বীরদেরও বীর, 'বাংলার ঈগল' খ্যাত মতিউর রহমানের বিমান নিয়ে পালিয়ে আসার অসম সাহসিকতার রোমহর্ষক
গল্প আমাদের সবার জানা। মতিউর রহমানকে নিয়ে কিছু অজানা তথ্যের কথা বলবো
আজ।
একাত্তরের জানুয়ারির
শেষ সপ্তাহে মতিউর সপরিবারে দুই মাসের ছুটিতে ঢাকা আসেন। ২৫ মার্চের
ভয়াবহতা দেখে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম
ঝুঁকি ও সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলেন মতিউর। বাঙালি
যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে
সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী ৷ ১৯৭১ সালের ১৪
এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাঁদের ঘাঁটির উপর
বোমাবর্ষণ করে৷ মতিউর রহমান যা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন৷ তাই ঘাঁটি পরিবর্তনের
কারণে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী ৷
এরপর,
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেন ও ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান।
সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তান থেকে বিমান নিয়ে ভারতে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করবেন।
প্ল্যান মোতাবেক ফিরে যান।
২০
আগস্ট শুক্রবার ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী রশিদ মিনহাজের উড্ডয়নের দিন ছিলো।
মতিউর পূর্ব পরিকল্পনা মতো অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান
রানওয়ের পূর্ব পাশে। সামনে পিছনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩।
শিক্ষানবিশ রশিদ মিনহাজ বিমানের সামনের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে
নিয়ে আসতেই তাঁকে ক্লোরর্মের সাহায্যে অজ্ঞান করে ফেলে দিয়ে বিমানের পেছনের
সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন।
জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ রেডিওতে বলে ফেললেন, তিনি সহ বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে।
ছোট
পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ তাদের দেখতে না-পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার শুনতে
পেল তা। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর বিমান নিয়ে ছুটে চললেন। রাডারকে
ফাঁকি দেবার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান
চালাচ্ছিলেন তিনি। রেডিও বার্তা শুনে চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে
ধাওয়া করে।
এ সময় রশীদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক
পর্যায়ে রশীদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন এবং বিমান
উড্ডয়নের উচ্চতা কম থাকায় রশীদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫
মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।
মতিউরের
সাথে প্যারাসুট না থাকাতে তিনি নিহত হন। তাঁর মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায়
আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। রশীদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার সর্বোচ্চ
সম্মানসূচক খেতাব নিশান-ই-হায়দার প্রদান করে।
... ... ...
জামায়াতে
ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে মিনহাজের মৃত্যুর জন্য গর্ববোধ করে ৩০
আগস্ট, ১৯৭১ এ ‘আমরা গর্বিত’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আল্লামা
মতিউর রহমান নিজামীর বয়ানে। পরবর্তীতে, ১ সেপ্টেম্বর ‘শহীদ মিনহাজের জীবনের
শেষ কয়েকটি মূহুর্ত’ শিরোনামে পরিবেশিত সংবাদে মতিউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক ও
মিনহাজ রশীদকে শহীদ বলে আখ্যায়িত করে।
৪
সেপ্টেম্বর ১৯৭১, তৎকালীন ছাত্র সংঘের প্রধান নিজামী মিনহাজের পিতার কাছে
একটি শোকবার্তা পাঠান। সেই শোকবার্তায় নিজামী বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে
ভারতীয় এজেন্ট বলে উল্লেখ করেন। সেখানে নিজামী আরো বলেছিল যে পাকিস্তানি
ছাত্রসমাজ তার পুত্রের মহান আত্মত্যাগে গর্বিত। ভারতীয় হানাদার ও এজেন্টদের
মোকাবেলায় মহান মিনহাজের গৌরবজ্জল ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর।
পাকিস্তান
সরকার রশিদ মিনহাজকে শহীদের মর্যাদা দেয়। তাকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ
সামরিক খেতাব 'নিশান-ই-হায়দার' এ ভূষিত করা হয়। তার নামে পাক বিমান
বাহিনীর একটা ঘাঁটির নামকরণ করা হয় এবং করাচীর একাধিক রাস্তারও নামকরণ হয়। ২০০৫
সালে তার ছবি সংবলিত দুই টাকার একটি ষ্ট্যাম্পও বের হয়।
সম্ভবত এটা পৃথিবীতে এক বিরলতম ঘটনা, যেখানে একই ঘটনার দুই পক্ষের দু'জন লোক দুটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব প্রাপ্ত হয়েছিলো।
... ... ...
আলোচনাটা এখানেই শেষ করে দেয়া যেতো। কিন্তু, না...! বলার আছে আরও কিছু কথা!
অনেকের
মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে মতিউর যেমন দেশের জন্য, সত্যের জন্য জীবন দিয়েছেন,
একই ভাবে রশিদও তো তার দেশ পাকিস্তানের জন্য জীবন দিয়েছেন। দুটো ঘটনার ভারসাম্যের
চিন্তা মাথায় আসার আগেই একটা শব্দ চিন্তায় আনা কর্তব্য বোধ
করি। শব্দটা হচ্ছে 'কনসাসনেস' বা 'সচেতনতা'।
যুক্তির বিচারে আসুন দেখি দুইজনই এক সাথে সঠিক হওয়া সম্ভব কি না? আজ
যদি কেউ বলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কোন ব্যাক্তি জানতেন না যে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সেনা বাহিনী যুদ্ধ করছে এমন কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এখন
সেই যুদ্ধটার কথা জানার পরও একজন সাধারণ মানুষের অবস্থান কি হওয়া উচিত।
রাষ্ট্র যেটা করে সেটাকেই অন্ধ সমর্থন দেয়া? নিশ্চয়ই না! একজন মানুষ হিসবে তার উচিত যুদ্ধের যৌক্তিকতা যাচাই করা। আসলে কার ভুল কারটা ঠিক সেটা চিন্তা করা।
ধরুন,
এই যে চব্বিশের জুলাইয়ে হাসিনার নির্দেশে বিনা কারণে বিনা উসকানিতে পুলিশ
ছাত্রদেরকে পাখির মতো হত্যা করলো এতে আমার করণীয় কী পুলিশকে বাহবা দেয়া! বাহ,
তুমি দুর্দান্ত দায়িত্ব পালন করেছো!
নিশ্চয়ই
সেটা যৌক্তিক না। একজন পুলিশ হিসেবে আমার তো উচিত ছিল নিজেই আপামর জনতার
পক্ষে দাঁড়ানো। সেটা না করে আমি যদি সেই গণহত্যার অংশ হই তাহলে আমাকে বীর
বলা কি বীরদের অপমান করা নয়?
জুলাইতে ঘটনাটা যেমন, একাত্তরেও তাই। একই প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় একজন পাকিস্তানী থাকা সাংবাদিকের কথা ।
৭১
এর প্রথম দিকে আসলে কি ঘটছিল পূর্ব-পাকিস্তানে সেটা পৃথিবীর
মানুষ খুব একটা জানতো না! টুকটাক নিউজে হয়ত দেখা যেতো খানিক গণ্ডগোলের কথা,
কিন্তু পুরো চিত্রটা মানুষের কাছে পরিস্কার ছিল না।
পরিস্কার
করেছিলেন যে মানুষটি বিস্ময়কর হলেও সত্য তিনি ছিলেন একজন পাকিস্তানে থাকা সাংবাদিক।
পাকিস্তানি সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি
সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে
ধরেছিলেন।
৭১ এর এপ্রিলে
যখন সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদের ওপর নির্বিচারে নিপীড়ন
চালাচ্ছিল, হত্যা করছিলো, ঠিক তখনই পাকিস্তানী সরকার সংবাদিক এন্থনি
মাসকারেনহাস সহ সাত পাকিস্তানি সাংবাদিককে যুদ্ধাবস্থার প্রতিবেদন তৈরির
জন্য সেখানে আমন্ত্রণ জানায়।
শাসক শ্রেণী ধারণা করেছিল বাকি ছয়জনের মতই মাসকারেনহাসও তাদের মিথ্যা প্রচারণায় সায় দেবে। চব্বিশের জুলাইয়ে 'সময়' কিংবা 'একাত্তর টিভি'র মতো।
কিন্তু তারপরের ঘটনা ইতিহাস, এন্থনি মাসকারেনহাস সেই কাজটাই করলেন যেটা একজন বিবেকবান মানুষের করা উচিত!
১৯৭১
সালের ১৮ মে মঙ্গলবার মাসকারেনহাস অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির হন লন্ডনস্থ
'দি সানডে টাইমস'র কার্যালয়ে। জানালেন, পূর্ব বাংলা ছেড়ে ৫০ লক্ষ লোককে কেন
চলে যেতে হয়েছে তার পেছনের কাহিনী তিনি জানেন। এবং এ-ও বললেন এই কাহিনী
লেখার পর তার পক্ষে আর করাচি ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না।
তিনি
জানালেন তিনি পাকিস্তানে আর ফিরে না-যাবার ব্যাপারে মনস্থির করেছেন; এজন্য
তাকে তার বাড়ি, তার সম্পত্তি, এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্মানীয় একজন
সাংবাদিকের মর্যাদার মায়া ত্যাগ করতে হবে।
তাঁর মাত্র একটি শর্ত ছিল, পাকিস্তানে গিয়ে তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ফিরে না -আসা পর্যন্ত যেন তার রিপোর্ট প্রকাশ না করা হয়।
সানডে
টাইমস রাজি হয় এবং তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। দশ দিন অপেক্ষা করার পর
সানডে টাইমসের এক নির্বাহীর ব্যক্তিগত ঠিকানায় একটি বৈদেশিক তারবার্তা আসে।
তাতে লেখা ছিল, 'আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন, সোমবার জাহাজ ছাড়বে'।
দেশত্যাগ
করার ব্যাপারে স্ত্রী ও সন্তানদের অনুমতি পেতে ম্যাসকারেনহাস সফল হন। তার
দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে তিনি কোনো রকমে একটা রাস্তা পেয়ে
যান। পাকিস্তানের ভেতরে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তিনি প্লেনে একজন তথ্য
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে দেখতে পান যাকে তিনি ভালোমতোই চিনতেন। এয়ারপোর্ট
থেকে একটি ফোনকল তাকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে কোনো ফোনকল হয়নি
এবং তিনি লন্ডনে এসে পৌঁছান।
এরপর
ছাপা হয় মাসকারেনহাসের কালজয়ী রিপোর্ট 'জেনোসাইড'। বিশ্ববিবেকের দৃষ্টি
ঘুরে যায় বাংলাদেশের দিকে। জুলাইতে নিজের জীবন বাজি রেখে যেমনটা করেছছিল, 'চ্যানেল ২৪'।
তো, সাংবাদিক মাসকারেনহাসের পাশে রশিদ মিনহাজকে দাঁড়া করানো হলেই বোঝা যাবে 'বীর' কিংবা 'শহীদের' মত সম্মানের শব্দের ওজন কাকে বলে।
... ... ...
আমাদের মতিউর রহমান যে রিস্কটা নিয়েছিলেন সেটা একবার
ভাবুন তো। পাকিস্তান থেকে
বিমান নিয়ে পালিয়ে এসে সেটা বাংলাদেশে ইউজ করবেন। উনি যেমন পাকিস্তানে ধরা পড়তে
পারতেন, তেমন ভারতে ঢুকেও পাকিস্তানী বিমান হিসাবে আইডিটিফাইড হয়ে
আক্রান্ত হতে পারতেন। সোজা কথা, একূল-ওকূল দুকূলই মৃত্যু!
মতিউরের
পুরো প্ল্যানে সারভাইভের চান্স ছিল ১ ভাগ। কিন্তু দেশের জন্য সেই ১%
চান্সকেই পূঁজি করে সাহস করেছিলেন। বিপরীতে মিনহাজের সাহসিকতারে বলতে পারেন
ট্রাফিক আইন মানার সাহস, আইনের বইতে লেখা আইন মানার গুড সিটিজেনের সাহস।
সেটা মানা ভালো। কিন্তু গুড সিটজেন আর বিপ্লবী একেবারেই ভিন্ন বিষয়।
হায় মতিউর! তুমি
তো মিনহাজকে মারতে চাওনি। তুমি চেয়েছিলে মুক্ত আকাশের নিচে এক টুকরো স্বাধীন
ভূমি, যেখানে তোমার দেশের মানুষ নির্ভয়ে দাঁড়াতে পারবে, যেখানে আগুনের
ফুলকি নয়, উঠবে শান্তির সুবাতাস। তুমি চেয়েছিলে শুধু স্বাধীনতার এক ঝলক,
যেখানে বন্দুকের নল আর রাজনীতির মায়াজালে মানুষ হারিয়ে যাবে না।
মিনহাজ
ছিলেন পাকিস্তানের 'গুড সিটিজেন', রাষ্ট্রের আদর্শ সৈনিক। কিন্তু একবারও কি
ভেবেছিল তিনি যে দেশের পক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন, সেই দেশটা কার বুকে আগুন
লাগাচ্ছে? কেড়ে নিচ্ছে কত লক্ষ প্রাণের স্বপ্ন?
যেমন ভাবেনি জুলাই হত্যাযজ্ঞে যারা গুলি চালিয়েছিল তারাও। বাস্তবে তাদের দায়িত্ব তো ছিল মানুষের প্রতি, তাই না?
কিন্তু
প্রতিটা দায়িত্বের পেছনে থাকা লাগে বিবেক। সেই বিবেক যখন প্রশ্ন করে, 'তুমি
কার পক্ষে দাঁড়াবে'? তখন শুধুই রাষ্ট্র নয়, মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোটা সবচেয়ে
বড় করণীয় হয়ে ওঠে।
মিনহাজ হয়তো জানতেন না বা বুঝতে চাননি। কিন্তু মতিউর জানতেন এবং বুঝতেন বলেই তাঁর সেই বোঝাপড়াই তো মতিউরকে বীর বানায়।
রাষ্ট্রের আইন মানাই কেবল সাহস নয়, সাহস হলো যখন আইন মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন সেটার মুখোমুখি হওয়া।
হায় মতিউর!
তুমি মিনহাজকে মারতে চাওনি। তুমি চেয়েছিলে পৃথিবীকে বোঝাতে, একজন প্রকৃত বীর কখনই কারো জীবন নেয় না, বরং জীবন দিতে জানে।
...
সংযুক্তি: মতিউর রহমানকে (তাঁর শবদেহ) দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত [১] পাকিস্তান বিমানঘাঁটির
মূল প্রবেশদ্বারে টাঙিয়ে রাখা হয় রশিদ মিনহাজের ছবি সমরবীর হিসেবে। জানানো
হয় অভিবাদন। অন্যদিকে মতিউর রহমানের ছবি টাঙিয়ে গাদ্দার হিসেবে থুথু
ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয় [২]।
সূত্র:
No comments:
Post a Comment