ইভা বিরক্ত হয়ে টিভি অফ করল। সিএনএন-এর অনুষ্ঠান হচ্ছে। নিউজ আর নিউজ, বিরক্তিকর। ক্লিনটন গোদা গোদা পা ফেলে দৌড়াচ্ছে, ক্যামেরাও দৌড়াচ্ছে। ক্লিনটন ক্যানের জুস খাচ্ছে, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, বোকা বোকা হাসি হেসে ফাটা গলায় গাঁ গাঁ করছে; আরিজোনায় বৃষ্টি হবে কি না এটা ঘনঘন জানানো হচ্ছে, যেন আরিজোনার বৃষ্টির আশায় আড়িখোলার লোক উদগ্রীব হযে বসে থাকে!
পরিবারের সবাই মিলে ‘শো বিজ’ 'স্টাইল'-এর অ্যাড দেখে কি করে কে জানে! ‘স্টাইল’-এর মডেলদের বুক কতভাগ ঢাকা আর কতভাগ খোলা এ নিয়ে থিসিস সাবমিট করা যেতে পারে। একেকজনের কী হাঁটা, কোমর একবার একহাত ডানে চলে যাচ্ছে আরেকবার দেড় হাত বাঁয়ে।
ইভা বিস্মিত হলো, জয়ের কালেকশনে দেখি প্রচুর বই। এসব বই পড়ল কখন! অডিও ক্যাসেটই হবে তিন চারশোর কম না। ডায়েরি দেখছে একুশটা। ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখল, একেকটায় একেক রকম বিষয়। কোনটায় বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য কোনটায় মজার মজার সব কথা, কোনটায় বা বিচিত্র সব তথ্য। তিনটা ডায়েরির পুরোটাই হলো পেপার কাটিং। সব ধুলোয় মাখামাখি।
শাশুড়ীর কাছে একটা ময়লা কাপড়-টাপড় চেয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন, কাপড় দিয়ে কি করবে, বৌমা?
মা, ধুলায় দেখেন না কি অবস্থা!
‘সাবধান, বৌমা, ও কাজ করো না। আমি পরিষ্কার করতে গেলে তেড়ে আসত যেন গুপ্তধনে হাত দিয়ে ফেলেছি।
মা, ক্যাসেটগুলো ধুলো পড়ে নষ্ট হবে তো।
হোক, তুমি এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। ও একটা পাগল-ছাগল। একবার কি হলো জানে, ওর চশমা ভেঙ্গে গেল। বাড়তি চশমা নাই। নতুনটা একদিন পর পাওয়া যাবে। ডানদিকে মাইনাস সাড়ে সাত, বামেরটা সাত। সন্ধ্যায় দেখি দিপুর খেলনা বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মগ্ন হয়ে টিভি দেখছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিরে জয়, এই সব কি!
জয় বলল, কিছু না তো মা, টিভি দেখছি। চশমা ছাড়া তো কিছুই দেখি না। এটা লাগিয়ে কি বড় আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
আমি হাহাকার করে বললাম, জয়, তোর চোখ এত খারাপ!
ও হাসতে হাসতে বলল, আহ মা, এমন করে বলছ, যেন আমি অন্ধ হয়ে গেছি?
কেমন দাঁত বের করে হাসছিল, ইচ্ছা করছিল ঠাস করে একটা চটকনা লাগাই। ওমা কি কান্ড, ওর চোখ যে এত খারাপ এটা বলে দিলাম বুঝি! বৌমা, আমি কিন্তু কিছু বলিনি।
শাশুড়ি হাসি গোপন করে আবার বলেছিলেন, ওর আরও কান্ড-কীর্তি শুনবে? বাসায় ও হঠাৎ করেই টুপি লাগানো শুরু করল। আমি স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম, যাক এতদিনে ছেলেটার ধর্ম-কর্মে মতি হলো। ওমা, কিসের কি! টুপি লাগিয়ে দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে! সন্দেহ হলো, নাহ, গন্ডগোল আছে। জিজ্ঞেস করতেই নিরীহ গলায় বলল, মা, চুল বসাচ্ছি।
আমার তো মাথায় হাত, চুল বসাচ্ছিস মানে? বান্দরটা বলল কি জানো? বলে, দেখো না, চুল কি শক্ত! জানো মা, মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়, ইচ্ছা করে মাথা কামিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করার ব্রাশ বানিয়ে ফেলি। আর দেখো, কেমন ভাঁজ খেয়ে পদ্মার ঢেউ খেলে থাকে। চুল ঠিক করতে দশ-পনেরো মিনিট সময় লাগে। এর কোন মানে হয় বলো, সুপারসনিক যুগে? এ অপচয়, জঘন্য-জঘন্য।
ইভা শাশুড়ীর কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। এর দেখি অদ্ভুত সব কান্ড কারখানা। ডায়েরিতে এক জায়গায় লিখে রেখেছে সংসদ বাঙ্গালা অভিধান মতে, কুত্তা মানে কুকুর। বন্ধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে খেঁকি কুত্তা, ডালকুত্তা, নেড়ি কুত্তা। এই তিন কুত্তাকে কি করে চেনা যাবে এটা বলা হয় নাই। এটা অনুচিত হয়েছে। এদের চেনার উপায় সম্ভবত এরকম,
খেঁকিকুত্তা: দু-পেয়েরা ওর মত নয় দেখে অযথাই খেঁক খেঁক করে।
ডাল কুত্তা: ভার্সিটির ডাল খেতেও যাদের অনীহা নেই।
নেড়িকুত্তা: নেড়া মাথায় বিমর্ষ মুখে যে কুত্তা ঘুরে বেড়ায়।
জয় আরেক জায়গায় লিখেছে, এবারের কোবানী অ্যান্ড চাবানী ঈদে (যে সময় গরু ছাগল কুপিয়ে আরামসে চাবানো হয়) সুবিধে করা গেল না।
ইভা ব্যবহারে একটা কাপড় দিয়ে যতটুকু পারা যায় কম নাড়িয়ে ধুলো সরাতে লাগল। মাগো, কী নোংরা! এত নোংরা মানুষ থাকে, ছি! আর এই সব কি, যেখানে-সেখানে সিগারেটের ছাই ফেলেছে। কোথায় ফেলেনি? অডিও ক্যাসেটের খালি খাপ, পেনস্ট্যান্ড, ডেস্ক ক্যালেন্ডার-এ।
জয় ভেতরে ঢুকে খক খক করে কাশতে কাশতে বলল, ‘একি অবস্থা, ঘর দেখি ধুলায় অন্ধকার, হচ্ছে কী!’
‘দয়া করে একটাই কাজ করো; হয় কাশো, নয়তো কথা বলো।’
‘অ, এই ব্যাপার। জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে নাকেমুখে ধুলা ঢুকে গেছে। কিন্তু তুমি করছ কি?’
‘দেখছ না, এত নোংরায় মানুষ থাকে!’
জয় ঠোঁট উল্টে বলল, ‘পরিষ্কার করে লাভ কি, আবার তো নোংরা হবে।’
ইভার খুব রাগ হচ্ছে, ‘লজ্জা করছে না তোমার এসব বলতে?’
‘কি মুশকিল, সত্য বলতে পারব না?’
কর্কশ শব্দে টেলিফোন বাজছে। ইভা বলল, ‘জয়, আমার মাথায় রাগ চেপে যাচ্ছে। তুমি যাও টেলিফোন ধরো।’
জয় টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে বলল, ‘ইভা, তোমার ফোন।’
‘কে।’
'তোমার বোন ধ্রুবা। কোন সমস্যা হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না, আমার সঙ্গে একটা কথাও বলল না।’
ইভার বুক ভয়ে কাঁপতে লাগল। কোন দুঃসংবাদ না তো? বাবার কি কিছু হলো? কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘ধ্রুবা-ধ্রুবা, কি হয়েছে?’
ওপাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দ ভেসে এল। ইভার সহ্যাতীত মনে হচ্ছে। ‘ধ্রুবা বল, বল কি হয়েছে; বাবা ঠিক আছে তো?’
ধ্রুবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আপু, বাবা না আমাকে চড় দিয়েছে।’
ইভার বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেল। কিন্তু বাবা তো আজতক কারও গায়ে হাত তোলেননি!
‘তুই কি করেছিলি?
‘সাকলে আমি, বাবা-মা নাস্তা করছি। একটা রুটি শেষ করে আরেকটা নিয়েছি মাত্র-’
‘আহ ধ্রুবা, হয়েছে কি সেটা বলবি তো!’
‘আপু, এমন করছ কেন, বলছি তো। বাবা আমাকে বলল, ধ্রুবা এরকম চপচপ করে খাচ্ছিস কেন। আমি বললাম, চপচপ করে খাচ্ছি না তো। বাবা বললেন, ফাজিল মেয়ে চড় খাবি। আমি বললাম, চড় দিতে ইচ্ছা করলে দিয়ে ফেলো। বকছ কেন। বাবা আমাকে ঘুরিয়ে চড় দিলেন। আপু, আপু, বাবা আমাকে চড় দিলেন।’
ধ্রুবা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে থাকল। ইভার কেন জানি হাসি পাচ্ছে। ধ্রুবা, বাবা এসব কি শুরু করছে। হাসি চেপে বলল, ‘তো এখন হয়েছে কি?’
‘হয়েছে কি মানে, বিনা কারণে চড় দিলেন, এটা কিছু না!’
‘তুই বললি চড় দিতে, বাবা দিলেন। ব্যস শেষ হয়ে গেল। ’
‘তুমি খুব মজা পাচ্ছ, না?’
‘দূর পাগল, ঠাট্টা করছিলাম।’
ধ্রুবা সম্ভবত টেলিফোন আছড়ে ফেলল।
জয় বলল, ‘কাজটা কিন্তু তুমি ঠিক করলে না।’
‘কি ঠিক করলাম না?’
‘ধ্রুবার সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। টিন-এজ মেয়েরা সাঙ্ঘাতিক আবেগপ্রবণ হয়, উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেললে মহা সমস্যা।’
ইভা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি মনে হয় টিন-এজ মেয়ে বিশারদ।’
‘ধ্যাৎ, বিয়ের আগে কোন মেয়ের সঙ্গে ভাল করে পরিচয়ই হয়নি। দেখছ তো বাঁশগাছের মতে এই আকৃতি, মেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যেত। ভাল লাগার কথা সাহস করে কাউকে বলতেই পারলাম না। বাঁশগাছ দেখে মেয়েরাও গা করল না। একজনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, সে হচ্ছ তুমি।’
‘এ নিয়ে খুব কষ্টে আছ মনে হয়, ঘটা করে ঠান্ডা শ্বাস ফেলছ।’
জয় খসখস করে গাল চুলকে হাসল। ইভা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘কোনও মেয়েকে তোমার ভাল লাগেনি বলতে চাও?’
‘লাগবে না কেন, লেগেছে। তাতে কি হয়।’
‘কি হয়, সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখে মাথা ঘুরে যায়। তখন আমার মত মেয়েদের কুৎসিত মনে হয়।’
‘যাহ, তুমি কুৎসিত কে বলল!’
‘বলতে হবে, আমি বুঝি না, কচি খুকি?
‘বাদ দাও তো এসব।’
‘কেন, বাদ দেব কেন?’
‘আঃ ইভা, কিসব বলছ। আমি শুধু বলেছি ধ্রুবার বয়স কম, ঠিক এ মুহূর্তে ওর সঙ্গে রসিকতাটা করা ঠিক হয়নি। ব্যাস, এই তো।’
‘আমার বোনের সঙ্গে কি করব এটা তোমায় বলে দিতে হবে না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। খাবার নিয়ে মা বসে আছেন। এসো, খেয়ে নাও।’
‘সব নোংরা হয়েছে। যাও, কাপড় পাল্টে আসছি।’
জয়ের বেরুতে একটু দেরি হলো দেখে ইভা রাগী গলায় বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ যে, আমি কি তোমার সামনে কাপড় পাল্টাব?’
জয় দ্রুত বেরিয়ে যেতে গিয়ে যে ভঙ্গিটা করল পেছন ফিরলে দেখতে পেত ইভা হাসি চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
সহায়ক লিংক:
কনক পুরুষ, ৩: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_26.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Friday, July 30, 2010
কনক পুরুষ: ৪
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
7 comments:
হাঃ হাঃ, বেশ মজা পেলাম। সিরিজটা চলতে থাকুক।
এটা সিরিজ হবে না কারণ এগুলো 'কনক পুরুষ' নামের আমার এক উপন্যাসের খন্ডিত অংশ...। @মুশাফ
হুমম, প্রথমে সিরিজ ভেবেছিলাম। লিংকটা দেখলাম এই মাত্র। বইটা কীভাবে পাওয়া যাবে? কোন অনলাইন সংস্করণ আছে?
"বইটা কীভাবে পাওয়া যাবে?"
বাজারে নাই, আমি নিশ্চিত। কারণ এই উপন্যাসটা প্রকাশ করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৯৫ সালে।
"কোন অনলাইন সংস্করণ আছে?"
দুঃখিত, এটার কোন অনলাইন সংস্করণ নাই :( । @মুশাফ
প্রায় একযুগ আগে পড়েছিলাম বইটা। তখন কি আর ভেবেছিলাম, লেখকের সঙ্গে এভাবে আলাপ হয়ে যাবে ইন্টারনেটে?
পৃথিবীটা আসলেই গোল! বামপক্ষ = ডানপক্ষ (প্রমাণিত)
:)
এই চান্সে বলি, সেই সময় দুর্ধর্ষ সব লেখকের আনাগোনা ছিল সেবা প্রকাশনীতে, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন নতুন, কিন্তু প্রতিভাবান। সেই সেবাতে আজ কেবল গুটিকয় লেখককে দেখা যাচ্ছে ঘুরে ফিরে বারবার। না, তাঁদের প্রতিভা নিয়ে কোন সন্দেহ পোষণ করছি না, তবে তৈরি হচ্ছে না নতুন লেখক।
দোষটা হয়ত সেবার নয়, নতুন লেখকরাই পেপারব্যাকে ছাপানোর জন্যে উপন্যাস দিতে চান না, অনুমান করি; বরং নিজের টাকায়, বিখ্যাত শিল্পিকে দিয়ে প্রচ্ছদ আঁকিয়ে, নিজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বই প্রকাশ করতেই যত উৎসাহ!
"প্রায় একযুগ আগে পড়েছিলাম বইটা। তখন কি আর ভেবেছিলাম, লেখকের সঙ্গে এভাবে আলাপ হয়ে যাবে ইন্টারনেটে?"
আপনি তো আমাকে ভাবনায় ফেলে দিলেন...।
"দোষটা হয়ত সেবার নয়, নতুন লেখকরাই পেপারব্যাকে ছাপানোর জন্যে উপন্যাস দিতে চান না"
দোষটা পুরোপুরি সেবারই। কাজীদা সম্ভবত খুব বড়ো ভুলটা করেছিলেন তাঁর পরিবারের লোকজনকে লেখায় প্রধান্য দিয়ে। বিশেষ করে কাজী শাহনূর ওরফে রিংকু। তার একের পর এক বই বের হতে থাকল- তার অনুবাদ বা লেখার ভঙ্গি নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি আছে। এই পরিবারতন্ত্রটা অহেতুক ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। ক্রমশ সেবা থেকে একের পর এক লেখক ছিটকে পড়তে থাকলেন। (এখানে আমি কিন্তু আমাকে বাদ দিয়ে বলেছি)।
আর কেবল পেপারব্যাক কেন, হার্ড কভারেও ছাপা হতো। কনক পুরুষটা কিন্তু পেপারব্যাকে ছিল না। @সুব্রত
"কনক পুরুষটা কিন্তু পেপারব্যাকে ছিল না।"
হ্যাঁ, তবে কাজীদা' কিন্তু বইটি প্রথমে পেপারব্যাকে ছাপতে চেয়েছিলেন, যা আপনি একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন। নতুন লেখক হওয়ার হ্যাপা অনেক। প্রকাশককে জোর করা যায় না। আপনি ভাগ্যবান। হার্ড কভারে ছাপার কথার বললেই হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট। আমার নিজের চোখেই দেখা।
Post a Comment