Search

Wednesday, July 2, 2008

আমাদের কোন পরিচয় নাই।

আটকেপড়া পাকিস্তানিদের নিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়: "দেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের মধ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নাবালক ছিল বা এর পরে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। সমস্ত নাগরিক সুবিধা তাদের প্রাপ্য"।

একটা ওয়েব সাইটে তখন চুটিয়ে লিখছিলাম। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের নিয়ে একটা লেখা দিয়ে তোপের মুখে পড়েছিলাম। আফসোস, লেখাটার মূল সুর অনেকেই ধরতে পারেননি।
অনেকে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন, আমি রাজাকার টাইপের কেউ বা রাজাকার ভাবাপন্ন। কে জানে, এই খোঁজও হয়তো লাগাতে শুরু করলেন, আমার নেটের বিল কারা দেয়। সংসার চালাবার পেমেন্ট মগবাজার থেকে আসে কি না?

অনেকের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। এদের মধ্যে কিছু বৈদেশি ভায়াদের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা এই রকম, যেন সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি। মন্তব্যগুলোর প্রিন্ট-আউটগুলো অনেকদিন পর আবারও পড়লাম। আফসোস, আঙ্গুরের রস সহযোগে সু-নিয়ন্ত্রিত ক্যালরিসম্পন্ন খাবার খেয়ে, নিরাপদ জীবন বেছে নিয়ে হিল্লি-দিল্লি ঘুরেও এদের দৃষ্টি কী সংকুচিত‍!
নামোউল্লেখ না করে একজনের খানিকটা সহনীয় মন্তব্য তুলে দেই। এখানকার শিশুদের নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে এমন, ‘এই জারজ সন্তানদের দায়িত্ব আমরা কেন নেব, জারাজদের সঙ্গে এদেরকেও মেরেকেটে সাফ করে ফেলতে হবে; সাপের বাচ্চা সাপই হবে…’।

এইসব নব্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভারী মুশকিল, ইনাদের আবেগ চুঁইয়ে দেশটায় বন্যা হয়ে যাওয়ার দশা। দুধের দুধ, পানির পানি- কে রাজাকার কে মুক্তিযোদ্ধা এরা ঠিক করে দেবেন। আমরা কিভাবে হাঁটব, কার কার সঙ্গে হাত মেলাতে পারব, কার সংগে খিচুড়ি খেলে পাপ হবে না এইসব এরা ঠিক করে দেবেন! আহা, কী কষ্ট গো আপনাদের, কারা কারা জানি আপনাদের স্কন্ধে এই জটিল দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। যাগ গে, এরা দেশের কাজ করুন আমরা কিছু অকাজই না-হয় করলাম।
ওই লেখাটা অনেক বড়, খানিকটা এখানে তুলে দিচ্ছি:

“একটি পাখির বাসা আছে
একটি গরুর গোয়াল আছে
একটি ঘোড়ার আস্তাবল আছে
একটি খরগোসের গর্ত আছে
সবাই বলে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব
আমরা ফিলিস্তানি, আমরা মানুষ(?)
আমাদের কোন আবাসভূমি নাই।”
(ফিলিস্তানি কবি মাহমুদ দারবিশ)
উপরে উল্লেখিত কবিতাটি যখন ফজলে লোহানী আবেগঘন গলায় আবৃতি করছিলেন, ফিলিস্তানিদের উপর একটা প্রতিবেদন দেখাবার পর; আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, বুক ভেঙ্গে কান্না আসছিল।

সাধারণভাবে এদের বিহারী বলা হলেও…বিহারী একটি হিন্দি শব্দ। আক্ষরিকার্থে এর অর্থ দাঁড়ায় বিহারের অধিবাসি। বিহার ছাড়াও ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, হায়েদ্রাবাদসহ বিভিন্ন প্রদেশের মুসলিমরা এসেছেন এখানে (এদের অনেকের ভাষা ছিল হিন্দি)।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তারা দাঙ্গার ভয়ে চলে আসেন এখানে। পাকিস্তানি সরকার এদের পরিচয় দেয় মোহাজির বা রিফিউজি। ভারত থেকে দাঙ্গার ভয়ে পালিয়ে আসা এই অভাগা জনগোষ্ঠি রাষ্ট্র হারায়। অথচ ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেশন অনুসারে এদের রিফিউজি বলার উপায় নেই।


…১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিহারিরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষ নেয়। বাঙ্গালী হত্যায় এদের ভূমিকা ইতিহাস স্বীকৃত। তবে এদের মধ্যে অনেকেই বিহারি বা হিন্দি, উর্দুভাষী সরাসরি অংশ নিয়েছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে! শহীদ হয়েছেন অনেকে। অনেক বিহারী মুক্তিযোদ্ধা নিদারুন কষ্টেও এই দেশ ছেড়ে যাননি। (উদাহরণ বিহারী মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক, সৈয়দ খান। পরিবার-পরিজন সবাই তাঁকে ফেলে চলে গেছে এই দেশ ছেড়ে। কিন্তু তিনি এই মাটির মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। তাঁর সাফ কথা, 'এই দেশকে হামি কবুল করিয়ে লিয়েছি'।)
আবার ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রতিবাদে বাঙ্গালীরাও হত্যা করেছে হাজার হাজার বিহারীকে।


ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে তাদের কেউই পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। অথচ এই ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এরা। ৮ ফুট বাই ৮ ফুট ঘরের অমানবিক পরিবেশে বাস করেন একেকটি পরিবার। ক্যাম্পের টয়লেট এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা শোচনীয়। শিক্ষার কোন পরিবেশ নেই অথচ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ সনদে সাক্ষর করেছে। সেই অনুসারে শুধু বাঙালীই নয়, এই ভূখন্ডের সব শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

যুদ্ধশেষে আমরা পেয়েছি একটি নতুন দেশ, নতুন পতাকা, একটি পরিচয়! আর বিহারিরা পরিচয়হীন। আজও এদের কোন পরিচয় নাই। এরা কি বিহারি, রিফিউজি, আটকেপড়া পাকিস্তানি নাকি বাংলাদেশি? এলিয়েনও তো না, তাইলে কী? প্রত্যেকটা জিনিসের একটা নাম থাকে, নরকেরও একটা নাম আছে। আমি মনে করি এদেরও একটা নাম থাকা প্রয়োজন।

সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যেসব পাখিরা এ দেশে অল্প সময়ের জন্য আসে এদের নিয়েও আমরা ভাবি, কাতর হই কিন্তু আমাদের চারপাশের মানব-সন্তান নিয়ে তিলমাত্র ভাবব না এ কোথাকার মানবতা? যুদ্ধক্ষেত্রে চরম শত্রুকেও তার ন্যূনতম অধিকার দেয়া হয় অথচ যুদ্ধের বাইরে ন্যূনতম ভাবনাও থাকবে না, এর কোন মানে হয়!


আইনের ফাঁকতালে গোলাম আজম, নিজামী গং এ দেশের নাগরিকত্ব পাবেন, আমাদের মাথার উপর বনবন করে ছড়ি ঘোরালে কোন সমস্যা নাই। বয়স্ক একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাথি মারার অপরাধে এই মানুষটার গোপনাঙ্গের কেশও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। এতে সমস্যা নাই! কেবল সমস্যা এই ক্যাম্পের অবোধ শিশুদের বেলায়। কেন এরা নাগরিকত্ব পাবে না- এদের জন্ম তো এই দেশেই?

খানিকটা ঋণ: জব্বর হোসেন, মহিউদ্দিন নিলয়: সাপ্তাহিক ২০০০।

No comments: