Search

Monday, May 31, 2010

রোপণ করছি একেকটা বিষ-বৃক্ষ

এখন পর্যন্ত জানা গেছে, পাকিস্তানের লাহোরে দু্ই মসজিদে অন্তত ৮০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এটার চেয়ে এই গ্রহে আর বড়ো কোন অন্যায় আছে কি না আমি জানি না। এই অন্যায়ের সঙ্গে উইকিলিকসের [১] দেখানো আমেরিকা নামের দানবদের সেই বর্বোরিচিত হামলাও নস্যি। 
যে যার বিশ্বাসমতে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনার সময়, কাউকে হত্যা করার মত জঘণ্য কাজ আর কিছু হতে পারে না।

আমি কোথাও লিখেছিলাম, "মানুষ যেহেতু প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না তার কোন অধিকার নাই কারও প্রাণ নেয়ার, এমন কি নিজেরও"।
কিন্তু যারা প্রার্থনাস্থলে হামলা চালায় এই সব দানবদের মেরে ফেলতে হবে, চোখের পলক না ফেলে। আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, মানুষ নামের কোন দানব এমন কান্ড করতে পারে!

তারচেয়েও বেশি আমি এটা পড়ে স্তম্ভিত, হতভম্ব। আমাদের কিছু কম্যুনিটি ব্লগ নামের সো-কলড দেশপ্রেমের চাদর গায়ে দেয়া দেশপ্রেমিকরা এই বর্বরোচিত হত্যা নিয়ে উল্লাস করেছে, রসিকতা করা হয়েছে!

কেন? আর কিছু না, এদের বক্তব্য, এই পাকিস্তানিরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের উপর ভয়াবহ অন্যায় করেছে। উল্লাসটা এর শোধ! আমি নিজে যদি এটা না পড়তাম তাহলে বিশ্বাস করতাম না, আমার দেশের মানুষ এতোটা হৃদয়হীন হতে পারে! 
এরা কারা? এরা কি ৭১-এর পরবর্তী কাল্পনিক মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করা 'নব্য মুক্তিযোদ্ধা'? যারা স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক(!)। দেশপ্রেমিক, হাহ, এত্তো সোজা? এটা কি মুড়ি-মুড়কি যে বাজারে কেজি দরে বিক্রি হয়? দেশপ্রেমিক কাকে বলে এই মানুষটাকে দেখে শেখেন [২]

এখন মুক্তিযুদ্ধটা একটা ফ্যাসানের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আসল মুক্তিযোদ্ধা, দুধর্র্ষ নৌকমান্ডো এখন ঠেলা চালান [৩], একজন ট্যাংকমানব [৪] আকাশপানে তাকিয়ে হাহাকার করেন। আর যারা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা হয় একাত্তরে গর্তে লুকিয়ে ছিলেন নয়তো তখন জন্মই হয়নি। এরাই এখন বড়ো দেশপ্রেমিক সাজেন, ভার্চুয়াল ভুবন কাঁপিয়ে তোলেন। 
এরা গালির বন্যা বইয়ে দেন। দেশপ্রমিক(!) সাজার জন্য কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করার নিয়ম আছে। অন্যের মা, প্রকারান্তরে নিজের মাকে নিয়েই কুৎসিত ভাষায় আক্রমন করারও প্রয়োজন আছে। যে গালিগুলো দিতে এই গ্রহের অতি নোংরা মানুষগুলোও দ্বিতীয়বার ভাববে এরা এখানে এসে অবলীলায় বলেন। 
আমার পূর্বে ধারণা ছিল, এই অসভ্য মানুষগুলো অসুস্থ, এদের চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরা চিকিৎসার বাইরে।

আসলে আমরা বড়ো গুজুগে জাতি [৫]। বিশ্বকাপের আবেগে একটা পতাকা নাহয় লাগালামই কিন্তু একজন ১০ গজ কাপড়ের লাগাচ্ছে তো অন্যজন ২০ গজ কাপড়ের পতাকা! অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি, সরু বাঁশের ঝাড়ুর উল্টোদিকে স্বাধীনতা দিবসে আমাদের বিবর্ণ পতাকা লাগাতে!

একজন মুক্তিযোদ্ধার উদাহরণ দেই। তার সনদ-সার্টিফিকেটের বহর দেখে আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। কয়টা না, বলুন কয় শো। 
অথচ যুদ্ধের সময় এর বয়স ছিল খুব জোর সাত। শেলের একটা টুকরা পড়ে এর নিম্নাঙ্গ উড়ে যায়। একে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেয়া হয় এরপর রাশিয়ায়। এটাকে পুঁজি করে এ একের পর এক সার্টিফিকেট যোগাড় করেছে। এখন তাকে মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত যে কোন সভায় সামনের কাতারে পাওয়া যায়। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এ ভোগ করছে, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত!

আচ্ছা, এই শিক্ষাটা এরা কোত্থেকে পেল? গোটা একটা দেশকে, গোটা একটা জাতিকে ঘৃণা করার? একাত্তরের কি পাকিস্তানের সমস্ত মানুষ মিলে আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল? আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি আর্মি, গুটিকয়েক মানুষের নির্দেশে। 
এরা কেন আমেরিকাকে একই ঘৃণা করতে আগ্রহ বোধ করে না- আমেরিকায় যাওয়ার কথা আসলে দেখি লালায় পা ভিজে যায়!

আসলে আমাদের শিক্ষায় গলদ আছে, একজন প্রফেসর সাহেব করেন বাথরুম উদ্বোধন [৬] করেন, মিডিয়া আমাদের ঘটা শেখায় কেমন করে একটা লাশকে [৭] অপমান করতে হয়। বিশেষ মাসে কেমন করে আয়োজন করে [৮] কাঁদতে হয়!

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের সৈনিকদেরই গড়ে তোলা হয় একেকটা রোবট হিসাবে। এদের নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কোন শব্দ থাকে না। নির্ভর করে তার কমান্ডারের কমান্ডের উপর [৯]। এদের ঘিলুর ব্যবহার করার অধিকার হরণ করা হয়!

আমরা নিজেরা কি করেছি? বিভিন্ন সময়ে আদিমানুষদের বিরুদ্ধে আমাদের সুসজ্জিত আর্মি লেলিয়ে দিয়েছি। আমরা নিজেরাও এদের ভুবন তছনছ করে দিয়েছি [১০]। কিন্তু এই দেশের সবাই কি এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত? 
এখন এটা কেমন হবে, আদিমানুষরা যখন এই দেশের সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা লালন করবে। আমাদের মা-রা যখন হাহাকার করে কাঁদবে এরা দাঁত বের করে হাসবে! এরা কি এদের সন্তানদের এই শিক্ষা দিয়ে বড়ো করবে এই দেশের আপামর জনগণের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠো। 
এরাও কি রোপণ করবে আমাদের মতো করে একেকটা বিষবৃক্ষ [১১]?

এটা সত্য, আমরা অভাগা-নপুংসক, পাকিস্তানি আর্মিদের নৃশংসতার বিচার করতে পারিনি। এও সত্য পাকিস্তান এখনও তার কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি- অবশ্য পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ নতজানু হয়েছেন। 
পাকিস্তানিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আমাদের খুব একটা চেষ্টা ছিল এমনটা বলা চলে না। পাকিস্তানি প্রাইম মিনিস্টার যখন আমাদের দেশে আসেন তখন আমরা লেজ নাড়তে নাড়তে তাকে স্মৃতিসৌধে নিয়ে যাই। এটা তো প্রটোকলের পর্যায়ে পড়ে না! তখন আমাদের এই সব দেশপ্রেমিকরা কই থাকেন? তখন সবাই অন্তত বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে ঘৃণার প্রকাশটা করেন না কেন?
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করবেন, এটাও আমাদের কম অর্জন না যে তাকে আমরা স্মুতিসৌধে নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করিয়েছি। আমার মত হচ্ছে, অন্যায় স্বীকার না করে কেবল দেখাবার জন্য এই নাটকের প্রয়োজন নাই।

ভার্চুয়াল ভুবনে দেশপ্রেমিক সাজা খুব সোজা কারণ এখানে গায়ে আঁচড়টিও লাগে না। আরও সোজা প্রবাসে বসে বসে দেশউদ্ধার করলে, ধর্ম নিয়ে লম্বালম্বা বাতচিত করলে। ওহে, নব্য মুক্তিযোদ্ধা, বৈদেশে না থেকে দেশে এসে দেশউদ্ধার করেন না কেন?
ধর্মের নামে দেশ রসাতলে যাচ্ছে, এটা দেশে এসে কোন এক জুম্মাবারে কোন মসজিদে দাঁড়িয়ে মুখ থেকে আগুন বর্ষন করুন, তবে বলসগুলো বাড়িতে রেখে আসবেন এই আমার পরামর্শ কারণ পরে এগুলো খুঁজে পাবেন না।

এদের শিক্ষাটাই এমন, বিষবৃক্ষ গাছে বিষবৃক্ষই ধরবে, জয়তুন ফল ধরবে না। আমাদের যে এসব শেখানো হচ্ছে অহরহ- যেসব মানুষগুলো একটা লাশকে সম্মান করতে জানে না তাদের কাছ থেকে এই সব অমানবিক আচরণ পাওয়া যাবে এ আর বিচিত্র কী!

৭১-এ পাকিস্তানি যে মানুষটা এই দেশে ভয়ংকর অপরাধ করেছে, ৩৯ বছর কেন ৩৯০ বছর পরও আমি তার বিচার চাইব কারণ রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না [১২]। কিন্তু এই মানুষটারই মা যখন আকাশ ফাটিয়ে কাঁদবে, ওই মাটার সঙ্গে আমিও কাঁদব। এটা আমার ব্যক্তিগত কান্না। 
আমার এই কান্নার জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করার আগ্রহ প্রকাশ করি না। আপনাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের এমন আবেগেরও [১৩] আমার প্রয়োজন নাই।

সহায়ক লিংক:
. দানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_15.html 
২. দেশপ্রেমিক যারা: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post_06.html 
৩. মুক্তিযোদ্ধা, একজন ঠেলাওয়ালা: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_18.html 
৪. মুক্তিযুদ্ধে একজন ট্যাংকমানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_03.html 
৫. হুজুগে বাংগাল: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_25.html 
৬. বাথরুম উদ্বোধন: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_20.html 
৭. মিডিয়া- লাশ: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_28.html 
৮. মিডিয়ার আয়োজন করে কান্না: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_18.html 
৯. রোবট, আমি এখনই মরতে চাই না: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_15.html 
১০. আদিমানুষ, পড়ো আমাদের নামে: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_23.html 
১১. বিষবৃক্ষ গাছ: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_6667.html 
১২. রক্তের দাগ: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_18.html 
১৩. মুক্তিযুদ্ধের আবেগ: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post_07.html

Sunday, May 30, 2010

নো পাসপোর্ট-নো ভিসা-নো ব্যারিআর

কত কিছু দেখার বাকী রয়ে গেছে- 'মেঘে মেঘে বেলা বয়ে যায়'। কখনও সুযোগ এলেও আমি হাঁই তুলে বলি, দেখি।  আমার এই দেখাদেখি আর শেষ হয় না!
অবশ্য পুরনো স্থাপনা আমাকে খুব টানে, কেন? এটার বিস্তারিত বলতে গেলে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাব। আমি নিজেও থাকি প্রায় ১০০ বছর পুরনো এক বাড়িতে, ব্রিটিশদের বানানো একটা স্থাপনা, এই বাড়িতে কারা কারা যেন ভূত দেখেছেন, আমি দেখিনি। ভূতের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নাই, মহিলা ভূত হলে আগ্রহ থাকত কিনা এই কুতর্কে এখন যাই না। [১]

তো, কোন দিন না এই ভূতেরবাড়ি ধসে পড়লে, পত্রিকায় আমার ছবি আসলে মরে গিয়েও কম অবাক হব না, একজন ব্লগারের অপমৃত্যু।

তাজমহলের সামনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম তখন আমার সঙ্গের মানুষটা পারলে এককোপে আমার কল্লা নামিয়ে ফেলেন। তাজ দেখে কেন আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না, কেন আমি এটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি উঠাচ্ছি না এই নিয়ে তাঁর আক্ষেপের শেষ ছিল না। 
তিনি অনল বর্ষন করতে লাগলেন, এই পৃথিবীতে দু-ধরনের লোক আছে- একদল তাজ দেখেছে, অন্য দল দেখেনি। আমি নাকি বড়ো বিচিত্র একজন মানুষ, কোন দলেই আমাকে ফেলা যাচ্ছে না। দেখিনি এটাও বলা যাচ্ছে না আবার দেখেছি এটা বললেও চলছে না, তাজ দেখার প্রকৃত উচ্ছ্বাস কই, ফটাফট ছবি উঠানো কই!

তিনি বললেন, তুমি যে একজন মানসিক রোগি এটা কি তুমি জানো?
আমি ঘুরিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, একজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'আর য়্যু কম্যুনিস্ট'? তার উত্তর ছিল, 'নো, আয়্যাম নরমাল'। 
এখন তোমার কারণে আমি নিজেকে নরমারও বলতে পারছি না। কী আর করা, কপাল! দেখি ফিরে কোন একজন মনোচিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলব।

অনেকে এটা বলার কারণে আমাকে চাবকাবার জন্য চাবুক হাতে ঘুরে বেড়াবেন কিন্তু আমার কাছে আহসান মঞ্জিল, পানাম নগরী [২] দেখে যে অনুভূতি হয়েছিল, তাজ দেখে এর বাইরে কোন বাড়তি তাগাদা অনুভব করিনি।

পূর্বে এই ভাবনা কাজ করত, আহা, এই গ্রহে কত কিছুই না দেখার বাকী রয়ে গেছে- না দেখে মরে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। এখন অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে! এখন আর এই ভাবনাটা কাজ করে না। কেন, এটা মনোচিকিৎসক ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু আমি জানি না কেন যেন এঁরা রোগি হিসাবে আমাকে গুরুত্ব দিতে চান না। কাল রাতেও এমন একজনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তিনি আরও উল্টা...।

মনোচিকিৎসকদের অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের মত উঁচু মাপের লেখক বলেন পাগলের ডাক্তার! এইবারের শিলালিপিতে (২৮ মে, ২০১০) তিনি লিখেছেন:
"...সাইকিয়াট্রিস্ট এবং লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক আমি ডিজোপেন খাই শুনে আঁতকে উঠে বলছিলেন, এটা তো পাগলের ওষুধ। আপনি পাগলের ওষুধ খাচ্ছেন কেন?
আমি বিনয়ের সঙ্গেই বলেছি, আমি তো পাগলই।...?"

আমি স্তম্ভিত! এটা আমি বিশ্বাস করি না, করতে চাই না কোন বিবেকবান মানুষ খানিকটা অন্য রকম মানুষকে পাগল বলেন, ঘটা করে এটা লিখে আমাদেরকে আবার শেখান। 
আমি এটাও বিশ্বাস করতে চাই না, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট নিজেকে পাগলের ডাক্তার বলেন! বলে থাকলে তাঁর সনদ কেড়ে নেয়া উচিৎ। অনুমান করি, হুমায়ূন আহমেদ বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। এই অভ্যাসটা তাঁর পুরনো।[৩] 
যাগ গে, হুমায়ূন আহমেদ একজন দুঁদে লেখক, তিনি আষাঢ়ে গল্প 'আমার নিজের চোককে দেখলাম' বলে আমাদেরকে আষাঢ়ের বৃষ্টিতে গোসল করালে আমাদের না ভিজে উপায় কী! হুমায়ূন আহমেদ বলে কথা!

আমার নড়বড়ে বাসাটার ছোট্ট সিড়িতে বসে থাকার যে সুখ তা অন্যত্র কোথায়। মাথার উপর দিয়ে যখন অতি দ্রুত যান উড়ে যায় [৪] তখন আমার মাথায় এই ভাবনা খেলা করে, আচ্ছা, আস্ত একটা ভিমরুলের বাসা যোগাড় করার উপায় কি [৫]?
আমি বুকে হাত দিয়ে এটা বলতে পারব না, কখনো কখনো কি এমনটা মনে হয়নি, এই সব আমি কি করছি [০]? আমি আসলে কি হতে চেয়েছিলাম...[৬]। কেন আমার দ্রুত রূপান্তর হয় না [৭]?

এই গ্রহের চমৎকার সব দৃশ্য দেখার জন্য, বুদ্ধিমান মানুষরা প্রতিবন্ধকতা সৃস্টির উদ্দেশ্যে কতই না উপায় আবিষ্কার করে রেখেছে! বুদ্ধিমান মানুষরা সব সময় সফল হয় কী!

অন্য একটা পোস্টে ছবিটা দেয়ার সময় এতোটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখা হয়নি [৮]। এখন এই ছবিটা দেখার পর মনে হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য সব চমৎকার সব দৃশ্য না দেখে মরে গেলেও আজ থেকে আমার হাহাকার করার কিছু নাই।

ঈশ্বরের বিশেষ সন্তান [৯], "রানী" নামের এই মেয়েটি নাকি হাসে না এমনটাই বলেছিল তার পরিবারের লোকজন। মিথ্যা-মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা! কী চমৎকার করেই না হাসে মেয়েটা! হাসিটার তুলনা কিসের সঙ্গে হয় আমি জানি না।
এর জন্য কোন পাসপোর্ট লাগে না, ভিসা লাগে না; কেউ রে রে করে তেড়ে আসবে না।
ভাল লেখক হয়তো-বা মনের মাধুরী মিশিয়ে লম্বা লম্বা কাহিনী লিখতে পারতেন। আমার কাছে  কেবল মনে হচ্ছে, অন্য ভুবনের এমন কিছু চমৎকার দৃশ্য দেখার জন্য আরও কিছুটা সময় বেঁচে থাকা যেতে পারে! মন্দ হয় না।
তাতে ২০০৯-এর মতোই [১০] চলে যাক না ২০১০...১১...১২...।

*স্বপ্ন: http://www.ali-mahmed.com/search/label/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A8 

সহায়ক লিংক:
০. একজন ব্যর্থ পুরুষ: http://www.ali-mahmed.com/2009/09/blog-post_12.html 
১. ভূতের বাড়ি: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_24.html 
২. ওড়নাসমগ্র: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_18.html 
৩. হুমায়ূন স্যারের নাটক: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_2278.html 
৪. মার অদেখা সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_10.html 
৫. খুনের দায় http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_10.html 
৬. পানাম নগর: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_10.html 
৭. রূপান্তর: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_1172.html 
৮. স্বপ্ন দুই: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_25.html 
৯. ঈশ্বরের বিশেষ সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post.html 
১১. জিরো: http://www.ali-mahmed.com/2009/07/blog-post_28.html 
১০. ০০৯: সালতামামি: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_31.html

Saturday, May 29, 2010

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক

আনিসুল হক আজ  (২৯ মে, ২০১০) প্রথম আলোয় জানাচ্ছেন, "...বেসক্যাম্পে মুসা ইব্রাহীম এসে পৌঁছেছেন বিকেল পাঁচটায়। সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। কমল আরিয়াল ফোন করলেন কাঠমান্ডু থেকে। ফোন আসতে লাগল ডয়েচে ভেলে, বিবিসি থেকে। তারপর তিনি পেলেন আমার ফোন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘মিটুন দা, আই সারভাইভড!’" [১]

"...ফোন আসতে লাগল ডয়েচে ভেলে, বিবিসি থেকে। তারপর তিনি পেলেন আমার ফোন।"
আনিসুল হক, এই সব আপনি এখন কী বলছেন! এই আপনিই না বলেছিলেন আপনিই প্রথম কথা বলেছেন মুসার সঙ্গে আর এখন বলছেন...! হায়-হায়, এইটা আপনি কি করলেন?

আমরা জানি, লিকারে ছড়াছড়ি কাঠমান্ডুর বাতাসেও লিকারের গন্ধ। শরীরে যতটুকু সয় ততটুকুই লিকারের সঙ্গে সখ্যতা করলে ভালো হয় নইলে এর প্রকোপে যা হওয়ার তাই হয়। আপনার কি স্নায়ু বিকার ঘটেছে, মস্তিষ্ক বিদ্রোহ করছে? আহা, কেন শরীরের উপর এতো অত্যাচার!

পুর্বের পোস্টে আমি লিখেছিলাম আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে [২], এই আপনিই লিখেছিলেন, "প্রথম আলোয় (২৬.০৫.১০)  তিনি (আনিসুল হক) লিখেছেন: '...এটা ২৫ মে কাঠমান্ডু থেকে তিব্বতের বেসক্যাম্পের ফোনে মুসা ইব্রাহীমের সঙ্গে প্রথম কোন বাঙালির কথোপকথন। এবং প্রিয় পাঠক, এই ঐতিহাসিক কথোপকথনটা আপনি পড়ছেন, আপনিও কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী। ভবিষ্যতে নাতি-নাতনিদের এই গল্প আমরা করতে পারব। হা হা হা...'।"

আপনার পত্রিকাও (২৬.০৫.১০)  লিড নিউজ করল, "বেসক্যাম্পে ফিরে মুসা ইব্রাহিমের প্রথম সাক্ষাৎকার"

যেখানে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি আপনার ফেরার অপেক্ষায়, ঠিক করে রেখেছি আপনি দেশে ফিরে এলে শ্যাম্পেনের বোতল খুলব, আপনাকে অভিনন্দন জানাব আর আপনি কি না...। এই বেদনার কথা কাকে বলি, কোথায় বলি!

আমি জানি না, এর পেছনে কোন বিদেশী চক্রান্ত আছে কি না। হে খোদা, আমার আশংকা যেন মিথ্যা হয়। আগের পোস্টে আমি এই বিষয়ে খানিকটা লিখেছিলাম, "...বিদেশী চক্রান্ত সফল হতে দেব না। কালো হাত গুড়িয়ে দাও।" 

বিদেশীদের ধপধপে সাদা হাত কালো কেমন করে হয় এটা আমার বিশেষ জানা নাই তবুও অন্যদের বলতে শুনেছি তাই বললাম। এমনটা কি হতে পারে না, আনিসুল হককে বিদেশী কোন চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছে? বেশ পারে...।

সিআইএ, মোসাদ না সম্ভবত কারণ এদের ওখানে কোনো কাজ নাই। কাউকে বলবেন না প্লিজ, নইলে আমার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে কিন্তু। কাছে আসেন কেবল আপনাকেই চুপিচুপি বলি, এর পেছনে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। ভালো কথা, জার্মান গোয়ান্দা সংস্থার নাম যেন কি?
হতে পারে না এমন, আনিসুল হককে অপহরণ করা হয়েছিল। মাথায় স্মল আর্মস ঠেকিয়ে হুমকি দেয়া হয়েছিল, 'হের, হ্যানিছ, লড়েছো কি মরেছো'। বা নাক বোঁচা বেরেটা দিয়ে তাঁর নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে বলা হয়েছে, হের আনিসুল হক, লেখো, আমাদের নামে, যাহা বলিব তাহাই লিখাবা। নইলে, ডিস্যুম-ডিস্যুম!

বেচারা আনিসুল হক। প্রাণের দায় বড়ো দায়। প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে সুড়সুড় করে এটা লিখেছেন, নিজের কৃতিত্বটাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছেন। 
যাক, এখন দুঃখ কিছুটা লাঘব হলো। আমরা 'প্রথম সাক্ষাৎকারী বাঙালি' এই খেতাব থেকে বঞ্চিত হলেও আনিসুল হকের মত একজন আদর্শ লেখকের [৩] প্রাণ রক্ষা পেল এটাই আমাদের আনন্দ। এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক এটাই আমাদের কাম্য। আপনার মতো অসাধারণ বিজ্ঞাপন [৪] না-হোক, অন্তত একটা বিজ্ঞাপন দেব ঠিক করে রেখেছি। হিমালয় পর্বতের নীচে থেকে ফিরে এসেছেন আমাদের ছাওয়াল। 

সহায়ক লিংক:
১, প্রথম আলো: http://prothom-alo.com/detail/date/2010-05-29/news/66820
২, আনিসুল হককে অভিনন্দন http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_27.html 
৩, একজন আদর্শ লেখক: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_07.html
৪, বিজ্ঞাপনতরঙ্গ: http://www.ali-mahmed.com/2009/03/blog-post_21.html

Friday, May 28, 2010

আমাদের সেলিব্রেটি তুষার মহোদয় সমীপে...

অভ্র-বিজয় নিয়ে এক ধুন্ধুমার কান্ড চলছিল, এখনো চলছে। এই নিয়ে আমার একটা লেখা ছিল, আজ আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, এই বিজয় মিছিলে পুরোধা অভ্র [১]

এই বিষয়ে ডয়চে ভেলে আমার কাছে জানতে চাইলে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলাম, "অভ্র চাচ্ছে ভাষা উম্মুক্ত হোক এবং এর জন্য এরা কেউ টাকা চাচ্ছে না। (ভাল লাগছে যেটা) এই সফটওয়্যার ব্যবহার করার জন্য কখনও আমার নিজেকে চোর মনে হবে না।
বাংলা ভাষার জন্য, বাংলা ভাষাকে উম্মুক্ত করার জন্য যে টাকা চাইবে তাকেই আমি অপছন্দ করব। অর্থের লালসার কাছে আর যাই হোক দেশপ্রেম হয় না"...[২] 

ওখানে আবদুন নুর তুষারের বক্তব্যও পড়লাম। 
ডয়চে ভেলেকে তুষার বলেন, ‘‘একটি সফটওয়্যার ফ্রি অথবা ফ্রি নয়, এটি আসলে তর্কের জায়গাটি নয়৷ আর আমার সহজ যুক্তিটি হচ্ছে, সফটওয়্যার হচ্ছে কলমের মতো, ভাষার পরাধীনতার সঙ্গে সফটওয়্যারের ফ্রি হওয়া না হওয়ার কোন সম্পর্ক নাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘যদি সফটওয়্যার দিয়ে বাংলা লিখতে গেলে সেই সফটওয়্যারটি ফ্রি হতেই হবে, এটি আমরা বলি, তাহলে কলম দিয়ে বাংলা লিখতে গেলে, সকল কলম ফ্রি করে দেয়া উচিত৷'' 

তুষার সাহেব সেলিব্রেটি টাইপের মানুষ। সেলিব্রেটি টাইপের মানুষদের ভুল ধরার দুঃসাহস আমার নাই। এমনিতেই আমি ভীতু টাইপের মানুষ তা আবার সেলিব্রেটিকে নিয়ে কথা, পাগল! কারণ সেলিব্রেটি টাইপের মানুষরা অন্য রকম হন, এরা অন্য গ্রহ থেকে দেশ উদ্ধার করতে আসেন। এঁদের আচরণের সঙ্গে আমাদের মত সাধারণদের আচরণের সাযুজ্য খোঁজা বৃথা।

একবার টিভিতে দেখলাম, এই দেশের বিভিন্ন সেলিব্রেটি মিছিলের মত একেকজন করে আসছেন। আলাদা এক গাম্ভীর্য নিয়ে বলছেন, "আমি জীবনেও কখনও কোন শিশুর গায়ে হাত তুলিনি, আপনিও তুলবেন না"।

ওয়াল্লা, আমি চিন্তায় তো পড়ে গেলাম! আচ্ছা, যারা এই অনুষ্ঠানটা করেছেন তারা কী বেছে বেছে সেইসব সেলিব্রেটিদের বিজ্ঞাপন দিয়ে খুঁজে বের করেছেন, যারা জীবনে কখনও শিশুদের গায়ে হাত তোলেননি? বিজ্ঞাপনটা কি ছিল এমন? 'কাহারা কাহারা শিশুদের গায়ে হাত তোলেননি তাহারা তাহারা জিপিও বক্সে আমাদের পত্রাঘাত করুন'।
নাকি সেলিব্রেটিগণ এমনই হন, এরা কখনও শিশুদের গায়ে হাত তোলেন না? অনেকটা দেবতা দেবতা টাইপের!

এখানেই দেবতা এবং আমাদের মত সাধারণ মানুষদের মধ্যে পার্থক্য। কারণ আমাকে 'খোদা-না-খাস্তা' কেউ দুম করে জিজ্ঞেস করে বসলে আমার এটা না বলে উপায় ছিল না, কখনও কোনো শিশুর গায়ে হাত দেইনি, এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না।
তবে এ অন্যায়ের জন্য আমি লজ্জিত। চেষ্টা করব আর কখনও এই অপরাধটা না-করতে।

তুষার সাহেবের মূল বক্তব্য, "তাহলে কলম দিয়ে বাংলা লিখতে গেলে, সকল কলম ফ্রি করে দেয়া উচিত" 

তুষার সাহেবের এই বক্তব্য পড়ে আমি ভাবছিলাম, এই কথাটা তিনি কী অবলীলায়ই না বলে বসলেন! এমন একজন সেলিব্রেটি মানুষকে যে কিছু বলব এই উপায়ও নেই। 
বাহ, তাহলে আমরা কি "মা", "বিজয়" এই সব শব্দের জন্যও কি পয়সা চাইব নাকি? আমরা কি আপনার মত তেমন ডাক্তার যে রোগী মারা গেলেও ফি পকেটে চালান করি? এই আমিই কি কখনও পারব, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোন লেখার জন্য টাকা চাইতে? 
আমরা কি আপনার মত ভানবাজ যে নিজের অনুষ্ঠান "শুভেচ্ছা"য় লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড-ওয়ান-টু-থ্রি-একশন বলে ভেউভেউ করে কান্না করি?

আপনাকে কে বলল, আমরা এই দেশের তাবৎ সফটওয়্যার বিনে পয়সায় চাচ্ছি? এখানে তো অভ্রর বিষয়টা অন্য রকম। 
তর্কের খাতিরে নাহয় ধরেই নিলাম, অভ্র টিম কিছু ভুলভাল করে ফেলেছে। বেশ। কিন্তু কার জন্য? নিজেদের স্বার্থের জন্য? এরা কি আমাদের কাছ থেকে একটা আধুলিও চেয়েছে?
এরাই সহজে আমাদেরকে বাংলা ইউনিকোডে লেখার সহজ উপায় করে দিয়েছে বলেই আমার ৯ ইঞ্চি মনিটর হয়ে উঠে গোটা বিশ্ব। আমি আমার অদেখা স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে দিতে পারছি এই গ্রহে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষীদের কাছে। 
প্রবাসে পড়ে থাকা এই দেশের সেরা সন্তানগুলোও বাংলায় লিখে মাখামাখি হয়ে থাকে এই দেশের সোঁদা মাটির গন্ধে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডে দমবন্ধ হয়ে আসা আটকে থাকা জারে, যেন একপশলা বিশুদ্ধ অক্সিজেন।

কেউ ফট করে আমাকে বলে বসতে পারেন, আচ্ছা, আপনি এটাই বা কেমন করে বলবেন, অভ্র টিম একসময় এটার জন্য টাকা চাইবে না?
আমি মানুষ চিনি না কিন্তু স্বপ্নবাজদের চিনি। অভ্র টিম, এরা হচ্ছে স্বপ্নবাজ। এরা কি করবে, কি করবে না, এটা আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি।

জব্বার সাহেব কি আমার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন, এই উদ্বেগ নিয়ে, অভ্ররা আবার টাকা কামাবে নাতো এটা থেকে? আমি ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলাম জব্বার সাহেবের প্রতি। ভবিষ্যতে কখনও টাকা চাইবে না, অভ্র টিমের কাছ থেকে এটার লিখিত এনে দিতে না পারলে আমার সন্তানসম লেখালেখি ছেড়ে দেব। 
আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি, অভ্র টিম নামের স্বপ্নবাজরা এক মুহূর্তও না ভেবে এটা লিখে দেবে, এই তীব্র বিশ্বাস আমি বুকে লালন করি।

কিন্তু আপনি মি. তুষার, আপনি কি পারবেন জব্বার সাহেবের কাছ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি এনে দিতে? তিনি বাংলা লেখার জন্য কোনো টাকা চাইবেন না? আহা, মি. তুষার, ছি, লাজুক মেয়েদের মত চোখ নামিয়ে নেবেন না, প্লিজ। আপনি না সেলিব্রেটি...! 

সহায়ক লিংক
১. এই মিছিলের পুরোধা, অভ্র: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_29.html
২. অভ্র-বিজয় বিতর্ক, ডয়চে ভেলে: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,5590862,00.html   

দানব বানাবার এক কারখানা!

আমি পুর্বের পোস্টে হালকা চালে লিখেছিলাম, "মুসার কপাল ভালো, প্রতিযোগীদের মধ্যে কোন বাঙালী ছিলেন না নইলে কেউ হয়তো কারও স্লিপিং-ব্যাগে তেলাপোকা ছেড়ে দিত (হিমালয়ে যাইনি বলে আমি ঠিক জানি না, হিমালয়ে তেলাপোকা আছে কিনা? ডায়নোসর নাই, তেলাপোকা দিব্যি আছে, এই ভরসায় লিখছি), কেউ কারও স্নো-গগসের স্বচ্ছ কাঁচ ঝামা দিয়ে ঘসে দিত।
পরে ব্যর্থ হয়ে ফেরে এসে অন্যদের বিজয়ের গল্প মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখত।"[১] 

এটা যে সত্যি সত্যি ফলে যাবে অন্তত আমি কল্পনা করিনি! ভুলেই গিয়েছিলাম, হিমালয়ে বাঙালি দূর্লভ হলেই কী- বাঙালির মাঝে ফিরে আসতে তো হবে। 
দৈনিক 'কালের কন্ঠ' আজ "প্রযুক্তি এবং আবহাওয়ার কারণে এভারেস্ট জয়ের হিড়িক" এই শিরোনামে এএফপি, বিবিসি, এবিসি নিউজের সুত্রে বিশাল এক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। সাহেবদের লেজ ধরে!

মূল বিষয় হচ্ছে, এভারেস্ট জয় করা এখন ডালভাত, যে কেউ ওখানে গিয়ে হাওয়া খেতে পারে। কালের কন্ঠ এর কিছু নমুনাও দিয়েছে, জেক নরটনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, "...অন্য পাঁচটা ব্যস্ত এলাকার মতোই সেখানে এখন মানুষ গিজগিজ করে"।

কালের কন্ঠ আরও জানাচ্ছে, "...জয়ীদের তালিকায় নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীরাও রয়েছে।" কালের কন্ঠের কাছ থেকে আমরা আরও জানতে পারছি, "...২০০৭ সালে জাপানি নাগরিক কাতসুকে ইয়ানাগিসাওয়া ৭১ বছর বয়সে চূড়ায় উঠে চমক লাগিয়ে দেন। 
মুসার এক দিন আগে তাঁর ব্যবহৃত পথ ধরেই সবচেয়ে কম বয়সে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়ে শিশু রোমেরো। 
...গত রবিবার রোমেরো মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করার পর তার নিজ দেশের পত্রপত্রিকায়ও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি"। 
"একই দিনে সবচেয়ে কম বয়সী অর্জুন বাজপেয়িকে নিয়েও তেমন মাতামাতি হয়নি [২]।"

এই সব তথ্য সঠিক কিনা এই নিয়ে আমি ভুলেও প্রশ্ন তুলব না কারণ সাহেবদের দেয়া তথ্য বলে কথা। এই সব তথ্য জানাবার জন্য আমি কালের কন্ঠের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব না তাও না। 
আমার কথা অন্যখানে। এখন পর্যন্ত কয় জন বাঙালি এভারেস্টের চুড়ায় এই দেশের পতাকা নিয়ে যেতে পেরেছে? মুসা ব্যতীত অন্য কেউ আছে কী? নাকি আবেদ খানের এস্টাইলে [৩] বলব, বোধ হয় [৪] আরও কেউ আছে! 

রোমেরো মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করার পর তার নিজ দেশের পত্রপত্রিকায়ও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। 

রোমেরোকে নিয়ে তার দেশের পত্রপত্রিকায় মাতামাতি হয়নি, এটাও কি সাহেবদের কাছ থেকে ধার করা কথা নাকি সেন্ট্রাল এসি কক্ষে বসে বসে আবিষ্কার করেছেন? ইয়ে, তার নিজের দেশ বাদ দিয়ে অন্য দেশে মাতামাতি হলে কি চলবে আমাদের বিবেক ভাইয়া? [৬]
প্রকারান্তেরে কি বলা হলো, আমাদের পত্রিকায় মুসাকে নিয়ে মাতামাতি দৃষ্টি কটু? ঘটনা কী এটাই, প্রথম আলো তার নামটা বেশী ফাটিয়ে ফেলছে বলে? কালের কন্ঠের ব্যানার নিয়ে মুসা পোজ দিলে কালের কন্ঠের প্রথম পাতার সবটাই এই খবরে ভরে যেত, না?
আপনারা নিজেরা নিজেরা কার অন্তর্বাসের রং কি এটা দেখতে থাকুন না কেন, আমাদের কেন এতে জড়ানো?

মিডিয়া কী না পারে! কাউকে মাথায় তুলতে পারে, আবার আছড়ে ফেলতেও সময় লাগে না। আজকের প্রথম আলোয় আনিসুল হক লিখেছেন:
"প্রথম আলো ফুটছে। সূর্যের প্রথম রশ্মি এসে পড়ল এভারেস্টের চুড়ায়। ঠিক তখনই আমি এভারেস্টের মাথায়। আমার কী যে ভাল লাগল। এই আলো। এই আমার স্বপ্নপূরন। ২৩ মের প্রথম আলোকরশ্মি এভারেস্টের চুড়ায় আমাকে স্বাগত জানাল।"
আনিসুল হক পারলে এটাও লিখে দিতেন, এভারেস্টের চুড়ায় দেখলাম, এক ইয়েতি নিবিষ্টচিত্তে প্রথম আলো পত্রিকা পড়ছে এবং তার বিশেষ মনোযোগ আনিসুল হকের কলাম পড়ায়।

না পাঠক, এটা আনিসুল হক এভারেস্টে উঠে বলছেন না। বলছেন মুসা, আনিসুল হকের সঙ্গে ফোনে সাক্ষাৎকারে। শব্দের যাদুতে মুসা যে লেখক আনিসুল হককে ছাড়িয়ে গেছেন এতে কোন সন্দেহ নাই।
মুশকিল হচ্ছে, এমন অনেক না-বলা কথা আসমান থেকে চলে আসে মিডিয়ার কল্যাণে। নমুনা [৫]। 
মিডিয়াই ঠিক করে দেয় আমরা কি বলব, এরা আমাদের ভাবনা তাদের মত করে ভাবতে আমাদেরকে বাধ্য করেন। আমরা নির্বোধ পাঠক মিডিয়ার সেই ভাবনাগুলোই পেট ভাসিয়ে পড়ি। বেদবাক্যের মত বিশ্বাস করি।

আমাদের ভার্চুয়াল জগতে যখন একজন অন্যজনকে ঈর্ষায় খাটো করে, কুৎসিত ভাষায় খিস্তিখেউড় করে তখন আমরা অনিচ্ছায় মেনে নেই, কী-বোর্ডের অন্য পাশের মানুষটা হয়তো অসুস্থ। আমি অবশ্য এই সব অসুস্থ মানুষদের জন্য করুণা করি, আহা, মানুষটা যে অসুস্থ। 
এরা কেন অসুস্থ এটা মনোবিদরা ভালো বলতে পারবেন। পিঠে চাবুকের অসংখ্য দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই সব কাপুরুষ মানুষগুলো নিজেদের দগদগে ঘা নিয়ে, গা ঘিনঘিনে কুকুরের মত অস্থির হয়ে উঠে। যন্ত্রণার না-বলা কথাগুলো অন্য ভাবে বের হয়ে আসে। সামনাসামনি বলার সাহস নেই বলে আড়ালে বলে, বাপান্ত করে হয়তো তার পৈশাচিক আনন্দ হয়। এদের চিকিৎসার প্রয়োজন।

কিন্তু মিডিয়া নামের ভয়াবহ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এই কাজটাই করে, তাদের এই সব ভাবনা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তখন আমি কেবল করুণাই করি না, বেদনার সঙ্গে বলি, এরা চিকিৎসার বাইরে। 
কারণ এই সব মিডিয়া হচ্ছে, বিবেক নামের এরা হচ্ছে, চুতিয়া বানাবার কারখানা। এরা অসংখ্য দানব বানাবার চেষ্টা করে।

আমি ধরে নিচ্ছি, কালের কন্ঠ যা লিখেছে সব সত্য। কিন্তু এটা এখন কেন? এখন আমাদের আনন্দ করার সময়, উল্লাসের সময়, ঠিক এখনই কেন? এটা ক-দিন পর লিখলে বসুন্ধরা সিটি নামের ভবনটা কি ধসে পড়ত?
ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হচ্ছে এমন, কোন একজনের দাওয়াতে গিয়ে, গৃহকর্তার সাধ্যাতীত আয়োজনের পরও কোন অপদার্থ গল্প জুড়ে দেয়, মশায় বুঝলেন, এ আর কী আয়োজন; পরশু গিয়েছিলুম এক দাওয়াতে। সে এক এলাহী কান্ড, আস্ত তিমি মাছের রোস্ট এসে হাজির। দেখুন দিকি কী কান্ড!
এই সব অসভ্য-অভদ্র-হৃদয়হীন মানুষদের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারা যায়। আফসোস, মিডিয়া তো আর মানুষ না!

কালের কন্ঠের যেসব অর্বাচীনদের মাথা থেকে এটা ছাপাবার আইডিয়া বের হয়েছে, এসি রুমে বসে এই সব লেখা বড়ো সহজ মনে হয়, না? আপনাদের এভারেস্টে যেতে হবে না, সীতাকুন্ড পাহাড়ে চড়ে দেখান। আমরাও একটু দেখি। 
বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম যখন কমান্ডো ট্রেনিং নিচ্ছিল তখন সেখানে আমাদের দেশের বিভিন্ন পত্রিকার ৩৭ জন সাংবাদিক ছিলেন। ইনস্ট্রাক্টর সাংবাদিকদের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, "চাইলে আপনারাও ট্রেনিং-এ অংশগ্রহন করতে পারেন, ক্রিকেটাররাও সঙ্গ পাবেন"। 
কী একেকজন বাহাদুর, একজনও রাজী হননি! ওহে, সাম্বাদিক (!) বীরবর, ক্রিকেট টিমদের সঙ্গ দিতে না পেরে লজ্জা করেনি তখন?

মুসাকে খাটো করতে কত উদাহরণই না এখানে দেয়া হয়েছে। "কাতসুকে ইয়ানাগিসাওয়া ৭১ বছর বয়সে চূড়ায় উঠে চমক লাগিয়ে দেন।" 
হ্যাঁ, চমক লাগিয়ে দেন তো। আবেদ খান, শাহআলম সাহেবের বয়স নিশ্চয়ই ৭১ হয়নি। এরাও একটু চেষ্টা করে দেখেন না কেন? এভারেস্ট না, বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ভবনটায় লিফট ব্যতীত সিড়ি বেয়ে উঠে দেখিয়ে দিলেই হবে। আমরা অপেক্ষায় আছি।

সহায়ক লিংক: 
১. প্রথম বাঙালি সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_27.html 
২. কালের কন্ঠের প্রতিবেদন: http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&type=single&pub_no=176&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=2 
৩. আবেদ খানের এস্টাইল: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_27.html 
৪. আবেদ খানের বোধ হয়: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_26.html 
৫. একটি আদর্শ সাক্ষাৎকার: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_05.html 
৬. রোমেরো, ডয়চে ভেলে: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,5600046,00.html    

Thursday, May 27, 2010

প্রথম বাঙালি সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী আনিসুল হককে অভিনন্দন(!)

মুসা ইব্রাহীম অসাধারণ একটা কাজ করে ফেলেছেন। তিনি বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে এই গ্রহের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটাকে ঢেকে দিয়েছেন। অহংকারী এই এভারেস্টকে এখন থেকে অন্য দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকার ভারও সইতে হবে, সমীহের ভঙ্গিতে।

যে কোন বিষয়ে শ্রেষ্ট একজন মানুষ, বাংলাদেশের পতাকা যিনি বহন করে নিয়ে যাবেন, তাঁকে সেই দেশের মানুষকে হাত তুলে স্যালুট করতেই হবে।
মুসার কপাল ভালো, প্রতিযোগীদের মধ্যে কোন বাঙালী ছিলেন না নইলে কেউ হয়তো কারও স্লিপিং-ব্যাগে তেলাপোকা ছেড়ে দিত (হিমালয়ে যাইনি বলে আমি ঠিক জানি না, হিমালয়ে তেলাপোকা আছে কিনা? ডায়নোসর নাই, তেলাপোকা দিব্যি আছে, এই ভরসায় লিখছি), কেউ কারও স্নো-গগসের স্বচ্ছ কাঁচ ঝামা দিয়ে ঘসে দিত।
পরে ব্যর্থ হয়ে ফেরে এসে অন্যদের বিজয়ের গল্প মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখত।

আফসোস, সবাই মুসার কপাল নিয়ে আসেন না। অন্য জায়গায় পা ধরে টানাটানি করার জন্য অসংখ্য বাঙালি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঈশ্বর হাতকে আঙুলে বিভক্ত করেছেন কাজের সুবিধার জন্য আর আমরা নিজেরা বিভক্ত হই দেশকে খাটো করার জন্যে। ওহ, ও ব্যাটা তো মিডিয়ার লোক না, ওর অর্জন হচ্ছে টিস্যু পেপার! আরে রসো, ও কি ছাই লেখে, এটা দিয়ে বাচ্চার...ও পরিস্কার করবে না কেউ।

মুসা ইব্রাহিমের অর্জনকে অন্তত খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে না দেখে ভালো লাগছে। আমি এখনো বড়ো ভয়ে ভয়ে আছি, এই দেশের কেউ না আবার বলে বসেন, আরে সবটা পথ ও আবার হেঁটে গেছে নাকি? অর্ধেকটা পথ  তো গেছে ভারতীয় হেলিকপ্টারে। এটা ইন্ডিয়ার একটা চাল!

যাই হোক, আশা করছি, এই অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠবে না। কিন্তু আমি বিষাদের সঙ্গে লক্ষ করলাম, একজনের অর্জনকে বড়ো করে দেখা হচ্ছে না। এ অন্যায়! 
মুসা ইব্রাহিমের প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যে বাঙালি তিনি হচ্ছেন, আনিসুল হক। তাকে আমি অভিনন্দন জানাই।
আনিসুল হকই প্রথম বাঙালি যিনি মুসা ইব্রাহিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। প্রথম আলোয় (২৬.০৫.১০) তিনি লিখেছেন: "...এটা ২৫ মে কাঠমান্ডু থেকে তিব্বতের বেসক্যাম্পের ফোনে মুসা ইব্রাহীমের সঙ্গে প্রথম কোন বাঙালির কথোপকথন। এবং প্রিয় পাঠক, এই ঐতিহাসিক কথোপকথনটা আপনি পড়ছেন, আপনিও কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী। ভবিষ্যতে নাতি-নাতনিদের এই গল্প আমরা করতে পারব। হা হা হা...।"

আসলেই তো তাই, আমরা আমাদের নাতি-নাতনিদের কাছে ফোকলা দাঁতে গল্প করব, নানা ভাই, কী কমু, পতম আলোর পতম বাঙালি আমাগো এই গল্পডা হুনাইছিল। এই দেখ, কেমুন লোম খাড়ায়া গেছে।

আচ্ছা, প্রথম আলো যে দ্বিতীয় শিরোনাম করেছে, "বেসক্যাম্পে ফিরে মুসা ইব্রাহিমের প্রথম সাক্ষাৎকার"। 
চট করে অনেক কিছু আমি বুঝে উঠতে পারি না, গুলিয়ে ফেলি সব। আমার এখনো চিকেন, কিচেন গুলিয়ে যায়। 
এটা নিয়ে আমি খানিকটা দ্বিধায় আছি, বেসক্যাম্পে ফিরে...মানে কী? বেসক্যাম্পে ফেরার পূর্বে বা বেসক্যাম্পের সীমানার মধ্যে আসার পূর্বেই মুসা ইব্রাহিমকে সাক্ষাৎকারের জন্য আটকে ফেলেনি তো কেউ? না-না, আমি ইয়েতি টিয়েতির কথা বলছি না- এমনিতে ইয়েতিরা মানুষের উপর খুবই বিরক্ত, এদের খুঁজে বের করার জন্য মানুষ হন্যে হয়ে আছে। 
বলছিলাম মানুষের কথা। কারণ পুরো লেখাটা পড়ে কোথাও এমনটা পেলাম না আনিসুল হক মুসাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়ে, মুসা ভাইয়া-মুসা ভাইয়া, আমার পূর্বে কেউ কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছিল?

আনিসুল হক কথা বলেছেন বেসক্যাম্পের বাবুর্চির ফোনে। তিনি যখন বাবুর্চির ফোনে ফোন করেন তখন নেপালের সময় পৌনে ছয়টা, "'পৌনে ছয়টায় ফোন। হ্যালো আই ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট মুসা ইব্রাহিম স্টাটাস।'
'মুসা ইব্রাহিম স্পিকিং।'
'মুসা, আমি মিটুন দা।' আনিসুল হক।" [১]

জেনে ভালো লাগল কিন্তু আমার বুঝতে খানিকটা সমস্যা হচ্ছে। ডয়েচে ভেলে মুসা ইব্রাহিমের সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জানাচ্ছে:
-->"...জার্মান সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় ডয়চে ভেলেকে এই সাক্ষাকার দেন মুসা ইব্রাহীম৷ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের উত্তরাংশের বেসক্যাম্পে (তিব্বতের দিকে) তখন সবে নেমেছেন তিনি৷ চীনা এক টেলিফোন নম্বরে মুসাকে প্রশ্ন, এই যাত্রায় কোন বিপদে পড়েননিতো?...[২]"

এ তো বড়ো মুশকিল হলো! হিসাবে আমার গোলমাল না হলে, জার্মান সময় দেড়টা মানে হচ্ছে নেপালের সময় তখন সোয়া পাঁচটা! এদিকে আনিসুল হক কথা বলেছেন পৌনে ছয়টায়। এখন আমি কোথায় যাই, কার কথা বিশ্বাস করি? ডয়েচে ভেলের, নাকি আনিসুল হকের? 
আনিসুল হক কেবল একজন সংবাদকর্মীই নন, একজন লেখকও। কেবল গত বইমেলায়ই তাঁর ১২টি বই বেরিয়েছে, সেই বইগুলোর চমৎকার বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল [৩]। যে বিজ্ঞাপনের মুগ্ধতা আমার এখনও কাটেনি। এমন একজন লেখকের কথা বিশ্বাস না করে উপায় কী! 
তাছাড়া আমরা তো আবার ছাপার অক্ষরের সব কথাই বিশ্বাস করি। ভার্চুয়াল ভুবনের কথার কী দাম!
ডয়েচে ভেলের মুসা ইব্রাহিমের দেয়া রেডিও সাক্ষাৎকার [৪] যখন শুনছি, তখন আমি কেন একটা বাচ্চাও বুঝবে, কথা বলার সময় মুসা তখন প্রচন্ড হাঁপাচ্ছিলেন। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ছিল না। অর্থাৎ তিনি তখনো বেসক্যাম্পের শান্ত পরিবেশে ছিলেন না বা মাত্র পা রেখেছেন। নাহ, সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। স্বল্প বুদ্ধিতে এই জট খোলা আমার কম্মো না। এটা পত্রিকার জট খোলা বিভাগের জন্য না-হয় থাকুক।

এক আনিসুল হক এবং প্রথম আলোর যন্ত্রণাতেই বাঁচি না এরিমধ্যে আবার যোগ দিয়েছে, বিবিসি। বিবিসি দাবী করছে,
"বেস ক্যাম্পে ফেরার পর কোনো সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারে বিবিসি বাংলাকে মুসা ইব্রাহীম বলেছেন...।"[৫]
আমি যখন বিবিসির এই রেডিও সাক্ষাৎকার শুনছি, ওখানে মুসা বলছেন, তিনি বেসক্যাম্পে ফিরেছেন, আধা ঘন্টা হয়েছে। বিবিসি কি নিশ্চিত, এই আধা ঘন্টায় অন্য কেউ সাক্ষাৎকার নেয়নি?

বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে সময় দেখাচ্ছে, দুপুর ১টা ১৯ মিনিট। তার মানে হচ্ছে, কাঠমান্ডুর সময় (তিব্বতের এদিক-ওদিকে ঘুরপাক খেলেও কয়েক মিনিটের ব্যবধান হবে) তখন আনুমানিক ৬ টা। 
বিবিসির কথা আমি অবিশ্বাস করি কেমন করে? অবশ্য এটা সত্য, আমরা এদের অবিশ্বাস করে এদেশ থেকে ব্রিটিশ খেদিয়েছি কিন্তু এদের বানানো আইন দিয়ে এখনো এই দেশ চলে- আমাদের দেশে বিবিসি যখন খবর পরিবেশন করে তখন আমরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে-শুয়ে-বসে শুনি!

এদিকে আবার ডয়েচে ভেলের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় হচ্ছে, সোয়া পাঁচটা (যদিও এরা একবারও দাবী করেননি, প্রথম সাক্ষাৎকার এরাই নিয়েছেন)।

কথা সেটা না, এরা সবাই মিলে আমাকে কি আনিসুল হককে অভিনন্দন জানাতে দেবে না? এ অন্যায়, ঘোর অন্যায়! আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বিদেশী চক্রান্ত সফল হতে দেব না। কালো হাত গুড়িয়ে দাও। 

সহায়ক লিংক:
১. প্রথম আলোর প্রতিবেদন: http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=1&date=2010-05-26 
২. ডয়েচে ভেলেকে দেয়া মুসার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদন:
-->http://www.dw-world.de/dw/article/0,,5605963,00.html 
৩. আনিসুল হক, একজন আদর্শ সাহিত্যিক: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_07.html 
৪. রেডিও ডয়েচে ভেলেকে দেয়া মুসার সাক্ষাৎকার: http://www.dw-world.de/popups/popup_single_mediaplayer/0,,5605930_type_audio_struct_11977_contentId_5605963,00.html 
 ৫. রেডিও বিবিসিকে দেয়া মুসার সাক্ষাৎকার: http://www.bbc.co.uk/bengali/news/2010/05/100525_mb_musaeverest.shtml

Wednesday, May 26, 2010

স্বপ্ন: বৃদ্ধাশ্রম


এই মানুষটার একদা স্বামী-সন্তান সবই ছিল। স্বামী খুব একটা স্বচ্ছল না হলেও অন্তত কারও কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে খেতে হয়নি। যতদিন বেঁচে ছিলেন মর্যাদার সঙ্গেই জীবন-যাপন করেছেন। স্বামী নামের মানুষটার মৃত্যুর পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। দিনে দিনে এই মহিলা কষ্ট করে তাঁর সন্তানদের বড়ো করেন।

আজ তাঁর সন্তানরা তাঁকে খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা দূরের কথা, বাড়িতে রাখতেও আগ্রহী না। তবুও এই মহিলা ছেলে নাতির টানে বারবার এদের কাছে ফিরে যান।
তাঁর ছেলের বউরা তাঁকে মারে, তাঁর নাতিরা তাঁকে মারে। এটা যখন আমার কাছে বর্ণনা করছিলেন, আমি খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।

আমি কেবল নিজের কথা ভাবি, আজ আমার যে সন্তানদের জন্য আমি যে ভারী ব্যাকুল; এরা ঠিক এমনটাই আমার সঙ্গে করলে আমি কোথায় যাব, কার কাছে যাব? কাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক হালকা করব?
আমার চোখে জল- এই মহিলার জন্য না, নিজের জন্য। আমি জলভরা চোখে অভিশাপ দেই, আমার সন্তানও যদি এই মহিলার সন্তানদের মত হয় তাহলে তাদের আর বড়ো হওয়ার প্রয়োজন নাই। আজই যেন তাদের মৃত্যু হয়।

আমি কেবল ভাবছিলাম, একজন মানুষ সীমাহীন দূর্নীতি করে বিপুল অর্থ রেখে যায়, কার জন্য, কেন? তার সন্তানদের জন্য? তার সন্তান ভোগ করল কিন্তু ওই মানুষটার কী লাভ?

এখন এই মানুষটার থাকার নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। পথে পথে ঘুরে বেড়ান, ভিক্ষা করেন। এই মহিলার ছবি উঠাতে আমার কেন যেন ইচ্ছা করছিল না। ঘোলাটে তাঁর চোখ কিন্তু কী তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি! এই চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা কই আমার! আমি তো আর পেশাদার আলোকচিত্রি নই। তাঁর চোখ বাঁচিয়ে চুপিসারে ছবি তুলি।

কিছু অনাবশ্যক কাজে জড়িয়ে অনেকটা সময় নষ্ট হলো। আজ থেকে ভারমুক্ত। আমাকে কার প্রয়োজন তারচেয়ে জরুরী হলো এই মহিলাকে আমার প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে, পছন্দসই বাসা খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও। 

স্বপ্নের কারখানায় [১] আমি উল্লেখ করেছিলাম, শিশু আশ্রম দাঁড় করাবার পর বৃদ্ধাশ্রম করব। আজ আমি আমার মত খানিকটা পরিবর্তন করি। করলে একসাথেই করব। একটা দাঁড় করিয়ে আরেকটা করার জন্য অপেক্ষা করার সময় কোথায়? কে দেখেছে নেক্সট সামার, কে দেখেছে নেক্সট উইন্টার...!

*স্বপ্ন: http://tinyurl.com/3y7bpz3 

সহায়ক লিংক: 
১. স্বপ্নের কারখানা: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_16.html 

 

Tuesday, May 25, 2010

আপডেট: স্বপ্ন, কেস স্টাডি, দুই


এই পরিবারটির যে স্বপ্ন ছিল একটি সেলাই মেশিনের, এই সমস্যার সমাধান হয়েছে। 

আর্থিক সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, "পড়শী ফাউন্ডেশন"। পড়শী ফাউন্ডেশনের জন্য রইল আমার সীমাহীন কৃতজ্ঞতা, যারা একটি পরিবারের স্বপ্নকে, অদেখা স্বপ্নকে, বাস্তবে রূপান্তরিত করতে আমাকে সহায়তা করেছেন।
এই পরিবারে মা এবং ছেলে হেলাল অসুস্থ। শুক্রবারে ঢাকা থেকে ডাক্তার নামের যে মানুষটা [১] এখানে আসেন, তিনি এদের চিকিৎসা করবেন বলে আমাকে কথা দিয়েছেন। তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা।

*স্বপ্ন: http://tinyurl.com/3y7bpz3 
** স্বপ্ন, কেস স্টাডি, দুই: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_9886.html 

সহায়ক লিংক:
১. ডাক্তার নামের মানুষটা: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_06.html

Monday, May 24, 2010

স্বপ্ন, কেস স্টাডি: ২


মাটির এই ছোট্ট ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই ছোট্ট পরিবারটির গল্প খুব সাধারণ। পরিবারটির কর্তা, বাবা ছিলেন স্বচ্ছল একজন মানুষ। এলাকায় ছিল যথেষ্ঠ পরিচিতি। তিনি মারা যান প্রায় ২০ বছর পূর্বে। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন আমাদের মতই কিন্তু তার সন্তানরা "ঈশ্বরের বিশেষ সন্তান" [৩]

এক ছেলে, হেলাল এবং দুই মেয়ে, রানী এবং তাখমিনা। এঁরা তিন জনই কানে শুনতে পায় না, কথা বলতে পারে না

এই পরিবারটির মা হোসনা বেগম এতদিন এই সংসারটাকে টেনে টেনে নিয়ে গেছেন, লোকজনের বাড়িতে কাজ করে। এখন শ্বাসকষ্ট এবং বিভিন্ন রোগে তিনি কাবু। এখন আর মানুষের বাসায়ও কাজ করা সম্ভব হয় না। ছেলে হেলাল টুকটাক কাজ করত কিন্তু এখন সেও অসুস্থ।

তাহলে পরিবারটির চাকা চলছে কেমন করে? এটার স্পষ্ট উত্তর কেউ দিতে পারেননি, এরাও না!

পাশের বাসার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যেটা জানলাম, ছোট মেয়েটি (রানী) চমৎকার হাতের কাজ করে, সেলাই করতে পারে। জামার একটা নমুনা দেখেই আমার মনে হয়েছে, চমৎকার হাতের কাজ, সেলাই জানে সে!

আমি অনেক ভেবে দেখলাম, এই পরিবারটির একটা সেলাই মেশিনের বড়ো প্রয়োজন। ছোট্ট মেয়েটি, রানি (বাম থেকে দ্বিতীয়) - ও একাই টেনে নিয়ে যেতে পারবে এই নড়বড়ে সংসার নামের চাকাটাকে।

এদের কাছে একটা সেলাই-মেশিন, একটা স্বপ্নের নাম। অদেখা এক স্বপ্ন!

*এই পরিবারটির খোঁজ আমায় দিয়েছেন দুলাল ঘোষ। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। 

**আপডেট: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_25.html

সহায়ক লিংক:
১. স্বপ্নের কারখানা: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_16.html
২. স্বপ্ন, কেস স্টাডি ১: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_17.html
৩. ঈশ্বরের বিশেষ সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_03.html
**স্বপ্ন: http://tinyurl.com/3y7bpz3

ধন্যবাদ, সি-নিউজ


সাক্ষাৎকার নামে যে জিনিসটা চালু আছে এটা নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের অনীহা কাজ করে। কারণ আমি মনে করি, লেখালেখি ভুবনের একজন মানুষের আলাদা করে বলার মত তেমন কিছু থাকে না কারণ ওই মানুষটা যা বলার তা তার লেখার মাধ্যমেই বলার চেষ্টা করেন। 
আর এমন একজন মানুষ যে প্রতিদিনই হাবিজাবি কিছু-না-কিছু লেখে তার আবার আলাদা করে বলার কী থাকে!

সাক্ষাৎকার নামের জিনিসটা হচ্ছে স্টারদের জন্য। যারা একটা বিজ্ঞাপন করে স্টার হয়ে যান। তারা কি কি দিয়ে ভাত খান, কেমন কাপড় পরেন, কেমন করে বেড়ালের মত করে হাঁটেন এই সব পাবলিককে ঘটা করে জানানো হয়। পাবলিক এটা দেদারসে খায়, কপকপ করে। 
কোথাকার কোন অখ্যাত লেখক, তাঁর সাক্ষাৎকার ছাপতে কারো বয়েই গেছে [১]! এই সব অখ্যাত লেখকদের বইয়ের বিজ্ঞাপনও পত্রিকায় যায় না। কোন প্রকাশকের দায় পড়েছে তার বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপাবার? তিনি তো জনপ্রিয় কোন লেখক না [২]

সাক্ষাৎকার জিনিসটার প্রতি  অনীহার পাশাপাশি আমি আতংকের চোখে দেখা শুরু করলাম, কারণ যা বলা হচ্ছে তা ছাপার হচ্ছে না। তারচেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে, যা বলা হচ্ছে না তাও ছাপা হচ্ছে [৩]। কী ভয়ংকর!

নুরুন্নবী হাসিব যখন বললেন তখন আমি খানিকটা চাপে পড়ে গেলাম। কারণ এই মানুষটার প্রতি আমার আলাদা সমীহ আছে। এই মানুষটার আছে ভুল করে ভুল স্বীকার করার সৎসাহস। এমন একজন মানুষকে সমীহ না করে উপায় কী!

তারপরও আমি বললাম, ভাইরে, আমি তো সাক্ষাৎকার বিষয়টা ভালো বুঝি না। 
তিনি বললেন, কোন সমস্যা নাই, আপনি আপনার মতো করে বলবেন।
এবার আমি খানিকটা আগ্রহী হই, আমি যা বলতে চাই তা বলতে পারব, আপনি ছাপাতে পারবেন?
বলতে পারবেন সমস্যা নাই।
ভেবে দেখেন। পরে আবার আমার বলা কথা উধাও করে না দেন। ভেবে দেখেন, আমার কোন বক্তব্যে যদি আপনার আপত্তি থাকলে আগেই বলবেন। আপনার কথায় যুক্তি থাকলে আমি আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করব।

তিনি সানন্দে রাজি হলেন। এবং কোন আপত্তি উত্থাপন করলেন না। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে থাকি। না জানি এবার কোন নমুনা দেখতে পাই। আমি "সি-নিউজ" নামের এই ম্যাগাজিনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এই কারণে না যে, এরা আমার সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছেন। এই কারণে, আমার বক্তব্য অবিকৃত ছাপার সাহস দেখিয়েছেন। সাহস দেখিয়েছে এটা বলার যথার্থ কারণ আছে।

প্রিন্ট মিডিয়া নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য ছিল। আমি অনেক জায়গায় এটা বলেছি, অন-লাইনে লেখালেখি যারা করেন তাঁদের প্রতি প্রিন্ট মিডিয়া কখনই সুবিচার করেনি কিন্তু যখনই প্রয়োজন পড়েছে তখনই চোরের মত এখান থেকে নিয়ে গেছে, যা খুশী। ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করেনি। অন-লাইনের ব্লগার নামের লেখকদের প্রতি এদের আছে সীমাহীন তাচ্ছিল্য।

আমার বক্তব্যটা ছিল, "...আমি ডয়েচে ভেলের কাছে নতজানু হই আমাকে এই সম্মানটা দেয়ার কারণে না। ডয়েচে ভেলে এদের (প্রিন্ট মিডিয়া) এই তাচ্ছিল্যের মুখে সজোরে একটা চপেটাঘাত করেছে। থাপ্পড়ের এই শব্দটা আমি স্পষ্ট শুনতে পাই...।"

এটা "সি-নিউজ" নামের এই প্রিন্ট মিডিয়া হুবহু ছাপিয়েছে বলে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। সত্যর মুখোমুখি হবার সাহস সবার থাকে না, কারও কারও থাকে। "সি নিউজ" তাদের একজন।
আমি আমার একটা পোস্টে স্পষ্ট করে লিখেছিলাম, একটি দৈনিকের মালিক এবং সম্পাদককে আমি নীতিগত কারণে পছন্দ করি না। ব্যস, স্যারদের বড়ো নাগ (!) হলো। বেচারারা ববস-এর খবরই ছাপায়নি কারণ তাহলে আমার নাম যে চলে আসে। হা হা হা। কী ছেলেমানুষী!

অন্য একটা দৈনিক আমার বিরুদ্ধে তাদের পোষা বাহিনী লেলিয়ে দিল। কেন? কারণ তাদের পক্ষে চমৎকার চমৎকার লেখা না লিখে কঠিন-কঠিন লেখা লিখেছিলাম। এই সব বালক কবে বড়ো হবে [৪]?

আমি বিস্মিত হই, অনেকে কেন এটা বুঝতে পারছেন না, আমার এই লড়াইটা আমার নিজের জন্য না। এই সব করে প্রকারান্তরে আমি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, প্রিন্ট মিডিয়ার চক্ষুশূল হচ্ছি। কারণ আমি নিজেও তো প্রিন্ট মিডিয়ার লোক। আগামী বছর হয়তো আমার বই বের হলো না- প্রকাশক সাহেব রেগেমেগে বললেন, যান মিয়া, আপনার বইই আর ছাপব না। আমাদের নিয়ে কী সব ছাতাফাতা উল্টাপাল্টা লেখেন। তখন আমার গতি কী!

একটা মজার বিষয় লক্ষ করলাম, অনলাইনের একজন সহযোদ্ধা (যদিও তিনি এলিট গোত্রের লোক) তাকে খানিকটা অন্য রকম মনে হতো। তিনি একটা ডকুমেন্টারি নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে লম্বা-লম্বা কাহিনী লিখলেন, এটা জার্মানীতে একটা সম্মান বয়ে এনেছে। 
বেশ, তার উল্লাসে আমিও উল্লসিত হই। কিন্তু তিনি আমার বেলায় একটা শব্দও ব্যয় করেননি। অভিনন্দন-এর 'অ' অক্ষরও না! কারণ কি এটা, আমি এলিট গ্রুপের সদস্য না। এই সব মানুষগুলোর জন্য আমার করুণা হয়।

এরা কেন বুঝতে চান না, যখন বাংলাদেশের কথা আসবে তখন কে ব্রাক্ষণ, কে শূদ্র এটা আলোচ্য বিষয় না। এখানে প্রয়োজন হাতের সবগুলো আঙ্গুলকে গুটিয়ে মুঠি শক্ত করে রাখা। চেইনের সবগুলো আংটাকে একত্রিত করে রাখা।
আফসোস, কেন এরা কেবল এটা আমার বিজয় দেখছেন। আমি বিশ্বাস করি এবং এখানে আমি যেটা বলেছি: "...এবং আমি মনে করি, এটা ব্লগার নামের লেখকদের একটা বিজয়, অভূতপূর্ব ঘটনা। আমার সহযোদ্ধাদের এই বিজয়ের মিছিলে আমি সামান্য একজন মাত্র। আমি গর্বিত আমার সহযোদ্ধাদের পাশে থাকতে পেরে...।"

আমি জানি না কেন, এই দেশের জাত-লেখকদের পাশে থাকার চেয়ে আমি অনেক আরাম বোধ করি ব্লগার নামের লেখকদের সঙ্গে থাকতে পেরে। হয়তো এই কারণে, জাত-লেখকদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। অনেক বড়ো লেখক হওয়ার স্বপ্ন থাকে। প্রয়োজনে শাহআলমের কালের কন্ঠে [৫] বা গোলাম আজমের 'মুড়ির ঘন্ট'-এ লেখার চাপও থাকে- গলা দিয়ে আওয়াজহ বের হয় না, নীচের অংশ ঢিলা হয়ে যায়। এখানে এতো হ্যাপা নেই- চোখে চোখ রেখে উচ্চারণ করা যায় অমোঘ সত্যটা।

সহায়ক লিংক:
১. কলম নামের মারণাস্ত্র: http://www.ali-mahmed.com/2008/08/blog-post_15.html 
২. বইয়ের বিজ্ঞাপন: http://www.ali-mahmed.com/2009/03/blog-post_21.html
৩. অশ্বডিম্ব: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_05.html 
৪. বালক-বালক খেলা: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_22.html
৫. মুড়ির ঘন্ট: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_16.html

Sunday, May 23, 2010

কয়েদী: রেল-বাড়ি: ২

উপবন ট্রেনটা সিলেট স্টেশন থেকে ছেড়েছিল কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। ভোর পাঁচটার দিকে ঢাকা পৌঁছার কথা। ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিল। আখাউড়া জংশন পৌঁছতেই ভোর ছ’টা বেজে গেল। ওদের টিকেট শোভন চেয়ার কোচের কিন্তু বগিগুলো প্রায় ফাঁকা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্টেশনে লোকজন নেমে গেছে। আখাউড়া এসে সেই যে ট্রেন দাঁড়াল আর নড়াচড়া নেই।

সাকিব শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। লুবাবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাকিবকে পাঠিয়েছিল স্টেশনে খোঁজ নিয়ে আসতে। সাকিব ফিরে এসেছিল শুকনো মুখে, চোখে ভীত দৃষ্টি।
লুবাবা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, জিজ্ঞেস করলে ট্রেন ছাড়ছে না কেন, হরতাল তো শুরু হয়ে গেছে।
হুঁ।
আঃ সাকিব, কি হয়েছে বলো!
টঙ্গির কাছে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, ট্রেন আর যাবে না।
ক্কি, কি বলছ এসব!
হুঁ।
ট্রেন টঙ্গি পর্যন্তও যাবে না?
না। ওরা বলছে দু-স্টেশনের মাঝখানে আটকা পড়লে নিরাপত্তার সমস্যা হবে।


লুবাবার মত শক্ত মেয়েও ভেঙে পড়ল। হায় হায় এখন কি হবে? ট্রেনের গার্ড এসে বলল, সার, আপনাদের তো নেমে যেতে হবে।
সাকিব অবাক হল: কেন নামব কেন?
ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে তালা মারতে হবে। এভাবে খোলা রাখলে ট্রেনটার তো লোকাল ট্রেন থেকেও খারাপ অবস্থা হবে। সিট-ফিট সব খুলে নিয়ে যাবে।
সাবিক চেঁচিয়ে উঠেছিল: পেয়েছেন কি আপনারা, মগের মুল্লুক, সময়মত ট্রেন পৌঁছাতে পারেন না আর এখন বলছেন নেমে যেতে হবে। হোয়াই, কি করবেন, জোর করে নামিয়ে দেবেন? নামান তো দেখি, ইয়েস-ইয়েস। টাচ মি, টাচ মি নাউ। গায়ে হাত দিয়ে দেখুন, দিন না, দিন না গায়ে হাত।


লুবাবা জোর করে সাকিবকে বসিয়ে দিল। নরোম গলায় বলল: গার্ড সাহেব, প্লিজ ওর আচরণে কিছু মনে করবেন না, ওর মার খুব অসুখ। খবর পেয়ে আমরা ঢাকা যাচ্ছিলাম। প্লিজ, গার্ড সাহেব, প্লিজ, আপনিই দয়া করে বলুন আমরা এখন কি করব?
গার্ড সাহেব আর্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। অল্পক্ষণ ভেবে বললেন: আমার ক্ষমতায় থাকলে আপনাদেরকে ঢাকায় পৌঁছে দিলাম কিন্তু আমি নিরুপায়, সে উপায় নেই। আপনাদের কোথায় যে থাকার ব্যবস্থা করি? আমি তো থাকব রানিং রুমে। পুরুষ হলে সমস্যা ছিল না আপনাকে নিয়েই সমস্যা।
লুবাবা বলল: এখানে ভাল হোটেল আছে না?


গার্ড সাহেব একজনকে হোটেলের খোঁজে পাঠালেন। সে ফিরে এলে জানা গেল আজেবাজে ধরনের যে দু-একটা হোটেল আছে ওগুলোতেও জায়গা নেই। গার্ড সাহেব প্রচুর ছুটাছুটি করেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। দেখে লুবাবার মায়াই হচ্ছিল। শেষ পর্যায়ে গার্ড সাহেব করুণ গলায় বললেন: আফসোস, আপনাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।
লুবাবা ইতস্তত করে বলল: ভাই, আমরা এই রেলের কামরায় থাকলে আপনার কি খুব সমস্যা হবে?
গার্ড সাহেব গর্জে উঠলেন: হলে হবে, কি আর হবে ঘোড়ার ডিম, বেশি-বেশি চাকরি চলে যাবে। আপনারা এক কাজ করেন, এই কামরায় না থেকে প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং কোচে চলে যান। আরামে থাকবেন এবং ওই কামরা এটার চেয়ে সেফ। ট্রেনের দরজা জানালা আমি বন্ধ করিয়ে দিচ্ছি।


এবার সাকিবের দিকে ফিরে বললেন: একটা চাবি আপনাকে দিয়ে যাব ডাইনিং কার দিয়ে আপনি খুলে ঢুকতে এবং বেরুতে পারবেন। অন্য দিক থেকে বের হলে লোকজন কৌতুহলী হবে। এমনিতে কোনো সমস্যা নেই তবুও সতর্ক থাকা উচিত। শক্ত হন, সাহস হারাবেন না। কোন-না-কোন একটা রাস্তা বেরুবে। সুযোগ করে আমি আপনাদের খোঁজ-খবর নেব। অন্য কোনও ব্যবস্থা হলে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেব। রাফার চিবুক নেড়ে খুব আদর করে বললেন: খুকি, এখন গোটা বাড়িটা তোমার। যাও, তোমাকে দিয়ে দিলাম, হা হা হা।

দু-দিন ধরে এই রেলের বগিটাই ওদের থাকার জায়গা। মাঝে-মাঝে সাকিবের দমবন্ধ হয়ে আসে, মনে হয় শ্বাস নিতে পারছে না। আজ সকালেও যখন সিগারেট খাচ্ছিল, তখন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সিগারেটের ছাইগুলো বাম হাতের তালুতে জমাচ্ছিল। কেউ হঠাৎ করে দেখলে ভাববে হয়তো মেঝে অপরিস্কার হবে এ কারণে মেঝেতে ফেলছে না। 
আসল ঘটনা হচ্ছে, পেস্ট নেই, দাঁত মাজা যাচ্ছে না। ছাই দিয়ে দাঁত ঘসালে অনেকখানি পরিস্কার হয়। লুবাবাকে অনেক বলে-কয়েও সিগারেটের ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে রাজি করানো যায়নি। ওর নাকি বমি আসে। আজ ডাইনিং কারের লোকজন কাউকে টাকা দিয়ে বলতে হবে, একটা পেস্ট কিনে নিয়ে আসার জন্য।
সাকিব দাঁত ঘসাচ্ছে, দরদর করে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ে ছাই পানিতে মাখামাখি। রায়হান পরিষ্কার করে কিছু বলল না, মা কি গুরুতর অসুস্থ, নাকি...? মাকে কি শেষ দেখাটা দেখা যাবে না। অ আল্লা-অ আল্লা, এই শাস্তিটা আমাকে দিও না, আল্লা।

গার্ড সাহেব তার সাধ্যাতীত করার চেষ্টা করেছেন। ডাইনিং কারের লোকজনরা নিজেদের জন্য রান্না করবে। ওদের জন্যও তিনবেলা রান্নার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। ডাইনিং কারের লোকদের খাবারের দাম দেয়া যাচ্ছে না। গার্ড সাহেব নাকি পইপই করে নিষেধ করে গেছেন, খাবারের দাম ওঁর নামে লেখা হবে। 
পরদিন গার্ডসাহেব খোঁজ নিতে এসেছিলেন, সাকিব টাকার প্রসঙ্গ উঠাতেই গার্ড সাহেব হা হা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন: আরে ভাই, সময় হোক দেখবেন জোঁকের মত লেগে টাকা আদায় করব।
আজ সকালেও এই প্রসঙ্গ নিয়ে সাকিব জোরাজুরি করলে গার্ড সাহেব মন খারাপ করা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেনন, আজ এখানে আমার বাসা থাকলে, তখনও কি আপনারা আমার বাসা থেকে যাওয়ার সময়ও খাবারের দামটা দিয়ে যেতেন।


এরপর সাকিব একটা টুঁ-শব্দও করেনি। হাত বাড়িয়ে এই ভাল-মানুষটাকে হাত ধরে ছলছল চোখে কেবল বলেছিল: জানেন আমার মা না মারা যাচ্ছে। আমি মার কুসন্তান তো তাই মা চাচ্ছে না তাঁকে শেষ দেখাটা দেখি।

*রেল-বাড়ি, ১:http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_7540.html 

আমি কোথাও লিখেছিলাম, "ফিকশনের জন্ম রিপোর্টিং-এর গর্ভে"। 
সালটা আমার মনে নেই। তখন পরিবহণ ধর্মঘটের নামে সম্ভবত টানা ২২ দিন হরতাল চলছিল। ছোট্ট একটা রেল-স্টেশনে একটা পরিবার আটকা পড়েছিলেন, বাচ্চাসহ। এঁরা ২দিন রেলের একটা কামরায় আটকে ছিলেন। আমি যখন এটা শুনি, তখন আর এঁদের গিয়ে পাইনি। কেউ তেমন ভালো খোঁজ-খবর দিতে পারল না, এরা কেমন করে, কোথায় গেলেন। আমাদের এতো সময় কোথায়। বড়ো কষ্ট হচ্ছিল তখন- গোটা এলাকায় হাজার-হাজার মানুষ কিন্তু আমার নিজেকেই কেন যেন নগ্ন মনে হচ্ছিল
আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, ওই পরিবারটির অনুভূতির কথা জানা- কেবল চোখ বন্ধ করে খানিকটা ভাবার চেষ্টা করা।

২৭ জুন হরতাল ডাকা হয়েছে। আমি আরেকটা "রেল-বাড়ি" দেখতে চাই না। আগের পোস্টে বিস্তারিত বলেছি, চর্বিতচর্বণ আর করি না। গণতন্ত্রের লেবেনচুষ: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_22.html 

এক কথায় বলি, আপনাদের হরতাল আমি মানি না। আমাকে কয়েদী বানাবার অধিকার আপনাদেরকে দেই না। 

Saturday, May 22, 2010

কয়েদী: রেল-বাড়ি: ১

(শুরু হলো এক অন্য রকম দিন! যথারীতি আজও সূর্য উঠেছে। ঝকঝকে গাঢ় একটা নীল আকাশ। আজ ৫৬ হাজার বর্গমাইল নামের এই গ্রহের সবচেয়ে বড়ো কারাগারে আটকা পড়েছে, সাকিব-লুবাবা-রাফা নামের তিনজন মানুষ। অন্য ১৫ কোটি কয়েদীর সঙ্গে। একটা রেলগাড়িতে।
আটকা পড়ে আছে সাকিবের মার দুর্বল হৃদপিন্ড, যেটা এখনো চলছে ধুকধুক করে, প্রিয় মানুষের অপেক্ষায়। প্রিয় মানুষের স্পর্শ কী মৃত্যুযন্ত্রণা কমিয়ে দেয়? কে জানে, হয়তো দেয়, হয়তো দেয় না। জানা নেই।)

‘বাবা- বাবা, এটাই কি আমাদের দাদাবাড়ি?’
‘না’, সাকিব অসংখ্যবার এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। ওর এই মেয়ে এমন অবুঝ হয়েছে কেন? অবশ্য এর বয়সই বা-কি, পাঁচ শুরু হল।
‘বাবা-বাবা, ও বাবা, ঠিক করে বলোই না ছাই, এটাই কি আমাদের দাদাবাড়ি না?’
সাকিব ধমক দিতে গিয়েও সামলে নিল, ‘বললাম তো মা এটা আমাদের দাদাবাড়ি না, তোমাকে তো আগেও অনেকবার বলেছি, বলিনি?’
রাফা ওর রেশমের মতো চুল নাড়িয়ে বলল, ‘হুঁ-উ।’
‘এই তো লক্ষ্মী মেয়ে, যাও খেলা কোরো গে।’


রাফা খানিকক্ষণ লক্ষ্মী মেয়ের মতো নিজে নিজে খেলল।
‘বাবা-বাবা, ও বাবা।’
‘আবার কি মা!’
‘এটা তাহলে কাদের বাড়ি? আমরা কি এখানে বেড়াতে এসেছি?’
‘রাফা বকবক করো না তো, চড় খাবে।’


এমন শক্ত কথায় কাজ হল না। রাফা বাবার মার দেওয়ার ব্যাপারটা এখনও দেখেনি, মা হলে অন্যকথা। রাফা সাকিবের গলা ধরে ঝুলে পড়ল, ‘বলতে হবে-বলতে হবে, এটা কাদের বাড়ি?'
‘এটা সরকারের বাড়ি, রেলবাড়ি, হলো তো।’
‘রেলবাড়ি কি, বাবা?’
‘রেলগাড়িই রেলবাড়ি, খবরদার আর একটা কথা না।’
‘আচ্ছা বাবা।’
‘রাফা, আর একটা কথাও না, লুবাবা প্লিজ রাফাকে সামলাও তো বড্ড বিরক্ত করছে। শেষে মেরে-টেরে বসব।’


লুবাবা পুরনো একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। শঙ্কিত দৃষ্টিতে সাকিবের দিকে তাকিয়ে ছোঁ মেরে রাফাকে একেবারে বুকের মাঝে নিয়ে এল। সাকিবকে কেমন উম্মাদ-উম্মাদ মনে হচ্ছে। মুখে ক-দিনের না-কামানো দাড়ি, টকটকে লাল চোখ, এই ক-দিন সম্ভবত চুলে চিরুনিও পড়েনি। সাকিব যখন খুব রেগে থাকে তখনই ওকে লুবাবা ডাকে নয়তো সুর করে বলে বাবা-লু-লু-লু। লুবাবা প্রথম প্রথম রাগ করে বলেছিল: খবরদার নাম নিয়ে ফাজলামো করবে না।
বেশ, তুমি আমায় বলো কোন শালা লুবাবা নাম রাখে।
লুবাবা রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিল। সাকিব সমস্তটা দিন রাগ ভাঙাতে পারেনি অবশেষে রাতে-। 

সাকিব নরোম গলায় বলেছিল: পাগল নাকি, ঠাট্টা করলাম আর তুমি কি-না!
লুবাবার গলাও নরোম: কেন তুমি এমন রসিকতা করবে। তুমি তো খোকা না, জানো না নাম-ধাম রাখে গুরুজন। তোমার কি একেবারেই লঘুগুরুজ্ঞান নেই।
সাকিব হাসতে হাসতে বলেছিল: আমি খোকাই তো, এই দেখ খোকার গায়ে কোন কাপড় নাই।
ছি!
ছি কেন, খোকার গায়ে কাপড় নেই এটা বললে, ‘নজ‌-জা’ আর খোকার সঙ্গে ওইসব-।
লুবাবা সাকিবের মুখ চেপে ধরেছিল। অন্যভাবে ওকে থামানো যেত না।


এখন রাফা দুহাতে মাকে জাপটে ধরে আছে। বাবার কাছ থেকে মার ওকে সরিয়ে নেয়ার ভঙ্গি দেখে রাফা তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝতে পারছে কোন একটা সমস্যা আছে। রাফা সর্বক্ষণ মাকে লক্ষ করে। মা হাসি-হাসি মুখ করে থাকলে তার আনন্দ হয়। মা মুখ অন্ধকার করে রাখলে ওর কিচ্ছু ভাল লাগে না, এমনকি কাঁদতেও না। মার শরীরে যেমন একটা মা-মা গন্ধ বাবার ঠিক উল্টোটা। বাবার শরীরে সবসময় সিগারেটের বিশ্রি গন্ধ। ওয়াক! 
বাবা বাবাই, অন্য কিছু কখনো মনে হয়নি। তবে বাবার সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করে। বাবাও তো ওর সঙ্গে বকবক করে বিরক্ত করে ফেলে কিন্তু আজ যে বাবা এমন করল? 
লুবাবা সহজ গলায় বলল, ‘সাকিব, রাফাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।’
সাকিব চেঁচিয়ে বলল, ‘বেশ করেছি।’
‘আঃ, চেঁচাচ্ছ কেন?’
‘বেশ করছি।’
‘আঃ সাকিব’।
‘বেশ করছি।’


লুবাবা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, সাকিবের মধ্যে এখন পাগলামীর লক্ষণ স্পষ্ট। কেবলমাত্র পাগল এবং মাতালই ক্রমাগত একই কথা আউড়ে যায়। নাকি সত্যি সত্যি মদ খেয়েছে, তা কি করে সম্ভব? অবশ্য ওরা যেভাবে জীবন যাপন করছে বদ্ধউম্মাদ হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু না। ওরা দু-দিন ধরে যেখানে বাস করছে, এটা আসলে একটা রেলগাড়ির কামরা। চারদিকের জানালা বন্ধ, ফাঁক-ফোকর দিয়ে আলো বাতাস আসে। দিনেই দমবন্ধ হয়ে আসে রাতে তো, লূবাবা খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

সেদিন একনাগাড়ে টেলিফোনের রিং বাজছিল। লুবাবা শাওয়ারের নিচে ভিজতে ভিজতে ভাবছিল কখন রিং থেমে যাবে। নিরুপায় হয়ে প্রায় নগ্ন লুবাবাকে ফোন ধরতে হয়েছিল। রাফা গেছে পাশের বাড়ি। ‘জুলাপাতি’ খেলতে। সাকিব বাসায় থাকলেও ফোন ধরবে না। ও নির্ঘাত ঘুমাচ্ছে। ছুটির দিনে ওর কাজ একটাই মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমানো। ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ছুটির দিনে কেউ বিরক্ত করলে, ঘুম ভাঙিয়ে দিলে তার মৃত্যু অবধারিত। জনে-জনে এটা বলে রেখেছে। টেলিফোনের রিং তো মাছি-মশা, কামান দাগালেও সাকিবের ঘুমের কোন সমস্যা হয় না, লুবাবা রাগ চেপে বলেছিল: হ্যালো।
কে ভাবি, ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এসেছিল।
হুঁ, কে?
ওপাশ থেকে ফোপানোর শব্দ এল: ভাবি, আমি, ভাইয়াকে ফোন দাও, ভাইয়া বাসায় আছে তো?
তুমি কে?
আমি রায়হান।
লুবাবা নাম বলায় চিনতে পারল। রায়হান ওর দেবর। আশ্চর্য ওর গলা শুনে একদম বুঝতে পারছিল না।
হ্যালো ভাবি, হ্যালো শুনতে পাচ্ছ না, ভাইয়া কি বাসায় নেই?
আছে, সমস্যাটা কি আমাকে বলো?
তুমি ভাইয়াকে দাও।
শোনো রায়হান, ও ঘুমাচ্ছে। ওকে এখন ডেকে তোলা যাবে না। আর এক্ষণ ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিলে কি অনর্থ করবে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
প্লিজ ভাবি, প্লিজ।
লুবাবা এবার রাগ করে বলল, সমস্যাটা আমাকে বলতে অসুবিধা আছে?
ভাবি, তুমি ভাইয়াকে বল মা কথা বলতে চান।


লুবাবার গা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে তবুও ঘেমে গোসল হয়ে গেল। অবশেষে সাকিব দয়া করে সিকিভাগ চোখ খুলে পাশ ফিরে বলল, এখন না রাতে।
লুবাবা ভাবল ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকছে। গা ধরে এবার ঝাঁকাতেই সাকিব বলল: তুমি নিমফোম্যানিয়াক নাকি!
সাকিবের কথার অর্থ এতক্ষণে বুঝল। কী লজ্জা-কী লজ্জা! পাশাপাশি রাগে গা জ্বলে গেল। ওর এখন ইচ্ছা হয়ে থাকলেও নিমফোম্যানিয়াক হয়ে গেল, বাহ! অথচ সাকিব যখন খুশি যেভাবে খুশি-।
লুবাবা হিসহিস করে বলল: আমি তোমার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করতে আসিনি। তোমার মা টেলিফোনে কথা বলতে চাচ্ছেন।


সাকিব যে ভঙ্গিতে ছুটে ফোন ধরল এই গতির সঙ্গে কেবল তুলনা চলে সপাং করে পড়া একটা চাবুকের সঙ্গে।
সাকিব টেলিফোন ধরেই ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, হ্যালো মা।
ভাইয়া-ভাইয়া, হ্যালো ভাইয়া।
ও রায়হান তুই, ফোন দে মাকে।
এরপর রায়হান কি সব বলছিল সাকিব গুছিয়ে কিছুই বুঝতে পারছিল না। রায়হান কথা বলতে গুলিয়ে ফেলছে কেন, গাধা নাকি!
সাকিব চেঁচাচ্ছিল: রায়হান পরিষ্কার করে বল কি হয়েছে! আগের মত উল্টাপাল্টা বলে দেখ, এমন মার দেব জনমের মত টেলিফোন করা ভুলিয়ে দেব।
রায়হান থেমে থেমে বলেছিল: ভাইয়া, তোরা চলে আয়, মার অসুখ। মা-মা, মা, তোদের দেখতে চেয়েছে।
আবার বল।


সাকিব এবার রিসিভার কানে চেপে গভীর মনোযোগ নিয়ে মোনার চেষ্টা করছিল। রায়হান হুবহু আগের বলা কথাগুল্ই আউড়ে গেল। সাকিবের পায়ে জোর নেই। ভাঙা গলায় বলল: কাল থেকে হরতাল শুরু হচ্ছে এটা জেনেও বলছিস চলে আসতে?
ওপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই লাইন কেটে গেল নাকি, রায়হান কি ফোন রেখে দিল!
হ্যালো রায়হান, হ্যালো।
হ্যা ভাইয়া, চলে আয়।


লুবাবা গা মুছে ফিরে এসে ভারী অবাক হয়েছিল। সাকিব রিসিভার হাতে ঠায় বসে আছে। অভিমান ভুলে ছুটে এসে সাকিবকে ধরে অবাক হয়ে বলেছিল: কি হয়েছে?
সাকিব শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মা, আমার মা মারা যাচ্ছে।

*রেল-বাড়ি, ২: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_23.html

সহায়ক লিংক:
কয়েদী, ৪: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_22.html