একদেশে এক রাজা ছিলেন। রাজার একটা দাঁতভাঙ্গা নামও ছিল। নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে, প্রবল অত্যাচার সইতে না পেরে দাঁত খুলে আসলে যন্ত্রণার একশেষ। নাম থাকুক।
তো, একদেশের এক রাজা এক রাতে এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলেন। আমাদের এই সময়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখলে বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রায় শূন্য গ্রে-মেটার শেষ করে ফেলতেন।
কেউ হয়তো বলতেন, কিছু ঘটনা চেতন মন অবহেলায় এড়িয়ে যায়- অবচেতন মন ওসব যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে। স্বপ্নের মাধ্যমে অন্যরকম বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। কেউ বা বলতেন, গুরুপাক খাবার এজন্যে দায়ী, হজমের সমস্যাই স্বপ্নের জন্যে সহায়ক হয়েছে।
কিসব কথা, গুরুপাক খাবারে রাজা-ফাজার সমস্যা হবে কেন! বরঞ্চ গুরুপাক না খেয়ে সাধারণ খাবার খেলেই রাজার হজমে সমস্যা হওয়ার কথা।
তবে এও সত্য, এই রাজার দাঁতগুলো ছিল অসম্ভব খারাপ। অনেক সময় খাবার চিবাতে গিয়ে দাঁত চিবিয়ে ফেলতেন, টেরটিও পেতেন না। ইনার সভাসদদের একজন, প্রধান ভাঁড় প্রায়ই ঠাট্টা করতেন: রাজা মশায়, আপনার দাঁতের যে অবস্থা, একদিন দেখবেন আপনার অজান্তেই টুপ করে মাটিতে দাঁত পড়ে, দেখবেন শেষে সেই দাঁতে হোঁচট খেয়ে নিজের পা নিজেই কেটে ফেলেছেন।
রাজা-টাজাদের সঙ্গে কেউ এরকম রসিকতা করলে তাদের মুণ্ডু মাটিতে গড়াগড়ি খায়। কিন্তু এ রাজা হা হা করে হাসতেন। এমনিতেও আংটির ছাপ মেরে লিখে দিয়েছিলেন, রাগ করে রাজা এই ভাঁড়কে হত্যার আদেশ দিলেও তা যেন পালন না করা হয়। তো, রাজা দাঁতের জন্যে খাবার ভালো চিবাতে পারতেন না, এজন্যে হজমে ব্যাঘাত ঘটলেও ঘটতে পারে।
তো যাই হোক, রাজা স্বপ্ন দেখলেন একটা গায়েবি আওয়াজ তাকে বলছে, এই রাজা তোর যে দু-চারটা দাঁত এখনো ঝুলে আছে এগুলো ফেলে দে।
রাজার দেহ থরথর করে কাপছে। ভয়াবহ রকম লাফাচ্ছে দেখে হৃদপিণ্ডটা মুঠোয় চেপে লাফালাফি কমালেন।
রাজা (গোঁ-গোঁ করে): এসব কি বলছেন, আমি খাব কি করে!
গায়েবী আওয়াজ: আরে ব্যাটা খাবার থাকলে তো খাবি! অচিরেই তোর দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, এককিনি, একটা শস্যও থাকবে না।
রাজা (বিলাপ করে): কী সর্বনাশ, আমার কি হবে গো, তাহলে উপায়!
গা. আওয়াজ: উপায় আছে। তার আগে তুই বল, কোন জিনিস কাটলে বাড়ে?
রাজা: গায়েবী ভাইয়া, আমার মাথা ঠিক নাই, দয়া করে রসিকতা করবেন না।
গা. আওয়াজ: হাহ, পারলি না তো। পুকুর রে ব্যাটা, পুকুর। খাল আর পুকুর কাটলে বাড়ে।
রাজা: বাড়লে বাড়ূক আমার কি! দুর্ভিক্ষের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?
গা. আওয়াজ: আরে কি ফড়ফড় করছে। সোজা ব্যাপারটা ধরতে পারছিস না? তোর দেশে এমন তো না ইন্ডাস্ট্রি-ফিন্ডাস্ট্রি আছে, মাটির নিচে যে সব সম্পদ আছে তাও তুলতে পারবি না। কৃষি নির্ভর দেশ। চাষাবাদই ভরসা। জানিস না, সূর্য দুহাত নিচে নেমে এসেছে, দেশটা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। খাবি কি, বালি? খাল কেটে পানির ব্যবস্থা কর। বাট রিমেম্বার, খাল কেটে কুমির আনিস না।
ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা তার সভাসদদের জরুরি তলব করলেন। সভা যখন শেষ হলো, ভোর হয় হয়। রাজা তখন চোখ ধাঁধানো আলখেল্লা (সাফারীর মত মত একটা জিনিস), মুকুট, নাটবল্টু যা যা ঠুন ঠুন করছিল সব খুলে ফেলে গেঞ্জির মতো একটা ফতুয়া পড়লেন। সাঙ্গোপাঙ্গোসহ হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। হাতিয়ার মানে কোদালের মতো একটা জিনিস। সাঙ্গোপাঙ্গো, প্রজাদের বললেন, বাদ্য বাজাও। হাজার হাজার নাকাড়া বেজে উঠল। আকাশলোকের বাসিন্দা চমকে উঠলেন, ভুল করে কেউ বজ্রপাতের সুইচ টিপে দেয় নাই তো!
রাজা মাটিতে কয়েক কোপ দিয়ে ভুড়ি ভাসিয়ে ওখানেই বসে পড়লেন। কৃষক, আপামর প্রজা এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলো। তাদের মুগ্ধতা চুয়ে মাটি ভিজে গেল। দেশের লোকজন খাওয়া আর ওই কাজটার (ভদ্রসমাজে বিস্তারিত বললাম না, মতান্তরে এতে জনসংখ্যা ধাম ধাম বাড়তে থাকে) সময় বাদ দিয়ে খাল কাটায় লেগে গেল। খাল কাটতে কাটতে এক সময় রাজার মৃত্যু হল। পাওয়ার মধ্যে পাওয়া গেল ছেঁড়া গেঞ্জি আর তোবড়ানো শাহী তোরঙ্গ।
রাজার বউ রাণী হলেন। এটাই নিয়ম।
এই রাণীও পূর্ণ উদ্যমে খাল কাটার কর্মসূচি হাতে নিলেন। সমস্যা দেখা দিল কাটার মতো খাল পাওয়া যাচ্ছিল না। যাও বা আছে, কোমর সমান থকথকে কাদা।
ঝানু সভাসদরা অনেক মাথা খাটিয়ে একটা উপায় বের করলেন। সেই অনুযায়ী কোমর সমান কাদার ওপর হাজার হাজার লোক টনকে টন মাটি ফেলল। শত শত হাতি এনে মাটি বসিয়ে সমান করা হল। রাণী এলেন, আওয়াজ উঠল, বাদ্য বাজাও। বাদ্য বাজল। রাণী আলতো কোপ দিয়ে জমাট মাখনের মতো এক খাবলা মাটি তুলে ফেললেন।
সে দেশে এমন ফসল ফলল যে, উদ্ধৃত্ত খাদ্য সাগরে ফেলে দিতে হল। উপায় কী, এতো গোলা কই! ওই দেশে এমন সুখ নেমে এল যে কেউ স্বর্গে যেতে চাইত না। পরিজনহীন, একাকী, অভুক্ত শীর্ণ দেহে কেউ বিশাল আকাশের নিচে আবর্জনায় শুয়ে থাকত না। কোন যুবতী মাকে নির্দয় হাতে বুকের শিশুকে একপাশে সরিয়ে দেহ বিক্রির আশায় বিমর্ষ মুখে ঘুরে বেড়াতে হত না।
শান্তি আর শান্তি...।
*আমি যেটা বলি, ফিকশনের জন্ম রিপোর্টিং-এর গর্ভে। মোটা দাগে ফিকশনের মা হচ্ছে রিপোর্টিং (বাবা কে এটা অবশ্য আমার জানা নাই)। এই লেখাটা লিখেছিলাম যে ঘটনার উপর সেটা খানিকটা বলি। সালটা ১৯৯১। রিপোর্টটা পত্রিকা থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি:
"২২ নভেম্বর, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ডিএনডি-তিতাস খাল পুন:খননের মাধ্যমে খাল কাটা কর্মসূচীর উদ্বোধন করবেন। ডিএনডি-তিতাস খাল ছিল খনন অনুপযোগী (মানে আদৌ খননের প্রয়োজন ছিল না)।
এজন্য উদ্বোধনের ১০ দিন আগে থেকেই সংস্কার কাজ শুরু হয়, যাতে খালেদা জিয়া নির্বিঘ্নে কোদাল চালাতে পারেন। প্রথমে কোমর সমান কাদা সরানো হয়। তারপর সেখানে বালি ফেলা হয়, বালির উপর মাটি দেয়া হয়। এভাবেই বিপুল অর্থ ব্যয়ে খালটিকে খনন উপযোগী করে তোলা হয়। মন্ত্রীরাসহ খালেদা জিয়া যে মাটি কেটেছিলেন তা মাত্র ২দিন আগে ফেলা।"
*বিটিভি-তে প্রচারিত সেই অনুষ্ঠান এ দেশের আপামর জনতা প্রত্যক্ষ করলেন। তাদের মধ্যে এ অধমও একজন।
**'একালের প্রলাপ' থেকে
***ছবিস্বত্ব: সংরক্ষিত
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Thursday, April 16, 2009
খাল কাটো রে, কুমির এনো না
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment