ইশকুলটা [১] চালু করা হয়েছিল (১৩ জুন, ২০১০)। প্রায় এক মাস হতে চলল। দেশের বাইরে যাওয়ার কারণে এবং আমার নিজস্ব কিছু জাগতিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিলাম বলে ইশকুলে নিয়মিত যাওয়া সম্ভব হয়নি।
কিছু কারণে আজ আমার মনটা ভারী বিষণ্ন। আমার মন খারাপ হলে হাঁটতে হাঁটতে ইশকুলে চলে যাই- বিচ্ছুদের যন্ত্রণায় কখন মনটা ভালো হয়ে যায় টেরটিও পাই না!
আজ এখানে আসার পর মাস্টার মশাই শশব্যস্ত হয়ে এদের পড়ার অগ্রগতি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি আগের পোস্টেও [২] উল্লেখ করেছিলাম, মাস্টার মশাইকে আমি স্পষ্ট করে বলেছিলাম, আমার কাছে এদের পড়ার চেয়ে গুরুত্ব বেশি যেটা এদের সহবত, পরিছন্নতা...। কারণ এরা আপনার আমার সন্তান না, এরা হরিজনদের সন্তান- যাদের আমরা তাচ্ছিল্য করে বলি, মেথরদের সন্তান।
ভাল লাগে এটা দেখে, এদের নোখগুলো ছোট করে কাটা, দাঁত পরিষ্কার! খাওয়ার পূর্বে হাত ধোয়ার অভ্যাসটাও এরা রপ্ত করে ফেলেছে।
ধন্যবাদ, মাস্টার মশাই।
ডান পাশেরটাকে আমি বলি, ব্যাটা দাঁত দেখি। এ একটু বেশি দাঁত দেখাতে গিয়ে মুখের চকলেটটা পড়ে গিয়েছিল। এদের জন্য আবার চকলেট না নিয়ে গেলে বড়ো যন্ত্রণা করে।
ডান পাশের বাচ্চাটাকে তার মা নিয়ে যেতে চাচ্ছিল কারণ এর গায়ে জামা নাই। এই পরিবারটা এতই হতদরিদ্র, বাচ্চাটা ইশকুলে আসে জামা ছাড়া।
অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এদের জামা-কাপড় প্রয়োজন, প্রয়োজন একটা ইশকুল ঘরের। এখন যে উঁচু চাতালটায় ক্লাশ করা হয় বৃষ্টি এসে সব পন্ড করে ফেলে। প্রয়োজন এদের প্রাথমিক চিকিৎসার।
ডাক্তার সাহেবদের তৈলমর্দন করে করে আমার ঘটির তৈল ফুরিয়ে গেছে। এমন না যে এদের মাগনা দেখে দেবেন কিন্তু ওখানে যেতে এদের বড়ো সমস্য। একজন ডাক্তার সাহেব আবার অতি ধার্মিক টাইপের, ধর্মের গাট্টি নিয়ে দেখি প্রায়ই ছুটাছুটি করতে। তো, ওনার আবার সামনে যেন কি একটা পরীক্ষা, তিনি ৩০ মিনিট সময়ও বের করতে পারছেন না! তিনি স্বর্গ জয় করুন!
কেন যে 'নেকাপড়াটা' ভালো করে করলাম না। ...শ্লার জীবন একটা আমার! ছোটখাটো একজন ডাক্তার হতে পারলেও কাজ হতো। এই একটা পেশাকে আমি ঈর্ষা করি।
আমার ভাষায় এঁরা দ্বিতীয় ঈশ্বর- একজন মুমূর্ষু রোগি যখন আধ-জবাই পশুর মত ছটফট করতে থাকে তখন উপরে প্রথম ঈশ্বর আর নীচে দ্বিতীয় ঈশ্বর ডাক্তার; মাঝামাঝি আর কেউ নাই, কিছু নাই।
আমি এই মা-টার মুখ [৩] এখনো ভুলতে পারি না।
সহায়ক লিংক:
১. ইশকুল, এক: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_14.html
২. ইশকুল, দুই: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_5273.html
৩. মা এবং তাঁর অদেখা সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_10.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Sunday, July 11, 2010
ইশকুল: অগ্রগতি
বিভাগ
আমাদের ইশকুল: এক
একজন ফ্রিডম ফাইটার এবং তিন টাকা দামের রাইটার
ক-দিন আগে ঢাকা থেকে ফিরছি। আসন সহ আমার একটা টিকেট দরকার, পাচ্ছি না। এই দিনই আমি জরুরি একটা কাজে ঢাকা গেছি রাতের ট্রেনে। ঘুমের সমস্যা হয়েছে, সমস্ত দিন রোদে পুড়তে হয়েছে, এরপর দাঁড়িয়ে আসাটা প্রায় অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে।
এই একটা ঢং হয়েছে, রেলওয়ে যাত্রীদের বসার জায়গা দিতে পারছে না। যত যাত্রী আসন পান প্রায় তত যাত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুখকর (!) ভ্রমণ করেন।
একবার রেলওয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, আপনারা কিছু জায়গায় ডাবল লাইন বসিয়ে, কিছু ইঞ্জিন, বেশ কিছু বগির ব্যবস্থা করলেই তো সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, বলেন কী, তাহলে এতোগুলো যে ভলভো বাস চলছে এগুলোর কি গতি হবে!
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে কী?
ভদ্রলোক হাতে কিল মেরে বললেন, লাগবেন বাজী?
সাথে কোন টাকা-পয়সা ছিল না বিধায় বাজী লাগার প্রশ্নই আসে না। আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকি।
তো, অপ্রচলিত স্পীড মানি, প্রচলিত ঘুষ নামের বাড়তি টাকা দিলে হয়তো টিকেট বের হয়ে আসত। এতে আমার আবার এলার্জি আছে [১]। আমি সহজ পথে না গিয়ে কঠিন পথটাই বেছে নেই। যে স্টেশনে নামব
আজমপুর, ওই স্টেশনের টিকেট না পেয়ে পরবর্তী একের পর এক স্টেশনের টিকেট চাইতে থাকি। অবশেষে শ্রীমংগলের একটা টিকেট পাওয়া গেল। তাই সই। আরামের শ্বাস ফেললাম। যাক, বসার একটা ব্যবস্থা তো হলো। রাতজাগার ক্লান্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে পায়ের ব্যথা। অন্যমনস্ক থাকার কারণে উঠার সময় ডান হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছি। এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।
ঢাকা থেকে ট্রেন যখন ছাড়ল, আসনগুলো ফাঁকা-ফাঁকা। আমার আসন থেকে খানিকটা দূরে কালো পোশাকে বয়স্ক একজন মানুষকে আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম। কেবল তাঁর পেল্লাই গোঁফ দৃষ্টি কেড়েছিল এমন না, মানুষটার বসার ভঙ্গি ঋজু, টান-টান! খানিকটা অন্য রকম।
ওয়াল্লা, বিমানবন্দর স্টেশন আসার পর পঙ্গপালের মত লোকজন উঠা শুরু করল। অল্প বয়সের দুইটা ছেলে অমার্জিত ভঙ্গিতেই এই মানুষটাকে বলল, এই যে-এই যে, সিট ছাড়েন।
মানুষটা শশব্যস্ত হয়ে আসন ছেড়ে উঠে একপাশে এসে দাঁড়ান। এবার মানুষটাকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার। মানুষটার বুকে মুক্তিযোদ্ধার ছোট্ট গোল ব্যাজ দেখে আমি তাঁর কাছে গিয়ে অনুচ্চ গলায় বলি, স্যার, আপনি কি ফ্রিডম ফাইটার? মানুষটা মাথা নাড়েন।
আমি তাঁকে বললাম, আপনি আমার সিটে বসেন।
মানুষটা রাজি হন না। আমি যতই বলি কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমিও হাল ছাড়ি না। বলি, প্লিজ বসেন, দেখেন লোকজন সবাই তাকিয়ে আছে।
মানুষটা তবুও রাজি হন না।
আমি আস্তিন থেকে লুকানো অস্ত্রটা বের করি। গলা আরও নামিয়ে বলি, স্যার, একজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে থাকলে আমি বসতে পারি না। আপনি কি চান আমিও দাঁড়িয়ে থাকি?
নিতান্ত অনিচ্ছায় এবার মানুষটা বসেন। আমার পাশের ছেলেটার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সে হড়বড় করে বলে উঠে, আপনিও বসেন, তিনজন বসা যাবে।
মুক্তিযোদ্ধা নামের মানুষটার সঙ্গে টুকটাক কথা চলতে থাকে। তাঁর নাম, মনোহর বিশ্বাস। বাড়ি রায়পুরার শ্রীনিধি। যাবেন আশুগঞ্জ। আমি জানতে চাই, আপনি কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন?
তিনি বলেন, ৩নং সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ।
আমি বললাম, আপনি কোন খেতাব পেয়েছিলেন?
তিনি সম্ভবত খানিকটা বিব্রত হন। বলেন, না।
এই প্রশ্নটা করার জন্য নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছা করছিল। আমি এবার তাঁকে বলি, দেখেন, খেতাব পাওয়া, না পাওয়া দিয়ে কি আসে যায়। আমাদের দেশে এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাদের যোগ্যতা থাকার পরও খেতাব পাননি। আপনি তো জানেন, খেতাব নিয়েও সমস্যা ছিল। তাঁকে বলি, দুলা মিয়ার কথা [২]। বলি, নৌ-কমান্ডোর ফজলুল হক[৩] [৪], ট্যাংক-মানব এম, এ জব্বারের কথা [৫]। মানুষটার হয়তো খানিকটা সংকোচ কাটে।
৩ নং সেক্টরে তাঁর যুদ্ধ করার জায়গা ছিল আজমপুর, আখাউড়া। তখন আখাউড়া-কসবায় তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল
কারণ ভারত সীমান্ত একেবারে লাগোয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হতে থাকে। তিনিই জানান তাঁর গেজেট নাম্বার ১৬২ হালের ১১২২। ভোটার নাম্বার ১৭১।
আমি অবাক হই, ভোটার নাম্বার কি আবার?
তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভোটের নাম্বার। ভোট দেয়ার পদ্ধতিটা বেশ জটিল, উপজেলায় পর্যায়ে ১১টা, জেলায় ১৭, কেন্দ্রীয় ৪১টা মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ৬৯টা ভোট নাকি দিতে হয়।
তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলেন। মামা দিয়েছিলেন গরু বিক্রি করার জন্য। দু-হাত উঁচু গরু। ১১০ টাকায় গরু ৯০ টাকায় বিক্রি করে মামাকে ৪০ দিয়ে বাকী ৫০ টাকা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আগরতলায়। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় আসাম।
তাকে এবার আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি সিট পাননি?
তিনি বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে টিকেট নিতে পারতাম, ইচ্ছা করেই নেই নাই। ভাবলাম, সরকার কেন একটা সিটের টাকা থেকে বঞ্চিত হবে।
আমি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি না। বললাম, এটা আপনার পাওনা। আপনি আপনার ন্যায্য পাওনা কেন ছাড়বেন!
তিনি মৃদু স্বরে বলেন, না, ভাবলাম কাছেই তো আশুগঞ্জ।
মানুষটা কথা ঘুরাতে চাচ্ছেন। আমি এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
আমি যখন তাঁর ছবি উঠাচ্ছিলাম, সেই দুইটা অমার্জিত ছেলের একজন জানতে চাইল, ভাই, আপনি কি সাংবাদিক নাকি?
এই হয়েছে এক জ্বালা! এই দেশে মনে হয় অলিখিত আইন হয়েছে সাংবাদিক ব্যতীত অন্য কেউ ছবি উঠালে তাকে জনে জনে ব্যাখ্যা দিতে হবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, না।
এ এবারও জিজ্ঞেস করে, না, উনার ছবি তুললেন তো। এই জন্য জিগাইলাম। ওনার ছবি দিয়া কি করবেন?
এবার আমি কঠিন গলায় বললাম, বাংলাদেশে কি কোন আইন পাশ হয়েছে যে কারও ছবি তোলা যাবে না? এটা আমার একটা বদঅভ্যাস, চলার পথে যাকে ভাল লাগে তার ছবি তুলে রাখি। অবশ্য সবার না, বেতমিজদের ছবি আমি আবার উঠাই না।
আশুগঞ্জ চলে আসে। তিনি নামবেন। তাঁর সঙ্গে অতি হালকা একটা ব্যাগ। আমি হাত বাড়াই, এটা দেন আমার কাছে।
আবারও মানুষটার তীব্র অনীহা। জোরে আঁকড়ে ধরেন ব্যাগটা। কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না। আমি আমার আস্তিন থেকে আবারও অস্ত্রটা বের করি, দেখেন, লোকজন জমে যাবে। দেন এটা আমার কাছে, আমার ভাল লাগবে।
মানুষটাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। আমাকে নামতে হবে আরও কয়েক স্টেশন পর। ট্রেনটা যখন স্টেশন অতিক্রম করছিল ভাগ্যিস তখন বাইরে তাকিয়েছিলাম। খানিকটা আড়ালে কালো পোশাকপরা ঋজু, টান-টান মানুষটা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। মানুষটা ঠায় দাঁড়িয়ে। ট্রেন চলে যাচ্ছে কিন্তু মানুষটা অনঢ়।
বিস্মিত হয়ে ভাবি, এঁরা কী অল্পতেই না তুষ্ট হন! অথচ এঁদের জন্যই আজ আমি বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখে মনের চাপ কমাতে পারি, বাংলায় হাহাকার করে বুক হালকা করতে পারি।
সহায়ক লিংক:
১. ঘুষখোর: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_3654.html
২. দুলা মিয়া: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_08.html
৩. নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া, ১: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_18.html
৪. নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া, ২: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_22.html
৫. ট্যাংক-মানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_03.html
৬. মিডিয়ার আয়োজন করে কান্না: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_05.html
এই একটা ঢং হয়েছে, রেলওয়ে যাত্রীদের বসার জায়গা দিতে পারছে না। যত যাত্রী আসন পান প্রায় তত যাত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুখকর (!) ভ্রমণ করেন।
একবার রেলওয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, আপনারা কিছু জায়গায় ডাবল লাইন বসিয়ে, কিছু ইঞ্জিন, বেশ কিছু বগির ব্যবস্থা করলেই তো সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, বলেন কী, তাহলে এতোগুলো যে ভলভো বাস চলছে এগুলোর কি গতি হবে!
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে কী?
তিনি বললেন, বুঝলেন না! যেসব ভলবো বাস চলছে, খোঁজ নিয়ে দেখবেন যারা রেলকে লাভজনক করার দায়িত্বে আছেন এদের অনেকেরই বেনামে অনেকগুলো বাস। এরা আবার বুদ্ধি করে কোন একটা কোম্পানিকে চুক্তিতে দিয়ে দেয়। ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল।
আমার চোখে অবিশ্বাস, কোত্থেকে পেলেন আপনি এই তথ্য!ভদ্রলোক হাতে কিল মেরে বললেন, লাগবেন বাজী?
সাথে কোন টাকা-পয়সা ছিল না বিধায় বাজী লাগার প্রশ্নই আসে না। আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকি।
তো, অপ্রচলিত স্পীড মানি, প্রচলিত ঘুষ নামের বাড়তি টাকা দিলে হয়তো টিকেট বের হয়ে আসত। এতে আমার আবার এলার্জি আছে [১]। আমি সহজ পথে না গিয়ে কঠিন পথটাই বেছে নেই। যে স্টেশনে নামব
আজমপুর, ওই স্টেশনের টিকেট না পেয়ে পরবর্তী একের পর এক স্টেশনের টিকেট চাইতে থাকি। অবশেষে শ্রীমংগলের একটা টিকেট পাওয়া গেল। তাই সই। আরামের শ্বাস ফেললাম। যাক, বসার একটা ব্যবস্থা তো হলো। রাতজাগার ক্লান্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে পায়ের ব্যথা। অন্যমনস্ক থাকার কারণে উঠার সময় ডান হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছি। এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।
ঢাকা থেকে ট্রেন যখন ছাড়ল, আসনগুলো ফাঁকা-ফাঁকা। আমার আসন থেকে খানিকটা দূরে কালো পোশাকে বয়স্ক একজন মানুষকে আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম। কেবল তাঁর পেল্লাই গোঁফ দৃষ্টি কেড়েছিল এমন না, মানুষটার বসার ভঙ্গি ঋজু, টান-টান! খানিকটা অন্য রকম।
ওয়াল্লা, বিমানবন্দর স্টেশন আসার পর পঙ্গপালের মত লোকজন উঠা শুরু করল। অল্প বয়সের দুইটা ছেলে অমার্জিত ভঙ্গিতেই এই মানুষটাকে বলল, এই যে-এই যে, সিট ছাড়েন।
মানুষটা শশব্যস্ত হয়ে আসন ছেড়ে উঠে একপাশে এসে দাঁড়ান। এবার মানুষটাকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার। মানুষটার বুকে মুক্তিযোদ্ধার ছোট্ট গোল ব্যাজ দেখে আমি তাঁর কাছে গিয়ে অনুচ্চ গলায় বলি, স্যার, আপনি কি ফ্রিডম ফাইটার? মানুষটা মাথা নাড়েন।
আমি তাঁকে বললাম, আপনি আমার সিটে বসেন।
মানুষটা রাজি হন না। আমি যতই বলি কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমিও হাল ছাড়ি না। বলি, প্লিজ বসেন, দেখেন লোকজন সবাই তাকিয়ে আছে।
মানুষটা তবুও রাজি হন না।
আমি আস্তিন থেকে লুকানো অস্ত্রটা বের করি। গলা আরও নামিয়ে বলি, স্যার, একজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে থাকলে আমি বসতে পারি না। আপনি কি চান আমিও দাঁড়িয়ে থাকি?
নিতান্ত অনিচ্ছায় এবার মানুষটা বসেন। আমার পাশের ছেলেটার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সে হড়বড় করে বলে উঠে, আপনিও বসেন, তিনজন বসা যাবে।
মুক্তিযোদ্ধা নামের মানুষটার সঙ্গে টুকটাক কথা চলতে থাকে। তাঁর নাম, মনোহর বিশ্বাস। বাড়ি রায়পুরার শ্রীনিধি। যাবেন আশুগঞ্জ। আমি জানতে চাই, আপনি কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন?
তিনি বলেন, ৩নং সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ।
আমি বললাম, আপনি কোন খেতাব পেয়েছিলেন?
তিনি সম্ভবত খানিকটা বিব্রত হন। বলেন, না।
এই প্রশ্নটা করার জন্য নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছা করছিল। আমি এবার তাঁকে বলি, দেখেন, খেতাব পাওয়া, না পাওয়া দিয়ে কি আসে যায়। আমাদের দেশে এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাদের যোগ্যতা থাকার পরও খেতাব পাননি। আপনি তো জানেন, খেতাব নিয়েও সমস্যা ছিল। তাঁকে বলি, দুলা মিয়ার কথা [২]। বলি, নৌ-কমান্ডোর ফজলুল হক[৩] [৪], ট্যাংক-মানব এম, এ জব্বারের কথা [৫]। মানুষটার হয়তো খানিকটা সংকোচ কাটে।
৩ নং সেক্টরে তাঁর যুদ্ধ করার জায়গা ছিল আজমপুর, আখাউড়া। তখন আখাউড়া-কসবায় তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল
কারণ ভারত সীমান্ত একেবারে লাগোয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হতে থাকে। তিনিই জানান তাঁর গেজেট নাম্বার ১৬২ হালের ১১২২। ভোটার নাম্বার ১৭১।
আমি অবাক হই, ভোটার নাম্বার কি আবার?
তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভোটের নাম্বার। ভোট দেয়ার পদ্ধতিটা বেশ জটিল, উপজেলায় পর্যায়ে ১১টা, জেলায় ১৭, কেন্দ্রীয় ৪১টা মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ৬৯টা ভোট নাকি দিতে হয়।
তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলেন। মামা দিয়েছিলেন গরু বিক্রি করার জন্য। দু-হাত উঁচু গরু। ১১০ টাকায় গরু ৯০ টাকায় বিক্রি করে মামাকে ৪০ দিয়ে বাকী ৫০ টাকা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আগরতলায়। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় আসাম।
তাকে এবার আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি সিট পাননি?
তিনি বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে টিকেট নিতে পারতাম, ইচ্ছা করেই নেই নাই। ভাবলাম, সরকার কেন একটা সিটের টাকা থেকে বঞ্চিত হবে।
আমি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি না। বললাম, এটা আপনার পাওনা। আপনি আপনার ন্যায্য পাওনা কেন ছাড়বেন!
তিনি মৃদু স্বরে বলেন, না, ভাবলাম কাছেই তো আশুগঞ্জ।
মানুষটা কথা ঘুরাতে চাচ্ছেন। আমি এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
আমি যখন তাঁর ছবি উঠাচ্ছিলাম, সেই দুইটা অমার্জিত ছেলের একজন জানতে চাইল, ভাই, আপনি কি সাংবাদিক নাকি?
এই হয়েছে এক জ্বালা! এই দেশে মনে হয় অলিখিত আইন হয়েছে সাংবাদিক ব্যতীত অন্য কেউ ছবি উঠালে তাকে জনে জনে ব্যাখ্যা দিতে হবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, না।
এ এবারও জিজ্ঞেস করে, না, উনার ছবি তুললেন তো। এই জন্য জিগাইলাম। ওনার ছবি দিয়া কি করবেন?
এবার আমি কঠিন গলায় বললাম, বাংলাদেশে কি কোন আইন পাশ হয়েছে যে কারও ছবি তোলা যাবে না? এটা আমার একটা বদঅভ্যাস, চলার পথে যাকে ভাল লাগে তার ছবি তুলে রাখি। অবশ্য সবার না, বেতমিজদের ছবি আমি আবার উঠাই না।
আশুগঞ্জ চলে আসে। তিনি নামবেন। তাঁর সঙ্গে অতি হালকা একটা ব্যাগ। আমি হাত বাড়াই, এটা দেন আমার কাছে।
আবারও মানুষটার তীব্র অনীহা। জোরে আঁকড়ে ধরেন ব্যাগটা। কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না। আমি আমার আস্তিন থেকে আবারও অস্ত্রটা বের করি, দেখেন, লোকজন জমে যাবে। দেন এটা আমার কাছে, আমার ভাল লাগবে।
মানুষটাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। আমাকে নামতে হবে আরও কয়েক স্টেশন পর। ট্রেনটা যখন স্টেশন অতিক্রম করছিল ভাগ্যিস তখন বাইরে তাকিয়েছিলাম। খানিকটা আড়ালে কালো পোশাকপরা ঋজু, টান-টান মানুষটা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। মানুষটা ঠায় দাঁড়িয়ে। ট্রেন চলে যাচ্ছে কিন্তু মানুষটা অনঢ়।
বিস্মিত হয়ে ভাবি, এঁরা কী অল্পতেই না তুষ্ট হন! অথচ এঁদের জন্যই আজ আমি বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখে মনের চাপ কমাতে পারি, বাংলায় হাহাকার করে বুক হালকা করতে পারি।
আমি অনুমান করতে পারি, মানুষটা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। মাস গুলিয়ে ফেলেছেন, এটা কি জুলাই না ডিসেম্বর? এই সব মানুষরা ধরেই নিয়েছেন, ডিসেম্বর এলেই আমরা এঁদের নিয়ে হইচই শুরু করব তারপর আরেকটা ডিসেম্বরের জন্য অপেক্ষা করব। বিশেষ মাস ব্যতীত আমাদের যে আবার জোশ-কান্না আসে না [৬]!
সহায়ক লিংক:
১. ঘুষখোর: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_3654.html
২. দুলা মিয়া: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_08.html
৩. নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া, ১: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_18.html
৪. নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া, ২: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_22.html
৫. ট্যাংক-মানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_03.html
৬. মিডিয়ার আয়োজন করে কান্না: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_05.html
বিভাগ
১৯৭১: প্রসব বেদনা
Subscribe to:
Posts (Atom)