Search

Thursday, February 18, 2010

ওড়নাসমগ্র এবং কলার খোসা


বইমেলায় একজন লেখকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছি।আমার বইয়ের প্রকাশকের স্টল থেকে নিরাপদ দূরত্বে। কারণ প্রকাশক আমাকে দেখলেই রে-রে করে তেড়ে আসবেন। তিনি আমার একখানা বহি বাহির করিয়াছিলেন। তাঁর বিক্রি-বাট্টার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। ফি-বছর সবসুদ্ধ আমার ২টা বই-ই বিক্রি হত। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, একটার ক্রেতা শুভ, অন্যটার আলী মাহমেদ। গোপনে এ-ও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এই দুজন একই 'লুক'। নামে-বেনামে খরিদ করে।
একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বদ্দা, বই বিক্রি বাড়াবার রহস্য কি?
তিনি বলেছিলেন, 'মিয়া, তুমি আজ-অবধি তোমার বইয়ের মোড়ক উম্মোচনই করলা না! 'মল-বাক্স' (রুচিমান লোকজনেরা কানে আঙুর দেন); মল-বাক্সের (মতান্তরে পেট) কাছে বই ধরে পোজ দিতে হয়, ফটাফট ছবি উঠাতে হয়। এইসব না করলে তোমার বই শুভ এবং আলী মাহমেদ কেনে এতেই তুষ্ট থাকো। আগামীতে এরাও কিনব না। কিনলে ভোঁতা দাও দিয়া কান কাইট্যা ফেলব'।
আমি ভাবনায় পড়ে গিয়ে বললাম, 'মোড়ক উম্মোচন কি খুব জরুরি'?
তিনি রাগ চেপে বললেন, 'তুমি কলা খাও'।
আমি মিসিং ২টা দাঁত ব্যতীত সবগুলো দাঁত বের করে বললাম, 'সেতো সবাই খায়, আমি খাই এ খাই ও খায় মায় বাঁদরও'।
এইবার তিনি রাগটা আর চেপে রাখতে পারলেন না, 'কলাটা কি খোসা সহ খাও'?
আমি বললাম, 'না, তা কেন, ওইটা তো খায় ছা...ছাগ'।
তিনি লাফিয়ে উঠলেন, 'ব্যস-ব্যস। কলা যেমন খোসা সহ খাওয়া যায় না তেমনি বইয়ের খোসা-মোড়ক না সরালে বইও বিক্রি হয় না। বই আর নারী...'। (কাশি) বাকীটা ভদ্র সমাজে বলার মতো না।
পাশ থেকে কে যেন বলল, 'একটা অটোগ্রাফ দিবেন'? আমি গা করি না, গল্প চালিয়ে যাই। সাথের লেখক বিরক্ত হলেন, বিষয় কী, অটোগ্রাফ দেন না কেন? এইটা কি বেতমিজগিরি!
আমি দুম করে আকাশ থেকে পড়লাম। মানুষটা আমাকে বলছে নাকি, আমার ক্কা কাছে, অ-অট-অটোগ্রাফ! মানুষটা পাগল নাকি, দুনিয়ায় আর লোক খুঁজে পেল না! আমি ভাল করে মানুষটাকে দেখি। তাঁর সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, তদুপরি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করি আমার কাছে কেন রে, বাপ! আঁচ করার চেষ্টা করি কিন্তু মানুষটাকে স্বাভাবিকই মনে হয়। ওয়াল্লা, ইনি দেখি সত্যি সত্যি আমাকেই বলছেন! অটোগ্রাফ কড়চা লেখার পর আমার ধারণা ছিল কেউ আর আমার টিকিটিও স্পর্শ করতে আসবেন না।

বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশের লেখক তাড়া দেন, 'আরে কি মুশকিল, অটোগ্রাফ দিয়ে শেষ করেন'।
আমি চিঁ চিঁ করে বলি, 'ইয়ে, হয়েছে কি বুঝলেন, অটোগ্রাফ যে দেব আমার তো যথেষ্ঠ প্রস্তুতি নাই। আগে বুঝি নাই কাজে লাগবে, ওড়না কাম চাদরটা তো কিনি নাই'।
তিনি বললেন, 'সুমন্ত আসলামের কাছে অনেকগুলো ওড়না-চাদর আছে। তিনি যে স্টলে বসেন ওখানে পেরেকে অসংখ্য ওড়না-চাদর ঝোলানো থাকে। কিছুক্ষণের জন্য একটা ওড়না নিয়া আসেন। না-দিলে আমার কথা বইলেন'।
আমার দিকভ্রষ্ট রোগ আছে। কোথায় 'ওড়নাখ্যাত সুমন্ত আসলাম' বসেন সেটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমি হাল ছেড়ে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা ভাই, আপনি তো অনেক বিখ্যাত লেখকদের অটোগ্রাফ নিয়েছেন। তো এঁরা অটোগ্রাফে আসলে কি লেখেন? ওখান থেকে ধার করে লিখে দিতাম আর কি'। 
তিনি বললেন, 'সিনিয়র, জুনিয়র বুঝে লেখা হয়। শুরুটা হয় শ্রদ্ধাস্পদেষু, শ্রদ্ধাভাজনেষু, স্নেহপুত্তলি, স্নেহার্শীবাদ ইত্যাদি'।
আমি জপ করতে থাকি, বানান মনে করার চেষ্টা করি। শ্রদ্ধা পদেশু, ভাজ-ভাজনেষু ইয়ে পুত্তলি। কী কষ্ট-কী কষ্ট, জীবন নষ্ট!

এমনিতে আমার মাথায় আসছিল না একজন লেখককে ওড়না দিয়ে বুক ঢাকতে হবে কেন? ওড়নার চল তো এমনিতেই উঠে যাচ্ছে। আজকাল মেয়েরাই ওড়না নামের জিনিসটা পছন্দ করছেন না। শখ করে কেউ পরলেও গলায় পেঁচিয়ে রাখেন বা কেউ একপাশে ফেলে রাখেন, একটা ইয়ে...। হোয়াই একটা? 'ইয়ে বাহোত না-ইনসাফি হ্যায়'!
আরেকজনকে বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, 'ভাই, আপনার নাম কি হ্রস্ব উ-কার নাকি দীর্ঘ উ-কার' দিয়ে?
তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, 'কেন, এই নামটা আপনি গুরু রবীন্দ্রনাথেরেওমুক গ্রন্থে পড়েননি'!
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, 'না, মানে কেউ রহমান লিখে কেউ রাহমান। আর ভাই, গুরুর সব লেখা পড়ব কি, আজপর্যন্ত একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতই লিখতে পারলুম না'!

যাক গে, লেখক মহোদয় মায়াকোভস্তি-দস্তয়ভস্কি-ট্রটস্কি-চমস্কিদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তিনি বলছিলেন, এঁরা এই দেশে আসলে দেশটার চেহারাই পাল্টে যেত।
আমি নিরীহ মুখে বললাম, 'এঁরা সম্ভবত এই দেশে আসতেন না কারণ এখানে বরফ কোথায়? স্কি করার সুযোগ কই'!
তিনি অবাক, 'মানে কী, স্কির প্রসঙ্গ আসছে কেন'!
আমি বললাম, 'না, সবার নামের শেষে স্কি আছে তো তাই আমি ভাবলাম এরা স্কি করতে পছন্দ করেন'।
তিনি চিড়বিড় করে বললেন, 'রসিকতা করবেন না। একদম না। আপনি রসিক লোক না। আর আপনাকে দেখলাম লোকজনের সঙ্গে হা-হা হি-হি করছেন। এইসব করবেন না। একজন লেখকের এইসব মানায় না'।
আমি ম্রিয়মান হয়ে বললাম, 'লোকজন না, এঁরা সবাই আমার বন্ধু। ব্লগিং-এর নামে এঁদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় লেখালেখি করেছি, মন্তব্য চালাচালি করেছি, অনেক বিনিদ্র রাত পার করেছি। সে এক সোনালি সময়! এঁরা আমার জন্য কতটা কাতর আমি জানি না কিন্তু আমি এদেঁর জন্য বড়ো কাতর'।
তিনি বিরক্ত হলেন, 'এইসব ছাতাফাতা বললে তো হইব না। একজন লেখক হতে গেলে রাশভারী ভঙ্গি ধরে রাখবেন। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে পা ফাঁক করে এলোমেলো ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করবেন'।
আমি মন খারাপ করা শ্বাস ফেললাম। হবে না, হবে না আমাকে দিয়ে, লেখক হওয়ার দেখি অনেক হ্যাপা! আফসোস, লেখক হওয়ার বড়ো ইচ্ছা ছিল, হতে পারলাম না। আফসোস...!

*পোস্টের সঙ্গে যে জিনিসটা যুক্ত করা হয়েছে এটা নামেই জলরঙ বাস্তবে জবরজ। চেষ্টাটা করা হয়েছিল এমন, একজন মানুষের মুখ আর একজন গর্ভবতী মহিলা মিলেমিশে থাকবে...।