এমনিতে একটা শিশু সারাটা দিন বকে মরে কিন্তু কেউ যখন বলে, ‘বাবু, এটা বলো তো’। বাবু চুপ। মুখে রা নেই!
আমার অবস্থাটাও তেমনই। মন বসে গেলে আমি তর তর করে লিখে যেতে পারি
কিন্তু যেই-মাত্র কেউ বলল, ‘এটা নিয়েেএকটু লেখেন তো’। ব্যস, কলম হালের কী-বোর্ড চিবিয়ে ফেললেও একটা অক্ষরও বের হয় না, দুম
করে কামান দেগে
দিলেও! কী আর করা,
এই গুণ আমার নেই! তাই বলে তো আর বেচারা আমাকে ইলেকট্রিক পোলে ঝুলিয়ে দেওয়া চলে না।
এই নিয়ে অনেকে অহেতুক আমার উপর রাগ করে থাকেন।
এখানে ব্যতিক্রম হলো। এমন একজন অনুরোধ করেছিলেন যিনি হচ্ছেন সেই
মানুষ- আমাকে এই গ্রহে যে অল্প কিছু মানুষ বিচিত্র কারণে পছন্দ করে তিনি তাদের একজন। তাছাড়া
বিষয়টা আমাকে অসম্ভব আগ্রহীও করে তুলেছিল।
তিনি যে প্রসঙ্গটা বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে রওশন আরা নামের একজন বুকে
মাইন বেঁধে পাকিস্তানি ট্যাংক উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে নিজেও নিশ্চিহ্ণ হয় যান।
এই বিষয়ে আমার কিছুই জানা ছিল না। খোঁজ করতে গিয়ে যে তথ্যগুলো পেলাম বিভিন্ন
পত্রিকা এবং ওয়েবসাইটের কল্যাণে তা এমন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা তাঁর বয়স তখন
ছিল ১৭। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বুকে মাইন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি
ট্যাংকের সামনে। মৃত্যু হয়েছিল ১৯ জন পাকিস্তানি আর্মির। মুজিব ব্যাটরির পাশাপাশি
আরেকটি ব্যাটরির নাম রাখা হয়েছিল ‘রওশন আরা ব্যাটরি’। রওশন আরার এই
আত্মত্যাগের পর তখন এপার-ওপার বাংলার বিখ্যাত কবিরা কবিতাও লিখেছিলেন, ‘রোশেনারা’, ‘একটি মেয়ের মৃত্যু’।
‘জন্মযুদ্ধ’ নামের ওযেবসাইটে বাড়তি
কিছু তথ্য পেলাম। যেমন বেছে-বেছে সেদিন রওশন আরা সবুজ শাড়ি পরেছিলেন। আবার তাঁর মৃত্যুর
পর রক্তমাখা সবুজ শাড়িটা ট্যাংকের ব্যারেলে আটকে থাকে। সেটা আবার কারও
কারও চোখে বাংলাদেশের পতাকাও হয়ে যায়!
কিন্তু রওশন আরাকে নিয়ে আহমদ ছফা অলাতচক্রে লিখেছিলেন:
“...তারপর থেকে ভারতের পত্র পত্রিকাসমুহ রওশন আরাকে
নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। ...পত্র পত্রিকার প্রচার একটু থিতিয়ে এলেই রওশন আরাকে নিয়ে
কবি মশায়েরা কবিতা লিখতে এলেন। ...কিন্তু আমি বা বিকচ (বিকচ চৌধুরী) ইচ্ছা করলেই
রওশন আরাকে আবার নিরস্তিত্ব করতে পারিনে। আমরা যদি হলফ করেও বলি, না ঘটনাটি সত্য
নয় রওশন আরা বলে কেউ নেই। সবটাই আমাদের কল্পনা- লোকজন আমাদেরকে পাকিস্তানি স্পাই
আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য ছুটে আসবে।...”
(অলাতচক্র। পৃষ্ঠা নং: ১৩৫)
“...তোমার (বিকচ চৌধুরী) গল্প সেই শর্তগুলো পূরণ করেনি। ধরো নাম নির্বাচনের বিষয়টি। তুমি
বলেছ ফুলজান। এই নামটি একেবারেই চলতে পারে না।...সুতরাং একটা যুতসই নাম দাও, যাতে
শুনলে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের ভাব জাগবে। রওশন আরা নামটি মন্দ কী!...।“
(অলাতচক্র। পৃষ্ঠা নং: ১৩৪)
যাই হোক, বিকচ চৌধুরীই রওশন আরাকে নিয়ে তৎকালীন পত্রিকায় প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন।
যেটা ছাপা হওয়ার পর প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেই বিকচ চৌধুরীর কাছ থেকে আমরা
একটু শুনি:
“...একদিন আমার একটি ছোট্ট সংবাদ কাহিনী চারদিকে
রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করল। ঢাকায় ১৭ বছরের এক অসম সাহসী মেয়ে বুকে মাইন বেঁধে পাক ট্যাংক বাহিনীর ১৯
জন খান সেনাকে খতম করে দিয়ছেন। ...দিকে-দিকে গঠিত হয় রওশন আরা ব্রিগেড। আজ
ইতিহাসের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই রনাঙ্গনের প্রচার কৌশলের
অন্যান্য অনেক সংবাদ কাহিনীর মতো রওশন আরার কাহিনীও ছিল প্রতীকী। রওশন আরা নামটি বাংলাদেশের
বন্ধু আহমদ ছফার দেওয়া।“
(সূত্র: ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন এর সভাপতি ড. আবুল
আজাদকে লেখা চিঠি।)
তখন... রওশন আরাকে যে-প্রকারে বিকচ চৌধুরী বা আহমদ
ছফা সৃষ্টি করেছিলেন এতে আমি দোষের কিছু দেখি না। যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল থাকে।
যোদ্ধা বা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত মানুষদের উদ্দীপ্ত করার জন্য এও এক কৌশল।
কিন্তু এখন...। রওশন আরাকে নিয়ে অনেকের লেখা পড়ে
মনে হচ্ছিল এরা নিজেরা অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে যেভাবে লিখেছেন
সত্য যে কেমন করে ফিকশন হয়ে যায় তার এক চমৎকার উদাহরণ। এরা ভুলে যান মুক্তিযুদ্ধ ফিকশন না। এখানে
বানিয়ে-বানিয়ে লেখার কোনও প্রকারের সুযোগ নাই।
তাছাড়া এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল হলে মার্জনা করা চলে
কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্যকে আড়াল করাটা অন্যায়। এক প্রকারের গুরুতর অপরাধ।
...
এবেলা বিকচ চৌধুরীর ঋণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করি। দুলাল ঘোষের
মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কিছু দুর্লভ পত্রিকা এবং বিভিন্ন কাগজপত্র
পেয়েছিলাম। যার কিছু অংশ বিভিন্ন সময়ে লেখায় দিয়েছিলাম।
বিকচ চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল। আফসোস, যাব-যাব করেও
যাওয়া হয়নি আমার। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল আর ভিসার জন্য অমানুষের
মত, অমর্যাদার
সঙ্গে দূতাবাসে দাঁড়াতে আমার ইচ্ছা করে না। পূর্বে দু-বার আমার ভারত যাওয়া পড়ে। অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত।
ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসগুলো একটা কাজ নিয়ম করে করে। সেটা হচ্ছে, অতিথির কাছে
প্রথমেই নিজের দেশকে নগ্ন করে দেওয়া। ফট করে ল্যাংটা হয়ে যাওয়া। সেটা ভারত হোক বা
জার্মানি আচরণ
একই। এ এক চরম অসভ্যতা।
হাতের নাগালে স্ক্যানার নাই। সেল ফোনই ভরসা। ১৯৭১ সালে ‘বাংলার মুখ’ নামের পত্রিকাটি থেকে বিকচ
চৌধুরীকে লেখা চিঠি। মুজিবনগর থেকে বের হওয়া এই পত্রিকাটির তখন দাম ছিল পঁচিশ
পয়সা!
এরা লিখেছে, “...ঢাকার রওশন আরার বুকে মাইন বেঁধে হানাদার বাহিনীর ট্যাংকের
সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া ...”
এরা আবার এক কাঠি সরেস। এরা বিকচ চৌধুরীকে বানিয়ে দেয় বিকাশ চৌধুরী!