Search

Thursday, June 30, 2016

‘কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার’ এবং কতিপয় গা ঘিনঘিনে কৃমি’!

খুন করার ভঙ্গিও আইনের কাছে বিবেচ্য বিষয়। রাগের মাথায় একজন একটা খুন করে করে ফেলল- আইন খানিকটা হলেও নরোম ভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু যে মানুষটা রসিয়ে-রসিয়ে খুন করে তার বেলায় কোনও প্রকারের ছাড় থাকার অবকাশ নাই।
বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে খুন করার পর এক লেখায় লিখেছিলাম [১], "সন্তানের সামনে তার মাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। যে খুনি হচ্ছে চরম কাপুরুষ এবং এই গ্রহের অতি নিকৃষ্ট সৃষ্টি- গা ঘিনঘিনে কৃমির চেয়েও। যে রাজনীতির কৌশল হিসাবে বেছে নিয়েছে একজন নারীকে, একজন মাকে! একটা শিশুর সামনে তার মাকে কোপানো হচ্ছে সেই মাটা পড়ে থাকেন থই থই রক্তের মাঝে…"।

পূর্বে খুব জোর গলায় বলা হচ্ছিল এটা জঙ্গিদের কাজ। আমাদের দেশে এখন এই কাজটা খুবই সোজা একটা মানুষকে মেরে ফেলো তারপর বলে দাও এ জঙ্গি ছিল। ব্যস, মামলা ডিসমিস। এমনিতে খুন হতে দেরি হয় না তদন্ত থাকুক কাজির গোয়ালে; যে-কোনও বিভাগের (তিনি পানি বন্টনের দায়িত্বে নাকি আকাশ তাতে কী আসে যায়) একজন ফস করে বলে বসেন, এটা জঙ্গির কাজ। এরপর আর কথা চলে না কারণ এই বাহাদুরগণ সব জানেন। ইহার পর আর কী- আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলাম, থাকিলাম!

কিন্তু এখানে খানিকটা ব্যতিক্রম ঘটল। দানবের মাঝেও খানিকটা মানবের দেখা মিলল। এই হত্যাকাণ্ডের দায় জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ সাফ অস্বীকার করে যে এই কাপুরুষিত খুন আমাদের না।
যাই হোক, এরপর খুনি সন্দেহে আনোয়ার এবং ওয়াসিম দুজনকে ধরা হয়। এরপরই শুরু হলো ‘হাশ-হাশ’। লুকোচুরি! বাদীর সঙ্গে কথা বলার নিয়ম আছে এই অমায়িক বক্তব্য জেনে আমরা বিমল আনন্দ বোধ করি বটে কিন্তু বাস্তবে যেটা জানা গেল রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে মামলার বাদী এসপি বাবুল আকতারকে পুলিশ নিয়ে গেল। রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ। ‘রাতভর’ মিডিয়ার খুব পছন্দের একটা শব্দ। 'চুতিয়া' মিডিয়া নারীদের প্রতি চরম শারীরিক নির্যাতনের বেলায়ও এটা হামেশা ব্যবহার করে, রাতভর…।

তো, এই কর্মকান্ড চলে ঝাড়া ১৫ ঘন্টা! অবশ্য পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার মিডিয়ার কাছে বলেন, "বাবুল আকতার মামলার বাদী। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁকে আনা হয়েছে…।"
ওহো, এটা তাহলে আলোচনা ছিল! বেশ-বেশ, আলোচনার জন্য গভীর রাত উপযোগীই বটে। তবে এটাকে কেবল আলোচনা বলাটা খানিকটা অমর্যাদার হয়ে উঠে, ‘ম্যারাথন আলোচনা’ বলাটাই সমীচীন- ১৫ মাইলের স্থলে হবে ১৫ ঘন্টা।
ছবি ঋণ: ব্লগার ও এনটিভির সাংবাদিক সন্দীপন বসু
এরিমধ্যে কিছু 'অমায়িক চুতিয়া' টাইপের মিডিয়া বিভিন্ন গল্পগুজব ফেঁদে বসল। এই সমস্ত কৃমি টাইপ নিউজ পোর্টালগুলোর বাইরেও আছে ‘বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর’, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর মত মিডিয়াও। ভাল কথা, মালিকের খুনিপুত্রের সর্বশেষ আপডেট কি?
সেসব অদায়িত্বশীল ছাতাফাতা মিডিয়ার কথা থাকুক। দায়িত্বশীল দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো (২৭ জুন ২০১৬) লিখেছে, "বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ থেকে তারা এমন সব তথ্য পেয়েছেন, যা শুনে নিজেরাই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির কারণে তাঁরা সেসব তথ্য প্রকাশ করতে পারছেন না।"

এটা পড়ে আমার মত বেকুব পাঠকও আঁতকে উঠে, কী সর্বনাশ, পুলিশ বাহিনীর লোক এর সঙ্গে জড়িত? ক-কে-ক্কে? মনের অজান্তেই যে অস্পষ্ট মুখটা ভেসে উঠে সেই মুখটা বাবুল আকতারের! না, তা কী করে হয়? এই মানুষটা নিজের স্ত্রীকে? আহা,প্রথম আলো যেহেতু বলছে তাতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়। কিন্তু, একটা কিন্তু থেকেই যায়। এতোশত উপায় থাকতে বাবুল আকতার সন্তানের সামনে লোক লাগিয়ে কোপাকোপি করতে গেলেন কেন! স্ত্রীকে অপছন্দের কারণ সে নাহয় বুঝলুম কিন্তু নিজ সন্তানের সামনে? আর বাবুল আকতারের মত চৌকশ লোক সোর্সকে ব্যবহার করবে এই খুনে! আর এমনটা হলে নিয়ম হচ্ছে খুন করার পর সোর্সকেও খুন করে ফেলা। আরে নাহ, তা কী করে হয়?

কিন্তু প্রথম আলো (২৮ জুন ২০১৬) যে জানাচ্ছে, "…তিনি আর চাকরিতে ফিরছেন না বলে অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে। …একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন…। …নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, …ওই সময় তাঁকে দুটি শর্ত দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বলা হয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সব তথ্য-প্রমাণ তাঁদের হাতে রয়েছে। তাকে জেলে যেতে হবে অথবা বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে বাবুল সম্মতি দেন বলে জানা গেছে।"

প্রথম আলো এই সমস্ত লেখা পড়ে এখন আর খুনির চেহারা অস্পষ্ট না, দিনের আলোর মত ঝকঝকে। বাবুল আকতার খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এই খুনাখুনি আপাতত থাকুক। আমার প্রশ্ন অন্যত্র। অসমর্থিত সূত্রের উল্লেখ করে তাহলে যা-কিছু বলা যায়? আচ্ছা, ধরা যাক, আমি লিখলাম, একটি অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা যায় আমাদের মতিউর রহমান ওরফে মতি ভাইয়া আপন মাকে মাসের-পর-মাস হাসপাতালে ফেলে রেখেছিলেন। দেখতে বিশেষ যাননি! এটা আমি এক আর্মি অফিসারের মুখে শুনেছিলাম। কিন্তু এটা লিখলে মতি ভাইয়া আহত হবেন না নিশ্চয়ই।

আমাদের দেশে সত্য-মিথ্যা, মিথ্যা-সত্য, মিথ্যামিথ্যা-সত্যসত্য; এইসবের ঘোরপ্যাঁচে আমার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে সেই কবে তাই কে খুনি,কে খুনি না এই কুতর্কে আর যাই না। এই দেশে সবই সম্ভব। পূর্বের লেখার রেশ ধরে বলি, যে-ই এই খুনটা করেছে সে যদি বাবুল আকতারও হন এটা একটা ঠান্ডা মাথার খুন কোনও প্রকারেই এর দায় থেকে অব্যহতির সুযোগ নেই। তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু…।
কিন্তু বাবুল আকতার যদি খুনি না-হয়ে থাকেন তাহলে প্রথম আলো গংদেরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার অপরাধে বিচারের সম্মুখিন করা হোক। এ-ও একপ্রকার খুন, ঠান্ডা মাথার খুন। আর যে-ই খুনি হোক সে একটা গুয়েভাসা গা ঘিনঘিনে কৃমি। কৃমি থেকে মুক্তি চাই…।

সহায়ক সূত্র
১. আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম: http://www.ali-mahmed.com/2016/06/blog-post_13.html

Tuesday, June 21, 2016

‘বিপ্লব’, বিপ্লব করিয়া ফেলিল!

বিপ্লব, একটি নাম! বিপ্লব, একটি বিস্ময়! বিপ্লব, একটি গাঁজাখুরি সিনেমার নাম! লক্ষীপুরের মেয়র এবং আওয়ামীলীগের নেতা তাহের নামের একজন মানুষ এই মহাবিস্ময় বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিলেন। কালে কালে এই বিপ্লব খুন করে। সবগুলো খুনের কথা তো আমরা জানি না কেবল যেটুকু জানি- খুনি বিপ্লব লক্ষীপুরের বহুল আলোচিত আইনজীবী নুরুল ইসলাম, কামাল এবং মহসিনকে খুন করে। আদালত খুনি বিপ্লবকে ফাঁসি কার্যকর করে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। কিন্তু না, বিপ্লব বলে কথা!

আমাদের দয়াবান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালে নুরুল ইসলামকে খুন করার অপরাধে খুনি বিপ্লবের মৃত্যুদন্ডের আদেশ মাফ করে দেন। পরের বছরই তিনিই ২০১২ সালে কামাল ও মহসিনকে খুন করার অপরাধে যাবজ্জীবনের আদেশ কমিয়ে ১০ বছর করেন।
এখন শুনতে পাচ্ছি সেই সাজাও বিভিন্ন প্রকারে কমানো হচ্ছে।

এক লেখায় আমি ক্ষোভ-কৌতুকে লিখেছিলাম, এবার ছেলেটাকে বিবাহ করিয়ে দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে [১]। ২০১৪ সালে জেলে বিপ্লবের বিবাহও সম্পন্ন হলো। এখন কেবল বাকী আছে বিপ্লবের সন্তান হওয়া। আমরা গোটা দেশবাসী বিপ্লবের সন্তানের আশায় প্রহর গুনছি। আহা, সত্যিকারের বিপ্লব যে আসবে সেদিনই…।

১. বড় ভাল লোক ছিলেন: http://www.ali-mahmed.com/2014/08/blog-post.html

Monday, June 13, 2016

“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…”।

'মা-মা, অ মা, দেখো তোমায় কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছি'।
হাসিখুশি মা-টার মনটা কি কারণে যেন আজ ভারী বিষণ্ন। অন্য সময় খোকার এই চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়া এবং ছুঁয়ে দেয়ার খেলাটা কী উপভোগ্যই না মনে হয়। কিন্তু আজ মোটেও ভাল লাগছে না, বিরক্ত লাগছে। মা’র বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে। আহ, খোকাটা এমন অবুঝ হয়েছে কেন! খোকারই বা কি দোষ, কীই বা বয়স ওর, ক-দিনইবা হলো এই পৃথিবীর মুখ দেখেছে! মা কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, 'বাবু, যাও, অন্যদের সাথে গিয়ে খেলা করো'।

খোকা চক্রাকারে ঘুরপাক থামিয়ে ঝলমলে মুখে বলল, 'উহুঁ, আমার যে তোমার সাথে খেলতেই ভাল লাগে, তুমি যে আমার লক্ষী মামইন্যা'।
খোকা এবার তার স্বরচিত ছড়া ক্রমাগত সুর করে বলতে থাকল, 'মামইন্না-মামইন্না, পিঁড়ি থেকে নামেইন্না'। 
খোকা আজকাল বড়ো ছড়াকার হয়েছে। তার এই সব স্বরচিত ছড়ার কোন আগামাথা নাই। অন্য সময় হলে মা হাঁ করে খোকার এই সব ছড়া শোনেন। আজ মোটেও এসব টানছে না।
মা রাগ-রাগ গলায় বললেন, 'বাবু, তোমাকে একবার একটা কথা বললে কানে যায় না, বললাম না অন্যদের সঙ্গে গিয়ে খেলা করো। আর শোনো, ঘসাঘসি করবে না, বিরক্ত লাগছে'।
খোকার এতক্ষণে হুঁশ হলো। মার বিবর্ণ মুখটা ভাল করে লক্ষ করল। আহা-আহা, মার কীসের কষ্ট! ইশ, কি করলে মার কষ্ট কমে এটা জানলে বেশ হতো কিন্তু খোকা তো এটা জানেই না ছাই! কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, দৈত্যরা তো আমাদের ধরতে পারলে মেরে খেয়ে ফেলে, না'?

মা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, 'হুঁ'।
খোকা শিউরে উঠে বলল, 'ইশ, দৈত্যরা কী নিষ্ঠুর, না'?
মা বললেন, 'হুঁ'।
'মা, আমাকে ধরলেও খেয়ে ফেলবে'?
মা হাহাকার করে উঠলেন, 'বালাই ষাট, তোকে খাওয়ার আগে যেন আমাকে খায়। খোকা, আর কক্ষণও এমন কথা মুখেও আনবি না। এইটুকুন ছেলে, কীসব কথা! খোকা, বুকে থুতু দে'।
'আচ্ছা মা, আমাদের তো দৈত্যরা ধরবে না, না? আমাদের এই জায়গাটা তো পবিত্র, তাই না? দৈত্যরা নাকি আমাদেরকে খেতেই পারবে না'?
মা খোকার চোখে চোখ রেখে বললেন, 'হুঁ'।
খোকা এবার মুখ ঝলমল করে বলল, 'আমাদেরকে খেলে নাকি দৈত্যরা নিজেরাই মরে যাবে? সত্যি নাকি, মা'?
'হুঁ, সত্যি'।
খোকা এবার লাফিয়ে উঠল, 'কী মজা-কী মজা। দৈত্যরা আমাদের খেতে পারবে না-পারবে না'। খোকা এবার কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, তোমার কি মন খারাপ'?
মা বললেন, 'হুঁ'।
'বেশি খারাপ'?
'হুঁ'।
'তোমায় একটা ছড়া বলি'?
'আহ, না। যাও গিয়ে খেলা করো গিয়ে'।

খোকা চলে যাচ্ছে। দেখো দেখি ছেলেটার কান্ড, পাগলুটা কেমন বারবার ফিরে তাকাচ্ছে, এই বুঝি মা পিছু ডাকল। খোকাটা একদম একটা পাগলু হয়েছে! খোকা একসময় চোখের আড়াল হয়ে গেল। মা খোকাকে এটা বলতে পারেননি, তাদের মাথার উপর বিপদ, ভয়াবহ বিপদ। ইশ, খোকা যদি বুঝত বড়দের কত সমস্যা, সমস্যার কূলকিনারা নাই! দৈত্য নামের মানুষরা তাদের খেতে পারবে না এটা সত্য কিন্তু খেতে পারবে না বলেই তাদের সবাইকে মেরে ফেলার জন্য বুদ্ধি করা হচ্ছে। কালই শুনছিলেন, দৈত্যরা বিচিত্র ভাষায় কথা বলছিল, শলা করছিল: সবাইকে মেরে ফেল, সব্বাইকে। ওষুধ ছড়িয়ে দাও। সবাইকে মেরে ফেল, একজনও যেন না বাঁচতে পারে।

এক্ষণ মার বুকে কেমন চাপ চাপ ব্যথা। দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে আসছে। এটা কী চোখের ভুল, পানির রঙ কী বদলে গেছে খানিকটা? এমন হচ্ছে কেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? মা নিমিষেই বুঝে ফেললেন, বোঝার আর বাকি রইল না। তাদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে। চারদিক থেকে অন্যরা ভুসভুস করে ভেসে উঠছে, পেট উল্টে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুখ হাঁ করে আটকে রাখা দম ফেলার চেষ্টা করছে, আপ্রাণ চেষ্টায় নীচে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে, লাভ হচ্ছে না। মা-টা তেমন কোন চেষ্টাই করছেন না। কেবল পাগলের মতো তার সন্তানকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। কোথায় পাবেন তার সন্তানকে? চারদিকে আর্তনাদ, হাহাকার।
মা বুঝতে পারছেন ক্রমশ তার সময় ফুরিয়ে আসছে। তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল, একই শব্দ বারবার আউড়ে যাচ্ছেন। অ খোকা, অ পাগলু, ফিরে আয়-ফিরে আয়, তোর মাথার দিব্যি আর কক্ষণও তোকে যেতে বলব না, কক্ষণও না...।"

* এটা অনেক পুরনো লেখা (সম্ভবত ২০০৫-এর)। এই ফিকশন-লেখার উৎস পত্রিকার যে খবরটা সেটা হচ্ছে:
"ঢাকা ওয়াসার পয়োপরিশোধন কেন্দ্রের লেগুনের সব মাছ বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়। ভেসে ওঠে কয়েক টন মৃত মাছ।“
এই সামান্য খবরটা যখন আমি পড়ি তখন আমার বড়ো অস্থির লাগছিল। গলায় কী যেন দলা পাকাচ্ছিল। কেন? আমি কী মাছ খাই না? খাই। তাহলে? এর উত্তর আমার কাছে নাই। সব প্রশ্নের উত্তর কী আমি জানি, ছাই!

** সে এক বড়ো সুখের সময়! তখন অবলীলায় লিখে ফেলা যেত আনন্দ-বেদনার কথা। তখন মাথায় এটা খেলা করত না যে লেখার কোনও অংশ নিয়ে সরকার বাহাদুরের গাত্রদাহ হবে আর সরকার বাহাদুরের কোনও মন্ত্রী বলে বসবেন, লাশের লেখালেখি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভাগ্যিস, বলে বসেননি, লাশটা তোতলা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেন লাশটা তোতলা হলে তার মরে যাওয়া নিয়ে বিকার হওয়ার কিছু নেই।
ধর্মের দোহাই দিয়ে যে খুনগুলো হয়েছে সবই 'দিন দাহাড়ে'-প্রকাশ্যে কিন্তু কোনও খুনিরই পুলিশ টিকিটি দূরের কথা টিকির আগাও স্পর্শ করতে পারেনি! আমাদের চৌকশ পুলিশ বাহিনী!
কেবল একটি ঘটনায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (হিজড়া)। এরপর? এরপর আর কী- বাংলাদেশে যা হয় আর কী! সেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ 'লাবণ্য হিজড়াকে' কি প্রকারে মূল্যায়ন করা হলো বা ওই খুনিদের বিচারের কী হলো সেটা অন্তত আমি জানি না! 

আর তখন লেখক(!) নামের ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চাদেরও এমন উৎপাতও ছিল না। যারা ফেসবুকের কল্যাণে একেকটা স্টার হয়ে বসে আছে। স্ট্যাটাসের নামে লেখার নমুনা এমন, দুইটা ধর্মগ্রন্থের নাম দিয়ে ‘দেখি কে জিতে?’ শিরোনাম দিয়ে লিখেছে, 'শরিরে এক ফুটা রক্ত থাকলে উত্তর দিবা কেউ এড়িয়ে যাবেনা'।
বানান এবং ভাষার কী ছিরি! ওই লেখায় মাত্র একদিনেই মন্তব্য ২৫৩২, লাইক ২১২৭। ছাগল উৎপাদনে এই দেশ যে পৃথিবীর মধ্যে এক নাম্বার এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
না, ভুল বললাম। আই, এস ইসলামিক স্টেট আছে না! আমাদের দেশে এই কাপুরুষেরা পেছন থেকে গলা কাটে আর ইসলামী স্টেট এর দায় স্বীকার করে। ইসলামী স্টেট নামের পশুরা গুয়ে ভাসতে থাকা কৃমিকেও ছাড়িয়ে যায় যখন আপন সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করে নিজের মাকে গুলি করে মেরে ফেলতে।

এই সেই ২০ বছর বয়সী বীরপুঙ্গব যে জনসমক্ষে আপন মাকে গুলি করে হত্যা করে। মার অপরাধ তিনি ছেলেতে আই, এস-ইসলামিক স্টেট ছেড়ে দিতে বলেছিলেন।

যাই হোক, পুরনো লেখাটার প্রসঙ্গ এলো এই কারণে আমার জাগতিক জটিলতা এবং ব্যস্ততার কারণে অনেক দিন ধরে লেখালেখি হচ্ছে না। তো, একজন অতি পরিচিত মানুষ ইনবক্সে জানতে চাইলে আমি এই কারণটাই বললাম। এবং এটাও বললাম এই দেখেন না পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে নিয়ে জরুরি লেখাটাও লেখা হয়ে উঠছে না। তিনি ফট করে লিখে বসলেন, এই মহিলা তো হিজাব পরতেন, ইত্যাদি…।

আমি হতভম্ব হলাম কারণ এই মানুষটিকে প্রজ্ঞাবান মানুষ হিসাবেই জানি। অথচ এই মানুষটা এই সব কী বলে! আমি মা-মাছকে নিয়ে লিখতে পারব কিন্তু মানুষ-মাকে নিয়ে লিখতে পারব না, আজব! কে জানে, আগামীতে হয়ত মা-মাছকে নিয়ে লেখারও ব্যবচ্ছেদ হবে!

এরিমধ্যে এই খুনের প্রসঙ্গ ধরে কিছু লেখা আমার চোখে পড়েছে এরমধ্যে একজন আছেন যিনি আবার সেলিব্রেটি(!) টাইপের মানুষ যিনি মুক্তচিন্তার নামে গালাগালিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। সন্তানের সামনে তার মাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। যে খুনি হচ্ছে চরম কাপুরুষ এবং এই গ্রহের অতি নিকৃষ্ট সৃষ্টি- গা ঘিনঘিনে কৃমির চেয়েও। যে রাজনীতির কৌশল হিসাবে বেছে নিয়েছে একজন নারীকে, একজন মাকে! একটা শিশুর সামনে তার মাকে কোপানো হচ্ছে সেই মাটা পড়ে থাকেন থই থই রক্তের মাঝে অার সব ছাপিয়ে আমাদের চোখে ভেসে উঠে মার পরিধানের হিজাব! শ্লা, একদিন অন্য কেউ রক্তের মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে আর আমরা গোল হয়ে তামাশা দেখতে দেখতে বলব, দেখ-দেখ, ব্যাটা বেল্লিক, মোজা ছাড়া জুতো পরেছে...।

আমার মনে পড়ছে কিশোরবেলায় পড়া সেই লেখাটা। এক সাধু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পয়দলে যাচ্ছেন। খরস্রোতা এক নদী যখন পার হবেন তখন লক্ষ করলেন এক মেয়ে আটকে আছে পার হতে পারছে না। তিনি অবলীলায় মেয়েটিকে তুলে পার করে দিলেন। কয়েকদিন পর সাধুর এক চ্যালা বলছে: গুরুদেব, আমাদের তো নারীস্পর্শ নিষেধ আর আপনি কিনা...! সাধু ভারী অবাক হয়ে বললেন, কী আশ্চর্য, আমি যে মেয়েটিকে সেই কবেই নদীর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে এসেছি আর তুমি কিনা এখনও তাকে বয়ে বেড়াচ্ছ!

এই সব ইতর মানুষদের(!) জন্য সংক্ষিপ্ত বাক্য, মাই ফুট!

*** 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম', শিরোনামের বাক্যটি  নেওয়া হয়েছে শাহ আবদুল করিমের গানের কথা থেকে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। 
 **** ভিডিও সূত্র: www.bdnews24.com

Wednesday, June 1, 2016

আইন সবার জন্য সমান…!

ছবি সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ মে ২০১৬
ছবিটা, ভয়াবহ একটা ছবি! ছবিটা যে শারীরিক ভাবে অক্ষম একজন মানুষের ছবি এটা বোঝার জন্য এক পলকই যথেষ্ঠ। এই মানুষটাকে চুরির অভিযোগে ধরা হয়েছিল। আটক করা হয়েছে সত্য কিন্তু বমাল না, সন্দেহজনক মনে করায়। পুলিশ বাসা ধরে ধরে এনেছিল।
অবশ্য ৫২ বছর বয়স্ক খোকন গাজির স্বজনের অভিযোগ মিরপুরের দারোগা আরিফ হোসেন ১০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবী করেছিলেন। পুলিশকে ২ হাজার টাকাও নাকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ এই মানুষটাকে ছাড় দেয়নি। ওই দারোগা আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলেন, ‘বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় আসামি…’, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই মানুষটিকে আদালতে হাজির করার সময় হাতে হাতকড়া পরানো ছিল তাই পত্রিকাটি ফলাও করে খবরটা ছাপিয়েছে। এটা একটা সুপ্রতিবেদন এতে কোনও সন্দেহ নেই। আচরণটা খুবই ন্যাক্কারজনক কিন্তু কনস্টেবল পদমর্যাদার একজন মানুষের কাছ থেকে [*] আমাদের খুব একটা আশা করারও কিছু নেই। অল্পশিক্ষিত এই পুলিশকে বলা হয়েছে আসামিদেরকে এমন করে নেবে সে এমন করেই নেয়। পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০ ধারা পড়ার সুযোগ কোথায় তার? আইনের কেতাবগুলো মুখস্ত করবে তার সে যোগ্যতাই বা কোথায়?

যাই হোক, এখানে পুলিশ খুব খারাপ কিন্তু সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই মানুষটিকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন খোকন গাজির আইনজীবী আদালতকে বলেন, “…মাননীয় আদালত, দেখুন, লোকটি পঙ্গু। একা চলাফেরা করতে পারেন না। সন্দেহজনক আসামি হিসাবে তাঁকে ধরা হয়েছে। তাকে জামিন দেওয়া হোক। জামিন না পেলে তিনি কারাগারে চরম সমস্যার সম্মুখীন হবেন…।" (প্রথম আলো, ২৫ মে ২০১৬)
শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম লস্কর সোহেল রানা এই মানুষটা জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। সোজা কথা, তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করেন যা কারাগারে নিক্ষেপ করারই সামিল।

আমাদের প্রচলিত আইনে আসামীকে ডকে-কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় সে যেই হোক না কেন। আইন বলে কথা- আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু…ধরা যাক, একজনের কোমর থেকে দু-পা নেই সে দাঁড়াবে কেমন করে? এখানে বিচারকের ‘inherent power’ থাকা লাগে না- এখানে তাঁর প্রজ্ঞা, বিবেচনা বোধই যথেষ্ঠ।
জামিন প্রসঙ্গে ফৌজদারী কার্যবিধিতে কি বলা আছে? "ফৌজদারী কার্যবিধি: ধারা ৪৯৬: যে সকল ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা যাইবে: জামিনের অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি কোন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার হইলে বা আটক থাকিলে, বা আদালতে হাজির হইলে বা তাহাকে হাজির করা হইলে, সে যদি উক্ত অফিসারের হেফাজতে থাকিবার সময় বা উক্ত আদালতের কার্যক্রমের কোন পর্যায়ে জামানত দিতে প্রস্তুত থাকে তাহা হইলে তাহাকে জামিনে মুক্তি দিতে হইবে: তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত অফিসার বা আদালত উপযুক্ত মনে করিলে তাহার নিকট হইতে জামানত গ্রহণের পরিবর্তে সে অতঃপর বর্ণিতভাবে হাজির হইবার জন্য জামিনদার ব্যতীত মুচলেকা সম্পাদন করিলে তাহাকে মুক্তি দিতে পারিবেন। তবে আরও শর্ত থাকে যে, এই ধারার কোন বিধান ১০৭ ধারার (৪) উপধারা বা ১১৭ ধারার (৩) উপধারার কোন বিধানকে প্রভাবিত করিবে বলিয়া গণ্য করা হইবে না।"

"তবে আরও শর্ত থাকে যে, …" সেই শর্তের গভীরতা বাদ থাকুক বা বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়েছে এই প্রসঙ্গেও গেলাম না। ধরে নিলাম এটা জামিন অযোগ্য অপরাধ। সে ক্ষেত্রেও ধারা ৪৯৭-এ বলা হচ্ছে, “ফৌজদারী কার্যবিধি: ধারা ৪৯৭: যখন জামিনের অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা যাইবে : (১) জামিনের অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার হইলে বা আটক থাকিলে অথবা আদালতে হাজির হইলে বা তাহাকে হাজির করা হইলে তাহাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যাইেত পারে; কিন্তু সে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় কোন অপরাধে দোষী বলিয়া বিশ্বাস করিবার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকিলে উক্তরূপে দেওয়া যাইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, আদালত এইরূপ অপরাধে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি ষোল বৎসরের কম বয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত বা অক্ষম হইলে তাহাকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারিবেন।

এখানে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে খোকন গাজি নামের এই মানুষটা অক্ষম, শারীরিক ভাবে অক্ষম।

* Enamul Haque rabbi নামের কনস্টেবল পদমর্যাদারই একজন মানুষের আইন সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে হাঁ হয়ে যাই মানুষটার জন্য টুপি খুলে অভিবাদন। এবং এমন করে লেখার জন্য লজ্জিতও হই, দুঃখপ্রকাশ করি! 
সূত্র: http://tinyurl.com/zyxrop4