধর্মীর মৃত্যু হয়েছিল।
হাবিজাবি প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাবে এ তো বিচিত্র কিছু না। কোন ফোরামে এই খটকা নিয়ে আলাপ সে করতেই পারে, রে রে করে তেড়ে আসার কোন কারণ দেখি না। আমাদের করণীয় হচ্ছে সঠিক তথ্য দিয়ে তার ধোলাইকৃত মগজে আঁচড় কাটা। আমরা নব্য মুক্তিযোদ্ধাদের এত সময় কই!
একমাত্র একজন নিষ্ঠুর, নির্বোধই একজন ড্রাগ এডিক্টকে দূরে সরিয়ে দেবে, তাকে চিকিত্সা করাবার বা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে না।

Friday, June 27, 2008

দলছুট, খাপছাড়া।

ছবিটা দেখে মন কেমন করে। সিড়িটার সোজা আকাশে উঠে যাওয়ার আজন্ম সাধ অথচ জানা নেই গন্তব্য, ফেরার পথও অজানা।

বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ধুসর...যে অল্প ক্ষমতা নিয়ে এসেছিলাম, কাজে লাগাতে পারলাম না! আজ নিজেকে থুথু দিতে ইচ্ছা করে। অবশ্য নিজেকে নিজেই থুথু দেয়ার পদ্ধতি ক-জনার জানা?


স্বর্গ নরকের মাঝামাঝি জায়গাটার চমত্কার একটা নাম আছে, ভুলে গেছি। স্বর্গ নরকের মাঝামাঝি ঝুলে থাকাটা কোন কাজের কাজ না- এদের মত অভাগা আর কেউ নাই! এমন দলছুট, এমনই খাপছাড়া- না তেলে মেশে, না পানিতে। আমারও যে বড় ইচ্ছা করে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে, বৃত্তের মাঝে অনবরত ঘুরপাক খেতে। কী হয় এমনটা করলে, আটকায় কে?


*ছবি স্বত্ব: সংরক্ষিত

দূর হ. বন্য সুন্দর...

আমার সাজানো বাগানটা কেমন করে ক্রমশ জঙ্গলে পরিণত হল জানাই হল না! রূপান্তরটা একদিনে নিশ্চয়ই হয়নি, সময় নিয়ে হয়েছে। হায় সময়- গড়িয়ে যাওয়া পানি!
 

এ তো হওয়ারই ছিল, বিচিত্র কিছু না। শুভ্র-সাদা থেকে ধুসর, ধুসর থেকে হলদেটে অবশেষে কালো, এইই নিয়তি। নিয়তিকে খন্ডায় কোন হার্মাদ- গোল হয়ে তামাশা দেখায় যে সুখ, এ সুখ সংগম ব্যতীত কোথায়!
 

এ গাছ আমি লাগাইনি কিন্তু দেখো দেকিনি কান্ড, আবার ঢং করে ফুলও ফুটেছে। ফুলের নামও বলিহারি। আমার স্মরণশক্তি যাচ্ছেতাই, সবার মত স্মৃতিশক্তিও আমার হাত ছেড়ে দিয়ে না থাকলে সম্ভবত এই ফুলের নাম 'বার্ডস অভ প্যারাডাইস'। বনবাদাড়ের ফুলের নামের কী নমুনা, কী রূপ!
দূর-দূর, নাম-রূপ, ছ্যা! দূর হ. বন্য সুন্দর...।



















 *ছবি স্বত্ব: সংরক্ষিত

Friday, June 20, 2008

একরত্মের আলাপ এবং আমার প্রলাপ।

কী কপাল, অন্য কারণে গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম। লেখাটা পেয়ে গেলাম, আমাকে নিয়ে। এমন লেখা পড়লে কান-টান লাল হয়ে যায়। আমার মত পোকামানবকে মানুষমানব বানিয়ে দেয়ার চেষ্টা, মমতায় অন্ধ হলে যা হয় আর কী!
বছরখানেক আগে 'ত্রিরত্ম' একদা ঘুরতে ঘুরতে আমার এখানে এসেছিলেন। ‍‌"ত্রিরত্মের আখাবিহার"। এই নিয়ে এক রত্ম ইতিহাস লিখে ফেলেছেন [১] । অরি আল্লা, কেউ কেউ এত অল্পতে মুগ্ধ হয়!


দীর্ঘ সময় ধরে আমার ব্যক্তিগত কারণে ভারী বিমর্ষ থাকি, লেখাটা পড়ে অজান্তেই মন ভাল হয়ে গেল। দুম করে অনেকগুলো স্মৃতি ফিরে এল। আশ্চর্য, ১ বছর চলে গেছে, না? কি জানি, টেরটিও পাইনি। হায় সময়!
ওই লেখায় মন্তব্য ইচ্ছা করেই করিনি, এখানে করছি। ওই পোস্টে যেভাবে বাড়িয়ে লেখা হয়েছে, আমার লজ্জা করে না বুঝি!
তবে সবিনয়ে এও বলি, কিছু-কিছু বিষয় পাবলিক ফোরামে শেয়ার করা সমীচীন না। কিন্তু এতে আমি কিছু মনে করিনি কারণ এর পেছনে আছে মমতায় মাখামাখি হাত, মমতায় বাড়ানো হাতের নোখের দিকে তাকাতে নেই যে।


অসাধারণরা তীব্র আনন্দ উপভোগ করেন নিরাসক্ত ভঙ্গিতে, আমি অতি সাধারণ বলেই তুচ্ছসব আনন্দ-বেদনায় কাবু হই। যেমন মনটা কী তরলই হয়ে গিয়েছিল এই লেখাটা পড়ে! কেবলই কী ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার আনন্দ, নাকি নিজের সম্বন্ধে ভাল ভাল কথার লোভ? উঁহু...।
আজ আমার কঠিন সময়ে ঘোলাটে হয়ে আসা চোখটা কেমন ঝকঝকে হয়ে উঠে। মানুষের উপর, এমনকি নিজের উপর থেকে হারিয়ে ফেলা বিশ্বাস খানিকটা ফিরে আসে। এক্ষণ এই বাড়ানো হাতটাও কী কম?
তবে আজ একটা কঠিন সত্য বলি, আমরা বড্ডো নাগরিক, শখের বশে ফুল তো কিনি কিন্তু এই ফুলের উত্স বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি না। চকচকে শার্ট গায়ে দেই কিন্তু বোতাম কয়টা বলতে পারি না, কেননা এর প্রয়োজন বোধ করি না, শার্ট গায়ে দেয়া নিয়ে কথা। আমরা লম্বা লম্বা বাতচিত করি, হাতি-ঘোড়া মারি কিন্ত হাতের রেখাটা ভাল করে চিনি না। ...। এই প্রসঙ্গ থাকুক...।

লেখাটায় কিছু বিষয় ঠিক না। বাথরুমের দরোজায় গোআ'র ছবি ছিল না। বাথরুমের দরোজায় ছিল আমেরিকা এবং ব্রিটেনের ছোট্ট পতাকা আড়াআড়ি করে লাগানো। আমার কাছে যখন কেউ জানতে চাইত, খাস দেশি ভাষায় আপনার টাট্টিখানা বা লেট্রিন, বাথরুম বা বৈদেশের ভাষায় রেস্টরুম কোথায়? আমি হেলাফেলা ভঙ্গিতে বলতাম, আমেরিকা এবং ব্রিটেন যেখানে কুপরামর্শ করছে, ওটাই। আমার এমন কু-ভাবনার উত্স কী? কোন নিতল থেকে উঠে আসে এমন অসভ্য কল্পনা? তাই মনে হয় বুঝি! প্যালেস্টাইনি সেই শিশুদের মুখ আমি এখনো বিস্মৃত হইনি। ফুটফুটে মেয়েটা মরে পড়ে আছে বাতিল পুতুলের মত। শিশুর লাশ নিয়ে বাবার সেই অমানুষিক, জান্তব চিত্কার। রাইস বসে বসে পিয়ানো বাজায়, তার বাজনা শুনে রথি-মহারথিরা মাথা নাড়ে। কে জানে, ঈশ্বরও বাজনাটা উপভোগ করছিলেন কিনা?
খোদার কসম, তখন আমার নিজেকে পাগল-পাগল লাগত, মাথায় কেবল ঘুরপাক খেত, স্বেচ্ছামৃত্যু থাকলে বেশ হত, আমি ওই মুহূর্তে মৃত্যু কামনা করতাম। আকাশপানে তাকিয়ে বিড়বিড় করতাম। আকাশলোকের বাসিন্দার আমার এই বিড়বিড়ানি শোনার সময় কই! আমি নপুংসকের, এমন অসভ্য চিন্তা করা ব্যতীত কিই-বা করার ছিল!


আর হুমায়ূন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইয়ের প্রচ্ছদ? হুমায়ূন আজাদ আপনার প্রিয় লেখক বলছেন, কষ্ট পেয়েছিলেন বুঝি? আর হুমায়ূন আজাদ আমার যে অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ, অসম্ভব প্রিয়। বিচিত্রসব বিষয়ে তাঁর লেখার কী হাত, ক্ষমতা থাকলে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতাম। এরশাদের সময় এই দেশের তাবড়-তাবড় লেখকরা যখন তাদের কলম এরশাদের পায়ে সমর্পন করে দিয়েছিলেন ঠিক তখন হুমায়ূন আজাদ এরশাদকে নিয়ে 'পূর্বাভাষ' সাপ্তাহিকে কীসব কলাম লিখতেন! সিংহাবলোকনন্যায় না, অবিকল যেন একটা রাগি সিংহ।
অতি ভীরু আমি, লেখালেখিতে যে খানিকটা সাহস যোগাতে পেরেছি এটাও সম্ভবত তাঁর অবদান। মানুষটার প্রতি আমার ভাললাগার আর কি ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে, বাডি? কিন্তু এই বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, একজন মানুষ লেজার গান দিয়ে চড়ুই পাখি শিকার করছেন! হায়, ক্ষমতার কী অপচয়!
অথচ বইটার থিম চমত্কার, জঙ্গিদের সম্বন্ধে তাঁর আগাম ভাবনা তখন অবিশ্বাস্য মনে হত কিন্তু পরবর্তীতে আমরা বিপুল বিস্ময়ে লক্ষ করেছি, তাঁর অনুমান কী নির্ভুল; যেখানে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বের বিভিন্ন এজেন্সি ঘুণাক্ষরে টেরটিও পায়নি। কিন্তু এই বইটার পাতার পর পাতা আরোপিত, অহেতুক চাপিয়ে দেয়া খিস্তি, এর কোন মানে আছে, বলুন? আমার ধারণা, বইটা লেখার সময় ক্রোধ তাঁকে অন্ধ করে দিয়েছিল। এমন প্রবলপুরুষকে পোকার মত দেখতে ভাল লাগে না।


যাই হোক, ত্রিরত্ম যেদিন আসলেন আমি কিন্তু খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তখন আমার মাথায় ঝুলছে বড় ধরনের বিপদ, অবশ্য এখনকার বিপর্যয়ের তুলনায় নস্যি। তো, কেবলই আমার মনে হচ্ছিল, আহারে, এত দূর থেকে এঁরা এসেছে; আমার বিমর্ষতা এরা টের পেয়ে বিব্রত না হন। এমনটা হলে নিজের চোখের দিকে তাকাতাম কেমন করে...।

সহায়ক লিংক:
১. http://www.somewhereinblog.net/blog/hariblog/28801891

Sunday, June 8, 2008

৩ পয়সার গাছ- ৩ টাকার কলমবাজ!

হা ঈশ্বর, এই গাছ এখানে কেমন করে টিকে আছে! কবে থেকে?
কেউ লক্ষ করল না! হা কপাল- এইসব যন্ত্রণা আমার ঘাড়ে কেন! এও সত্য, আমার বাসায় মনুষ্য প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত লুক(!)-জন পদ-কাদা দেন কদাচিৎ কিন্তু বাসার অন্য লোকজনের তো অভাব নাই। সিড়ির মাঝখানে এদের পদভার সহ্য করে এই শিশুবৃক্ষ টিকে আছে কেমন করে, বাসার শিশু সন্ত্রসীদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে?
আমাকে অবাক করেছে যেটা, পাকুড়-বটবৃক্ষ টাইপের হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না- এরা কঠিন করে বাঁচতে না পারলে আরাম পায় না কিন্তু এই গাছটা ফুলবান। সাদা-সাদা, থোকা-থোকা ফুল উপচে পড়ে।
একদা গাছের চকচকে পাতা দেখে মুগ্ধ হতাম, গভীর শ্বাস বেরিয়ে আসত, অজান্তেই: হায় সবুজ, হায়! আহা, সেইসব দিন!

দেশে থেকেও জাপানীদের মত রোবট হয়ে গেছি। জাপানীদের রোবট বলায় নিশ্চই কেউ মারামারি করতে আসবে না। আমার ভাগিনা বিবাহ করতে দেশে আসবে ১ দিন বেশি ছুটি চেয়েছিল, ওর চীফ কপালে চোখ তুলে বলেছিল, তুমি ২৪ ঘন্টা বেশি ছুটি চাইছ! স্বাভাবতই বাড়তি ছুটি পাওয়া যায়নি। তো, সেদিন পড়লাম ওই জাপানীদের কী কান্না। বিষয় ভারী হাস্যকর, রাস্তা ফুড়েঁ ১টা মুলা গাছ গজিয়েছিল কোন এক বুড়বাক ওটা উপড়ে ফেলেছে, এই-ই!
সময় চাবকাতে চাবকাতে আমাকে যন্ত্রমানব বানাতে মুক্তকচ্ছ। নইলে যে যন্ত্রমানবদের মেলায় আমায় বড়ো বেমানান ঠেকে, একজন নিসংগ শেরপার চেয়ে অভাগা আর কেউ নাই।
আচ্ছা, এখন কি আর কেউ গাছদের নিয়ে আত্মজীবনী লেখে? এই গাছের আত্মজীবনী লিখলে এ কি তার অব্যক্ত কথাগুলো বলত: বড়ো কষ্ট গো- আমায় কি নেবে? তোমাদের সাথে যেতে সাধ জাগে যে বড়ো।
ইশ, বললেই হল আর কী! আমার কী দায় পড়েছে, কাজে-অকাজে আমার সময় কই, ইচ্ছাই বা করবে কেন।
কে জানে, মন ভাল না থাকলে এদের দেখে সাধ মেটাব। আপ্রাণ চাইব প্রকৃতির এই অংশটুকু তার সাধ্যমত চকচকে পাতা দিয়ে, ধপধপে ফুল দিয়ে আমার মন ভাল করে দেবে, এইই তো। কে এটাকে মাড়িয়ে গেল, দুমড়ে দিল; নাকি এই খরতাপে, খাবারের অভাবে ধুকেঁ ধুকেঁ অক্কা পেল তাতে কী আসে যায়। পণ করেছি গাছটাকে একদিন উপড়ে ফেলব, যথেষ্ট রাগ উঠলেই হল- আল্লাহু আকবর। আসলে কাজটা বড্ডো কঠিন- এ যে আমারই প্রতিবিম্ব...। নিজের প্রতি বড়ো মায়া গো!

Thursday, June 5, 2008

খোদেজার অংশবিশেষ

খোদেজার সকাল থেকেই মন ভাল নেই। কারণ তুচ্ছ। ওর পোষা হাসগুলো কেবল ঝিম মেরে থাকে, কাল তো একটা মরেই গেল। কি যে কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বুকটা কেমন যেন হালকা। কাল খোদেজা রাগে দুপুরে ভাতও খায়নি।
কষ্টের চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল বাজানের উপর। বাজানটা এমন কেন, খোদেজা ক-দিন ধরে ঝুলাঝুলি করছে হাসগুলো সদরের পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বাজান হেসেই উড়িয়ে দেয়: বেটিরে, তুই ফাগলি, ভাত খাইবার ভাত পাই না, সাইকেল লইয়া হাগবার যাই। তিন টেকার হাস, নয় টেকার ভ্যাজাল।
খোদেজার মোটেও ভাল লাগেনি বাজানের কথা। বাজানটা এমন নিষ্ঠুর কেন? ওর হাসগুলোর বুঝি বাজানের কাছে কোন দাম নাই! বাজান কি বুঝবে, এরা তো বাজানকে প্যাঁক প্যাঁক করে ঘিরে ধরে না। হাসের বাচ্ছাগুলো আগের মতো আর নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে না। ঘোলাটে চোখ নিয়ে কেবল ঝিমায় আর ঝিমায়।

বাইরে সূর্যটার কী তেজ! মনে হয় সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। বাজান বলছিল এইবার ফসল ভাল হবে না। না হলেই কী, ওদের তো আর নিজস্ব জমি নাই। অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে যে ধান পাওয়া যায় তিন মাসের মাথায় শ্যাষ। এটা বাজান শুনলে খুব করে বকা দেবেন: কি কস মাইয়্যা, আমাগো কয়ডা ধানই দেখলি; মাইনষের যে এক কুড়ি, দুই কুড়ি গোলা ধান, হের কি হইব চিন্তা কর।
যদি খোদেজা বলে বসত: মাইনষের ধান দিয়া আমাগো কাম কি, মাইনষে কি আমাগো একবেলা খাওয়াইব?
যখন বাজান খুব রেগে যান তখন খোদেজাকে নাম ধরে বলেন। তখন নিশ্চিত বলতেন: খোদেজা, একটা চড় দিয়া তোর সব দাঁত ফালাইয়া দিমু, ফাজিল কুনহানকার, তোর খাওয়াখাওয়ি বাইর কইরা দিমু। তুবা কর, আল্লার কাছে মাপ চা। অণ তুবা করবি, আমার সামনে।
তখন খোদেজা বাজানের এই চন্ডাল রাগ দেখে কাঠ হয়ে থাকত। এমনিতে বড় ঠান্ডা মানুষ, সাত চড়ে রা নাই। কিন্তু বাজান এইসব একদম সহ্য করতে পারেন না।
এমনিতে মন ভাল থাকলে খোদেজার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমুদে গলায় বলবেন: বেটিরে, সব সুময় মনে রাখবি, আমাগো ভংশের কথা মনে রাখবি। দুনিয়াত দুই ধরনের মানু, চুর-বাটপার আর ভালা মানু। ভালা মানুর চরিত্র শ্যাষ হইলে আর হের দাম নাই। খুদাও হেরে ভালা পায় না। কব্বরের আজাব হেরে ছারখার কইরা দিব।
খোদেজা বাপের এইসব কথা সবটা মনোযোগ দিয়ে শোনে না। বুঝেই না সবটা। কতই বা বয়স ওর,ভাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়?
ওর জন্মের সময় নিয়ে বাজান বলেন: বড় ঢলডার সময় হইছিলি। চাইরদিকে আকাশ-পাতাল ঢলের পানি। তর মার গর্ভযন্ত্রণা শুরু হইল। হেরে লইয়া কই আর যামু? আমি কইলাম, সোহাগের মা, মনডারে শক্ত করো, যাগো কেউ নাই হেগো আল্লা আছে। দেখবা সব ঠিক হয়া যাইব। তুই যখন চিক্কুর দিলি বাইরে ঘুটঘুইট্যা আন্ধার, ঘরে আন্ধার। তোর মা সুমানে চিল্লাইতাছে: সোহাগের বাপ, ঘর আন্ধার থাউন ভালা না। বাচ্চাটার অমঙ্গল হইব। বাত্যি দেও। হুন দেহি তোর মার কতা, বাইত নাই এককিনি কেরাসিন, বাত্যি জালামু কইত্থন?

আহা, বাজানের আদরের সোহাগ। খোদেজা মন খারাপ করা শ্বাস ফেলে। ওর ভাইটাকে দেখেছে কবে মনেও করতে পারছে না। কেবল মনে আছে যেইবার খুব শিলাবৃষ্টি হল, আকাশ থেকে হুড়মুড় করে পড়া শিলা দু-জন মিলে জমাল, তার পরই সোহাগ ভাইজান চলে গেল।
খোদেজা, বাড়ির সবার কী কান্না। বাজান গামছা দিয়ে চোখ ডলছিলেন আর ভাঙ্গা গলায় একটু পরপর ধমক দিচ্ছিলেন: সবাই আল্লারে ডাকো, মন শান্ত হইব। আমার বেটা শহরে ভালা থাকব, ভালা খাইব, ডাঙ্গর হইব। আমরা ঘুরতাম যামু। আমার বেটা ঢাহা শহর ঘুরাইয়া দেহাইব।
ইশ, খোদেজা বুঝি মাকে বলা কথাগুলো শোনেনি! বাজান নিচুস্বরে যে বলছিলেন: সোহাগের মা, খিদার কষ্ট বড় কষ্ট। আমার পুলাটারে ঠিকমতন খাওন দিতাম ফারি না। আল্লা ভরসা, দেখবা সংসারের অভাব আর থাকব না। তুমি রাজরানি হয়া সুখ করবা।
মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিলেন: পিছা মারি এমুন রাজরানির মুখে। আমার তেনাই ভালা, পুলার টেকায় আমার ভালা কাপড় পিন্দনের কাম নাই। অ সোহাগের বাপ, তুমি আমার বুক খালি কইরা দিয়ো না, তুমার দুইটা পায়ে পড়ি। আমার এমন অনিষ্ট কইরো না, তুমার আল্লার দুহাই লাগে।

খোদেজা ভাল লাগছে না, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। ইচ্ছা করছে ছনের ঘরটায় আগুন ধরিয়ে দিতে। পায়ে কিসে যেন ঠোকর দিতে ও লাফিয়ে উঠে খিলখিল করে হেসে ফেলল। অমা, এইটা দেখি চিনি। খোদাজার হাসের বাচ্চাগুলোর আলাদা আলাদা নাম আছে। নামগুলোও অদ্ভুত। কোনটার নাম চিনি কোনটার লবন। এ নিয়ে সবার কী হাসাহাসি! আসলে নাকি এদের নামের কোন গুরুত্ব নাই, সব হাসের বাচ্চাই নাকি একরকম। ইশ, রঙ্গ করলেই হল, বললেই হল! এরা দাগ দিয়া রাখুক না। চিনিকে ডাকলে চিনিই আসবে। ঠিক না হলে পিঠে দুমাদ্দুম করে দুই কুড়ি কিল বাজি।
খোদেজা গলা দিয়ে বিচিত্র শব্দ বের করছে তই তইই তইইই। জট পাকানো চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বলল, কিরে চিনি, ঠুক্কুর দিলি ক্যা, আমি বুঝি দুক্কু পাই না।
সরলদৃষ্টিতে চিনি নামের হাসের বাচ্চাটিকে কেউ কিছু বলতে শোনেনি কিন্তু খোদেজার নাকি বুঝতে কখনই সমস্যা হয় না। খোদেজা নিচুস্বরে বলল, কি কইলি খেলা করস, একটা আছাড় দিয়া পেডা গাইল্যা ফালামু। তহন বুঝবি নে মজা। অমা, আমাগো লবন বিবির কি হইছে, রাগ হইছে, চিনির লগে কতা কইছি দেইখ্যা। তোর পেটটা ভরা হিংসা। আয় কাছে আয়, অই-অইত, বেশি ভংচং করিস না তাইলে কিন্তু তোর লগে কথা কমু না। তোরে কাউয়া ঠুকুর দিলেও ফিরা চামু না।
খোদেজা একমনে এদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যায় আবার এটাও লক্ষ রাখে কেউ দেখে না ফেলে, তাইলে লজ্জার একশেষ! এমনিতেই হাসদের সঙ্গে এইসব কথা চালাচালি নিয়ে ওকে সবাই খেপায়। আর হাসগুলোও বজ্জাত কম না, এমনিতে কী ফড়ফড় করে কথা বলে, অন্য কাউকে দেখলেই চুপ। এই বজ্জাতগুলো ইচ্ছা করে ওকে অপদস্ত করে। একদিন তো খোদেজা রাগ করে এদেরকে খাবার পর্যন্ত দেয়নি। পায়ের কাছে কেমন ঘুরঘুর করে, রাগ করে থাকা যায় বুঝি!
রাগ ভুলে খোদেজা চোখ পাকিয়ে বলে, আর যুদি একটারেও মরতে দেহি এমুন মাইর দিমু। আইচ্ছা আয়, কয়ডা শামুক খুঁইজা দেই।

শামুক খুঁজতে গিয়ে রাস্তায় বড়ই গাছের টসটসে বড়ই ঝুলতে দেখে খোদাজের জিভে পানি চলে এল। হাতটা কেমন নিশপিশ করছে, কখন ঢিল ছুঁড়েছে বলতেও পারবে না। দূর থেকে কে যেন তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আইল্যা বাড়ি জাইল্যা বাড়ি, বড়ি পাইরা লাইল্য, লাইল্য। খোদাজা ঝেড়ে দৌড় দিল, থামল গিয়ে বিলের পারে। খোদেজা রেল লাইনের বিলটায় সাবধানে নামে। আনন্দে বিড়বিড় করে, আল্লাগো পানি কী ঠান্ডা! শামুক খোঁজার কথা ভুলে যায়। আচ্ছা করে দাপাতে থাকে।
ওই মায়া, দিলি তো ভিজায়া।
নিমিষেই খোদেজার দাপাদাপিতে ভাটা পড়ে। হায়-হায়, এ দেখি ওদের গ্রামের শফিক ভাই। কী শরমের কথা, ওর কারণে শফিক ভাইয়ের উপর পানির ছিটা পড়েছে। কিন্তু ও যখন পানিতে নামল তখন কি শফিক ভাই এখানে ছিল? থাকলে তো দেখার কথা।
খোদেজা জিভে কামড় দিয়ে বলল, মাফ কইরা দেও শফিক ভাই, আমি দেহি নাই।
শফিক মুখে বলল, চোউককানি, যাঃ তোরে মাফ কইরা দিলাম।
মুখে কথাগুলো বলছে ঠিকই কিন্তু মানুষটার ভঙ্গিতে কি যেন একটা অসঙ্গতি আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে খোদেজার ভেজা কাপড়, ভেজা অপুষ্ট শরীরে। এই দৃষ্টি খোদেজার কাছে দুর্বোধ্য কিন্তু কেন জানি শফিক নামের মানুষটাকে ওর ভয় করছে। মানুষটা কেমন বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। নাক দিয়ে কিছু একটা শোঁকার চেষ্টা করছে।
শফিক ভাই, এমন করতাছেন ক্যান? হুংগেন কিতা, মনে হইতাছে গুয়ের গন্ধ পাইতাছেন?
শফিকের আরও এগিয়ে এসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জড়ানো গলায় বলল, হ, গুয়ের গন্ধই। এই গন্ধেই আমার মাথা খারাপ হয়া যাইতাছে।
খোদেজার কিছুই মাথায় আসছে না। এই লোকটা এখন একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর শরীর থেকে তামুকের বোটকা গন্ধ ছাড়াও কেমন একটা অজানা গন্ধ মিশেছে। গন্ধটা খোদেজার সহ্য হচ্ছে না।
শফিকের কোমল গলা, লক্ষী মাইয়া, কিতা করতাছ এইখানে। ডুবাইতে আইছ? একলা একলা ডুইবা যাইবা তো। আইও, একলগে ডুবাই। দেইখো, খুব মজা হইব।
খোদেজার মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। লোকটা ওকে সমস্ত শরীর দিয়ে আটকে ফেলেছে। মুখ দিয়ে কেমন বিচিত্র শব্দ বের হচ্ছে।
খোদেজা বিস্মিত হতেও ভুলে গেছে। লোকটার আচরণ ওর কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। সম্বিত ফিরল ট্রেনের হুইসেলের শব্দে। ট্রেনটা কাছের ব্রীজটায় কোন কারণে গতি কমিয়ে দিয়েছে।
শফিক নিমিষেই খোদেজাকে ছেড়ে নিরাপদ দূরুত্বে সরে এসে পশুর আক্রোশে ড্রাইভারকে গাল দিচ্ছে, চুতমারানির পোলা, খানকি বেডির পোলা...।
খোদেজার মাথায় ঢুকছে না। ট্রেনের ড্রাইভার এর কী ক্ষতি করল! এত ভাবাভাবি না করে খোদেজা রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে।