Search

Thursday, November 4, 2010

ওই আসে মহাপুরুষ

মহাপুরুষ কাকে বলে আমি জানি না, এঁরা কি লোকালয়ে থাকেন নাকি গভীর অরণ্যে তাও জানা নেই। আমি মহাপুরুষ কখনও দেখিনি, দেখার কোন গোপন ইচ্ছাও নেই। দেখে কী করব! এঁদের সঙ্গে আমার কি কাজ? খানিকটা ভয়ও যে কাজ করে না এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না, এঁদের দেখে ভস্ম হয়ে যাই যদি, তখন কে আমায় বাঁচাবে?
কিন্তু মহাপুরুষরা ঠিকই থাকেন, প্রায় হাতের নাগালেই। না থেকে উপায় নেই কারণ কে আমাদের আগলে রাখবে? কে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে? তাঁরা থাকেন দয়া করে আমাদের সঙ্গেই জড়াজড়ি করে।

যাদের অধিকাংশই নারী, এমন ৮০ লক্ষ মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন যে মানুষটি, তাঁকে মহাপুরুষ বলব না তো কাকে বলব? এঁরা সবাই এখন সুখে-শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছেন। আমার প্রবল আশা, অচিরেই এই দেশের সমস্ত মানুষ এই মহাপুরুষের ঋণের আওতায় চলের আসবেন এবং তখন আর কোন দুঃখ আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না। তখন কেবল শান্তি আর শান্তি।
ঠিক ধরেছেন, আমি মহাপুরুষ মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বলছি। মানুষটা আমাদের জন্যে বিরল সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছেন, তিনি একজন নোবেল লরিয়েট। শান্তির জন্যে তিনি জগদ্দল জিনিসটা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এসেছেন।
মানুষটা আমাদের জন্য কত ভাবনাই না ভাবেন। আমাদের শিশুদের জন্য ভাবনায় ভাবনায় তাঁর দু-চোখের পাতা এক হয় না। আমরা কি খোঁজ রেখেছি কত নির্ঘুম রাত তিনি কাটিয়েছেন? আমাদের তো বাচ্চাদেরকে 'শক্তি প্লাস' দই খাইয়ে 'তনদুরুস্ত'-বলশালী করা নিয়ে কথা, এতো ভাবাভাবির সময় কোথায় আমাদের। এখন শুনতে পাই তিনি আমাদের 'শক্তি পানি' খাওয়াবেন, 'গ্রামীন ভেওলিয়া ওয়াটার'।
অক্সিজেনের খোলে শুয়েও মাইকেল জ্যাকসন বেচারা মরে গেল নইলে ইউনূস সাহেবকে পরামর্শ দিত, 'শক্তি বাতাস' চালু করার জন্য। 'গ্রামীন জ্যকসনীয়া এয়ার' (!)।

টিটু দত্ত গুপ্ত 'পুঁজির নয়া রূপকার' শিরোনামে বেশ গুছিয়ে একটা লেখা লিখেছেন [১]। ওখানে সবই পাওয়া গেল কিন্তু পাওয়া গেল না কেবল গ্রামীন ব্যংকের সুদের হার কত? আমি হন্যে হয়ে আছি এই তথ্যের জন্য। জনে জনে জিগেস করেও কোন লাভ হয়নি। সবারই ভাসা ভাসা উত্তর। গ্রামীন ব্যাংকের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও লাভ হয়নি। পারতপক্ষে এরা এই বিষয়ে মুখই খুলতে চান না। এও এক রহস্য। এতো লুকোচুরি লুকোচুরি কেন? যিনি নোবেলের মত জগদ্দল পাথর উঠাতে পারলেন তিনি আমাদের এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর কেন দিতে পারছেন না, আসলে সুদের হারটা কত?

এই রহস্য আছে ব্র্যাক ব্যাংক নিয়েও। এর প্রতিষ্ঠাতা ফজলে আবেদও আমাদের জন্যে নাইট উপাধি নিয়ে এসেছেন। এরা বলে থাকেন সুদের ফ্ল্যাট রেট ১৩ পার্সেন্ট। এমনকি এরা একটা মামলা প্রসঙ্গেও কোর্টেও হুবহু এই কথাটাই বলেছিলেন। আমি লিখিত আকারে, এক্সেল শিটে প্রমাণ করে দেব, ব্র্যাক ব্যাংকের সুদের হার ২০.৪ পার্সেন্ট, প্রায় ২১ পার্সেন্ট। এটা আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে করা মেইলে এটাচও করে দিয়েছিলাম। এটারও প্রমাণ দিয়েছিলাম, এরা লোকজনের কাছ থেকে ব্ল্যাংক চেক নিয়ে কেমন করে ফাঁসিয়ে দেন। নীতিগত কারণে মেইল সংক্রান্ত আর কোন তথ্য এখানে শেয়ার করতে চাচ্ছি না।

একটা লেখায় আমি লিখেছিলাম [২]:
"...স্যার, ফজলে আবেদ, আপনি কি আমাকে দয়া করে বলবেন, এই দেশে নারী, আর্মস, ড্রাগস ব্যতীত এমন কোন বৈধ ব্যবসা আছে যেটা ২১ (২০.৪) পার্সেন্ট সুদ দিয়েও লাভ করা যায়? প্লিজ স্যার, জানালে আমি ওই ব্যবসাটাই ধরব...।"
আমার এই চ্যালেঞ্জটা এঁদের জন্য এখনও আছে, ২১ পার্সেন্ট সুদ দিয়ে কোন বৈধ ব্যবসা বাংলাদেশে করা যায়, ওই ব্যবসাটার নাম আমি জানতে চাই।
এদের কিস্তির টাকা শোধ করতে না-পেরে, এদের অপমান-অত্যাচারে কত মানুষ আত্মহত্যা করছেন সব খবর কি পত্রিকার পাতায় আমরা পড়ি? পত্রিকায় কি এই সব খবর আসে? আসে না।
অনেকে বলবেন, তাহলে এত্তো এত্তো মানুষ এদের কাছে যাচ্ছে কেন? অধিকাংশ মানুষকেই এরা প্রকৃত সুদের হারটা জানতে দেন না, অনেকেরই এটা বোঝার ক্ষমতাও নাই। তদুপরি অধিকাংশ মানুষকে নিরুপায় হয়েই এদের কাছে যেতে হয়, উপায় থাকে না।

তবুও ফজলে আবেদকে আমি ধন্যবাদ দেব মহা সুদখোরের দৌড়ে তিনি অনেকখানি পিছিয়ে আছেন। এবং আর যাই হোক, প্রত্যন্ত গ্রামে যেমন করেই হোক তিনি বাচ্চাদের পড়াবার ব্যবস্থাটা চালু রেখেছেন। এজন্য তাঁকে স্যালুট।

কিন্তু জনাব ইউনূসের গ্রামীন ব্যাংকের সুদ কত? আমি সঠিক অংকটা এখনও বের করতে পারিনি তবে ৩০ পার্সেন্টের কম না এটা আমি প্রায় নিশ্চিত। ইউনূস সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন, এই সুদ দিয়ে কি ঘন্টা-ছাতাফাতা ব্যবসা হয় এই দেশে? নাম বলেন তো একটার?

ইউনূস সাহেব কি জানেন, তাঁর ব্যাংকের মহিলারা যে কিস্তি পরিশোধ করেন, কিস্তি চালাবার জন্য তাদের অনেকেই তা বাইরে থেকে চড়া সুদ দিয়ে আনেন? সুদের তাড়নায়, অত্যাচারের মাত্রায় আত্মহত্যা করার মত ক-টা ঘটনা আমরা জানতে পাই?
 বললে কেউ বিশ্বাস করবেন, কিশোরীর পায়ের নূপুর খুলে নিয়ে আসার [৩] পর তার আত্মহত্যা করার খবরটা এসেছিল মফস্বলের পাতায় সিঙ্গেল কলামে মাত্র ৬ লাইন! তাও প্রায় চোখে পড়ে না এমন একটা জায়গায়। কত অপ্রয়োজনীয় একটা খবর! আহা, মিডিয়া যে নাকেখত দিয়ে রেখেছে, লাখ-লাখ টাকার বিজ্ঞাপন যে আসে এদের কাছ থেকে। আব্বা-আব্বা বলে মুখে ফেনা উঠে যায়।

গভর্নর ড. আতিউর রহমান পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, '...শিগগিরই ক্ষুদ্রঋণের হার নির্ধারন করে দেয়া হবে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থার উপর নজরদারি বাড়ানো হবে।...অনেক ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থা আইন মানতে চায় না।"
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, "অনেক এনজিও ঋণগ্রহিতাকে চাপ দিয়ে ঋণ আদায় করে, ঋণের জন্য নির্যাতন করে এবং এ ধরনের ঘটনার কারণ আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটে...।" (সমকাল/ ০৫.০৮.১০)

ইউনূস সাহেবের দই প্রসঙ্গে মনে পড়ল। আমাদের স্কুলের বাচ্চাদেরকে চেষ্টা করা হয় খাবার কিছু একটা দেয়ার জন্য। সীমাবদ্ধতার কারণে সব সময় সম্ভব হয় না। কলাটাকেই বেছে নেয়া হয়, দু-আড়াই টাকায় একটা সাগর কলা পাওয়া যায়। অন্তত একটা ফলের উপকার তো পাওয়া যাচ্ছে, পেটটাও ভরছে। ওদিন আমি ভাবলাম, কলা খেতে খেতে এরা বিরক্ত হয়ে গেছে খানিকটা বদলে দেয়া যাক। প্রায়ই শক্তি দইয়ের বিজ্ঞাপন দেখতাম। ইউনূস সাহেব দেশের বাচ্চাদের জন্য পুষ্টির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। বিজ্ঞাপনটা আরও খানিকটা লম্বা হলে ইউনূস সাহেবের কান্নাটাও আমরা দেখতে পেতাম।
যাই হোক, আমি দাম জানতাম না। দাম জেনে আমি হতভম্ব, এইটুকুন দইয়ের দাম ১০ টাকা! ইউনূস সাহেব কি ফাজলামি করার আর জায়গা পাননি! তিনি কলিমুদ্দিন-ছলিমুদ্দিন গোয়ালা হলে আমার বলার কিছু ছিল না। আহা, গোয়ালা ব্যবসা করতে এসেছে, গলা কেটে ব্যবসা করবে আটকাচ্ছে কে? কিন্তু ইউনূস সাহেবের শিশুর পুষ্টি হেন-তেন এই সব বলার অর্থ কী, কান্নাকাটি করে তহবন ভেজানো কেন! এই জিনিসটার দাম ১০ টাকা হলে কোন শিশুর পুষ্টির কথা বলছেন আপনি? বাংলাদেশের দরিদ্র শিশুদের? বাংলাদেশের দরিদ্র শিশু সম্বন্ধে ধারণা আছে আপনার?
তো, আপনার কি ধারণা, বাংলাদেশের দরিদ্র শিশুরা ফট করে দশ টাকায় এই দুই চুমুক দই কিনতে পারবে? হ্যা, আপনি যদি দু-চার টাকায় এটা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন তাহলে আপনার কান্নাকাটির সঙ্গে আমিও খানিকটা কাঁদতাম।

'আল-আমিন' নামের খুব পুরনো একটা বিস্কিট কোম্পানি আছে। এরা সুদৃশ্য মোড়কে ১ টাকায় বিস্কিটের প্যাকেট বিক্রি করে। এতে তিনটা বিস্কিট থাকে। এই সময়ে ১ টাকায়, ভাবা যায়! আমি অনেক দরিদ্র শিশুকে দেখেছি বিপুল আগ্রহে এই বিস্কিটের প্যাকেট কিনতে- এদের অনেকেরই সকালে নাস্তা করার সৌভাগ্য হয় না।
আমি নিশ্চিত, এই আল-আমীন নামের ব্যবসায়ি কোম্পানির পাশে দাঁড়াবার যোগ্যতা আপনি মি. ইউনূসের নাই। 
আপনি তো শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, ওম শান্তি! আফসোস, অর্থনীতিতে পাননি! তবে আমি আনন্দিত হতাম, যদি আপনাকে 'সামাজিক ব্যবসানীতি' নামের কোন বিভাগ সৃষ্টি করে নোবেলটা দেয়া হতো। তাহলে আপনাকে আর কেউ মহা সুদখোর, নির্লজ্জ ব্যবসায়ী বলে গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করত না। 'ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি' বইয়ে সামাজিক ব্যবসার কথা ঘটা করে লিখেছেন, এটা এখন বাস্তবায়িত করে দেখাচ্ছেন। আপনার সামাজিক ব্যবসা নামের সুগার কোটেড ট্যবলেটটাও আমরা গিলব এতে সন্দেহ কী!

অফ-টপিক:
জোঁক এবং জোকস-এর সংজ্ঞা সরল। জোঁক হচ্ছে রক্তচোষা এবং জোকস হচ্ছে হাসি উদ্রেককারী। এই যেমন "...দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মানহানির মামলা করা হয়েছে...।" (প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর ২০০৯)
১০ হাজার কোটি ডলার!! এই টাকাটা পাওয়া গেলে ইউনূস সাহেবকে আর কষ্ট করে 'ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি' বই লিখে দারিদ্রতা দূর করতে হবে না। যেখানে পোভার্টিই থাকবে না সেখানে এর উপর বই লেখার আবেদন কোথায়! বেচারা, বেকার হয়ে পড়বেন এটা ভেবে অবশ্য মন বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছে।

*এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস বলছেন, ৬০ গ্রামের এককাপ দই বিক্রি হয় ছয় টাকায়। এতে নাকি এক টাকা ত্রিশ পয়সা লাভ থাকে। অথচ এই দইয়ের কাপে লেখা আছে খুচরা মুল্য আট টাকা! দোকানদার বিক্রি করে দশ টাকায় কারণ তাকে এই দই ক্রয় করতে হয় আট টাকায়! আট টাকায় ক্রয় করে আট টাকায় বিক্রি করবে, এরা তো আর ইউনূস সাহেবের সামাজিক ব্যবসার ট্যাবলেট খায়নি। আমি এটাও খোঁজ নিয়েছি, দোকানদার বিপুল পরিমাণে ক্রয় করলে এককাপ দই সাত টাকা সত্তর পয়সায় ক্রয় করা যায়। ত্রিশ পয়সা লাভে একজন দোকানদারের ইউনূস সাহেবের দই বিক্রি করতে বয়েই গেছে।

তিনি আরও জানাচ্ছেন, বিরাট মুচি এডিডাসকেও সহসাই তিনি সামাজিক ব্যবসার নামে আমাদের কাছে হাজির করছেন। আমি এটাও দেখার অপেক্ষায় আছি, এডিডাস মুচি কেমন পুষ্টিকর জুতা তৈরি করে আমাদের উপহার দেবে। দাম চড়া হোক, এই জুতা পায়ে দিলে কি ক্ষিধা লাগবে না? আহা, তাহলে বেশ হয়-বেশ হয়। আমাদের স্কুলে যে বাচ্চাগুলো খালি পায়ে আসে এরা জুতা পায়ে দিতে পারবে এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় এদের পড়তে হবে না। তখন আমি গড় হয়ে ইউনূস সাহেবকে প্রণাম করব, আমার লেখালেখির কসম।

সহায়ক লিংক:
১.পুঁজির নয়া রূপকার: http://www.dailykalerkantho.com/epaper/pop_up.php?archiev=yes&arch_date=31-10-2010&img_name=2010/10/31/newspaper/images/07_101.jpg
২. লাশ-পদক-বানিজ্য: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_23.html
৩. নূপুর: http://www.ali-mahmed.com/2008/07/blog-post_3333.html 

No comments: