Search

Sunday, February 28, 2010

আমাদের সূর্য-সন্তান, লহ মোর সালাম!

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, পরে উচ্চতর শিক্ষাদানের সঙ্গেও যুক্ত হয়। কবি নজরুলের কারণেও বিখ্যাত রাণীর দিঘীর পাড়ে অবস্থিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি একদা গ্রেটার কুমিল্লার গর্ব, এখনও।

কোথাও গেলে প্রথমেই আমাকে টানে পুরনো স্থাপনাগুলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খানিকটা আঁচ করা সম্ভব হয় তখনকার মানুষগুলো কতটা এগিয়ে ছিলেন।


এর প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর আনন্দ মোহন রায়। আমি কুমিল্লাবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ, মূর্তি নামের ভাস্কর্যটি এখনও অটুট আছে।


কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শহীদদের স্মরণে প্রতীকটির কারুকাজ দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কী!


গুটিকয়েক শহীদদের নাম।



স্বাধীনতা সৌধ নামের এই স্থাপনার গায়ে অসংখ্য অশ্লীল ছবি, কথা! আমার তোলা অসংখ্য কুৎসিত ছবি থেকে বেছে বেছে খানিকটা সহনীয় ছবি এখানে যোগ করলাম। কখনও ছবি এমন জান্তব হয় উপরের এই ছবিটা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমি যখন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল পেশাবের ছিটা আমার গায়ে এসে পড়ছে!

আমার মাথায় কেবল ঘুরপাক খায় আসলে সূর্য-সন্তান কারা? যাঁরা এখানে শুয়ে আছেন, তাঁরা? উঁহু। যারা এই ছবিগুলো, কথা এখানে লিখেছে, তারা? উঁহু, আমার মনে হয় না। কারণ ভুল ইতিহাস নিয়ে বড়ো হওয়া এই প্রজন্মকে খুব একটা দোষ আমি দেই না।
তাহলে কারা? এই ব্যস্ততম রাস্তার মাঝ দিয়ে অসংখ্য মানুষ চলাচল করেন। এটা কারও-না-কারও চোখে পড়েনি এ আমি বিশ্বাস করি না! তাছাড়া এই ভিক্টোরিয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই আছেন সিকি-আধুলী (আমার আবার সহকারী, সহযোগী অধ্যাপক এইসব মনে থাকে না) পরফেসর (!) সাহেবরা! এইসব সূর্য-সন্তানরা আসলে ভাবেননি এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু। কারণ তারা যে সূর্য-সন্তান, আমাদের দেশের সেরা সন্তান!

ডিসেম্বর, হালের ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে যে কান্নাটা আমরা কেঁদেছি, ওই কান্নার পানি সরে না গেলে দেশে অকাল বন্যা বয়ে যেত এতে অন্তত আমার কোন সন্দেহ নাই। আজ ১৬ ফাল্গুন যার চালু নাম ২৮ ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি মাস প্রায় শেষ, আগামী বছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধার নামে আবারও কাঁদার জন্য প্রস্ত্তত হবে, ইনশাল্লাহ। কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে...।

Saturday, February 27, 2010

বন ভয়েজ, বইমেলা

২১ তারিখের বইমেলার মানবস্রোতে হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। অতি দ্রুত এখান থেকে বেরুতে পারলে বেঁচে যাই। আহা, আমি বেরুতে চাইলেই তো হবে না, মানবস্রোত আমায় বেরুতে দিলে তো!
তাছাড়া আমায় ফিরতে হবে কাফরুল, স্কুটারে ফেরা যাবে না। আমি নিশ্চিত, আটকে দেবে। আবারও এলিয়েন ওরফে আর্মিদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলাম না। গতবার এই নিয়ে কম হেনেস্তা হতে হয়নি।

হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় থামতে বাধ্য হই, কাশেম প্রকাশনীর কাছে। এই প্রকাশনীর সবগুলো বইই একজন লেখকের! এ পর্যন্ত ওনার ৯৪টি বই বের হয়েছে। লেখক এবং প্রকাশক একই ব্যক্তি। আমি বইগুলোর নাম পড়ার চেষ্টা করি, বোরকাওয়ালীর প্রেম, প্রেমে এতো জ্বালা কেন?, প্রেম একটি ফুটন্ত গোলাপ, ইত্যাদি। আমি ওই লেখকের জরায়ুর জন্য বেদনা বোধ করে ওখান থেকে সরে আসি।

আমার বন্ধুরা বুদ্ধি দিল বাসে করে চলে যেতে, এলিয়েন-আর্মিরা নাকি বাস আটকায় না (আহা, বাস আটকালে নিজেদের চলাফেরায় খুব সমস্যা হয় বুঝি!)। ৪ নাম্বার বাসে করে গেলেই সহজেই চলে যেতে পারব। আমি চোখে অন্ধকার দেখি। বাস আমাকে কোত্থেকে কোথায় নামিয়ে দিয়ে ভুস করে চলে যাবে, তখন আমার গতি কী? পারতপক্ষে সঙ্গে কেউ না-থাকলে আমি বাসে উঠি না।

এরা আমাকে পানির মত সব বুঝিয়ে দিলেন, যথারীতি আমি কিছুই বুঝলাম না। রাসেল, মাশা এঁরা আমার সম্বন্ধে খানিকটা ওয়াকিবহাল, এঁদের মনটাও নরোম। এরা বললেন, 'ঘটনা বুজছি আর বলতে হবে না। আসেন শাহবাগ যাই, চা-চু খাই। ওখান থেকে আপনাকে বাসে উঠিয়ে দেব'।
আমি
মহা আনন্দে এদের পিছুপিছু হাঁটতে থাকি, এরা হাঁটলে আমি হাঁটি, থামলে থামি। ফাঁকতালে কথা, ভাবনা চালাচালি হতে থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া, সিগারেট টানার সঙ্গে অন্য আনন্দের তুলনা কোথায়?

অসম্ভব ব্যস্ত শাহবাগ চৌরাস্তা পেরুতে হবে। এদের সঙ্গে আমিও অপেক্ষা করি। এরা হাঁটা ধরলে আমিও হাঁটা ধরি, থামলে থামি। কোথাও একটা ভজকট হয়ে যায়, মাঝ রাস্তায় বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি। আরেকটু হলেই স্কুটার গায়ের উপর উঠে আসত। রাসেলের চিল চিৎকার, 'আপনি নিজেও মরবেন, সাথে আমারেও মারবেন'।
রাস্তা পার হওয়ার পর রাসেল চোখ লাল করে রাগে লাফাতে থাকেন, 'আচ্ছা, বিষয়টা কী! হে, বিষয়টা কী! আর একটু হইলেই তো কাম সারছিল! বাড়িত থিক্যা কি বিদায় নিয়া আইসেন?'

আমি মুখে বোকা বোকা হাসি ঝুলিয়ে রাখি। কি বলব, এই প্রশ্নের কী উত্তর হয়!
রাসেলের রাগ কমে না, 'এইটা আপনের মফস্বল না, এইটা ঢাকা শহর। এইখানে মানুষকে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটতে হয়'। নইলে সব শেষ'।
আমি উদাস হয়ে সিগারেট টানতে টানতে বলি, 'তাই! মন্দ কী, মাঝে মাঝে জীবনটা বড়ো ক্লান্তিকর মনে হয়'।
রাসেল নামের মানুষটা একসময় হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু রাগ কমে না, 'আপনে আর ঢাকা আইসেন না। ঢাকা শহর আপনের জন্য না। আমি লেইখা সই কইরা দিব, আপনে ঢাকা শহরে চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত-অচল'!

তিনি এই অচল মালকে মাশার কাছে হস্তান্তর করে বিদায় নেন। আমি যেদিকে যাব মাশা যাবে এর উল্টোদিকে। বাসের জন্য অপেক্ষার একশেষ! ৪ নাম্বার বাস তো আর আসে না। সব ৩ নাম্বার। আজ ৩ নাম্বাররা সব দলে-দলে বেরিয়ে পড়েছে! মাশা হচ্ছে একটা চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া- এ কেমন করে সব মুখস্ত করে বসে থাকে আমি ভেবে ভেবে সারা। দুনিয়ার তাবৎ বই পড়ে বসে আছে, জিজ্ঞেস করামাত্র গড়গড় করে বলে দেয়, এমন।
তো মাশা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ৩ নাম্বার বাসে গিয়ে ফার্মগেটে নেমে কেমন কেমন করে পৌঁছা যাবে। আমি হুঁ-হুঁ, ও আচ্ছা-আচ্ছা করছি কিন্তু এর বুঝতে বাকী থাকে না, এটা পন্ডশ্রম। মাশা নামের দয়াবান মানুষটা বলেন, 'চলেন, ফার্মগেট পর্যন্ত আমিও যাই'।
অবশেষে ফার্মগেটে ৪ নাম্বার বাসে উঠিয়ে কন্ডাকটরকে বলে দেন, 'মামা, অসুস্থ মানুষ একটু কাফরুল নামায়া দিয়েন'। মানুষটা বিদায় নেন।

বাসে উঠে আমি গভীর শ্বাস ফেলে বলি, প্যারাডাইস লস্ট। বন ভয়েজ, বইমেলা। আগামীতে তোমার সঙ্গে দেখা হবে এ আশা ক্ষীণ!

Friday, February 26, 2010

ঘুষ দিতে আমার মোটেও আপত্তি নাই

দুর্নীতির প্রধান একটা স্তম্ভ, ঘুষ। এই দেশে সুযোগ পেলে ঘুষ কে খান না এটা গবেষণার বিষয়! খানিকটা ঘুরিয়ে বললে ঘুষ খান না, বেশ, কত টাকা খান না? অবশ্য একটা অংশ আছে যাদের সুযোগ এবং সাহসের অভাব।
খুব অল্প মানুষই আছেন যারা তাঁদের নীতিতে অটল- মরে যাবেন তবুও ঘুষের টাকা ছুঁয়েও দেখবেন না।

একজন আমলা সাহেব ৩ কোটি টাকা খরচ করে এম, পি পদে দাঁড়ান। এই খরচ কেমন করে যুগিয়েছেন, একজন শিক্ষিত মানুষকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, ইনি ম্যালা টাকা বেতন পান। এই ম্যালা টাকা কত?
এই দেশে, এই পদমর্যাদার সরকারী চাকুরে কেউ ৫০ হাজার টাকার উপরে বেতন পান বলে আমার জানা নাই।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, গড়ে তিনি ৫০ হাজার টাকা করে বেতন পেতেন। পুরো টাকাটাই জমাতেন। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ইনি অতি হিসাব করে চলতেন। ইনার ইস্তিরি সাহেবার মাত্র দুইটা কাপড় ছিল। একটা গায়ে দিতেন অন্যটা শুকাতে। ওনার ছাওয়াল-বাচ্চারা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে, ফ্রি হাই-স্কুলে, ফ্রি কলেজে, ফ্রি ভার্সিটিতে নেকাপড়া (!) করে তাবড়- তাবড় ডিগ্রি বাগিয়েছেন। তর্কের খাতিরে আরও ধরে নিলাম, ইনি আলু চাষ করতেন, তিন বেলায়ই আলু খেতেন (সাবেক সেনাপ্রধান আলু খাওয়ার আইডিয়াটা সম্ভবত এখান থেকেই বাগিয়েছিলেন)। বেলায় বেলায় আলুর জুস, আলুর সরবত, আলুর নুডুলস, আলু ফ্রাই, হট ডগের বদলে আলুডগ, আলুর সুরুয়া ইত্যাদি।

এইসব করেও ৩ কোটি টাকা জমাতে মাত্র ৫০ বছর লাগবে। মাত্র ৫০ বছর। এবং আমরা এটাও জেনে আনন্দিত হবো, যেহেতু ৫০ বছর ধরে চাকুরীতে থাকতে হবে তাই ওনাকে বালকবেলায় (যখন মানুষ ঢোলা-ঢোলা হাফ-প্যান্ট পরে এবং বসলে ইয়ে দেখা যায়) চাকুরিতে যোগ দিতে হবে এবং তখনই ৫০ হাজার টাকা মহিনা-বেতন পেতে হবে।

ঘুষ না দেয়ার কারণে জীবনে আমাকে অনেক যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফিরিস্তি অনেক লম্বা। সাধারণ একটাই বলি, বাড়তি টাকা-ঘুষ দিতাম না বলে আসনবিহীন টিকেট পেতাম। ট্রেনে উঠার পর সবাই ঘুষ দিয়ে ফাঁকতালে খালি আসন ম্যানেজ করে ফেলত। আর চুতিয়া আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করেছি। অবশ্য বই পড়তে পড়তে সময়টা কেটেই যেত।

স্রোতের বিপরীতে গিয়ে লাভ নাই, এই ক্ষমতাও আমার নাই।
এখন থেকে ঠিক করেছি ঘুষ দেব, দেবো না কেন? আমি দেব। কেবল চাহিদা মাফিক ঘুষের টাকাই দেব না, বোনাসও দেব।
তবে...।
ঠিক করেছি, বিভিন্ন টাকার মাপে কাগজ কেটে নিজস্ব টাকা বানাব। গভর্নরের স্বাক্ষরের জায়গায় আমার স্বাক্ষর থাকবে। কাউকে চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ দিলে সরকারের ছাপানো আসল টাকার সঙ্গে আমার টাকাও দেব। একদম ফ্রি!
আগাম সতর্কতা: পোস্ট এখানেই শেষ।

(পরের অংশটুকু সূক্ষরূচির পাঠকেদের জন্য না। যাদের রূচি আমার মত ভোঁতা তাদের জন্য)।

আমার টাকাগুলোর মাপের কাগজগুলোর নমুনা এমন। ৫০ টাকার সমান নোটে লেখা থাকবে 'আবর্জনা খা'। ১০০ টাকার নোটে 'গু খা'। ৫০০ টাকার নোটে 'কাচা গু খা'। ১০০০ টাকার নোটে...। 


*ঘুষখোর ব্যাংকের গভর্নর: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_3654.html

Thursday, February 25, 2010

হুজুগে বাংগাল (!)

পূর্বের একটা পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম, ঠিক ২১ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য ছিল আমার। কাছ থেকে লোকজন দেখা, এদের আবেগ-ভাবনা স্পর্শ করার চেষ্টা করা।

বইমেলায় মানব-স্রোত দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আজ আর কেউ বাড়িতে নাই সবাই বইমেলায় চলে এসেছে! আমি কান পেতে অনেকের কথা শুনছিলাম, এদের অধিকাংশদের মধ্যেই আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই। বিচিত্রসব উদ্দেশ্য, কোনটাই ভাষা-বইমেলার সঙ্গে যায় না।
লাভের লাভ যা হয়েছে আমাকে কষ্ট করে রাস্তা খুঁজে বইমেলায় যেতে হয়নি। এরাই আমায় নিয়ে গেছে। বহু দূরে এক জায়গায় কেবল দাঁড়িয়েছিলাম, অনেকটা সময় পর আবিষ্কার করলাম, কেমন কেমন করে যেন আমি বইমেলার ভেতরে চলে এসেছি। এই ম্যাজিক দেখে আমি মুগ্ধ!

আমি নিজে যেটা করেছিলাম, দুই হাত উপরে তুলে হ্যান্ডস আপের ভঙ্গিতে ছিলাম। না, নড়েছো কি মরেছো বলে কেউ মাথার উপর হাত তুলতে বলেনি, কাজটা ছিল ইচ্ছাকৃত। আমি আসলে নারীঘটিত কোন জটিলতায় যেতে চাইনি। এই মানবস্রোতে কোন এক তাড়কা রাক্ষসি টাইপের মহতরমা অন্যের দায় আমার উপর চাপিয়ে ফট করে বলে বসলেন, এই আমার গায়ে হাত দিলি কেন? অভিযোগ খন্ডাবার প্রমাণ কোথায়, বাওয়া? হাতি যেমন কলাগাছের ভর্তা করে ফেলে আমাদের দেশের অতি উৎসাহী আমজনতা আমাকে মানবগাছের ভর্তা করে ফেলত। একটাই প্রাণ, মরলে আর বাঁচার উপায় ছিল না আমার!

বইমেলার প্রকাশকদের জন্য শংকা বোধ করছিলাম। আজ এদের কি উপায় হবে? এই মানবস্রোত, এদের দশ ভাগের এক ভাগও যদি একটা করে বই কেনে তাহলে নিমিষেই স্টলগুলোর বইয়ের তাক খালি হয়ে যাবে। এরপর এরা কি করবেন! আহারে, বেচারা প্রকাশক!

কিন্তু কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা হলো। এরা মুখ লম্বা করে উদাস হয়ে বসে আছেন। মুখ অন্ধকার করে বললেন, অন্য দিন যা বিক্রি হয় আজ তার চেয়ে বিক্রি অনেক কম।
বই তো আর উড়ে উড়ে পাঠকের নাকের ডগায় বসে না, পাঠককে এগিয়ে আসতে হয়, বই উল্টেপাল্টে দেখতে হয়। সেই সুযোগ কোথায়, এই মানবস্রোত দাঁড়াতে দিলে তো!

আমার মোটা মাথায় এটা ঢুকছিল না, এই মানবস্রোতের এখানে আগমণের উদ্দেশ্য কী! নাকি 'হুজুগে বাংগাল' নামটার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে গিয়ে এই ক্লেশ! ভনিতাবাজি!

*আমাদের ভনিতাবাজির খানিকটা নমুনা এখানে,
"১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ আবুল বরকতের ছোট ভাই এর ছেলে আলাউদ্দিন বরকত বলেন, চাচা শহীদ হবার পর আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশের অনুষ্ঠানে কিংবা বই মেলায় আমাদের কেউ কোন দিন ডাকেনি।..."
.................


Wednesday, February 24, 2010

এক কাপ চায়ে দু-কাপ চিনি

অসাধারণ ব্যক্তিগণ কিছু চালু কথা চালু করে গেছেন। 'দা থেকে আছাড় বড়ো', 'বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচী', 'দারোগার নৌকার মাঝির শালা' ইত্যাদি।
আমরা সাধারণ যারা তারা বসে থাকব বুঝি? তাই 'এক কাপ চায়ে দু-কাপ চিনি'। উপায় কী, কখনও কখনও এর বড্ডো প্রয়োজন দেখা দেয়!

কোটি-কোটি বাচ্চা প্রসব হয়, এটা কোন খবর না কিন্তু বিমানে কোন বাচ্চা প্রসব হলে তা অবশ্যই খবর। এবারের বইমেলায় হাজার-হাজার বই বেরিয়েছে, মোড়ক উম্মোচন হয়েছে কিন্তু এইসব আলোচনায় আসে না।
পত্রিকার খবর, রাজধানীর একটা হোটেলে এম আসফউদ্দৌলার প্রবন্ধ 'অব পেইনস অ্যান্ড প্যানিকস' (
'প্যানিকস' শব্দটা পড়ার সময় সতর্কতা আবশ্যক। তাড়াহুড়োয় সর্বনাশ হয়ে যাবে, বেইজ্জতির একশেষ)। বইটির মোড়ক উম্মোচন করা হয়।

রাজধানীর এই হোটেলটির নাম এখানে দেয়া হয়নি এমন কি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও বলা হয়নি কিন্তু এই হোটেলটির কার্পেটের নকশা দেখে নিশ্চিত হয়েছি এটা ফাইভ স্টার হোটেল সোনারগাঁ।
দেশের বাঘা বাঘা সুশীলগণ এখানে তশরীফ এনেছিলেন। ভদ্রতার খাতিয়ে এঁদের জন্য নানাপ্রকার চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় এবং মুত্রত্যাগ এই সবের সুব্যবস্থা ছিল বলেই অনুমান করি।

যেখানে প্রকাশকবৃন্দ লেখকদের বাদামের খোসাও ধরিয়ে দিতে চান না সেখানে অখ্যাত এই প্রকাশনী এই লেখক বই প্রসব করামাত্র পাঁচ তারকা হোটেলে মোড়ক উম্মোচনের নামে যে মাস্তির আয়োজন করেছিলেন এ লা-জবাব। আমি এমন লেখকের জরায়ুকে সেলাম জানাই।

আমি খসড়া
একটা হিসাব করে দেখেছি, বইটার অন্তত ১ লক্ষ কপি বিক্রি হলে প্রকাশক সাহেবের এই উদ্যোগ নেয়াটা স্বাভাবিক মনে হতো। আমার জানামতে, বাংলাদেশে এখনও কোন একটা বই ১ লক্ষ কপি বিক্রি হয়নি, তাও আবার প্রবন্ধ! এই বইটা কিনতে গিয়ে মারামারি করতে গিয়ে মেলায় দু-চার জন বিচি, নিদেনপক্ষে দাঁত হারিয়েছেন এমনটাও এখনও শুনিনি। জাস্ট কৌতুহলের কারণে এই প্রকাশনীর স্টলে কয়েক দফা সময় নস্ট করেছি কিন্তু কাউকে তখন বইটা কিনতে দেখিনি। অনুমান করি, আমি ওখান থেকে সরে আসা-মাত্র হাজার-হাজার বইক্রেতা পঙ্গপালের মত বই কেনার জন্য স্টলটাতে ঝাপিয়ে পড়েছেন। আফসোস, এই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে পারলুম না।
তাই হবে! এরাই লেখক বাকীসব তক্ষক।

Tuesday, February 23, 2010

আদিমানুষ: পড়ো, শক্তিমানের নামে



পার্শ্ববর্তী দেশে উপাসনালয় (বাবরি মসজিদ) ভাঙ্গলে আমাদের দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। একেকজনের শরীরে তখন কী জেহাদী জোশ! এই দেশের যে মানুষটি দাঁড়াবার ভঙ্গিই এখনও শেখেনি, শেখেনি কারও দিকে তাকালে মুখ বন্ধ রাখার ভব্যতা। পেশাবের পর যে মানুষটি প্রকাশ্যে যন্ত্র ধরে হাঁটাহাটিঁ করে, কাশাকাশি করে; সেই মানুষটার হাতেও নাঙ্গা তলোয়ার শোভা পায়।
অথচ এখন এই আমাদের দেশেই উপাসনালয় আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে, পদদলিত করছে এটা তেমন কোনো বিষয় না। কারণ, এঁদের প্রতিরোধ করার সেই ক্ষমতা কই!

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঘাইহাটে যে কান্ডটা ঘটে গেল এটা দেখার পর একজন ইসরাইলির সঙ্গে নিজের খুব একটা তফাত খুঁজে পাচ্ছি না। এবং প্যালেস্টাইনদের প্রতিও আলাদা করে মমতা দেখাবার উৎসাহ পাচ্ছি না। আদৌ এই নিয়ে আদিখ্যেতা দেখাবার প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না।

বাঙ্গালিরা আদিমানুষদের (আমরা এদের অবজ্ঞা করে কখনও উপজাতি বলি, কখনও আদিবাসি) প্রতি তাদের ক্ষোভ জানিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু
আদিমানুষদের ভয়ংকর অভিযোগ আছে, (যেটা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এসেছে ) সেনাবাহিনী বাঙ্গালীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছে, আদিমানুষদের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করেছে!
মা-হারা সুনীতার চোখের সামনে যখন তার মার মৃত্যু হচ্ছিল তখন তার মাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করলে আর্মি তাদের দিকে বন্দুক তাক করে। তারা বাধ্য হন বন্দুকের মুখে মুমূর্ষু এই মাটাকে মৃত্যুর কোলে ফেলে পালিয়ে যেতে। এমন অজস্র উদাহরণ!

এই ঘটনাগুলো ঘটল ২০ ফেব্রুয়ারি, যখন গোটা জাতি তাদের ভাষার লড়াই, অস্তিত্বের লড়াইয়ের দিনটাকে নতজানু হয়ে স্মরণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা আমাদের সেই লড়াইটা নিয়ে অহংকার করি কারণ আজ আমরা বাঙালিরা বিজয়ী, শক্তিশালী। পাকিদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আমরা জিতে গেছি, না-জিতলে এই পাহাড়িদের মতই হতো আজ আমাদের অবস্থা।

এই পাহাড়ি নামের আদিমানুষদের ভুবনটা তছনছ করা শুরু করি আমরা আশির দশকে। এর পুরোটা ক্রেডিট দিতে হয় জিয়াউর রহমান সাহেবকে। তিনি পুনর্বাসনের নামে পাহাড়ে বাঙ্গালিদের পাঠাতে শুরু করেন। ধুতুরা গাছটা তখনই লাগানো হয়ে গিয়েছিল, কালে কালে এতে ধুতুরা ফল ধরবে এতে অবাক হওয়ার কী আছে?


আজ আমরা পাহাড়িদের খুঁত ধরি। কিন্তু কোনঠাসা, পাহাড়ের এইসব মানুষদের পিঠ ঠেকাবার জন্য পেছনের গাছও অবশিষ্ট রাখছি না আমরা।
আমরা এইসব আদিমানুষদের ভব্যতা শেখাবার নাম করে আমাদের মত করে কথা বলাবো, আমাদের মত পোশাক পরাবো, আমাদের মত করে ভাবতে শেখাবো। একদা এদের ভাষা কোনো এক পাহাড়ে হারিয়ে যাবে।

আহারে, এদের তো একজন মতিউর রহমান নাই যে, জন রীডের ভাবনা ধার করে গ্রামীনের মত জোঁকের হাত ধরে, 'পাহাড় কাঁপানো ২০ ফ্রেব্রুয়ারি' নামে একটা সার্কাসের আয়োজন করবেন। বা আমাদের গাফফার চৌধুরী সাহেব ফেনীর জয়নাল হাজারীকে নিয়ে গান রচনা করা থেকে অবসর পেলে একটা গান রচনা করে ফেলবেন, 'আমার পাহাড়িদের বাড়তি রক্তে রাঙানো...'।

খর্বাকৃতির চেয়েও ক্ষুদ্র খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিদের কাছে অনেক মার খেয়েছি দুর্বল আমরা, আর না। এবার আমাদের পালা। বিশ্বের কাছে সেই ক্ষুদ্র আমরা পদে পদে অপদস্ত হই। এবার আমাদের পালা। আমাদের আছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মার্সেনারি, আছে সুশীল সমাজের বুদ্ধি। এবার আমাদের আর পায় কে?

অসহ্য ক্ষিধা নিয়ে সভ্যতা-লোভ-যান্ত্রিকতার কাঁধে ভর দিয়ে শহর ক্রমশ এগিয়ে আসছে। গ্রাস করে ফেলছে প্রকৃতি, প্রকৃতির আদি-সন্তানদের। পাহাড় থাকল, না আদিমানুষ তাতে কী আসে যায়! এই দানবকে থামাবার সাধ্যি কার? সহসাই আমরা সগর্বে বলব, 'দিস ইজ মাই ল্যান্ড, নো পাহাড়ি রাইডস হিয়া()'।

*ছবি ঋণ: রবি শংকর, কালের কন্ঠ

** জামাল ভাস্করের ধারাবাহিক লেখা। হেথাক তুকে মানাইছে নারে: http://www.amrabondhu.com/vashkar/1591 

সহায়ক সূত্র:
১. ইসরাইল...: http://www.ali-mahmed.com/search/label/%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B2
২.  মতিউর...:  

Monday, February 22, 2010

আমারব্লগ, মলাটবন্দি: স্বপ্ন এবং বাস্তব


গতকাল ২১ ফ্রেব্রুয়ারি আবারও বইমেলায় যাওয়া হলো। ঠিক ২১ তারিখে যাওয়ার একটা বিশেষ কারণ ছিল। সেটার বিস্তারিত অন্যত্র, অন্য পোস্টে বলব।

সালটা ২০০৭। তখন আমি একটা ওয়েব সাইটে শুভ নিকে ব্লগিং-এর নামে লেখালেখি করি। ওখানকার পোস্টগুলো নিয়ে "শুভ'র ব্লগিং" নামে একটা বই বের হলো। বাংলায় ব্লগিং-এর উপর প্রথম বই, আমার আনন্দিত হওয়ার কথা কিন্তু ওই সময় অনেকখানি বিষাদগ্রস্ত ছিলাম। কারণটা এখন বললে অনেকের কাছে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। না হোক, তাতে আমার আবেগের কী আসে যায়, ঘন্টা!

আমি যাদের সঙ্গে ওখানে দিনের পর দিন লেখালেখি করেছি, মন্তব্য চালাচালি করেছি। যাদের লেখার ক্ষমতা আমাকে হতভম্ব করেছে, পারলে এঁদের হাতগুলো সোনা দিয়ে বাঁধাই করে দেই! এঁদের বিচিত্র ভাবনা, লেখার ক্ষমতা দেখে আমি হিংসায় মরে যাই।
অথচ আমার আস্ত একটা বই বের হলো- আমার নিজেকে কেমন অপরাধি অপরাধি লাগছিল। আমি এটা মেনে নিতে পারছিলাম না, কেন এঁদের অন্তত একটা করে লেখা নিয়ে বই বের হবে না?

তখন চেষ্টা করেছিলাম ওখানকার অন্তত ১০০জন ব্লগারের লেখা নিয়ে একটা বই বের করতে। কিন্তু পারিনি, ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমি এই বেদনাটা আজও ভুলিনি! তখন এইসব নিয়ে অসম্ভব মন খারাপ করে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম: একজন দুর্বল মানুষের দুর্বল মস্তিষ্ক

মেলায় এবার আমার থাকার জায়গাটা ছিল লিটল ম্যাগ চত্ত্বরে। অনেক কারণের একটা হচ্ছে জায়গাটা তুলনামূলক ফাঁকা। অন্তত শ্বাস ফেলা যায়, পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলা যায়।
প্রায় সবাই নিজ নিজ দলের সঙ্গে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ান, আমি দলছুট টাইপের মানুষ- না ঘার কা, না ঘাট কা। আমি পারতপক্ষে এখান থেকে নড়ি না কারণ বইমেলা নামের এই ব্যবসায়িক বাজারে (মতান্তরে ঠাঠারি বাজার) হারিয়ে যাব।

এখানে আবার আমার ব্লগের স্টল। আজ 'মলাটবন্দি আমারব্লগ' বইটা কিনলাম। আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ। সবচেয়ে বেশি টেনেছে নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে ব্লগারদের নাম দিয়ে লেখা সাজানো- কারও ট্যাঁ ফো করাও যো নাই। আমার ব্লগের এই প্রকাশনীটা প্রায় নিখুঁত একটা কাজ হয়েছে। এখনও পড়া শুরু করিনি। এখানকার অল্প ব্লগারই আমার পরিচিত, তাতে কী! বরং এও ভাল নতুনদের ছড়াছড়ি। একজন নতুন লিখিয়ের কাছে একটা লেখা প্রকাশ হওয়ার যে কী আনন্দ এটা আমি খানিকটা বুঝি। এক সময় পত্রিকার পাতায় চিঠিপত্র কলামে আমার কয়েক লাইনের লেখা ছাপা হতো। ওই আনন্দের সঙ্গে কিসের তুলনা হয়, আজ আর সেই আনন্দ কোথায়!

আমি খানিকটা আঁচ করতে পারি এটা বার করাটা চাট্টিখানি কথা না। এর পেছনে আছে এক ঝাঁক হার-না-মানা, অদম্য তরুণ। সেইসব তরুণ যারা ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে গান গাইতে গাইতে হাঁটতে জানে! কেবল এরাই পারে সব কিছু বদলে দিতে। কাল আমার ব্লগের স্টলে আমি যখন
'মলাটবন্দি আমারব্লগ' বইটা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলাম, তাঁদের এই উচ্ছ্বাস তেমন স্পর্শ করতে পারেনি, এ আমি বিলক্ষণ জানি। কারণ এরা জানেন না, আমি যে কাজটা করতে পারিনি এঁরা তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। হার-মানা আমার কাছে এরচে আনন্দের আর কি হতে পারে।

*ছবি ঋণ: http://dewdropsreturn.amarblog.com/posts/99566

Sunday, February 21, 2010

জীবনটাই যখন নিলামে: ৪


লোপার রাগ অনেকখানি উবে গেছে। রাব্বিকে কেমন অস্থির-অস্থির লাগছে। মানুষটা এমনিতে বড়ো অস্থির কিন্তু বেশ কয়েক মাস ধরে এ অনেকখানি পাল্টে গেছে। এর স্বাভাবিক জীবন-যাপন, নিজের সময় বলতে কিছু নেই। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে হা-হু বলতেও বড্ড কষ্ট হয় এমন। বারবার জিজ্ঞেস করলে ঘুরেফিরে একটাই উত্তর, অফিসে খুব ঝামেলা যাচ্ছে।
কি ঝামেলা জিজ্ঞেস করলেই চিড়বিড় করে উঠে, আহ, আমি অফিসের সমস্যা নিয়ে তোমার সাথে ডিসকাস করব নাকি! কী যন্ত্রণা, আমাকে কী লিখিতাকারে তোমার কাছে রিপোর্ট করতে হবে! তুমি কি আমার বস?

লোপা অবাক হয়ে ভাবে, মানুষটা কতো বদলে গেছে। মানুষটা শেষ কবে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে, শেষ কবে গল্প করেছে, শেষ কবে তাকে কাছে টেনেছে মনেও পড়ে না। মানুষটা একটা রোবট হয়ে গেছে। আজ আট বছর হলো ওদের কোন সন্তান নেই। এই নিয়েও মানুষটার কোন বিকার নেই। হা-হুতাশ নেই, কোন চেষ্টা নেই। লোপার এটা আজও বোধগম্য হয় না, একটা মানুষ সন্তান নেয়ার ব্যাপারে কেমন করে এতোটা নির্বিকার থাকে। এই বিষয়ে কিছু বললেই গা-ভাসানো উত্তর, এতো অস্থির হওয়ার কী আছে। যখন হওয়ার এমনিই হবে।

এটা কেমন কথা। এতো বছর হলো, সন্তান না-হওয়ার পেছনে কোন না কোন জটিল একটা সমস্যা আছে নিশ্চয়ই। কার সমস্যা, কেন সমস্যা এটা জানাটা কি জরুরি না? অন্তত ডাক্তারের কাছে না-যাওয়ার পেছনে যুক্তি কী। চুপিচুপি লোপা ডাক্তারের কাছে যায়নি এমন না কিন্তু কিছু বিষয় আছে যার জন্য দু-জনের যাওয়াটা জরুরি। লোপা একবার বলেছিল। রাব্বি ঠোঁট উল্টে বলেছিল, তোমার প্রয়োজন হলে তুমি যাও, আমি যাব না।
লোপা নাছোড়বান্দা, আহা, ডাক্তারের কাছে গেলে তো আর দোষ নেই। মানুষ বেড়াতেও তো যায়।
বেড়ালে তুমি বেড়াও। আর এই নিয়ে হইচই করো না তো, অফিসের যন্ত্রণায় দম ফেলার ফুরসত নাই।
রাগে লোপার গা জ্বলে যায়। অফিস আর অফিস, যেন এই পৃথিবীতে আর কেউ অফিস করে না। বিয়ের পর পরই কোথাও ঘুরতে যাওয়া দূরের কথা, আত্মীয়দের বাড়িতেই যাওয়া হয়নি!

কিন্তু এখন এইসব সব ভুলে গেছে। রাব্বিকে দেখে এখন কী মায়াই না লাগছে!
রাব্বি, কি হয়েছে তোমার?
রাব্বি চুপ করে রইল।
লোপা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নরম গলায় বলল, বলো না কি হয়েছে?
কিছু না, অফিসের ঝামেলা।
তোমার এই ঘোড়ার অফিসের ঝামেলা কবে শেষ হবে! বিয়ের পর থেকে তো শুনেই আসছি এটা।
রাব্বি ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দিল।
লোপা রাব্বির গায়ে হাত রাখলে রাব্বি বিরক্তি ভরে হাতটা সরিয়ে দিল। লোপা কষ্টের শ্বাস গোপন করল। রাব্বি কি এটা জানে ওর এই আচরণ ওকে কতটা কষ্ট দেয়? ও কোন দিন জানার চেষ্টাও করবে না। একজন মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কেমন করে? এইসব মানুষরা বিয়েই বা করে কেন? এরা থাকবে একা একা, পৃথিবী থেকে বিদায়ও নেবে একা।

লোপা আবারও হাত ধরার চেষ্টা করলে রাব্বি সজোরে সরিয়ে দিল। লোপার কষ্টের শ্বাস এবার আর গোপন থাকল না। লোপা নিজেকে ধিক্কার দিল, ওর মত বেহায়া মানুষ এই পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাব্বির এতোটা তাচ্ছিল্যের পরও রাব্বির জন্য ওর এই মায়ার উৎস কমে না কেন? এই উত্তরটা ওর অজানাই থেকে যাবে। আজকাল এই উত্তরটার জন্য ওর মনে প্রশ্নটা কেবল ঘুরপাক খায়, কেন-কেন!
লোপা ম্লান গলায় বলল, চা খাবে?
হুঁ, চা খাওয়ার বিষয়ে রাব্বির কোন না নাই।
শুধু চা, সঙ্গে আর কিছু খাবে?
নাহ, চা-ই দাও।
খালি পেটে চা খাবে?
আহ, না বলতাম তো।
অফিসে সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই কিছু খাওনি?
লোপা, তুমি বড়ো বিরক্ত করো।

লোপা আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু চা নিয়ে আসার সময় কয়েকটা বিসু্কট নিয়ে এসেছে। রাব্বি ঠিকই আগ্রহের সঙ্গে চার-পাঁচটা বিস্কুট খেল। লোপা কাতর চোখে তাকিয়ে আছে। মানুষটার পেটে ক্ষিধে অথচ ইচ্ছা করেই সে অন্য কিছু খাচ্ছে না।
রাব্বি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, লোপা, আমার না অফিসে খুব সমস্যা হচ্ছে। আমার এই চাকরিটা করতে আর ভাল লাগছে না।
চাকরি করতে কার ভালো লাগে, বলো।
জানো, আমি এখানে আর কিছুদিন চাকরি করলে ঠিক পাগল হয়ে যাব।
লোপা অজান্তেই কেঁপে উঠল। নিশ্চিত এ খুব বড়ো সমস্যায় আছে। মানুষটা শক্ত প্রকৃতির। লোপা অনেকবার দেখেছে, কেমন করে অনেক বড়ো বড়ো সমস্যা এ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। অনেক গুন্ডা-পান্ডাকে দেখেছে একে সমীহ করে কথা বলতে। অনেক জায়গায় লোপা রাব্বির বউ হওয়ার সুবাদে আলাদা খাতির পেয়েছে। অথচ আজই একে দেখল একেবারে ভেঙ্গে পড়তে।
রাব্বি, তোমার অফিস থেকে কি চাকুরি ছেড়ে দিতে বলেছে?
নাহ।
তাহলে?
আরে, সৈয়দ মাদারফাকারটার জন্য-।
প্লিজ রাব্বি, মুখ খারাপ করবে না।
মুখ খারাপ করব আবার কী, এর নাম মুখে নিলে অজু ভেঙ্গে যায়, জানো না?
না জানি না।
আজ তো জানলে।
জানলাম, বেশ। প্লিজ, তুমি মাথা গরম করো না। কুল।
ফাকিং কুল।
রাব্বি, তুমি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে খুব মুখ খারাপ করো।
হুম।
হুম, কুল।
হুম।
হুম, কুল।
রাব্বির মুখে অজান্তেই একচিলতে হাসি ফুটে উঠল।
আচ্ছা রাব্বি, তুমি কি জানো, তোমাকে হাসলে খুব সুন্দর দেখায়?
না, জানি না।
আজ তো জানলে।
লোপা বাজে বকবে না, আমাকে সুন্দর দেখায়। আমার মা-ই এই গ্রহের একমাত্র মহিলা যিনি আমাকে সুন্দর বলে এসেছেন, তার চোখে আমার চেয়ে সুন্দর আর কেউ নাই।
লোপা হাসি চাপল। রাব্বি এটা প্রায়শ বলে ওর চেহারা নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই। যারা করে তারা চাটুকার ইত্যাদি ইত্যাদি। রাব্বিকে বললে বিশ্বাসই করবে না লোপা কখনও এই মানুষটার চেহারা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এটা ভেবে লোপা লাল হয়ে গেল, রাব্বিকে ওর বেশ লাগে!
কী আশ্চর্য, মানুষটা সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে!

লোপা অবাক হতেও ভুলে গেছে, মানুষটা এতো যন্ত্রণার মধ্যেও কী অবলীলায় ঘুমিয়ে পড়েছে। লোপার কেন যেন অন্য রকম কষ্ট হতে লাগল। এই মুহূর্তে একে কী অসহায়-ভঙ্কুরই না লাগছে! মাথাটা কেমন এলিয়ে আছে, চোখ থেকে চশমাটা পর্যন্ত খুলে পড়েছে। লোপা আলগোছে চশমাটা সরিয়ে রাখল। লোপা অপেক্ষা করছে রাব্বি উঠলে একসঙ্গে খাবে বলে কিন্তু রাব্বি গাঢ় ঘুমে। সারাটা রাত ও সোফায় শুয়ে রইল। কয়েকবার জাগাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, এই ছোট্ট সোফায় ঘুমাতে ওর কষ্ট হবে ভেবে। কেমন গোল হয়ে শুয়ে আছে, পা মুড়ে। খালি পেটে কেমন করে ঘুমাবে কে জানে! নিরুপায় হয়ে একটা চাদর ওর গায়ে দিল। এখানে এভাবে ওকে ফেলে যায় কেমন করে? লোপার রাত কাটল নির্ঘুম!

*জীবনটাই যখন নিলামে: ৩

**সুলেখক শেখ জলিল, যিনি নিজেও লিখেন চমৎকার। বইটার একটা সমালোচনা লিখেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।

Saturday, February 20, 2010

রাতারাতি বিবাহযোগ্য বাচ্চা পয়দা হয় না


কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকা অনেকগুলো পলাশ গাছ ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে।
কেন?
নিরাপত্তার জন্য নাকি এই অসভ্য কান্ডটা করার প্রয়োজন ছিল।

এই পলাশ ফুলের সঙ্গে ফাল্গুন-ফেব্রুয়ারি মাখামাখি হয়ে থাকে।
পেছনে নীল আকাশ, রক্তলাল পলাশ দেখে আমাদের কত ভাবনাই না খেলা করে। আজিব একটা দেশ, ততোধিক আজিব এই দেশের মানুষ, আমাদের এই ভাবনাটাগুলোও এদের কারাগারে আটক!

ঢাকা শহর রোবট বানাবার কারখানা হয়ে যাচ্ছে, গেছে। যেসব প্রাচীন অল্প গাছ এখনো টিকে আছে এগুলো কেটে সাফ করে ফেললে পুরোপুরি রোবট হতে সুবিধে হয়। তখন আর সভ্য-সভ্য ভাব ধরে থাকার প্রয়োজন নাই, পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে গেলেই হয়।

নিরাপত্তার অজুহাত? আগেকার জমানা হলে বলতাম, নিরাপত্তার সমস্যা দেখা দিলে পলাশ গাছে কিছু হনুমান উঠিয়ে রাখলেই হয়। আহা, সেই রামের আমলও নাই সেই অযোধ্যাও নাই‍! এখন কলিকাল। এখন কি আর হনুমানজীকে অনুরোধ করা চলে?
আচ্ছা, কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বৈদেশ থেকে ট্রেনিং দিয়ে যে Sniper (A skilled military shooter detailed to spot and pick off enemy soldiers from a concealed place.) আনা হয়েছে এরা কি বিল-হাওরে পাখি শিকার করে বেড়াচ্ছেন? নাকি রাইফেলে মঘা কোম্পানির হালুয়া মাখাচ্ছেন?
এমন নিরাপত্তার সমস্যা মনে করলে এদের পলাশ গাছে উঠিয়ে বসিয়ে রাখলেই হতো, আটকাচ্ছে কে? বাংলা-লাদেন টাইপের কাউকে দেখলেই সাইলেন্সার লাগানো রাইফেল দিয়ে মাথাটা তরমুজের মত ফাটিয়ে দিলেই হতো, দাবড়াচ্ছে কে?

আমাদের দেশে যারা এইসব সিদ্ধান্ত নেন, তাদের কে বোঝাবে লক্ষ-লক্ষ শিমুল গাছের চারা লাগানো যায় কিন্তু চট করে এগুলোতে ফুল ফোটানো যায় না। যেমন যায় না বিবাহযোগ্য বাচ্চা (মতান্তরে অবাচ্চা) পয়দা করা!

*ছবি ঋণ: রাশেদ সুমন, কালের কন্ঠ
**এটার চেয়ে প্রথম আলোর ছবিটা পছন্দ হয়েছিল কিন্তু ওটায় সমস্যা,
ওই ছবিটার উঠিয়েছে প্রথম আলো। আমি বুঝে উঠতে পারছি না প্রথম আলো ছবি উঠায় কেমন করে? এও ধরতে পাছি না এটা কি এই অফিসের কোন চাপরাসি উঠিয়েছেন নাকি মতিউর রহমান স্বয়ং? অবশ্য মতিউর রহমানের ছবি উঠাবার কায়দা-কানুনই অন্য রকম, নমুনা এখানে

Friday, February 19, 2010

মতিউর রহমান: আগে নিজের শপথটা সেরে ফেলুন

এখন টিভি দেখাটা এক যন্ত্রণা হয়ে গেছে। ফ্রেব্রুয়ারি মাসটা জুড়ে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেই। একেকজনের কী কান্না, কপাল ভিজে যাচ্ছে! আমরা আবার বিশেষ আয়োজন ব্যতীত, বিশেষ দিন ব্যতীত ঘটা করে কাঁদতে পারি না। শব সামনে নিয়ে চালবাজরা যেমন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে, লাউ দিয়া শোল মাছ খাইতে চাইছিল রে-এ-এ-এ। হেই দিন আমারে কইল, বাজারে লইয়া চল, কে রে লইয়া গেলাম না, রে-এ-এ। যাওয়ার আগে কইয়া গেলো না, রে-এ-এ।
টিভিতে কী একেকটা বিজ্ঞাপন! দেশের সেলিব্রেটিরা বুকে কালো কাপড় লাগিয়ে ভাব ধরে বলছেন, 'ভাষা...বিনম্র শ্রদ্ধা'...'ওয়ালটন আমাদের পণ্য'।  আহ, আমাদের সেলিব্রেটি, এরা ভাল পেমেন্ট পেলে পটিতে বসারও পোজ দেবেন। টাকার অংকটা ভালো হলেই হয়, ব্যস।

এই দেশের জন্য এখন সবচেয়ে বেশি মায়া সেল কোম্পানীগুলোর, রক্তচোষা গ্রামীন ফোন সবার আগে মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটছে। ১৬ কোটি মানুষ এদের গ্রাহক এটা শুনলেও আমি বিস্মিত হবো না।
এদের সঙ্গে যোগ দেন আমাদের দেশের সুশীলগণ। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এগুলোকে এরা এখন জাস্ট একটা পণ্য বানিয়ে ফেলেছে। বিক্রয়যোগ্য পণ্য। হজম করার জন্য আমরা জনগণ আছি না!

১৬
ফ্রেব্রুয়ারি, মতিউর রহমান সাহেব প্রথম আলোয় লিখলেন, "দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট"।
জন রীডের বিখ্যাত একটা বই আছে "দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন"।
আমি এই ফিজুল তর্কে যাই না কিন্তু অনুমান করি, মতি সাহেব ওখান থেকে দশ দিনটাকে ৩০ মিনিট করে দিয়েছেন।
জন রীড তাঁর বইয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কেমন করে ১০ দিনে দুনিয়াটা কেঁপে উঠেছিল।
এ সত্য, ভাষার জন্য লড়াই এটা আমাদের জন্য বিপুল, বিশাল এক ঘটনা, আমাদের অহংকার কিন্তু আমি যদি পক্ষপাতহীন-নির্মোহ দৃষ্টিতে মতিউর রহমানের এই লেখাটা পড়ি তাহলে বুঝে উঠতে পারি না কেমন করে এই ৩০ মিনিট দুনিয়াটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল! এটা আমাদের জন্য কাঁপানো দিন, দুনিয়ার জন্য কেমন করে? মতি সাহেব জন রীডের লেখা পড়ে মাছিমারা কেরানির মতো আইডিয়া প্রসব করে ফেলেছেন নাকি? ভালো-ভালো!

এই লেখার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, "আমরা নতুন করে শপথ নেব...জনগণের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট গ্রামীনফোন। ...।" গ্রামীনফোনের মত কোম্পানি আমাদের চোর বানাতে উস্কে দিলেও আমরা মতি সাহেবদের কল্যাণে এদের লেজ ধরে হাঁটব, ইনশাল্লাহ।
ওয়াল্লা, আবারও দেখি মতিউর রহমানের শপথ কিচ্ছা। এতো শপথ করিয়া আমরা কী করিব, কোথায় যাইব, কোথায় রাখিব? শপথ করিতে গিয়া শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জানের মত সুশীলদের কাছা খুলুক, আমার কী! মতি সাহেব দেখছি আমাদের শপথ করাইয়া করাইয়া সুশীল-মানুষ বানাইয়া দিবেন। কিন্তু একটা বিষয় আমার বোধগম্য হইতেছে না তিনি নিজে কেন শপথ নিচ্ছেন না, নাকি তিনি আকাশলোকের বাসিন্দা, তাহার শপথের প্রয়োজন নাই?

এখন
হরদম গ্রামীনের (প্রকারান্তরে মতি সাহেবের আইডিয়া) ওই বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, "...আহারে সেই ত্রিশ মিনিট, দুনিয়া কাঁপানো ত্রিশ মিনিট"। আহারে, আমাদের মতিউর রহমানরা যা ভাবেন তাই আমাদের গিলিয়ে ছাড়েন, করপোরেট ভুবনের রাক্কসদের কাঁধে ভর করে। যথারীতি এতে যোগ দিয়েছে গ্রামীন ফোন।
আহারে, এইসব কোম্পানিগুলো কান্নাকাটি খানিকটা কমালে তাদের অন্তর্বাস ভেজার হাত থেকে বেঁচে যেত! আমাদের ক-জনই বা ভাষাসৈনিক আজ বেঁচে আছেন। যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের একটা করে ফ্ল্যাট দিয়ে দিক না। অন্তত ভদ্রস্ত হয়ে বাঁচার জন্য ন্যূনতম সহযোগীতা।

মতিউর রহমানরা ব্যবসাটা ভালই বোঝেন, একটু বেশি বেশি। যে ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে মতিউর রহমান কাঁদতে কাঁদতে শ্যাষ, গামছা ভিজিয়ে ফেলছেন। এই ভাষা আন্দোলন যারা করেছিলেন তাঁদের প্রতি মতিউর রহমানের শ্রদ্ধা দেখে আমাদের প্যান্টলুন খুলে যাওয়ার দশা। ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের মৃত্যু সংবাদ আমাদের মতিউর রহমান সাহেবের পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা হয় না, ছাপা হয়েছিল শেষ পৃষ্ঠায়, সিঙ্গেল কলামে, হেলাফেলা ভঙ্গিতে। কারণ এই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় কোথাকার কোন ভাষাসৈনিকের খবর ছাপাবার চেয়ে জরুরী জল্লাদ কোন কালারের আন্ডারওয়্যার পরেছিলেন এর বিশদ বর্ণনাসহ ঢাউস ছবি ছাপানো।

মতিউর রহমান সাহেব আমাদের মগজ ধোলাই করবেন কখন আমরা কোন শপথ নেব, কাকে কখন সম্মান করব, কখন অসম্মান। ভয়ে ভয়ে আছি, আমাদের মতি সাহেব কোন একদিন, আমরা কেমন করে বিছানায় আচরণ করব এই বিষয়ে কোন একটা শপথ আহ্বান করে বসেন। বড়ো ভয়ে ভয়ে আছি, তখন আমাদের কী হবে গো!

Thursday, February 18, 2010

ওড়নাসমগ্র এবং কলার খোসা


বইমেলায় একজন লেখকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছি।আমার বইয়ের প্রকাশকের স্টল থেকে নিরাপদ দূরত্বে। কারণ প্রকাশক আমাকে দেখলেই রে-রে করে তেড়ে আসবেন। তিনি আমার একখানা বহি বাহির করিয়াছিলেন। তাঁর বিক্রি-বাট্টার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। ফি-বছর সবসুদ্ধ আমার ২টা বই-ই বিক্রি হত। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, একটার ক্রেতা শুভ, অন্যটার আলী মাহমেদ। গোপনে এ-ও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এই দুজন একই 'লুক'। নামে-বেনামে খরিদ করে।
একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বদ্দা, বই বিক্রি বাড়াবার রহস্য কি?
তিনি বলেছিলেন, 'মিয়া, তুমি আজ-অবধি তোমার বইয়ের মোড়ক উম্মোচনই করলা না! 'মল-বাক্স' (রুচিমান লোকজনেরা কানে আঙুর দেন); মল-বাক্সের (মতান্তরে পেট) কাছে বই ধরে পোজ দিতে হয়, ফটাফট ছবি উঠাতে হয়। এইসব না করলে তোমার বই শুভ এবং আলী মাহমেদ কেনে এতেই তুষ্ট থাকো। আগামীতে এরাও কিনব না। কিনলে ভোঁতা দাও দিয়া কান কাইট্যা ফেলব'।
আমি ভাবনায় পড়ে গিয়ে বললাম, 'মোড়ক উম্মোচন কি খুব জরুরি'?
তিনি রাগ চেপে বললেন, 'তুমি কলা খাও'।
আমি মিসিং ২টা দাঁত ব্যতীত সবগুলো দাঁত বের করে বললাম, 'সেতো সবাই খায়, আমি খাই এ খাই ও খায় মায় বাঁদরও'।
এইবার তিনি রাগটা আর চেপে রাখতে পারলেন না, 'কলাটা কি খোসা সহ খাও'?
আমি বললাম, 'না, তা কেন, ওইটা তো খায় ছা...ছাগ'।
তিনি লাফিয়ে উঠলেন, 'ব্যস-ব্যস। কলা যেমন খোসা সহ খাওয়া যায় না তেমনি বইয়ের খোসা-মোড়ক না সরালে বইও বিক্রি হয় না। বই আর নারী...'। (কাশি) বাকীটা ভদ্র সমাজে বলার মতো না।
পাশ থেকে কে যেন বলল, 'একটা অটোগ্রাফ দিবেন'? আমি গা করি না, গল্প চালিয়ে যাই। সাথের লেখক বিরক্ত হলেন, বিষয় কী, অটোগ্রাফ দেন না কেন? এইটা কি বেতমিজগিরি!
আমি দুম করে আকাশ থেকে পড়লাম। মানুষটা আমাকে বলছে নাকি, আমার ক্কা কাছে, অ-অট-অটোগ্রাফ! মানুষটা পাগল নাকি, দুনিয়ায় আর লোক খুঁজে পেল না! আমি ভাল করে মানুষটাকে দেখি। তাঁর সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, তদুপরি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করি আমার কাছে কেন রে, বাপ! আঁচ করার চেষ্টা করি কিন্তু মানুষটাকে স্বাভাবিকই মনে হয়। ওয়াল্লা, ইনি দেখি সত্যি সত্যি আমাকেই বলছেন! অটোগ্রাফ কড়চা লেখার পর আমার ধারণা ছিল কেউ আর আমার টিকিটিও স্পর্শ করতে আসবেন না।

বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশের লেখক তাড়া দেন, 'আরে কি মুশকিল, অটোগ্রাফ দিয়ে শেষ করেন'।
আমি চিঁ চিঁ করে বলি, 'ইয়ে, হয়েছে কি বুঝলেন, অটোগ্রাফ যে দেব আমার তো যথেষ্ঠ প্রস্তুতি নাই। আগে বুঝি নাই কাজে লাগবে, ওড়না কাম চাদরটা তো কিনি নাই'।
তিনি বললেন, 'সুমন্ত আসলামের কাছে অনেকগুলো ওড়না-চাদর আছে। তিনি যে স্টলে বসেন ওখানে পেরেকে অসংখ্য ওড়না-চাদর ঝোলানো থাকে। কিছুক্ষণের জন্য একটা ওড়না নিয়া আসেন। না-দিলে আমার কথা বইলেন'।
আমার দিকভ্রষ্ট রোগ আছে। কোথায় 'ওড়নাখ্যাত সুমন্ত আসলাম' বসেন সেটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমি হাল ছেড়ে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা ভাই, আপনি তো অনেক বিখ্যাত লেখকদের অটোগ্রাফ নিয়েছেন। তো এঁরা অটোগ্রাফে আসলে কি লেখেন? ওখান থেকে ধার করে লিখে দিতাম আর কি'। 
তিনি বললেন, 'সিনিয়র, জুনিয়র বুঝে লেখা হয়। শুরুটা হয় শ্রদ্ধাস্পদেষু, শ্রদ্ধাভাজনেষু, স্নেহপুত্তলি, স্নেহার্শীবাদ ইত্যাদি'।
আমি জপ করতে থাকি, বানান মনে করার চেষ্টা করি। শ্রদ্ধা পদেশু, ভাজ-ভাজনেষু ইয়ে পুত্তলি। কী কষ্ট-কী কষ্ট, জীবন নষ্ট!

এমনিতে আমার মাথায় আসছিল না একজন লেখককে ওড়না দিয়ে বুক ঢাকতে হবে কেন? ওড়নার চল তো এমনিতেই উঠে যাচ্ছে। আজকাল মেয়েরাই ওড়না নামের জিনিসটা পছন্দ করছেন না। শখ করে কেউ পরলেও গলায় পেঁচিয়ে রাখেন বা কেউ একপাশে ফেলে রাখেন, একটা ইয়ে...। হোয়াই একটা? 'ইয়ে বাহোত না-ইনসাফি হ্যায়'!
আরেকজনকে বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, 'ভাই, আপনার নাম কি হ্রস্ব উ-কার নাকি দীর্ঘ উ-কার' দিয়ে?
তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, 'কেন, এই নামটা আপনি গুরু রবীন্দ্রনাথেরেওমুক গ্রন্থে পড়েননি'!
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, 'না, মানে কেউ রহমান লিখে কেউ রাহমান। আর ভাই, গুরুর সব লেখা পড়ব কি, আজপর্যন্ত একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতই লিখতে পারলুম না'!

যাক গে, লেখক মহোদয় মায়াকোভস্তি-দস্তয়ভস্কি-ট্রটস্কি-চমস্কিদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তিনি বলছিলেন, এঁরা এই দেশে আসলে দেশটার চেহারাই পাল্টে যেত।
আমি নিরীহ মুখে বললাম, 'এঁরা সম্ভবত এই দেশে আসতেন না কারণ এখানে বরফ কোথায়? স্কি করার সুযোগ কই'!
তিনি অবাক, 'মানে কী, স্কির প্রসঙ্গ আসছে কেন'!
আমি বললাম, 'না, সবার নামের শেষে স্কি আছে তো তাই আমি ভাবলাম এরা স্কি করতে পছন্দ করেন'।
তিনি চিড়বিড় করে বললেন, 'রসিকতা করবেন না। একদম না। আপনি রসিক লোক না। আর আপনাকে দেখলাম লোকজনের সঙ্গে হা-হা হি-হি করছেন। এইসব করবেন না। একজন লেখকের এইসব মানায় না'।
আমি ম্রিয়মান হয়ে বললাম, 'লোকজন না, এঁরা সবাই আমার বন্ধু। ব্লগিং-এর নামে এঁদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় লেখালেখি করেছি, মন্তব্য চালাচালি করেছি, অনেক বিনিদ্র রাত পার করেছি। সে এক সোনালি সময়! এঁরা আমার জন্য কতটা কাতর আমি জানি না কিন্তু আমি এদেঁর জন্য বড়ো কাতর'।
তিনি বিরক্ত হলেন, 'এইসব ছাতাফাতা বললে তো হইব না। একজন লেখক হতে গেলে রাশভারী ভঙ্গি ধরে রাখবেন। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে পা ফাঁক করে এলোমেলো ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করবেন'।
আমি মন খারাপ করা শ্বাস ফেললাম। হবে না, হবে না আমাকে দিয়ে, লেখক হওয়ার দেখি অনেক হ্যাপা! আফসোস, লেখক হওয়ার বড়ো ইচ্ছা ছিল, হতে পারলাম না। আফসোস...!

*পোস্টের সঙ্গে যে জিনিসটা যুক্ত করা হয়েছে এটা নামেই জলরঙ বাস্তবে জবরজ। চেষ্টাটা করা হয়েছিল এমন, একজন মানুষের মুখ আর একজন গর্ভবতী মহিলা মিলেমিশে থাকবে...।

Wednesday, February 17, 2010

লেজটা লুকিয়ে রাখা আবশ্যক


কিছু কান্ড দেখে কখনও কখনও আমার ইচ্ছা করে আফ্রিকার কোন জঙ্গলে গিয়ে বাস করি। নিদেনপক্ষে এমন কোন জায়গায় যেখানে চলে কেবল জঙ্গলের আইন।
হায় সভ্যতা, এমন সভ্যতা লইয়া আমরা কী করিব?

গত দুই দিন ধরে আমাদের মহান সংসদ ভবনে দলীয়-বিরোধী দলীয় কতিপয় মহান সংসদ সদস্যদের যেসব কান্ড, যেসব ভাষার প্রয়োগ দেখছি তারপর আর সভ্য-সভ্য ভাব ধরে থাকতে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করে দিগম্বর হয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করি।
এই সংসদ সদস্যারাই আমাদের জন্য আইন বানান, আইন প্রণেতা!
দেশের কতসব জটিল সমস্যা। সব বাদ দিয়ে কোন নেতার বাক্সে লাশ ছিল না, কোন নেতা এবং তাঁর সন্তানকে ট্রাকে নিয়ে যাওয়ার সময় লাশ আগুপিছু হয়েছে তাই নিয়ে একজন অন্যজনের উপর ঝাপিয়ে পড়ছেন।

বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। সব দলই একই কাজ করেছেন। এই নিয়ে নতুন করে বাতচিতে যাই না কারণ যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা এই কাজটা খুব যত্মের সঙ্গে করেছেন। এই নিয়ে নতুন করে কালি খরচ করা হালের কী-বোর্ড নিয়ে কস্তাকস্তি করার কোন মানে হয় না।

কার কথা এটা ভুলে গেছি, 'ফ্রিডম' বইয়ে ব্যাবহার করেছিলাম:
"There is a thin layer between a genius and a mad man and a thinner layer between a politician and a scoundrel."
এরপর আর বলার অবকাশ থাকে না! এইসব রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আমাদের আর চাওয়ার কী থাকতে পারে? নেতা এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যাবে কেবল এই মানুষটাকে দেখলে।

তবে জিয়া বিমানবন্দর নিয়ে যে খেলাটা খেলা হয়েছে এই নিয়ে আমার একটু কথা ছিল। পোস্টের সঙ্গে ছবিটা একটা দুর্দান্ত ছবি! শেখ হাসান নামের মানুষটার তারিফ করি। প্রথমে এই বিমানবন্দরটার নামের হ্রস্ব ই-কার উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, জিয়া থেকে হয়েছে জয়া। আমি আরও আনন্দিত হতাম, যদি কামান দেগে এই কাজটা করা হতো। পরে আবার জিয়া হলো, এরপর জিয়া উধাও।

যাগ গে, আমার আলোচ্য বিষয় এটা না। উল্লেখ করলাম এই কারণে, এদের বুদ্ধির তারিফ করার জন্য! আমি যেটা বলতে চেয়েছিলাম, ভালো কথা, মন্ত্রী পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেন নিয়েছে, এটা নিয়ে কুতর্কে আমি যাই না। আমি কেবল জানতে চেয়েছিলাম, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কি লিখিত আকারে কোন চিঠি পেয়েছেন? যেটায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে কামান দেগে এই নাম উড়িয়ে দাও? আমি নিশ্চিত, লিখিত নির্দেশ এখনও পৌঁছেনি কারণ মাত্র মন্ত্রীসভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এটার প্রসেস করতেও তো সময়ের প্রয়োজন।
তাহলে?
এই কাজটা লিখিত নির্দেশ পাওয়ার পর করলে কি বিমান বন্দরের উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ত? নাকি দু-চারটা বিমান গোত্তা খেতে খেতে বিমানবন্দরের উপর উল্টে পড়ত! লিখিত নির্দেশ না আসা অবধি এই সময়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না, না?

আমরা শুধুশুধু রাজনীবিদদের দোষ দেই এদের শিক্ষা কম ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু এইসব গামলা নামের আমলা, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, এঁরা তো অতি শিক্ষিত। অনেকগুলো পাশ দিয়ে এইসব
জায়গায় চেয়ারের পেছনে তোয়ালে ঝুলিয়ে বসেছেন। তাহলে? আফসোস, এইসব অতি শিক্ষিত মানুষদের যখন বাথরুম উদ্বোধন করার প্রয়োজন হয় তখন বুকের গভীর থেকে ঠান্ডা শ্বাস বেরিয়ে আসে আহা, এরা লেজটা কেন লুকিয়ে রাখেন না।

ছবি সূত্র: শেখ হাসান, কালের কন্ঠ ১৭.০২.১০

Tuesday, February 16, 2010

পরাবাস্তববাদ বনাম বাস্তববাদ!


আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যখন দেখি, কোন একজন প্রকাশক জাঁক করে বলছেন, 'এই দেশে ভালো পান্ডুলিপির বড়ো অভাব'।

তখন আমার ইচ্ছা করে পায়ের চটি খুলে একে আচ্ছা করে পিটাই। আফসোস, নিরাপদ দূরত্বে থেকে এই কর্ম সম্পাদনের উপায় এখনও চালু হয়নি। তাই বলে আমার দুর্দান্ত ক্রোধের কী হবে? টিস্যুতে থুথু ফেলে গোল করে বল পাকিয়ে টিভি পর্দায় ছুঁড়ে দেয়া ব্যতীত উপায় কী! ক্রোধ এবং টিভি দুইয়ের-ই একটা গতি হলো।

রফিকুল আলম। মানুষটা একজন ডক্টর। ফাইন আর্টস তাঁর বিষয়, সঙ্গীতেও। মানুষটার প্রতি এটাই আমার মুগ্ধতার কারণ না।
আমি এমন অনেক ডক্টরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যাদেরকে আমার ভাষায় বলি, 'পাইপ মানুষ'। এরা পৃথিবীতে এসেছেন একটা পাইপ হয়ে, যার শুরুটা খাদ্য গ্রহন দিয়ে শেষাংশটা খাদ্যের অবশিষ্টাংশ বের করে দেয়ার জন্য। এরা বিশেষ একটা বিষয়ে কোন রকম এই ডিগ্রিটা যোগাড় করেন এরপর আর কোন কাজ নাই। হর্স মাউথ- কেবল বকে যাওয়া, জানার আর প্রয়োজন নাই।

কিন্তু ড. রফিকুল আলম নামের মানুষটার অগাধ পান্ডিত্য, সরলতা, বিনয় আমাকে চমকে দেয়! সবচেয়ে বেশি যেটা আমাকে আকৃষ্ট করে সেটা হচ্ছে তাঁর সততা। এই দেশে এখন সৎ মানুষের বড়ো অভাব। যেটা আমি আমার ভাষায় বলি, "একজন ভালো ম্যানেজার, ভালো শিল্পী, ভালো সাহিত্যিক মানেই একজন ভালো মানুষ না"।

ফাইন আর্টসের উপর তাঁর গবেষণামুলক প্রচুর প্রকাশনা আছে, দেশে বিদেশে। সম্প্রতী তিনি লিখেছেন, আমাদের মত সাধারণদের বোঝার উপযোগী করে অন্য ঘরানার একটা লেখা। সুরিয়ালিজম নামের অসাধারণ একটা লেখা। এটা এবারের বইমেলায় প্রকাশ হয়নি। যে প্রকাশক ছাপাবেন তিনি কলকাতা থেকে ফিরলে হয়তো ছাপা হবে। এখানেই আমার আপত্তি। কেন এটা বইমেলায় যাবে না, কেন?
তাহলে এই বইমেলা কাদের জন্য? কারা কারা লিখছেন, কাদের কাদের বই এখানে বের হচ্ছে, কেমন কেমন করে ছাপা হচ্ছে? এই বইমেলা নামের মেলাটা চলে গেছে কতিপয় নির্লজ্জ, অমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের হাতে। এরা কেবল লেখাই ফেরি করেন না, ফেরি করেন এমন ভঙ্গিতে যেটা করতে একজন কমার্শিয়াল সেক্স ভলান্টিয়ারও রাজি হবেন না, আই বেট।

একটা উদাহরণ দেই, প্রথম আলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারী ছাপা হয়েছে শাহাদত সোহাগ নামের একজন লেখকের বিজ্ঞাপন। এটায় আবার ঘটা করে লেখা, "পরিবর্তন হোক লেখালেখিতেও।" বটে রে, ইনি লেখালেখিতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাইছেন।
তো, এই ভদ্দরনোক একই সঙ্গে ৩টি বই প্রসব করেছেন। তা করুন, প্রসব বেদনা তার, আমার কী!
মূল ঘটনায় আসি, বিজ্ঞাপনে লেখা "বই ৩টির দ্বিতীয় মুদণ চলছে।" মুদণ কি জিনিস আমি বুঝি নাই। হয়তো আধুনিক বাংলা! হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন মুদ্রণ। বেশ-বেশ। এই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে ১৪ তারিখ। মানে ম্যাটারটা বা বিজ্ঞাপনটা দেয়া হয়েছে ১৩ তারিখ। প্রথম আলোর নিয়মানুযায়ী ২দিন পূর্বে বিজ্ঞাপন জমা দিতে হয়। তাহলে ১১ তারিখে জানা গেল, প্রথম মুদ্রণ শ্যাষ। বাহ, কী সোন্দর!
মাত্র ১১ দিনে এই লেখকের ৩টি বইয়েরই প্রথম মুদ্রণ শেষ। বাপু রে, একই সঙ্গে যেমন ৩টা বাচ্চা যেমন প্রসব করা যায় না তেমনি ৩টা বইও শেষ হয়ে যায় না। এইসব লেখকদের জরায়ুর জন্য আমার প্রার্থনা করা ব্যতীত আর কীই বা করার আছে!

ড. রফিকুল আলম যখন আমার বইটা উল্টেপাল্টে দেখছিলেন, নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হচ্ছিল। কেবল মনে হচ্ছিল, কি লিখি আমি, কি অধিকার আছে আমার এইসব ছাইপাশ লেখার?

রফিকুল আলমের সুরিয়ালিজম, এই অসাধারণ ম্যাটারটার জন্য প্রকাশকদের প্রকাশের জন্য যেখানে প্রতিযোগীতা করা প্রয়োজন ছিল সেখানে ব্যাটারা লম্বা লম্বা বাতচিত করেন, দেশে ভালো স্ক্রিপ্ট কুতায়(!)? বটে রে, এই দেশের ক-জন প্রকাশক স্ক্রিপ্ট পড়ে দেখেন? এক প্রকাশক তো বাংলা একাডেমী কোথায় বলে আমাকে প্রচুর ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিলেন! আফসোস, এই দেশে সমস্ত সু বা ভালো পরখ করে রায় দেন অপদার্থরা! কতিপয় প্রকাশক নামের আকাটমূর্খ নির্ধারণ করেন কে লেখক, কে লেখক নন।

একজন পাঠক হিসাবে আমি সুরিয়ালিজম বইটা আগ্রহের সঙ্গে পড়তে চাইতাম। কারণ বাংলায় এইসব বিষয় নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে। সুরিয়ালিজম-এর ব্যাখ্যা দেবেন এই বিষয়ে অগাধ জ্ঞান যাদের, তাঁরা। আমি আমার অল্প জ্ঞানে, মোটাদাগে যেটা বুঝি, "সুরিয়ালিজম হচ্ছে, একটা অদেখা স্বপ্ন। যে স্বপ্ন সবাই দেখতে পায় না, কেউ কেউ দেখে। চট করে এই ছাড়া-ছাড়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা চলে না। আপতত দৃষ্টিতে সেই স্বপ্নটা কয়েক মুহূর্তের কিন্তু ব্যাপ্তি রাতভর।"

তাঁর সুরিয়ালিজম বইটা বের হয়নি তাতে কী, আমি সাথে করে পান্ডুলিপিটা নিয়ে এসেছি। চিত্রকলাই বুঝি না তা আবার সুরিয়ালিজম! পড়ে কতটুকু বুঝলাম সেই পান্ডিত্য এখানে ফলাই না কিন্তু ইতিমধ্যে একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটে গেছে। যে হাত কখনও তুলি ছুঁয়ে দেখেনি সেই হাতে তুলি উঠে এসেছে। যারা আমার লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত তারা
হয়তো জানেন, কাঠপেন্সিলের সঙ্গে আমার খানিকটা সখ্যতা আছে। কাঠপেন্সিল নিয়ে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করি। 'ডুডল' নামের অজান্তেই আঁকাআঁকি নামের কিছু জিনিস চাল করে আমি আমার লেখার মধ্যে ঢুকিয়ে দেই। গালভরা স্কেচ নামের এই জিনিসগুলো অনেকের বিরক্তি উৎপাদন করলেও আমি নির্বিকার থাকি।

কিন্তু তুলির সঙ্গে আমি কখনও খেলার চেষ্টা করিনি কারণ আমি তুলি দিয়ে একটা সোজা লাইনও আঁকতে পারব এই ভাবনাটাই আমার ছিল না। কিন্তু সুরিয়ালিজম বইটা পড়ে, মানুষটার সঙ্গে কথা বলে আমার হাতে কেমন কেমন করে চারকোল, তুলি উঠে এলো আমি জানি না।
এই মানুষটা অসাধারণ এই একটা কাজ করেছেন আমার মতো মানুষের হাতে তুলি তুলে দিয়েছেন। একজন শিল্পী-সাহিত্যিকের কাজই সম্ভবত এটা। তাঁদের স্বপ্নগুলো অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া।

এই মানুষটা আজ খানিকটা অসুস্থ। চলাফেরায় তাঁর বেশ খানিকটা সমস্যা হয়। আমি বিশ্বাস করি, আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এই মানুষটা সহসাই নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, দৌড়াতে শুরু করবেন। দাঁড়াতে তাঁকে হবেই, তিনি হাল ছেড়ে দিতে চাইলেও দেশমা তাঁকে ছাড়বে না। এই দেশে তাঁর মতো মানুষের খুব প্রয়োজন।
আমাদের দেশে স্বপ্নবাজের যে বড়ো অভাব।

আঁদ্রে ব্রেঁত, সায়মন ব্রেঁত, পল ইলুয়া, পিয়ের নাভিল, হানস আর্প, জোয়ান মিরো- এঁরা থাকুন না এঁদের মত করে, এঁদের ঘাটাচ্ছে কে?
আমার মত অতি সাধারণের চারকোল দিয়ে ঘসাঘসির যে মজা, জল-রঙে একটার পর একটা রঙ মেশাতে যে আনন্দ তা অন্যত্র কোথায়? কে বলেছে, আমার মতো অগাবগা-অ্যামেচারের টোন, টেক্সচার, রিদম, লাইন এই সব ঠিক না থাকলে মাথা কাটা যাবে! রিপিটেশন, ভেরিয়েশন, কন্ট্রাস্ট, ইউনিটি, ব্যালান্স না হলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে!
------------------

আগাম সতর্কীকরণ: লেখা শেষ। পরবর্তী অংশে শিল্প বোদ্ধাদের প্রবেশ নিষেধ।

এখানে আমার কিছু অপকর্ম দেব। লেখালেখি বা আমার সমস্ত অপকর্ম আমার কাছে সন্তানতুল্য। কার কার দেবশিশুর মত সন্তান আছে তাতে আমার কী, আমি আমি সন্তান নিয়েই সুখী! আমি তো আমার কালো-কালো, লিকলিকে, দুবলা সন্তানকে ফেলে দিতে পারি না।


নারী (মাধ্যম: চারকোল)




ত্রিভুজ মানুষ (মাধ্যম: জলরঙ)



গতি (মাধ্যম: জলরঙ)




মুখোমখি নারী (মাধ্যম: জলরঙ)





হয়তো মানুষ (মাধ্যম: জলরঙ)





এটা কি আমি নিজেও জানি না! (মাধ্যম: জলরঙ)

Monday, February 15, 2010

আমি ব্লাডি সিভিলিয়ান, এখনই মরতে চাই না

আমাদের বিবাহের প্রায় এক যুগ পার হলো কিন্তু কেমন কেমন করে যেন আমরা দু-জন কখনও একসঙ্গে বইমেলায় যাইনি। এবারের মেলায় যাওয়াটা তাই খানিকটা ব্যতিক্রম ছিল। সঙ্গে আমাদের দু-সন্তান। বাচ্চাগুলো কখনই বইমেলায় যায়নি। এবারই প্রথম। বাচ্চাগুলো প্রচন্ড উত্তেজনায় ছটফট করছে।

শত-শত বার ঢাকা গেছি কিন্তু ঢাকার লোকেশন আমার মনে থাকে না। বাড্ডার আগে ফার্মগেট নাকি ফার্মগেটের আগে বাড্ডা এই নিয়ে তালগোল লেগেই থাকে। কোথাও যাওয়ার হলে, ক্যাব-স্কুটার-রিকশার চালক আমাকে
যখন জিজ্ঞেস করেন, 'কোন দিগ দিয়া যামু'?
আমি রাশভারী গলায় বলি, 'যেই দিক দিয়া সুবিধা হয় হেই দিক দিয়া যান। আমারে জিগাইতাছেন কেন'!
বাহনে উঠে বসে আলাদা গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকি, ব্যাটা যেন বুঝতে না পারে ঢাকার রাস্তা-ঘাট আমি কিছুই চিনি না। বুঝে ফেললে সর্বনাশ!
(এ এক বিচিত্র কান্ড! রাজশাহী-খুলনার রাস্তা, ওখানকার বিখ্যাত স্থাপনা না-চিনলে কোনো লাজ নাই কিন্তু ঢাকার ভূতের গলির নাম না-শুনলে, না-চিনলে জনে জনে জবাবদিহি করো; ওরি বাবা, ঢাকার এইটা চিনো না!)।

যাই হোক, এবারও যথারীতি স্কুটারে এদের নিয়ে বসে আছি। কাফরুল থেকে যাব শাহবাগ।
রাস্তায় আর্মি নামের দুই হাত, দুই পা-ওয়ালা একজন মানুষ আটকে দিলেন। কঠিন গলা, 'কোথায় যাবেন'?
আমি কিছু বলার আগেই আমার ছেলেটা ঝলমলে মুখে বলে বসল, 'চাচ্চু, আমরা বইমেলায় যাব'।
পাথুরে মুখটা শিশুটির দিকে না তাকিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, 'এই রাস্তা আপনার জন্য না'।
আমি শান্ত গলায় বললাম, 'দেখুন, স্কুটারওয়ালা আমাকে বলেনি যে এখান দিয়া যাওয়া যাবে না। জানলে, অবশ্যই এদিক দিয়ে আসতাম না। অনেক গাড়িই তো যেতে দিচ্ছেন, আমাদেরকেও যেতে দিন। আমাদের এখন ঘুরপথে যেতে হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্লিজ...'।
পাথুরে মুখে বিন্দুমাত্র চিড় ধরল না, 'উঁহু, সেটা আপনার সমস্যা। জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে যাওয়া যাবে না। এই রাস্তা আপনার জন্য না'।

আমার পরিচিত কিছু মানুষকে ফোন করে এর এই সিদ্ধান্ত বদলাবার চেষ্টা করতে পারতাম কিন্তু আমার ইচ্ছা হলো না। আমি কথা বাড়ালাম না। বলতে পারতাম: আমাদের ট্যাক্সের টাকায় দেশ আপনাদেরকে কেবল যুদ্ধ করার জন্যই লালন-পালন করে না। আর ফাও আমাদেরকে এটা শেখাবার জন্য, এই রাস্তা আমাদের না! আজ এটা বলছেন, কাল বলে বসবেন, এই দেশ আপনাদের জন্য না! আমি ব্লাডি সিভিলিয়ান, অন্তত এটা আপনার কাছ থেকে শিখতে আগ্রহ বোধ করি না। কেন এটা বললাম না বা কেন কথা বাড়ালাম না এটা পরে বলছি।

এই মানুষটা উপরঅলার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সবই হয়তো ঠিক ছিল কিন্তু এই কথাটা আমার বুকে গিয়ে ধাক্কার মত লাগল। যেন খুব কাছ থেকে গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে বুক ভেঙ্গে আসছিল, মাথায় আটকে গেল, এই রাস্তা আমার না-এই রাস্তা আমার না...! প্রকারান্তরে মনে হচ্ছে, এই দেশ আমার না-এই দেশ আমার না। এই দেশ আমার না?
স্কুটার অনেক ঘুর পথে এগুচ্ছে। আমার ছেলে বারবার বলছে, 'বাবা-বাবা, অ বাবা, আমরা কেন এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারব না'?
আমি আমার সন্তানের চোখাচোখি বাঁচিয়ে স্কুটারের খাঁচার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখি।
আমি আমার সন্তানের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কী তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি! কি বলব আমার সন্তানকে? আমি কি এখনই তাকে অন্ধকারের ভাষা শেখাব? নাকি বলব, তোমার বাবা একটা কাপুরুষ!

কোনো সভ্য দেশে শহরের মাঝখানে ক্যান্টেনমেন্ট থাকা সমীচীন কি না এই কুতর্কে আমি যাব না। কেউ শখ করে বা নিজেদের নিরাপত্তার উদ্বেগে ক্যান্টনমেন্ট শহরে জুড়ে রাখতে চাইলে, ১০০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেললেই হয়। বা রাস্তার শুরুতে বিলবোর্ড লাগিয়ে দিলেই হয়, এই রাস্তা ব্লাডি সিভিলিয়ান এবং কুকুরের জন্য নিষিদ্ধ। সমস্যার তো কিছু নাই।
এমনিতেও ঢাকা বসবাস অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার উপর চাপ কমানো অতি জরুরি। ঢাকায় কেবল ক্যান্টনমেন্ট রেখে সমস্ত ব্লাডি সিভিলিয়ানদের এখান থেকে সরিয়ে দিলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে! আমরাও ঢাকায় যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাই। খোদার কসম,
আমি অন্তত মুত্রত্যাগ করার জন্যও ঢাকামুখি হবো না।

তখন আমি কথা বাড়াইনি ইচ্ছা করেই। কেন বলছি। ধরা যাক কথা কাটাকাটি শুরু হলো। কে জানে এ হয়তো তখন ফট করে বলে বসত: 'এই নীচে নাম। কান ধরে উঠবস কর'।
এই নিয়মটা এদের আছে। স্বামীর হেলমেট না থাকার অপরাধে জনবহুল রাস্তায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য করেছে। অথচ এরা নিজেরা স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদা এতটাই উঁচুতে রাখে; একজন সৈনিকের সঙ্গে লেডি থাকলে জেনারেল পর্যন্ত কেয়ার করেন। বাহ, বেশ! নিজেদের লেডির জন্য এক নিয়ম অন্যদের জন্য আরেক রকম!

আজ খানিকটা বুঝি এদের জন্য দেশের লোকজনের এমন তীব্র রোষ কেন। সাধারণ মানুষ কেন এদের নিজেদের কেউ না ভেবে এলিয়েন ভাবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এদের ক্রাইসিসে আমার চোখের জলের সঙ্গে রক্ত মিশে ছিল। আহারে-আহারে, এরা তো আমাদেরই ভাই-বন্ধু। আমার বুক ভেঙ্গে আসত যখন দেখতাম ইন্টারনেটে এদের নিয়ে, এদের বিপক্ষে কী উল্লাস। এদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে গিয়ে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর দালালও বলেছেন আমাকে।
অবশ্য এও বুঝি, নিরামীষভোজী হলেই কাউকে ষাড় গুতাবে না এমনটা আশা করা বোকামী। এদের প্রতি সাধারণ মানুষদের ভালোবাসা-মমতা ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমাতাটাই এদের নাই আসলে।
আফসোস, এদের জন্য কেবলই অনর্থক বেদনা বোধ, কোনো মানে নাই আসলে! আজ বুঝতে পারি, কেন এরা আমাদের কেউ কখনই হতে পারবে না, পারা সম্ভব না। এরা এলিয়েন...।

আমাদের দেশে তো ফলোআপের চল নাই। পরবর্তীতে আমাদের আর জানা হয়নি সেই কান ধরে উঠবস করা স্বামীটির কি হয়েছিল? আচ্ছা, ওই স্বামীটা কী দুর্দান্ত লজ্জায়-অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলেন? জানি না আমি। কেবল আমার নিজেরটা জানি, এ আমাকে কান ধরতে বললে আমি কান ধরতাম না। কক্ষণও না, আমার লেখালেখির কসম, আমার বাচ্চার কসম। আমি বলতাম, তারচেয়ে আমাকে মেরে ফেল। কারণ এমনটা না করলে এরপর হয়তো প্রাণে বেঁচে থাকতাম কিন্তু আমার স্ত্রী, সন্তানদের চোখে চোখ রাখতাম কেমন করে? একবার মরার চেয়ে প্রতিদিন মারা যাওয়াটা বড়ো কষ্টের, বড়ো কষ্টের।

আচ্ছা, আমি কান ধরে উঠবস করতে অস্বীকার করলে তখন কি এ সত্যি সত্যি হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে দুম করে আমাকে গুলি করে বসত? রক্তে ভাসতে ভাসতে রাস্তায়
আমি থেতলে যাওয়া কুকুরের মত মরে পড়ে থাকতাম, হাত পা ছড়িয়ে? আমার সন্তানরা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকত, 'বাবা-বাবা, তোমার গায়ে এতো রক্ত কেন! বলো না, বাবা- বলো না, তোমার গায়ে এতো রক্ত কেন? বাবা-বাবা, অ বাবা...'।
হিজড়া নামের কিছু লোকজন
গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখত। হয়তো মিডিয়ায় লোকজন খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মৃতদেহের ছবি উঠাতো। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। চেষ্টা করত আমার টকটকে রক্তে সূর্যের প্রতিফলনটা আটকে ফেলতে। আমার মতো অখ্যাত একজনের পত্রিকার পাতায় ছবি ছাপা হওয়া, এও কী কম!

আমি আসলে মরতে চাইনি। আমার যে এখনও অনেক কাজ বাকী!
কতশত লেখা মাথায় ঘুরপাক খায়- লিখব লিখব করে আলস্যে আজও লেখা হয়ে উঠেনি। এখনও তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটাই লেখা হয়নি। আমার সন্তানকে বলি, এমন সময়ে দুম করে মরে যাওয়াটা কোনো কাজের কাজ না রে, ব্যাটা...। ব্যাটা, বড়ো হলে বুঝবি, একজন মানুষকে কেন কাপুরুষ হতে হয়...।

অফ-টপিক: মূল পোস্টের সঙ্গে এই ছবির সম্পর্ক খোঁজা বৃথা।









(কী আশ্চর্য! এলিয়েনরা কাঁদেও নাকি!
)

*ছবি পরিচিতি: বাম পাশের ছবি একজন এলিয়েনের, ডান পাশেরটা মানুষের।
**ছবি সূত্র: গুগল

Sunday, February 14, 2010

বোকা-সোকা মানুষ!

গত দুই বইমেলায় যাওয়া হয়নি। কারণ অনেক। বিস্তারিত বলি না।

এমনিতেও বইমেলায় গেলে আমি এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করি। ধবধবে পাঞ্জাবীতে কালো কালো ছোপ সহ্য করতে পারি না। আমার পরিচিত অনেক ব্লগার নামের দুর্ধর্ষ লেখকের বই বের হয় না অথচ ছাতাফাতা অনেকে প্রসবযন্ত্রণা সহ্য করে যাচ্ছেন। জন্তুর মত গাদা গাদা বাচ্চা-বই প্রসব করছেন। এইসব লেখকদের জরায়ুর জন্য আমি বেদনা অনুভব করি। আহা, বেচারারা, আহা। কী কষ্ট! অবশ্য যেখানে বইমেলা উদ্বাধনটাই একটা অশ্লীলতা সেখানে অন্য কথা বলার খুব একটা অবকাশ কই!

দুই সমকামী বুড়ার বিশেষ কর্মকান্ডের চেয়ে আমার কাছে অশ্লীল মনে হয় লেখকদের কিছু কাজকারবার দেখলে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া দেখলেই এঁরা মুখ দেখাবার জন্য যে কস্তাকস্তি করেন, খদ্দের ধরার জন্য একজন কমার্শিয়াল সেক্স ভলন্টিয়ারও এতটা নির্লজ্জ হন না। লেখক মহোদয়গণ চামড়ায় মুড়িয়ে রাখা মল-বাক্সের (মতান্তরে পেট) কাছে যে ভঙ্গিতে নিজের বই ধরে ফটো খিঁচান; দৃশ্যটা দেখে আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। ইচ্ছা করে গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করি।
ভাগ্যিস, বইগুলো গলায় ঝুলিয়ে ফটোসেশন করা হয় না (অবশ্য হলে মন্দ হতো না) নইলে সন্ত্রাসীরা আপত্তি না করলেও র‌্যাব-ট্যাবরা আপত্তি করত।
নিজেকে ধন্যবাদ দেই আমি নিজেকে লেখক বলে স্বীকার করি না। লেখার রাজমিস্ত্রী হয়ে আছি, এই বেশ। লেখক হতে গিয়ে দিগম্বর হয়ে যাওয়া কোন কাজের কাজ না। বিশেষ মুহূর্ত ব্যতীত নগ্ন হওয়াটা ভালো দেখায় না।

এবারের মেলায় না গিয়ে উপায় ছিল না। অজ্ঞাত একজন আমার কাছে গিফট ভাউচার পাঠিয়েছেন, আমার জন্য। শর্ত একটাই,
মেলায় ঘুরে ঘুরে আমি যেন বই কিনি, নিজের জন্য। কেবল বই-ই কেনার জন্য এই টাকাটা বিপুল!
কিন্তু এই টাকায় এক ঠোঙা বাদামও কেনা যাবে না
, মহা মুসিবত তো। এইটা আবার কোন দেশের আইন, বাহে!

আমার এমন সময়ে এটা নেয়াটা আমার জন্য ভারী বিব্রতকর। ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। এই ভালবাসা নিতে না বলে খুব একটা সুবিধা করতে পারলাম না। আমি যুক্তির পিঠে যুক্তি চালাচালি করতে পারি না তার উপর কঠিন সব আবেগীয় যুক্তি। ভালবাসার দাবী- হার না মেনে, না নিয়ে উপায় কী!
আরেকটা কঠিন শর্ত, মানুষটার নাম আমি জানতে চাইতে পারব না। পর্দার আড়ালে থাকা এই মানুষটার পরিচয় বের করা আমার পক্ষে অসম্ভব না। কারণ এই গ্রহে আমাকে পছন্দ করে এমন মানুষের সংখ্যা খুব অল্প। খানিকটা আঁক কষলেই এই ছোট্ট বৃত্তটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসবে। তখন এই মানুষটাকে অনায়াসে চেনা যাবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে না। থাকুন না বোকা-সোকা মানুষটা তাঁর বোকামী নিয়ে, তাঁর মত করে। অহেতুক আমাদের এই চালাক পৃথিবীতে তাঁকে এনে লাভ কী, আর কেনই বা বোকা-সোকা মুখটা ধূর্ততার চোখে দেখার চেষ্টা করা!
আহারে, এমন বোকাদের সঙ্গে থেকে থেকে এমন খানিকটা বোকামি যদি খানিকটা শিখতে পারতাম!

Thursday, February 11, 2010

উপন্যাস: জীবনটাই যখন নিলামে: ৩


শালার মিটিং। জীবনটা ভাজা ভাজা হয়ে গেল। রাব্বি মিটিং শেষ করে নিজের চেয়ারে মাত্র বসেছে মাত্র, পিয়ন মুনিম এসে বলল, স্যার, বড়ো স্যার আপনাকে এক্ষণ দেখা করতে বলছেন।

বড়ো স্যার মানে সৈয়দ। এই অফিসে ওই-ই চীফ। রাব্বি কষ্টের শ্বাস ফেলল। শালার চাকরের জীবন, খানিকটা নিজের মত চলারও কোন উপায় নাই। বড়ো ক্লান্ত লাগছে কিন্তু এখন সৈয়দ নামের এই বুড়বাকটার প্রলাপ শুনতে হবে, ক্ষণে ক্ষণে অদৃশ্য লেজটা নাড়াতে হবে। ৫টা পর্যন্ত অফিস কিন্তু এ প্রতিদিন ঠিক ১০টা বাজিয়ে ছাড়বে।
অথচ নিজে মার্কেট ভিজিটের কথা বলে সটকে পড়বে, ধাড়ি শুয়োরটাকে ঠিক-ঠিক বাসায় পাওয়া যাবে। কপাল আর কী, ওর কপালেই কিনা এমন একটা ছাগল মার্কা বস জুটল! মানুষটা ওর জীবনটা তছনছ করে ফেলল, এই চুতিয়া জীবন আর ভালো লাগে না। এমন অবস্থা নাই, নইলে এমন চাকরি লাত্থি মেরে কবেই চলে যেত। যাওয়ার আগে সৈয়দকে বলে যেত, গো ফাক ইয়্যুরসেলফ উইথ ইয়্যুর অফিস এন্ড ইয়্যুর নোংরা আন্ডারওয়্যার।

একটাই জীবন কিন্তু মানুষের জীবনে কত রকমের যে কষ্ট! রাব্বি সৈয়দ সাহেবের রুমে ঢুকতেই তিনি হাসিমুখে বললেন, বসেন-বসেন।
রাব্বি এই মানুষটাকে সবসময়ই দেখেছে মুখে একটা তেলতেলে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে। এটা এর আরেকটা বদ-চর্চা। আচ্ছা, এর মুখটা এমন তেলতেলে থাকে কেমন করে, বাথরুমে হাত মেরে মুখে মাখে নাকি? বিষয়টা নিয়ে শামসিরের সঙ্গে আলাপ করতে হবে তো। আল্লা জানে, শুয়োরটার মাথায় এখন কী ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মুখ দেখে আঁচ করা দুঃসাধ্য, বোঝার উপায় নেই।
চা দিতে বলি, রাব্বি?
নো থ্যাংকস, বস।
আরে খান খান। চা হচ্ছে টনিক। এক চুমুকে দেখবেন সব কান্তি উধাও। এই আমাকে দেখেন না, এত্তো এত্তো কাজ করি। দেখেছেন কখনও ক্লান্ত হতে? এক কাপ চা মেরে দেই, ব্যস। এরপরই আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
রাব্বি বিড়বিড় করল, শালা, শজারুচো...।
কিছু বললেন?
না বস, বলছিলাম, আপনি একজন কর্মবীর।

সৈয়দ সাহেব চোখ সরু করে তাকিয়ে রইলেন। বুঝতে চেষ্টা করছেন এটা কি কমপ্লিমেন্ট নাকি অন্য কিছু। রাব্বি নিশ্চিত এর মস্তিষ্ক এখন পুরোদমে ব্যস্ত এটা নিয়ে। মানুষটা যত নির্বোধই হোক বুঝতে এর বাকি থাকবে না। এরপর এ একের পর এক ছুরি চালাবে, তেলতেলে পিচ্ছিল হাসি নিয়ে।
ইয়ে, রাব্বি, আপনার তো এম.বি.এ করা নাই, না?

রাব্বির অজান্তেই মন খারাপ করা শ্বাস বেরিয়ে এলো, এটা এ লক্ষবার জিজ্ঞেস করেছে। মানুষ এমন পশুর মত হয় কেন? জানার পরও লক্ষবার এই প্রশ্ন করে বিব্রত করার মানে কী! অথচ এ নিজেও এম. বি. এ করেনি। এরপরও একটা মানুষ কেমন করে নির্লজ্জের মত অন্যকে অপদস্ত করে?
বলবে না বলবে না করেও রাব্বির মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, না বস। ইয়ে, আপনারটা কি কমপ্লিট হয়েছে, বস?
সৈয়দ সাহেবের পরিচিত তেলতেলে হাসি উধাও হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন। অজান্তেই মুখ লম্বা হয়ে গেছে, চোয়াল ঝুলে পড়েছে। অনেক সময় নিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করলেন। খানিকক্ষণ রিভলবিং চেয়ারে আগুপিছু করলেন।
রাব্বি, আপনার সমস্যা কী!
আমার তো কোন সমস্যা নাই, বস।
আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি। সাফ সাফ এর উত্তর দেবেন। এটা অফিস, আপনার বাসা না। জেন্টেলম্যান নর্ম কী গুলে খেয়ে ফেলেছেন নাকি? এমনিতেও আপনার কাজকর্ম নিয়ে অফিস বিরক্ত।
রাব্বি রাগ চেপে বলল, অফিস বিরক্ত, নাকি আপনি?
আয়্যাম নো বডি। অফিস মানে অফিস, এর সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিচ্ছেন কেন!
বস, আমি আমার কাজে কখনও ফাঁকি দেই না। যখন যে কাজটা দেয়া হয় আমার সাধ্যমত শেষ করার চেষ্টা করি। তারপরও আপনি এটা বলছেন কেন আমি বুঝতে পারছি না। আপনি ব্যতীত আর একজনের নাম বলেন যিনি আমার কাজ নিয়ে বিরক্ত।
আমি আপনার কাছে এর ব্যাখ্যা দিতে চাইছি না।
ব্যাখ্যা না, বস, আপনি জাস্ট জানতে চাচ্ছি, কারা কারা আমার উপর বিরক্ত এবং কি কারণে? এটা জানাটা নিশ্চয়ই অপরাধ না?
সৈয়দ সাহেব মুখ শক্ত করে বললেন, সময় হলে জানবেন। এই মুহূর্তে এটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করার কোন আগ্রহ আমার নাই। শুনুন, যে জন্য আপনাকে ডেকেছি, রিটেল সেনসাসের কাজ কতটুকু হলো?

রাব্বি বুঝল ওর কপালে খারাবি আছে। যদিও এটা ওর দায়িত্বে পড়ে না কিন্তু ঠিক ওকে গছিয়ে দেবে। এটা হচ্ছে রাব্বিকে ঝামেলায় ফেলার সহজ উপায়। এটার দায়িত্ব নিলে দম ফেলার আর ফুরসুত থাকবে না। দোকানে দোকানে যেতে হবে, একেকটা আউটলেট সম্বন্ধে হাবিজাবি দুনিয়ার তথ্য সংগ্রহ করে এক্সেল শিটে সাজাতে হবে। এক-দুইটা আউটলেট না, প্রায় ৫০ হাজার আউটলেট। প্রচুর লোকজনের সহায়তা নেয়া যাবে কিন্তু তবু্‌ও প্রায় অসাধ্য একটা কাজ। সচরাচর এটা থার্ড পার্টিকে দিয়ে করানো হয়। কিন্তু এখন ওকে দিয়ে করানো মানে স্রেফ ওকে ফাঁসিয়ে দেয়া।
রাব্বি জানে লাভ নাই তবু্‌ও বলল, বস, এটা তো থার্ড পার্টি সুমেরার করার কথা।
থার্ড পার্টি না ফোর্থ পার্টি এটা আপনার কাছ থেকে আমায় জানতে হবে না। ওদের গতবারের কাজ আমার পছন্দ হয়নি। আমি ঠিক করেছি এবারেরটায় অফিসের কাউকে এই দায়িত্বটা দেব। আপনিই যোগ্য ব্যক্তি।

রাব্বির চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে মনে বলল, যোগ্য ব্যক্তি না বা...। আমার যোগ্য হয়ে কাজ নাই। অযোগ্য হতে পারলে বেশ হতো তোকে জুতায় গু লাগিয়ে পিটিয়ে আরাম পেতাম। ভেবেছিল, কয়েক দিন ছুটি নেবে, লোপাকে নিয়ে ঘুরবে। বেচারির বেড়াবার বড়ো শখ। ওদিন কেমন মুখ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। যমুনা রিসোর্টে ওকে নিয়ে গিয়ে চমকে দেবে। সব ভেস্তে গেল। যমুনায় যাওয়া দূরের কথা এবার সোজা যমের কাছে যেতে হবে। লাভ নাই তবু্‌ও শেষ চেষ্টা করল, বস, এটা অন্য কাউকে দিলে-।
আমি কি ম্যানেজমেন্টকে বলব আপনি অফিসের কাজ করতে অস্বীকার করছেন?
না বস, আমি কেবল বলছিলাম এবারও সুমেরা কাজটা করলে এবার যেন আপনার মনমত হয় এটার আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আমি নিজে এটা মনিটর করব।
সৈয়দ সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন, কে চাইছে আপনার নিশ্চয়তা।

রাব্বির নিজেকে সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়া দরকার নইলে নির্ঘাত একটা অনর্থ হয়ে যাবে। ম্লান গলায় বলল, আমি কি তাহলে এবার উঠব?
যেতে পারেন।
রাব্বি পা টেনে টেনে বেরিয়ে যেতে গিয়ে মাঝপথে বাধা পেল, শুনুন, আরেকটা কথা, ড্রাইভারের সঙ্গে মাখামাখি কম করবেন।
মানে।
প্রায় সময় দেখি আমার ড্রাইভারের সঙ্গে গুজুর-গুজুর করেন। এটা আমার পছন্দ না।
প্রায় সময় না। মাঝে-মধ্যে সে আমার সঙ্গে কথা বলে বলেই আমি বলি। কেউ কথা বললে তো এটা বলা যায় না, না আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না।
আমার সঙ্গে চাল করবেন না। আপনি হাঁটেন ডালে ডালে, আমি হাঁটি পাতায় পাতায়।
রাব্বির ধৈর্যর বাঁধ ভেঙ্গে গেল। পাতায় হাঁটেন, হাটেন মানা করছে কে আপনাকে। ইচ্ছা হলে পাতা চিবিয়ে খান। ভাল লাগলে চা দিয়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খান। আমাকে জানাবার দরকার কী!
পেছন থেকে সৈয়দ সাহেবের চিল-চিৎকার ভেসে এলো, ক্কি, কি বললেন আপনি?
গায়ের জোরে দরোজা খুলতে খুলতে রাব্বিও চেঁচিয়ে বলল, ছাতাফাতা, আপনার মাথা।
দড়াম করে দরোজা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। তীর ছোড়া হয়ে গেছে ফেরাবার আর উপায় নেই। সৈয়দ ওকে ছাড়বে না। পাতা না, ওকেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

*জীবনটাই যখন নিলামে: ২

Wednesday, February 10, 2010

মা এবং তাঁর অদেখা সন্তান।

রেলওয়ে স্টেশনে মা-টা বসে ছিল পা ছড়িয়ে। সাদা মুখ। লাশ ব্যতীত এমন পান্ডুর মুখ আমি আর কখনও দেখিনি! আমি ডাক্তার না হয়েও বুঝতে পারছি মাটা প্রচন্ড রক্তশূন্যতায় ভুগছে। আয়রনের তীব্র অভাব  
 
আহা, আমি ডাক্তার হতে পারলে বেশ হতো। ডাক্তার হতে পারলে অন্তত আজ এই মাটাকে ন্যূনতম চিকিৎসাটা দিতে পারতাম। ডাক্তার- দ্বিতীয় ঈশ্বর, কেবল এই একটা পেশাকে আমি ঈর্ষা করি। মুমূর্ষু কারও কাছে কখনও কখনও মনে হয় এমন, উপরে প্রথম ঈশ্বর নীচে দ্বিতীয় ঈশ্বর-ডাক্তার; মাঝে আর কিছু নাই, কিচ্ছু নাই! 
 
আমি আমার অল্প পড়াশোনা নিয়ে কখনই বিব্রত হইনি। কিন্তু আজ কেবল মনে হচ্ছে, আহা, জীবনটাকে তাচ্ছিল্য না করলেও পারতাম। কেন ভাল করে লেখাপড়াটা করলাম না। কস্তাকস্তি করে ডাক্তার হতে পারতাম যদি। আহা! 
আফসোস, সবাই যখন ইশকুলে যায় তখন আমি ইশকুলের নাম করে গোয়াল ঘরে বসে বই পড়ি[click]  ইশকুলে সবাই পরীক্ষার খাতায় লেখে, ইঞ্জিনিয়ার হবো, ডাক্তার হবো। আমি লিখেছিলাম, রাখাল হব। কসম, আমার তো রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। মাস্টার মশাই খুবই আনন্দিত(!) হয়ে বিরাট একটা গোল্লা দিয়েছিলেন যার চালু নাম 'লাডডু' বা 'খাতালাড্ডু'। এই করে-করে কালে-কালে হয়ে গেলাম জিরো [click]! ক্রমশ জিরো থেকে আ বিগ জিরো [click]! সেসব হাবিজাবি কথা থাক।
 
আজ এই মা-টার ছবি উঠাতে ইচ্ছা করছিল না। পরাজিত বীরের ছবি যেমন উঠানো যায় না তেমনি এই মার এমন অসহায় ছবিও উঠানো চলে না। তাঁর এই অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করারও কিছু নেই। নিম্নবিত্ত পুরুষদের বাড়তি এই একটা সুবিধা আছে, বউ-বাচ্চা ফেলে সময়মতো উধাও হয়ে গেলেই হয়। নারী পড়ে থাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা। তাঁর অনাগত সন্তানের অপেক্ষায়।
আমাদের এই মা বিখ্যাত ওরিয়ানা ফালাচী না যে ফালাচীর মত বলবেন:
"হে অনাগত সন্তান, তুমি কি আসতে চাও এই নির্দয় পৃথিবীতে'? তার ভ্রুণ বলবে, 'তুমি নরকে যাও, মা, আমি আর আসছি না'।
ওরিয়ানা ফালাচীদের সঙ্গে আমাদের মার এখানেই ফারাক। আমরা নারকেল গাছ, আমাদের শেকড় ছড়িয়ে থাকে অনেক দূর। মায়ায় জড়াজড়ি করে। তাই কি আমরা মার কাছে ফিরে আসতে ব্যাকুল হয়ে থাকি?

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ধার করে বলি: "পেটে তার উপোসী ছেলেটা কিচ্ছু বলে না-শুধু দিন গোনে।"
না, সুভাষ বাবু, আপনি কিন্তু ভুল। ভুল! কে বলেছে উপোসী ছেলেটা কিচ্ছু বলে না? আমি আমার মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এই মার অদেখা সন্তানটা গাল ফুলিয়ে বলছে: 'অ, মানুষ, তোমরা এমন নিষ্ঠুর কেন গো! জানো, আমি না কাল থেকে কিচ্ছু খাইনি। ইহ, আমার মা না খেলে আমি খেতে পারি বুঝি! এক চুমুক গরম দুধ আমার মাকে খেতে দিলে কি হয়? বলো না কী হয়? এই মানুষ, বলো না কি হয়! এই মানুষ...এই...এই...'।
গোটা বিশ্বটা আমার আধার হয়ে আসে। আমি আকাশপানে তাকিয়ে থাকি। ঝকঝকে আকাশটা আজ এমন ঝাপসা কেন? ঝাপসা কেন! জানি না...জানি না আমি...জানি না...।

* এটা সত্য এটি একটি অতি সাধারণ স্কেচ। আঁকার কায়দাটাও
অতি সাধারণ- কেবল তিনটা টান। যখন এটা আঁকি, মাথায় যেটা কাজ করছিল, মা এবং তাঁর অনাগত সন্তানের অবয়বটা কত অল্প রেখায় করা যায়। অবশেষে ফিগারটা দাঁড় করিয়েছি কেবল ৩টা রেখায়।
 
** প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে পরে জানতে পেরেছিলাম এক রাতে স্টেশনে পুলিশ মা-টাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল। মা-টার একটাই চেষ্টা ছিল অনাগত সন্তানকে রক্ষা করা। সে তাঁর সন্তানকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পেরেছিল কি না সেটা জানার অবকাশ কোথায় আমাদের। গণতন্ত্র, মানবতা,  এই-সেই কত বড় বড় কাজ আমাদের...!
 
***কেবল মাদের বড় কোন কাজ নেই- একটাই কাজ তাঁর সন্তানকে যে-কোন মূল্যে রক্ষা করা। এই মা হরিণটার মত। অবলীলায় নিজের জীবনটা ময়লা কাপড়ের ন্যায় ছুড়ে ফেলা...!

Tuesday, February 9, 2010

মজা, না মজাক, নাকি মজারু?


কাল ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখছিলাম, খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে দেশের বাঘা-বাঘা সম্পাদক সাহেব এসেছেন। তাঁরা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন আবদার, বক্তব্য রাখছেন।

কেউ বলছেন, ম্যাডাম সংসদের চেয়ার আপনাকে ডাকছে। কেউ-বা বলছিলেন, দেশটা আপনারা দু-জন নারী মিলে চালাচ্ছেন আপনাদের দায়িত্ব অনেক। ইত্যাদি ইত্যাদি।

ম্যাডাম সবার কথা শুনছিলেন। ঝিম মেরে রইলেন। প্রশ্নগুলোর ধারে-কাছেও গেলেন না। যথারীতি বিরোধীদলের কুৎসা গাওয়া শুরু করলেন। তখন আর দম ফেললেন না, এক শ্বাসে বলতেই থাকলেন!

আজ দৈনিক পত্রিকায় দেখছি (প্রথম আলো), খালেদা জিয়া বলেছেন, "সময়মতো সংসদে যাব। এখনই সব বললে তো মজা থাকবে না।"
বেশ-বেশ! সংসদে যাওয়া এটা তাহলে মজার কিছু, নাকি মজাক? আর সময়মতো বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন? কবে সময় হবে? প্রায় ৩৬৫ দিন তো চলে গেল- নাকি আপনাদের বছর হয় হাজার দিনে?
সংসদে না যাওয়ার কারণ কী! ওয়াল্লা, চেয়ার ইস্যু! সংসদে কি বসতে দিচ্ছে না, দাঁড়িয়ে থাকতে হয়? আমার তো মনে হয় দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও সংসদে যাওয়া প্রয়োজন। এতে অন্তত দেশের আপামর জনতা আপনাদের সঙ্গে থাকত।

খালেদা জিয়া আরও বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকতে পারছে না। ভি.সিকে বলেও কাজ হয় না। তিনি তো দলীয় লোক।"
হাসি থামানো কঠিন হয়ে পড়ে। দলীয় লোক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভিসি দলীয় লোক ছিলেন না? এ-ও এই দেশের দূর্ভাগ্য শিক্ষকরা পর্যন্ত নীল-সাদা-গোলাপি দলের আড়ালে দলবাজি করেন। যখন যে সরকার আসেন সেই সরকারের ভাষায় কথা বলা শুরু করেন- মেরুদন্ড হয়ে যায় জেলির মত। পিতাসম শিক্ষকদের কেন কোন দলের চামচা হতে হবে এটা আমার বোধগম্য হয় না! এই দেশে দলবাজি ব্যতীত কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নাই।

এই দেশের সব কিছুই অন্য রকম। দেশটা চালাচ্ছেন দু-জন নারী, ঘুরেফিরে! জামাতের মতো কট্টর একটা দলেরও এই নিয়ে উচ্চবাচ্য নাই! দেশের আপামর মোল্লাদের কথাও এখানে চলে আসে।
আজ একটা দৈনিকে দেখলাম, একটা রাস্তায় সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে, "এই রাস্তা দিয়া মহিলাদের হাঁটা নিষেধ।" এমন একটা দেশের সবগুলো চাকা বনবন করে ঘোরাচ্ছেন দু-জন মহিলা, ভাবা যায়?

আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন ছিল, এই যে আপনারা সংসদে যাচ্ছেন না আপনারা কি সংসদ সদস্য হিসাবে ভাতা, সুযোগ-সুবিধাগুলো নেয়া বন্ধ রেখেছেন? সংসদে না গেলে তো এগুলো আপনাদের প্রাপ্য না।
এই দেশের রাজনীতিবিদদের দেশের জন্য কেমন মায়া এটার খানিকটা নমুনা পাওয়া যাবে এখানে। স্রেফ অপচয়! আমাদের ভিক্ষা না করে উপায় কী!

*ছবি স্বত্ব: সংরক্ষিত

The Game of Light and Darkness.



The grass always looks greener on the other side of the fence. After reading my post some of you may think very highly of me. But for your kind information, this is a wrong way of thinking. I am not that generous.
The child is not getting a good living standard in my dwelling. He is an anomaly (mentally disabled). It is very hard to communicate with this child because he does not speak, by judging the expressing of his face we can tell when he is having a hard time to deal with something. This is not possible for us to spend a fair amount of time to take care of him. Today in the morning I figured that his teeth were bleeding but he did not weep at all. He had no idea how he got hurt.
From his attitude we can sense that he was lost from his family and he was forced to work as a beggar for some period of time of his life. He lives in a world that is messed up. Now his interference in our life is messing up our world.
He has the problem of uncontrolled bowel movement. He gets dirty with feces and wet cloths in the middle of the night. Somebody needs to wake up and clean him frequently at night. He makes himself dirtier by playing with his feces whenever he gets a chance. How long can we keep this up?
The greatest challenge to us is we do not have proper training to look after this mentally disabled child. All we have is some feeling of compassion which is of no use. He requires an individual place to live, constant caregiver assistant. This is beyond our financial capability to make such arrangement.
This child is spoiling our happy time. The worst thing is he is exposing us into moral vulnerability! He wants me to confront the inner beast within me. What if I give up the inner struggle and the beast shows up? The world will turn upside down! Will I be conspired to leave him in the railway-station?
At this moral point every good hearted people in the world would strongly disagree to do this, they would scream and say, I can never do that!
But I confess that I am not that great, I do not know anything about this game of uncertainty. We admire the light, the good part of life but we deliberately choose to ignore the dark part of this life.
*Isn’t that a nice photograph? You might think that the child has been covered in a cozy blanket. Just to let you know that it is an old rejected jacket. I was considering throwing it out!
(Once somebody accused me of being a 'Prothom Alo' hater. The reason for his blaming was my couple of posts where I criticized this newspaper. Not that I am particularly a big attacker of this newspaper. For various reasons my family subscribes this newspaper. I personally think their feature page 'Naksha' is a horrible thing to read, but to my surprise it provides life giving pleasure to other member of my family.
This is not a cheap newspaper; I have to pay 800 paisa every single day to buy it but it barely meets my expectations. Why on earth I have to allow all those crap that are being published in this newspaper? As I have no choice but to subscribe and read this newspaper, my eyes cannot ignore the inconsistencies of their published news and writings. Sometimes it is hard for me tolerate their unfairness.
Today there is an article written by Shumona Sharmeen named khide pete ghum’ published in the section chutir dine’ which is very heart touching. A previously published picture has been attached to this article where a child is sleeping on the ground. As far as I know, Shumona Sharmeen is one of the top positioned officials of Prothom Alo. She has written in a touchy tone.
I do not mean to give any detrimental opinion about her emotional writing. But it would be difficult for the common readers not to have any deep emotional response towards this article. After reading this, they will be quiet convinced that this newspaper cares about people’s well being and every single page of this newspaper contains enough miserable stories about life to touch readers heart!
I wrote about this four years old child before. I requested a local representative of Prothom Alo to publish news about this missing child. Even though every other newspaper did that but Prothom Alo did not pay attention to my request. I do not put blame on that local representative, he has limited authority. He did send the news to main office but it was no value to them.
I did not get very disappointed because it was an expected response from them. How can they provide some space in the page of the newspaper for a least significant child in the society?
They would rather publish the news about what color of sharee’ the leader wears. The wedding news of bang babaji’ comes to the front page; where else can they accommodate a missing child’s news? It is all about making money, nothing else matters! But when I read about pathetic article ‘khide pete ghum’, I felt sick in my stomach and wanted to throw up just for a relief. What a naked hypocrisy!) Original post
**English translation by: Tithi, Canada**