নিশিকে সোহাগের ঘুম ভাঙ্গাতে বেগ পেতে হলো। সোহাগ নিশিকে দেখে চোখ মেলল, ধড়মড় করে উঠে বসল।
আফা, রাগ কইরেন না, বইয়া বইয়া ঘুমাই গেছিলাম। অক্ষণই কাম শ্যাষ কইরা ফালামু।
কাজ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না, ইচ্ছা করলে ঘুমা। ঘুমাবি?
না গো আফা, আর ঘুমাইতে ইচ্ছা করতাছে না।
নিশি ঝোকের মাথায় বলে বসল, বাড়িতে যাবি রে, সোহাগ?
সোহাগ চোখ বড় বড় করে বলল, হেছা আফা। আল্লার কিরা, মিছা কইতাছেন না।
নিশির বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ঘোর কেটে গেল। বাড়িতে সোহাগকে নিয়ে যাবেটা কে? জাবীরকে বললে ও ঠিক ঝাঁঝিয়ে উঠবে: তোমার কোন কান্ডজ্ঞান নাই নাকি!
নিশি হয়তো জটিলতা এড়াবার জন্য বলবে: আহা, একটা কথা বলেছি, না করলে না করবে, এ নিয়ে হইচই করার তো কিছু নাই! ছেলেটা কতদিন হলো বাড়িতে যায় না। ও খুব মন খারাপ করে থাকে।
হইচই-হইচই। হোয়াট ডু য়্যু মীন বাই হইচই! একটা কথা বুঝে, না বুঝে বলে আমার মাথায় একটা বোঝা চাপিয়ে দিলে। এমনিতেই আমার যন্ত্রণার শেষ নাই।
তখন নিশির কষ্টের নিঃশ্বাস ফেলা ব্যতীত আর কোন উপায় থাকবে না। নিশি প্রায়শ ভাবে, আচ্ছা এই মানুষটার সঙ্গে ও ঝুলে আছে কিভাবে? মানুষটাকে ছেড়ে যাবে ভাবলেই বুকের গহীন থেকে অজানা এক কষ্ট পাক খেয়ে উঠে কেন? এই জটিল প্রশ্নের উত্তর নিশির কি কোন দিনই জানা হবে না? নিশির কি এ দ্বিধা থেকে কোন মুক্তি নেই।
নিশির বিব্রত ভঙ্গি, সোহাগ, দেখব তোর ভাইজানের সঙ্গে কথা বলে।
সোহাগ মিইয়ে যায়। খানিকক্ষণ কি যেন আনমনে ভেবে বলে, আফা, আমি এখলা এখলা চইলা যামু, কুনু সমস্যা হইব না। রাস্তাই আমারে টাইন্যা লয়া যাইব।
নিশি আঁতকে উঠে, যাহ, কি বলিস, মাথা খারাপ, তুই একলা একলা যাবি কেমন করে।
কুনু সমুস্যা হইব না, আফা। চোক্কের নিমিষে যামু গা।
নিশি আলগা গাম্ভীর্য এনে বলল, এমন পাগলামির কথা আর যেন না শুনি, আমি তোর ভাইজানের সঙ্গে কথা বলব। সে কোন একটা ব্যবস্থা করবে। হ্যা রে, সোহাগ, তোর লেখাপড়া কোদ্দুর হল?
সোহাগের অক্ষরপরিচয় আগে থেকেই ছিল। নিশি কোন কোন দিন ওকে নিয়ে পড়ত। একদিন বই-খাতা এনে দিল, ক-দিন সোহাগ পালিয়ে পালিয়ে থাকল। নিরূপায় হয়ে একসময় ভাঙ্গ ভাঙ্গা বানান করে পড়া শুরু করল। বিচিত্র সব ছড়া লেখা শুরু করল।
পালকি চলে
"পালকি চলে
পালকি চলে
গান তরে
আগুন জলে
ছদু গায়ে
আদুল গায়ে
জাচে তারা
রদি সারে।
মনা মদু
চখ মদু..."।
আরেকদিন লিখল:
"ফালাইননা খারাপ
ফালাইননা বানর
ফালাইননা দুষ্টামি করে
ফালাইননাকে লাতি মারব
ফালাইননাকে ঠাওয়া মেরে ফেলে দিব
ফালাইননা একটা মেতর, সে গু সাপ করে"।
নিশি হাসি গোপন করে বলেছিল: সোহাগ, ফালাইন্যা কে রে?
সোহাগ কোন উত্তর দেয়নি। মুখ নিচু করে কেবল হেসেছিল। ফালাইন্যা কি ওর প্রিয় বন্ধুর নাম? নিশি নাছোড়বান্দা: বল না সোহাগ, ফালাইন্যা কি তোর প্রিয় বন্ধু?
সোহাগ বলেছিল: ফ্রিয় কি, আফা?
ধুত, ফ্রিয় না, প্রিয়।
সোহাগের মুখ নিচু হতে হতে গিয়ে হাঁটুতে ঠেকত, হ।
ফালাইন্যা আবার কি নাম রে?
বুঝেন নাই আফা, ফালাইননার মাইনে হইল গিয়া যারে সবাই ফালাইয়া দেয়।
কি বলিস, বুঝিয়ে বল।
হের আগে হের ভাই ভইন হক্কলে মইরা যাইত তো। এর লিগ্যা হের নাম রাখছিল ফালাইননা।
রাখলে কি হয়?
অমা, জানেন না বুজি, ফালাইননা হইল ফালাইননা, হেরে তো আজরাইলও নেয় না। আজরাইল না নিলে মরব কেমনে? আফা, আফনে দেহি কুছতা জানেন না।
এক্ষণ সোহাগ মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে ছাদের টিকটিকি তাড়াবার চেষ্টা করছে। বিচিত্র শব্দটা করতে করতেই বলল, আফা-আফা গো, দেখছেন নি, এইডা কেমুন লাফলালাফলি-ঝাপলাঝাপলি করতাছে?
নিশি অনেক কষ্টে হাসি গোপন করল, সোহাগ, এতদিন এখানে থেকেও তুই ভাষাটা বদলাতে পারলি না!
সোহাগ মুখ ভরে হাসল, আফা, আপনেগো কথা কইয়া শান্তি নাই। ফাপড় লাগে।
সোহাগ, তোকে যে ছড়াগুলো শিখিয়েছিলাম, মনে আছে না, নাকি ভুলে গেছিস?
সোহাগের এই পরীক্ষা টাইপের বিষয়গুলো ভাল লাগে না। সে কথা ঘুরাবার জন্য বলল, আফা, আমাগো গেরাম দেশের একটা ছড়া কই?
বল।
"আতা গাছের মাথা নাই
মাথার মইদ্যে চুল নাই
চুলের মইদ্যে উকুন নাই
উকুনের মরন নাই
মরলে কিন্তু বাছন নাই"।
নিশির এবার হাসি চাপা সম্ভব হলো না।
আফা, সোন্দর না?
হুঁ, সুন্দর। কিন্তু তুই দেখি দুনিয়ার সব আজগুবি কথা বলিস।
সোহাগের মন খারাপ হয়ে গেল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে আপা তার কথা খুব একটা পছন্দ করেনি। আপা এমন করলে তার বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়!