Search

Thursday, May 8, 2025

গুমঘরের যত কথা!

লেখক: Nabila Idris (https://www.facebook.com/share/1BgAt6pGE8/)

যিনি গুম কমিশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, আছেন। তাঁর লেখার মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন ধরনের গুম সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়...:

" ১. আমরা রেগুলারলি ভিক্টিমদের থেকে গোপন ডিটেনশন সেলে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা শুনি। এসব নির্যাতন প্রায়ই এতটা নিষ্ঠুর হয় যে তাদের শরীর ও মনে স্থায়ী ক্ষত রেখে যায়। কিন্তু মাঝে-মাঝে কিছু ভিক্টিম এমন ঘটনার বর্ণনাও দেন যেখানে আচমকা এক ধরনের অস্বাভাবিক মানবতার ঝলক দেখা যায়!

কখনও কোন প্রহরী থেকে, কখনও কোন অফিসারের থেকে। ভুক্তভোগীরা এসব মুহূর্ত ভোলেন না। এবং, তাদের মাধ্যমে, আমরা এখন এমন অনেক স্মৃতির রিপজেটরি হয়ে গিয়েছি যা আমাদের যথেষ্ট ভাবায়।

একজন তরুণ ছাত্র, যিনি টর্চারের চোটে আজ স্থায়ীভাবে অসুস্থ, আমাকে বলেছিলেন যে, টর্চারিং অফিসার মারতে-মারতে দুটো ইন্সট্রুমেন্ট ভেঙে ফেলে পরবর্তীতে তৃতীয়টি দিয়ে টর্চার চালিয়ে যান। নির্যাতন এতটাই নৃশংস ছিল যে সেই ঘরে থাকা দুই নারী অফিসার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ঘর ছেড়ে চলে যান। যদিও তিনি অর্ধচেতন ছিলেন, সেই দুজনের কান্নার দৃশ্যটি আজও তার মনে গেঁথে আছে।

আরেকজন বন্দি আমাকে বলেছিলেন, এক রাতে তিনি তাহাজ্জুদ পড়ছিলেন। তার সুরেলা তিলাওয়াত শুনে এক প্রহরী খুব কাঁদতে থাকে। অতঃপর ক্ষমা চাইতে-চাইতে বলেন:
'আমি জানি আপনারা নির্দোষ, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না'।
পরিবর্তীতে যখন বন্দিকে কিছু সময়ের জন্য সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে আবার ফেরত আনা হয়, সেই প্রহরী আবেগাপ্রুত হয়ে যান:
'আপনি বেঁচে আছেন! আমি ভেবেছি আপনাকে মেরে ফেলতে নিয়ে গিয়েছে। তাই আমি বাড়ি ফিরে নামাজে দাঁড়িয়ে আপনার জন্য অনেক কান্না করেছি'।
একজন অফিসারকে বলা হয়েছিল তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকার একটিভ রাজনৈতিক কর্মীদের তালিকা জমা দিতে। পরে যখন তিনি জানতে পারেন সেই তালিকার প্রতিটি মানুষকে এলিমিনেট করা হয়, তিনি প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন, ইন ফ্যাক্ট সুইসাইডাল হয়ে যান।

কিছু গোপন বন্দিশালায় বন্দিদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের পরিমাণ ছিল প্রহরীদের আনুমানিক অর্ধেক। কিন্তু এসব বন্দিশালার কিছু ভিক্টিম আমাদের বলেন,
'নিষ্ঠুর প্রহরী বহুত ছিল কিন্তু ভাল প্রহরী ডিউটিতে থাকলে আমরা একটু বেশি খাবার পেতাম'।
প্রথমে ব্যাপারটা আমার কাছে কনফিউজিং ছিল কারণ রেশন তো নির্দিষ্ট, এই অতিরিক্ত খাবার কোথা থেকে আসে? কিছু সাক্ষ্য নেয়ার পর বুঝতে পারি সম্ভবত অল্প সংখ্যক প্রহরী তাদের নিজেদের খাবার বন্দিদের দিয়ে দিত। হয়তো এসব ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র 'জেশচার'-এর মাধ্যমে কিছু মানুষ অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে, এক রকম নীরব প্রায়শ্চিত্ত করেছে।

এই 'প্রায়শ্চিত্ত' বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। একজন জুনিয়র অফিসারকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়:
'আপনি কি হত্যা করেছেন?' তিনি ইতস্তত করে বলেন, 'দুইজনকে করতে হয়েছে, আর চারজনকে হতে দেখেছি'।
তাকে আবারও জিজ্ঞেস করা হয়, 'এই কাজের বিনিময়ে যে টাকা পেয়েছিলেন, কী করেছেন'? তিনি বলেন, 'গ্রামের মসজিদে দান করে দিয়েছি'।
তার উত্তরটা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। ক্রিমিনাল এলিমেন্টটা তো সহজেই বোধগম্য, কিন্তু আমি চিন্তা করেছি তার মনের ভেতরের সেই দ্বন্দ্বটি নিয়ে। যেই দ্বন্দ্বের তাড়নায় ২৭ বছরের ছেলেটা চেষ্টা করেছে 'হ্যাপহ্যাজার্ড'  ভাবে হলেও নিজের অন্তরকে শোধরানো। একজন সিনিয়র অফিসার আমার কাছে স্মৃতিচারণ করেছিলেন যে এমন এক অপরাধীকে তিনি বলেছিলেন:
'তুমি এখন যেসব নামাজ-কালাম করছ, তা আল্লাহর হক। কিন্তু যে ক্রাইম এর আগে করেছ, সেটা মানুষের হক। আল্লাহ মানুষের হক নিজে ক্ষমা করে না, তোমার বান্দার থেকে ক্ষমা চাইতে হবে। নামাজ is not enough'.
প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে আপনাকে এখন কথা বলতে হবে। কমিশনে আমরা সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। সে যে-ই হোক, প্রত্যেককে কনফিডেনশিয়ালিটি অফার করি। যদি আপনার আত্মা কোনো ক্ষত বহন করে, তবে এটাই সময় সেই ক্ষত নিরাময়ের। আমাদের কাছে আসুন, কথা বলুন। বুঝতেই পারছেন অনেকেই এরই মধ্যে বলেছেন।

এই সুযোগ চিরকাল থাকবে না। এখন মুখ না খুললে আপনার soul-এর wound তো unhealed রয়ে যাবেই, আপনি নিজেও নিজের কাছে coward প্রমাণিত হবেন। আগস্ট ৫ তারিখ কবে পার হয়ে গিয়েছে, তবুও আপনি সত্য বলার সাহস করতে পারেননি? নিশ্চিত থাকুন ন্যায়বিচার একদিন হবেই। হয় আমাদের মাধ্যমে, বা পরকালে আল্লাহর দরবারে। It is unavoidable.

. গুমের ভুক্তভোগীদের 'রেজিলিয়েন্স' আর 'ইনজেনুইটি' এখন আর আমাকে অবাক করার কথা না! আমি তো অলরেডি শতাধিক সাক্ষ্য নিয়েছি কিন্তু আসলে এখনও অবাক করে।
এক ভুক্তভোগী আমাকে বলেছিলেন, কীভাবে একদিন জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে স্পেশালি নির্মমভাবে মারা হয়েছিল। মারধরের আগে তিনি শুনেছিলেন টর্চারিং অফিসার ফোনে খুব উত্তেজিত হয়ে কাউকে 'এবরশন' করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, সব ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন, ভদ্রমহিলা যাতে জাস্ট কাজটা করে ফেলেন, ইত্যাদি।
ফোনালাপে যা-ই ঘটছিল তা ওই অফিসারকে এতটা অস্থির করে তোলে যে অতঃপর তার সব রাগ ওই ভুক্তভোগীর ওপর ঝাড়েন। এদিকে ভুক্তভোগী সেই কথোপকথনের সবকিছু মনে রেখে পরে আমাকে বলেছিলেন। আর আমি তো আগেই ওই কর্মকর্তার সেক্স স্ক্যান্ডাল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম তাই টাইমলাইন মিলিয়ে এক্সট্রা করে নিশ্চিত করা সহজ ছিল যে এটাই সেই অফিসার যে অলরেডি আমাদের লিস্টে ছিল। 

মানুষ কীভাবে কী-কী মনে রাখে, সেটা শুনেও অবাক না-হয়ে পারা যায় না। এক বন্দী আমাকে খুব নির্দিষ্ট করে প্রহরীদের সম্পর্কে বলছিলেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম:
'আপনার চোখ বাঁধা ছিল না'? তিনি হেসে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, কিন্তু প্রতিটি প্রহরীর গায়ের গন্ধ আলাদা ছিল'।
আরেকজন বলেছিলেন গোপন বন্দিশালায় কীভাবে বন্দীরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। সেখানে সেলগুলো মুখোমুখি ছিল। যদিও ২৪ ঘণ্টা হাতকড়া আর চোখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হতো, যখন প্রহরীরা দূরে থাকত, তখন একটু করে চোখের বাঁধন সরিয়ে বা হাত নাড়িয়ে ইশারা করা যেত। করিডোরের মুখে লাইট বাল্ব যে পজিশনে ছিল, তাতে কোন প্রহরী কাছে এলে তার ছায়া আগে ভেতরে এসে পড়ত, যা আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করত।

তো যখন প্রহরীরা কাছে থাকত না, তখন বন্দীরা ইশারা সহ নানা ক্রিয়েটিভ উপায়ে কথা বলতেন। একটি উপায় ছিল বাতাসে হাত দিয়ে অক্ষর লেখা। কিন্তু যেহেতু সেলগুলো মুখোমুখি ছিল, তাই অক্ষরগুলো উল্টো করে অর্থাৎ মিরর ইমেজের মতো লিখতে হতো। সেই বন্দী বললেন, বাতাসে লিখতে-লিখতে তিনি এত দক্ষ হয়ে গিয়েছিলেন যে এখনও আয়নার মতো উল্টো করে খুব দ্রুত লিখতে পারেন।
আমিও আমার ডায়েরি এগিয়ে দিলাম। তিনি মুহূর্তের মধ্যে তার পুরো নাম উল্টো করে লিখে দেখালেন। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে অর্জিত এক অদ্ভুত দক্ষতা নিয়ে ওঁর জাস্টিফাইড প্রাইড দেখতে আমার সেদিন বেশ ভালোই লেগেছিল!

কিন্তু আমরা যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি পাচ্ছি তা হলো 'রেজিলিয়েন্স থ্রু রিলিজিয়োসিটি'। শুরুর দিকে ভেবেছিলাম, 'স্যামপ্লিং বায়াস', হয়তো ধার্মিক মানুষরা বেশি টার্গেটেড হয়েছে বলে আল্লাহর কথা এত বারবার আসছে জবানবন্দিতে? কিন্তু পরে দেখলাম এটা অতি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই আসলে বন্দিত্বের মধ্যেই অধিক ধর্মপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন।
অনেকেই বলেন তারা বন্দিত্বে থাকাকালীনই নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেন, নতুন করে সূরা মুখস্থ করেন, ইত্যাদি...। সবই হত চোখ বাঁধা-হাতকড়া পরা অবস্থায়। যখন দুনিয়ার সব আশা নিভতে বসেছিল, তখন তারা আল্লাহর কাছে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। একজন তো বললেনই যে তারা অনেকে এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন, তাদের বন্দী রাখতে-রাখতে দরকার হলে অফিসাররা ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু বন্দীরা ক্লান্ত হবে না।
এই যে অসীম সাহস... এটাই কিন্তু বাংলাদেশ!

. গুম কমিশনের কাজ হল একটা ইমোশানাল রোলার-কোস্টারের মত। একবার একজন বন্দি বলেছিলেন, যে গোপন বন্দিশালায় দীর্ঘ সময় থাকার কারণে ওঁর সঙ্গে আরও চারজন বন্দীর ভাল পরিচয় হয়ে যায়। একদিন রাতে ভদ্রলোক দেখেন তার চার বন্ধুকে ওখান থেকে নিয়ে  যাওয়া হচ্ছে। এদের মাঝে একজন ছিল যথেষ্ট আন্ডারএজ।

কয়েক বছর পর তিনি নিজে ছাড়া পাওয়ার পর চারজনের একজনের বাসা ট্রেস করতে সক্ষম হন এবং জানতে পারেন যে তার বন্ধু গুম হওয়ার পর আর কখনও ফেরেননি। যদিও অন্য তিনজনকে এখনও ট্রেস করা যায়নি, বাহিনীগুলোর 'মোডাস অপারেন্ডি' যতটুক বুঝি, যেহেতু একত্রে বের করা হয়েছিল তাই বেস্ট গেস হল সেই রাতে সবাইকেই লাইকলি এলিমিনেট করা হয়।

আন্ডার এজ ভিক্টিম বলে কিনা, নাকি সারভাইভরের গলার গভীর বিষণ্ণতা, কেন জানিনা তবে ইন্টার্ভিউটা শেষ করে অনেকদিন পরে একাকী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সব কাজ বাদ দিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। Sometimes somethings just become too much to take.

তবে বিপরীত ধর্মী ঘটনাও ঘটে! একজন বন্দী বলেছিলেন বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি দোয়া করেছিলেন যাতে তার ক্যাপ্টর অফিসারের সঙ্গে জীবনে আবারও দেখা হয়। যেদিন সেই অফিসারকে খুঁজে এনে ভদ্রলোকের মুখোমুখি করেছিলাম আইডেন্টিফাই করার উদ্দেশ্যে, সেদিন দোয়াটার কথা স্মরণ করে দিয়েছিলাম, যাতে তিনি অফিসার সাহেবকে দোয়া কবুলের বিষয়টা জানাতে পারেন। I felt very good that day. বললাম না, পুরো ব্যাপারটাই একটা 'ইমোশানাল রোলার-কোস্টার'!

. 'ম্যাডাম, আমার যাবজ্জীবন হয়ে গিয়েছে। কী করব', বলে ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠল? ২৩ বছর বয়সে, বিরোধী দলের কর্মী হওয়ার অপরাধে গুম করে, টর্চার করে, ভুয়া অস্ত্র মামলা দিয়ে এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যেই দেখি যে টিম গুম করেছিল, তাদের পাশের অফিসে বসেন মামলার ইনভেস্টিগেটিভ অফিসার আর তার পাশের অফিস দিচ্ছে সাক্ষী সাপ্লাই। এখানে সবাই সবার ভাই-ভাই!
বলছিলেন ছেলেটি:
'আপু, আমাকে যেইঅফিসার গুম করেছিল, সে-ই মামলার সাক্ষী',  ৫ই আগস্টের পর কোর্টে দেখা হলে আমি তাকে বলেছিলাম যে, আপনি তো জানেন আমি দোষী না, আমাকে এবার ছেড়ে দেন। কিন্তু সে ছাড়বে না। সাক্ষী দিয়েই যাবে কারণ নাহলে তো তার মিথ্যাও প্রমাণ হয়ে যাবে। আমার কি তাহলে মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাবে'?
সেদিন একজন বললেন:
'গুম করা অবস্থায় আমাকে অনেক থ্রেট দিয়েছিল যাতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ওদের বানানো গল্প বলি। তবুও সাহস করে ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি সব সত্যি কথা বলে দেই। আল্লাহ, ম্যাজিস্ট্রেট উল্টো পুলিশকে বলে, 'একে না-বানিয়ে এনেছেন কেন?'
তখন পুলিশ আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের রুমের বাইরেই পেটাতে থাকে। এই দেখেন, সেদিনের আঘাতের চিহ্ন এখনও আমার কপালে আছে। আমি জোরে চিৎকার করি এই আশায় যে কেউ হয়ত বাঁচাবে। ভেতর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে বলে ন, যাতে এত আওয়াজ না হয়'!

 এরকম মাল্টিপল ঘটনা শোনার পর আর অবাক হইনা।

গুম কালচার আজীবনের জন্য শেষ করার যুদ্ধটা আসলে খুব কঠিন একটা যুদ্ধ। তার একটা বড় কারণ আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম ফান্ডামেন্টালি ব্রোকেন। সেটার সুযোগ নিয়েছে গুমকারী অফিসাররা, যারা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে ওয়েপেনাইজ করেছে। একজন বিদেশী প্রসিকিউটারের সঙ্গে একবার আমাদের প্রবলেমগুলো শেয়ার করছিলাম। সব শোনার পর ভদ্রলোক 'জাস্টিস সিস্টেম' থেকে সরতেই পারছিলেন না! খালি বলছিলেন উনি হলে নাকি ফার্স্টে জাস্টিস সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত অফিসারদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতেন, তারপর বাহিনী ধরতেন। যুদ্ধটা আসলেই অনেক বড় আর অনেক লম্বা...!

. শুনতে হাস্যকর লাগলেও 'বাথরুম' আমাদের অনুসন্ধানের অন্যতম অংশ। বন্দীদের সার্বক্ষণিক চোখ বেঁধে রাখলেও, বাথরুমে অধিকাংশ সময়ই চোখ খুলে দেয়া হত বিধায় বাথরুমের লোকেশন এবং ডিজাইন দিয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রে গোপন বন্দিশালা চিহ্নিত করি। এর সাথে যোগ হয় বাথরুম শিডিউল আর গার্ড বিহেভিয়ার।
'আমাদের শুধু অমুক আর অমুক সময় বাথরুমে যেতে দিত, এছাড়া দিত না'।
'দরজা বন্ধ করতে দিত না', 'দরজায় ফুটা ছিল, ওরা যে কোন সময় ভেতরে দেখতে পারত'।
'বাথরুমে সময় দিত সর্বোচ্চ ৩ মিনিট, এর পরেই ওরা ঢুকে পড়ত আর পেটাত'।
'একদিন আমি বাথরুমে বসে থাকা অবস্থাতেই গার্ড ঢুকে আমাকে লাঠি দিয়ে পেটায়, কেন আমার কয়েক মিনিট বেশি সময় লেগেছে, এই দোষে'।
'আমার গা দিয়ে এত দুর্গন্ধ বের হত যে ওরাই আমার সেলের পাশে দাঁড়াত না'।
'ইন্টারোগেশন রুমে নিলে কড়া করে এয়ার ফ্রেশনার দিত।
'টর্চারের চোটে, কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম, আমি প্রস্রাব করে ফেলি'।
'সিসিটিভি ছিল সেলের সামনে, তাই আমি সেলের ভেতরের প্যান ব্যবহার করলে ওরা সবই দেখতে পারত কিন্তু আমার এছাড়া কোন উপায় ছিল না'।
'আমার ছেলেকে কাশিমপুরে যেদিন দেখতে যেতাম সেদিন আমি সারাদিন পানি খেতাম না ইন কেস পথে বাথরুম লাগে, আমি মহিলা মানুষ, বয়স হয়েছে, বুঝেনই তো'!
...এমন শত শত জবানবন্দি শুনেছি আমরা।

রিসেন্টলি এসব জবানবন্দির কোডিং স্কিম তৈরি করতে গিয়ে আমার বারবার 'মিল্গ্র্যাম এক্সপেরিমেন্ট-এর কথা মনে পড়েছে। মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিল্গ্র্যাম ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গবেষণাটি করেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একজন ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে বলা হয়। যতবার ব্যক্তিটি ভুল উত্তর দেয়, ততবার অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় উত্তরদাতাকে ইলেক্ট্রিক শক দিতে।
(অংশগ্রহণকারীর অজান্তে উত্তরদাতা আসলে কোন শক খাচ্ছিল না, কষ্টের অভিনয় করছিল মাত্র।) এক্সপেরিমেন্টে দেখা যায় যে অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী ভুল উত্তরদাতার নিদারুণ আর্তনাদ উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শক দিতেই থাকে, দিতেই থাকে, এমনকি সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্তও দিতে থাকে।
'মিল্গ্র্যাম এক্সপেরিমেন্ট' দেখিয়েছিল সাধারণ মানুষও অথোরিটির চাপে কেমন অমানবিক কাজ করতে পারে।

আওয়ামী জাহেলিয়াতে কত এভারেজ মানুষ অমানুষ হয়ে গিয়েছিল। খেয়াল করেন, যেসব মিলিটারি অফিসার এবং পুলিশের বড় কর্মকর্তারা হাসিনা বা তারেক সিদ্দিকী থেকে সরাসরি নির্দেশ পেত এবং আজ্ঞা পালন করত। যেসব জুনিয়র কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা এই ডার্টি ওয়ার্কগুলো নিজ হাতে করত। যেসব আর্কিটেক্টরা এই বন্দিশালাগুলো ডিজাইন করেছে, যেসব ডাক্তার এবং মেডিকেল এসিস্ট্যান্টরা সেখানে সার্ভ করেছে... লিস্টটা লম্বা!

ব্যক্তিগত ভাবে আমি ৫ই আগস্টের পূর্বের অনেক বিহেভিয়ারই মেন্টালি র‍্যাশনালাইজ করতে পারি। কারণ ওই যে, মিল্গ্রাম দেখিয়েছে অথোরিটির চাপে মানুষ অনেক অমানবিক কাজ করতে পারে। তবে যেটা আমি একেক করেই র‍্যাশনালাইজ করতে পারি না তা হল, ৫ই আগস্টের এত মাস পরেও গুমের মত বীভৎস ক্রাইমের জন্য অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে না-দেওয়া। এই ট্র্যাজিক ক্রাইমটা আমি বুঝি না। ... দেখি আরও পড়াশোনা করতে থাকি। একদিন হয়ত এই সাইকোলজিও বুঝব।

. টর্চার পদ্ধতিগুলোর ফ্যান্সি নাম বেশির ভাগ বন্দীরাই জানেন না। তাই প্রথমবার যখন আমাকে একজন বন্দী 'ওয়াটারবোর্ডিং' বর্ণনা করেছিলেন, আমার একটু সময় লেগেছিল বুঝতে আসলে তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন।
'আপনাকে শুইয়ে কী করল? পানি ঢালল? কোথায় ঢালল? নাকে-মুখে? এক টানা, কতক্ষণ? ওহ-হ'! 
গুয়ান্তানামো বে'র বাইরে আমাদের এই বাংলাদেশে, মানে এই যে, যেমন মাত্র কয়েক কদম দূরে মোহাম্মাদপুরে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হরদম মানুষ তুলে এনে পুরোদুস্তর ওয়াটারবোর্ডিং করা হত অবলীলাক্রমে। এটা আমার নাইভ কল্পনার বাইরে ছিল।
এখন অবশ্য অনেক কুতুব হয়েছি, 'আই স্লিপ আ লট লেস দ্যান বিফোর বাট আই টেক দিস ডেইলি ডোজ অফ হরর ইন মাই স্ট্রাইড'। আজকাল উল্টো প্রোবিং প্রশ্ন করি, টর্চার করাকালীন ওরা কী কী জানতে চাচ্ছিল, ভাই? কোন কোন প্রশ্নগুলো মনে আছে? মোটিভ বোঝার চেষ্টা করি আর কি।
আজকে একজন বললেন, তাঁকে ওয়াটারবোর্ড করতে-করতে তার রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তৎকালীন বিরোধীদলের সমর্থক নিশ্চিত হওয়ার পর, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে বার-বার জিজ্ঞেস করা হয়:
'ফজরের নামাজ জামাতে পড়িস ক্যান, হ্যাঁ? তোর গার্লফ্রেন্ড নাই ক্যান, বল তো'?
এই দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ থেকে আমরা বের হয়ে এসেছি, বুঝেছেন? এর থেকে বড় বিজয় আমি কল্পনাই করতে পারি না।

. গুম কমিশনে আমরা গোপন বন্দিশালাগুলোর আলামত ধ্বংসের মাত্রা দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি এবং এ কারণেই সেপ্টেম্বরের প্রথম প্রেস কনফারেন্স থেকেই এ বিষয়ে সতর্ক করে আসছি। বিভিন্ন বাহিনী গত ১৫ বছরের অপরাধের প্রমাণ সিস্টেম্যাটিকালি ধ্বংস করেছে। এটি শুধু ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ঘটেনি, যারা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে চেয়েছিল বরং কিছু ক্ষেত্রে তাদের দ্বারাও ঘটেছে যারা পরবর্তীতে এই পোস্ট গুলোতে এসেছে। যারা অপরাধে সরাসরি জড়িত ছিলেন না তারাও যখন আলামত নষ্ট করেন, তা আসলে দায়মুক্তি সংস্কৃতির গভীর শিকড়ই ফুটিয়ে তুলে।

অনেক স্থানে টাইলস উপড়ে ফেলা হয়েছে (কিন্তু কর্নারে খুঁজলে ঠিকই ইন-ট্যাক্ট টাইলস পাচ্ছি), দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে সেলের আয়তন বড় দেখানো হয়েছে (কিন্তু সিলিঙে পূর্বের দেয়ালের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে), এবং দেয়াল রঙ করে বন্দীদের সব লিখিত আকুল আর্তনাদ তো ঢেকেই ফেলেছে! আমি নিজ চোখে দেখেছি গুমের সত্যকে মুছে ফেলার দেশব্যাপী একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা।

তবুও, ভুক্তভোগীদের অনেকের অসীম সাহস ও ধৈর্যের জন্য আমরা সঠিকভাবে অনেক গোপন বন্দীশালার অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছি। যদিও অধিকাংশ সময় চোখ বাঁধা থাকত এবং অনেকেই হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিলেন, তাঁরা তাদের আশপাশের পরিবেশ বোঝার অসাধারণ কৌশলও বের করেছিলেন। অনেকেই চোখের বাঁধনের নিচ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতেন, যদিও ধরা পড়লে আবার নৃশংস মার খেতে হতো।
তাঁদের অসংখ্য সাক্ষ্যের জোরেই আমরা এই সুবিশাল জিগস পাজেলের অনেক টুকরো একত্রিত করতে পেরেছি। একজন একটি বিষয় বর্ণনা করতেন, অন্যজন আরেকটি। এভাবে শত-শত সাক্ষ্য শোনার পর ধীরে ধীরে গোপন বন্দীশালাগুলোর মানচিত্র আমাদের মনে তৈরি করতে পেরেছি। এটি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং সময় সাপেক্ষ কাজ। আমি এখনও মনে করতে পারি প্রথম কয়েক সপ্তাহে আমরা কীভাবে বিভ্রান্ত বোধ করতাম, ঘন্টার-পর-ঘন্টা সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করতাম, যা এখন আমাদের জন্য মাত্র কয়েক মিনিটের কাজে পরিণত হয়েছে।

কাজটি আরও জটিল ছিল কারণ এই বন্দীশালাগুলোর অবস্থান স্থির ছিল না। নানাবিধ কারণে এগুলো বারবার সংস্কার করা হয়েছে, পলিটিক্যাল হাওয়া বদলের সঙ্গে গার্ডদের বিহেভিয়ারও বদল হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, CTTC বন্দীদের সাক্ষ্য ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়।
এই সময়ে ওখানে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভবন নির্মিত হয়েছিল এবং কার্যক্রম ধীরে ধীরে বাইরের টিনের ঘরগুলো থেকে অভ্যন্তরের বিশেষায়িত সেলে স্থানান্তরিত হয়েছিল। বন্দীদের বর্ণনাও তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হতে থাকে। ২০১৬ এর TFI গার্ডদের ব্যবহার আর ২০২০ এর ব্যবহার এক না। এই পার্থক্যগুলো বুঝতে সময় লেগেছে। স্পেশালি কারণ জবানবন্দিগুলো তো আর ক্রনোলজিকালি কালেক্ট হয় না!

যাহোক, দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে, আমরা গত ১৫ বছরে এই সেলগুলোর চেহারা ও অবস্থানের পরিবর্তনের একটি সময়ভিত্তিক মানচিত্র মোটামুটি ভাবে তৈরি করতে পেরেছি যা এখনও প্রতিনিয়ত আপডেট করছি। এই গোটা কাজটি বন্দীদের অসীম সাহসিকতা এবং কমিশনের কঠোর অধ্যবসায়ের এক জলজ্যান্ত সাক্ষ্য।
কিছু কমন প্রশ্ন পাচ্ছি - এখানেই উত্তর দিয়ে দেই:
ক. এগুলো 'গোপন' বন্দীশালা। যেটা যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সঙ্গে- সঙ্গে সেগুলোতে পরিবর্তন বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এবং সেই নির্দেশ আমরা দেখছি মান্যও হচ্ছে। কিন্তু যে স্থান আমরা এখনও খুঁজে পাইনি তা কীভাবে সিলগালা করব! 
খ. অন-গোয়িং তদন্ত এটা। ইমিডিয়েট ভিডিও রিলিজ করলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। সত্য মিথ্যে যাচাই করার একটা বড় উপায় হচ্ছে বন্দীশালার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিহেভিয়ারের বর্ণনার সত্যতা নির্ণয় করা।

. ছেলেটা অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ত, ফ্রি ল্যান্সিং করত। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, আইন শৃঙ্খলা 'রক্ষাকারী' বাহিনী এক সকালে তাকে হোস্টেলের পাশ থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন বাহিনীগুলো এরকম র‍্যান্ডম গুম কেন করত? নিশ্চয় কোন কারণ ছিল, তাই না?
জেনে অবাক হবেন যে নিছক সন্দেহের বশে বা মিসটেকেন আইডেন্টিটির কারণে, বা পূর্ব শত্রুতার জেরে, বা টাকার স্বার্থে, বা স্রেফ প্রমোশনের আশায়, অথবা ঢাকায় একটা পোস্টিঙের লোভে, কত হরেক রকম ফালতু কারণে যে গুম করা হত তার ইয়াত্তা নেই। 
এমনকি যখন লেজিটিমেট কারণও থাকত কাউকে এরেস্ট করার, বিজ্ঞ স্যাররা আইনত এরেস্ট না-করে উল্টো আসামীকে গুম করে অধিক পুণ্য কামাই করত। ১৫ বছর ইনএফিশিয়েন্ট এবং অকর্মণ্য মানুষ সমাজের অন্য সব জায়গায় জেঁকে বসার সঙ্গে-সঙ্গে গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর মাঝেও এটা ছড়ায়। অতঃপর তারা গুম করে নির্মম টর্চার করাকেই গোয়েন্দাগিরির সমার্থক ধরে নিয়েছিল।

যা হোক, ছেলেটার কথায় ফিরি। গুম থেকে জীবিত ছাড়ার কালে অবধারিত ভাবে কয়েকটা ভুয়া মামলা ঠুকে দিত উর্দিওয়ালারা। সেই সুবাদে বহুদিন পর জেল খেটে, ছেলেটা এখন বাসায় ফিরেছে। এইটুক বলেই হউমাউ করে কেঁদে উঠল:
'আমার ফ্যামিলি আমাকে বার্ডেন ভাবে, ম্যাডাম। গুম হওয়ার কারণে আমি পড়াশোনা শেষ করতে পারি নাই, তাই কোন চাকরি পাই না। মাসে মাত্র ৩০০০ টাকা আয় করি। আমার মেয়ের চিকিৎসার পয়সা দিতে পারি না। আমার ফ্যামিলি আমাকে বার্ডেন ভাবে, ম্যাডাম'। 
ছেলেটা অঝোরে কাঁদছে আর কাঁদছে। সে আমার কাছে কিচ্ছু চাচ্ছে না। জাস্ট তার ওপর করা এই হরিফিক অবিচারটা কারও সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি ফোন করে ফ্যামিলিকে বুঝিয়ে বললে কোন লাভ হবে কিনা। বলল, মনে হয় না। তারা আসলে বোঝে ওর কোন দোষ নাই কিন্তু ওকে ছাড়াতে পরিবারের যে  ভিটামাটি সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে... 'অভাব হ্যাজ ইটস ওউন ল্যাংগুয়েজ', আমার সান্ত্বনায় তো সেই ল্যাংগুয়েজ পরিবর্তন হওয়া সম্ভব না।

গুমের বিচার যারা হতে দিচ্ছেন না এবং অভিযুক্তদের সেফ এক্সিট দিচ্ছেন তারা প্লিজ ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন। আমাদের কাছেই প্রায় ১৮০০ কেস, অনুমান করি এর ডবল কেসলোড এখনও আমরা হদিস পাইনি। এই ছেলেটার কান্নার মত ১৮০০টা পরিবারের কান্না দুনিয়াতে তো বটেই আখেরাতেও কিন্তু আপনাদের তাড়া করবে। কথা দিচ্ছি, প্রস্তুত থাকেন।

. প্রতিদিন মনে হয় যেন অথৈ সাগরে সাঁতরাচ্ছি! এত কেস, এত বাহিনী, এত মানুষ, অথচ সময় এত কম! তার ওপর কত আলামত যে হারিয়ে গেছে। ১৩-১৪ বছর দূরের কথা, ৭-৮ বছরের পুরনো কল ডেটাই মেলে না। তবু, কেমন-কেমন করে যেন কেস ব্রেক হয়, আর আমরা সফলও হই! আমার সবচেয়ে প্রিয় সাফল্যের গল্পটা একেবারে সাম্প্রতিক।

জীবিত ভিক্টিমদের জবানবন্দিতে প্রায়ই একটা ১৫-১৬ বছরের ছেলের কথা আসত। গোপন বন্দিশালায় টর্চারের চোটে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অনেক কান্নাকাটি করত ছেলেটা। কান্নাকাটি থামাতে তাকে আরও বেশি মারা হত। বেশ কিছু বন্দীর কাছ থেকে একই বিবরণ বারবার শোনার পর আমরা ছেলেটাকে খুঁজতে শুরু করি। একটা বাচ্চা ছেলে নির্যাতনে পাগল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত কিন্তু সে এখন কোথায়, আদৌও বেঁচে আছে কিনা, ফ্যামিলি জানে কিনা? কেউ কিছুই জানি না এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।

প্রথম মাসখানেক কোনো অগ্রগতি হয়নি। হঠাৎ এক বন্দী জানালেন, গুম সেল থেকে বের হওয়ার কয়েক মাস পর তিনি ছেলেটাকে এক জেলের ‘পাগলা সেলে’ দেখেছে। কিছু আইডেন্টিফায়াবেল বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করলেন। অবশেষে একটা লোকেশান এবং টাইমলাইন তো পেলাম। তাই নব উদ্যমে আমরা ‘পাগলা সেল’-এর রেজিস্ট্রি যোগাড় করলাম। কিন্তু সে তো বিরাট তালিকা! এদিকে ছেলেটার নাম জানা নেই, তাই কিছুই মেলানো পসিবল না। 'ইট ওয়াজ আ ডেড এন্ড'।

দিন যায়, আমরাও খুঁজি। এক বন্দী জানালেন তিনি এক সময় ছেলেটার নাম জানতেন কিন্তু এখন ভুলে গেছেন। আমরা বললাম, মনে পড়লে জানাবেন। কদিন পর ফোন করে ঠিকই জানালেন! কিন্তু সেই নাম 'পাগলা সেল' রেজিস্ট্রিতে নেই! হয়তো ডাকনাম আর অফিসিয়াল নাম আলাদা? আবারও ডেড এন্ড।

তারপর আরেক বন্দী বললেন, একবার তিনি আর ছেলেটা জেল থেকে একই দিনে কোর্টে গিয়েছিলেন। ডেটটা মনে নাই বিধায় কয়েক বছর আগের দুইটা সম্ভাব্য তারিখ দিলেন। সেদিন তিনি ছেলেটার সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করেছিলেন কারণ ওর জন্য কেউ খাবার আনেনি। এই ছোট্ট তথ্য আমাদের সংকল্প আরও দৃঢ় করল।
কোর্ট হাজিরার তারিখ নিয়ে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত হল যদিও তখনও আমরা শিউর না ছেলেটার আসল নাম কী। যে কলিগ এই অসম্ভব দায়িত্বটা পেলেন তিনি বললেন, 'খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজব, কিন্তু খুঁজতে হবে'!

এদিকে রমজান শুরু হলে আমি লিটারেলি দোয়া করলাম কেসটা নিয়ে! একদিন কেন জানি এক বন্দীকে ছেলেটার কথা বললাম, কেন বললাম, নিজেও জানি না। তিনি একই বন্দিশালায় ছিলেন না। তবে কারেক্ট টাইমলাইনে একই জেলে ছিল, তাই চান্সটা নিলাম। আর আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ছেলেটাকে চিনলেনও! এমনকি নামও নিশ্চিত করলেন। তারপর হেসে বললেন:
আমি একবার দূরে সাইকেল ভ্রমণে গিয়েছিলাম..." আমি চুপচাপ শুনছি! আমি তো সাইকেলের গল্প শুনতে বসিনি! 'হঠাৎ টায়ার পাংচার হলে মেরামতের দোকানে গিয়ে দেখি সেই ছেলে'! আমি বললাম,  'কবে'? তিনি বললেন, 'গত বছর! ও তখনও মানসিক ভারসাম্যহীন। ওর বাবা সাইকেলের দোকানে কাজ করে, ও সেখানেই থাকে'।
ইউরেকা! টু কাট আ লং স্টোরি শর্ট, ভদ্রলোক ফিরে গিয়ে ছেলেটাকে খুঁজে বের করে আমাদের কাছে আনলেন। আমরা আইডেন্টিটি কনফার্ম করলাম। এটাই সেই ছেলে, যার কান্নার শব্দ এত বন্দীর মনে দাগ কেটেছিল। আমি একেবারেই আবেগপ্রবণ নই। কিন্তু যখন ছেলেটা আর তার বাবার সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম, চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল।

ক্লাস এইট থেকে সবে নাইনে উঠেছিল, নতুন বই হাতে পাওয়ার আগেই দুই বছর গুম, দুই বছর বিনা অপরাধে জেলে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, এই গল্প আরেক দিন। আজ শুধু সেলিব্রেট করতে চাই, কত মানুষ একসঙ্গে চেষ্টা করলে কেমন অবিশ্বাস্যভাবে একটা রহস্যের সমাধান করা যায়, আলহামদুলিল্লাহ!

১০. মানুষ নিজের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধগুলো অনেক সময়ই মেন্টালি ফেস করতে পারে না। উল্টো এক গাদা এক্সকিউজ খাড়া করে। কমিশনে কাজের সুবাদে এমন অনেক এক্সকিউজ আমাদের হরহামেশা শুনতে হয়। বেশ কমন একটা হল:
'দেখেন, আমাদের মধ্যে কেউ-কেউ হয়ত অবৈধভাবে মানুষ তুলে এনেছে। টেকনিক্যালি এইটাকে হয়ত গুম বলে। কিন্তু খেয়াল করেন আমরা কিন্তু মেরে ফেলি নাই। জেনারেল জিয়াউল আহসান মানুষ মারত। মানুষ মারাটাকে উনি শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেসিলেন। উনি খারাপ মানুষ। আমরা না'।
Some people are plain facetious and dishonest when they say this stuff, but to my surprise. I found some others quite sincere in these protestations. আমি অনেক ভেবেছি, হাউ টু এক্সপ্লেইন দিস মাইন্ডসেট। তারপর মনে হয়েছে ওনারা আসলে কখনও ওনাদের ভিক্টিমের স্থানে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা ভেবে দেখেন নাই। এক ভুক্তভোগী ভদ্রলোক আমার ডেস্কে বসে বলেছিলেন:
'আমার বাচ্চাটাকে একবার কোলে নেয়ার আগেই আমাকে গুম করে ফেলে'। আমি জানতে চাই, 'কিভাবে'?
তিনি বলেন, 'আমাকে তুলে নেওয়ার ১৪ দিন আগে আমার বাচ্চা হয়েছিল। বাচ্চার হার্টে ফুটো ছিল বলে সঙ্গে-সঙ্গে NICU-তে নিয়ে যায়। ওকে দেখতেই পারি নাই ঠিক মত, কোলে নেয়া তো দূরে থাক।
এরপর তো আমাকে তুলে নিয়ে গেল। গুম সেলে এবং পরবর্তীতে কারাগারে পানির বোতল কোলে নিয়ে বাচ্চাটার কথা ভাবতাম'।
আমি অবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বলি, শেষে কবে তাকে কোলে নিলেন? তিনি চোখে জল নিয়ে বললেন, 'চার মাস পর জেল গেটে'।
আমি জানি কেউ মাত্র চার মাসের এই কাহিনী শুনে এবং  যেখানে ভদ্রলোক মারাও যান নাই, বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন... অনেক অফিসার ভাববেন জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো হতেই পারে, কি আর করা, মেরে তো ফেলিনি। কিন্তু আসলে এটা হতে পারে না।
এই লোকটা কিন্তু একটা মানুষ। ঘটনার আট বছর পরেও সে ওই চার মাস ছেলের শোকে বোতল কোলে নিয়ে বসে থাকা ভুলতে পারছে না। এই অপরাধ আপনার সঙ্গে হলে আপনিও ভুলতে পারতেন না। মেন্টালি ফেস করতে কষ্ট হলেও, অন্তত নিজের মনের গহীনে স্বীকার করা উচিৎ যে এগুলো একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
 
১১. গুম-দশার লাস্টে যে লোকটা আমাকে চোখ বেঁধে হাত ধরে বের করেছিল, সেই লোকটা আমাকে বলে:
'দেখেন ভাই, আমাদের মাফ করে দিয়েন। আমরাও আসলে বাধ্য। অফিসাররা আমাদের যেভাবে বলে আমাদের সে ভাবে করতে হয়। আমাদের প্রতি কোন অভিযোগ রাখবেন না'।
: মাফ করেছেন, আমি জানতে চাই?
: আমার তো ওই সময় ব্রেনে ওইসব কাজ করে নাই। 
: আজকে, আবারও বলি?
: আজকে? আমি তো জেলে আসার পরেই ওদের মাফ করে দিসি। আমি তো কখনও বদ-দোয়াও করি নাই।
: কেন করেন নাই?
: করি নাই কারণ আপনি যদি আগুনে হাত দেন আপনার হাত এমনিতেই পুড়ে যাবে। আমার তো বলতে হবে না, হাতটা পুইড়ো না।' 
: আচ্ছা, আমি বিস্মিত। 
: আমার দরখাস্তটায় দেখবেন শেষে লেখা আছে তাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নাই। কারণ তাদের কৃতকর্মই তাদের পাপের শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট। আমার নতুন করে কিছু করতে হবে না।
: হুম, তারপরেও।
: গুম করার পর মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে তো আমাদের কনডেম সেলে রেখেছিল অনেক দিন। শোনেন, ওইখানে যারা ফাঁসির আসামী তাদের মধ্যে একজন ছিল কন্ট্র্যাক্ট কিলার- ছবি নিত আর লাশ ডেলিভারি দিত। সে সবসময় মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত থাকত। বলত, 'আমি যখনই ঘুমাইতে যাই, খাইতে যাই, যেই মানুষগুলোরে গুলি করছি,কোপাইছি, ওগুলা শুধু আমার চোখে ভাসে। ওরা মরার আগে যে গোঙ্গানির আওয়াজ করে, আমি শুধু সেই গোঙ্গানির আওয়াজ শুনি। খাইতেও পারি না, কিছু করতেও পারি না'।
তো, বাহিনীগুলো আমাদের সাথে যা করেছে এইগুলো তো ওদের চোখে ভাসবে। পৃথিবীতে হয়ত কেউ জানবে না, কিন্তু যে-ই করেছে ওই পাপেই সে পুড়ে মরে যাবে। আমাকে কিছুই করতে হবে না।

The battle to eradicate this curse from our lands will not stop. No ifs, no buts.

১২. মানুষের ব্রেন profound trauma কিভাবে deal করে তা বোঝা কঠিন। গুমের ভুক্তভোগীদের কথা শুনলে এটা প্রতিনিয়ত টের পাই। বেশির ভাগ ভিক্টিমরা তাদের সাধ্যমত স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়। ওসময় ওঁদের হাত বাঁধা, যম টুপি পরে থাকা সত্ত্বেও এতটা ingenious উপায়ে তারা clue বের করত যে আমরা সত্যিই চমৎকৃত হতাম। আজতক আমরা যা-যা রহস্য উদ্ঘাটন করেছি তা নিঃসন্দেহে ভিক্টিমদের অস্বাভাবিক নিষ্ঠার জোরে এবং বাহিনীগুলোর সৎ এবং সাহসী কর্মকর্তাদের ঐকান্তিক সাহায্যে।
তবে মাঝে-মাঝে কিছু ভিক্টিম পাই টর্চার বা ট্রমার ধাক্কায় যাদের কোথায় যেন কোন-একটা সমস্যা হয়ে গিয়েছে। সবই ঠিক আছে, দৈনন্দিন কাজে তারা ঠিকই নরমালি চলা ফেরা করছেন কিন্তু বন্দীদশার দিনগুলি আলোচনা করতে গেলে কোথায় যেন সুর কেটে যায়। 
তেমনই একজন ভিক্টিমের সাক্ষ্য নিচ্ছিলাম। তাঁর কাগজ-পত্র সব নির্দেশ করে যে তিনি গুম ছিলেন। (বলা ভাল, বাহিনীগুলো ভাবত তাদের কাজ একদম undetectable. It's not true. We have found predictable patterns in their work, distinctive signatures of their crimes, that we now use to quickly solve cases.)
 
তো , ভদ্রলোকের জবানবন্দি পুরোই লজিক্যালি এগোচ্ছিল। তাঁর বন্দীশালা তিনি চিনতে না-পারলেও বর্ণনা থেকে আমি অনায়াসেই বুঝে ফেলেছিলাম তিনি কোথায় ছিলেন! যখন উনি হঠাৎ বললেন, 'ইন্টারোগেশন রুমের দেয়ালে অনেক ভয়ানক ছবি ছিল'।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে এটাও মিলে যায় তাই ভেরিফাই করার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম, 'কিসের ছবি ছিল'?
ভদ্রলোক নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, 'ড্রাগনের'।
আবারও জানতে চাই, 'কিসের'?
পুনরায় বললেন, ড্রাগনের'।
 
আমি নিশ্চুপ। অনেক ইন্টারোগেশন রুমের বর্ণনা শুনেছি জীবনে, ড্রাগন এই প্রথম। আবার প্রশ্ন করা আরম্ভ করলাম প্রথম থেকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে একই জায়গায় এনে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের ছবি'?
নির্বিকার উত্তর, ড্রাগনের'।
আমি জিজ্ঞেস করি, 'ড্রাগন বলতে আপনি কী বুঝেন'?
'ওই যে ভয়ঙ্কর জিনিস। তাকানো যায় না। ভয়ঙ্কর জিনিস। এলুমেশানে থাকে'।
'কিসে থাকে'?!
এ পর্যায়ে এক জুনিয়র কলিগ পেছন থেকে বলল, এনিমে'?
'হ্যাঁ-হ্যাঁ, এনিমে না কি যেন। মোট কথা, ভয়ানক। ভয়ানক! তাকানো যায় না'।
'আপনি কি শিউর ওগুলো মৃত মানুষের ছবি ছিল না'?
ভদ্রলোক ইতস্তত করে বললেন, 'না, নিশ্চয় না। ড্রাগনের ছবি ছিল'।

শেখ হাসিনা আমাদের কী করেছে এটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। একটা সুস্থ মানুষ নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছে যে দেয়ালের ছবিগুলো ড্রাগনের ছিল। কারণ আসলে কিসের ছবি ছিল তা ধারণ করার ক্ষমতা তার ব্রেনের ছিল না। অতএব ইন্টারোগেশন রুমের দেয়ালে ড্রাগন ছিল।

১৩. কোন জিনিসটা হারানোর বেদনা কোন জনকে কতটুক পীড়া দেয়, এটা বোঝা কঠিন। এক ভুক্তভোগী, সাধারণ ঘরের ছেলে যার ওপর নিদারুণ টর্চার করা হয়েছিল। একদিন আক্ষেপ করে আমাকে বলেছিলেন:
'তুলে নেয়ার সময় আমি মাস্টার্স করছিলাম। গুমের আগে পরীক্ষায় আমি ৯৯, ৯৭, এরকম মার্কস পেতাম। ওরা টর্চারের সময় আমাকে বলে, 'শুনেছি তুই নাকি অনেক মেধাবী? দেই তোর মেধা একটু কমিয়ে, দেই? দেই।'
এই বলে মাথায় অনেক ইলেকট্রিক শক দেয়। দিতেই থাকে আর দিতেই থাকে। গুম থেকে বের হবার পর দেখি আমি আর পড়াশোনায় ভাল নেই। আমি এমনকি কিছু পরীক্ষায় ফেলও করেছি। সাত বছর হয়ে গেল, আমি আর পড়াশোনা করে দাঁড়াতে পারলাম না'।
আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে অনেক পড়ুয়া মানুষ, 'নার্ড' বলাটা ভুল হবে না। হয়ত সেই কারণেই শত জবানবন্দির ভেতরও এই জবান্দন্দিটা খালি আমার কানে বাজে। গুম কালচার যদি আমরা এবার বিলুপ্ত করতে না পারি, কখনও পারব না। যা করার এখনই করতে হবে। যতটা রিস্ক নেওয়ার দরকার, যতটা সেক্রিফাইস করার দরকার, করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে গুম বিলুপ্ত করতেইই হবে।

১৪. এক ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে তিনি জানিয়েছেন, যখন তাঁকে ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছিল, তখন গাড়িতে থাকা এক ডিবি কর্মকর্তা চোখে জল নিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চান এবং আদেশটি পালন করতে বাধ্য হওয়ার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন।
আরেকটি আরও মর্মান্তিক উদাহরণ এসেছে একজন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে, যিনি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছিলেন। তিনি জানান, তাঁকে হত্যা করার জন্য একটি গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হয়। তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করুন। আমার কোনো উপায় নেই'।
যদিও শেষ মুহূর্তে গাড়িটি হঠাৎ দিক পরিবর্তনের কারণে এবং কর্মকর্তার মনোভাব পরিবর্তনের কারণে ওই ভুক্তভোগী বেঁচে যান'।
 
আমাদের গুম কমিশনের কাজ মোটেও প্রতিশোধ পরায়ণ না। নিরাপত্তা বাহিনীগুলি আমাদের শত্রু নয়। বরং, তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা একটি গভীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে পারে, যা তাদের নিজেদের জন্যও প্রয়োজন। গুম কালচার সমূলে উৎপাটন করা যেমন জাতি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য উপকারী, তেমনি এই বাহিনীগুলির জন্যও উপকারী। The linked report in the first comment is worth reading in its entirety, trust me.

১৫. এক গুমের ভিক্টিম তার জিজ্ঞাসাবাদ এবং টর্চারের কাহিনী বর্ণনা করছিলেন। ওনাকে বেসিক্যালি অনলাইনে লেখালেখির জন্য গুম করা হয়। তো, চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ওরা ওঁর ফেসবুক পাসওয়ার্ড চায়। উনি সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেন। অতঃপর কেউ একজন বলল, 'স্যার, মেলেনি'।
আর যায় কোথায়। বেদম টর্চার শুরু হল। উনি বারবার বললেন, আমি মিথ্যে বলিনি, কিন্তু কে শোনে কার কথা। নেক্সট ব্রেকে ওনাকে কাগজ কলম দেয়া হল, যাতে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই উনি 'সত্যিকারের' পাসওয়ার্ডটা লিখে দেন। উনি একই পাসওয়ার্ড লিখলেন। এবারে পাসওয়ার্ড নিয়ে আর কোন কথা নাই। মিলে গিয়েছে। কেন? এবারে মিলল কেন?
'ম্যাডাম, আমার পাসওয়ার্ডের @-কে তো মুখে বলেছিলাম, তো ওরা ওটাকে পূর্ণাঙ্গ at the rate of লিখেছিল।" 👀 এটা শুনে আমি হাসি আটকাতে পারলাম না। ভদ্রলোকও দেখি চোখের পানি মুছে আমার সাথে মন খুলে হাসছেন। কী অকাট গণ্ডমূর্খগুলো আমাদের এত বছর বন্দী করে রেখেছিল, আল্লাহ!

১৬. আজকে অফিসে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। চুল সব সাদা, গোল্লা মুখ, মিষ্টি হাসি! দেখতে অনেকটা আমার নানীর মত (যারা নানীকে চেনেন না, সিন্ডারেলার ফেইরি গডমাদারকে কল্পনা করে নিন)। একটার পর একটা এপয়েন্টময়েন্ট থাকায় ওনাকে সময় দিতে আসলেই বিলম্ব হল। ক্ষমা চাইলাম, স্মিত হেসে উড়িয়ে দিলেন। ছেলে গুম হয়েছে কয়েক বছর আগে। পরে চিরচেনা মামলা ইত্যাদি, কারাগারে বন্দী এখনও।

খুবই জটিল কেসে জড়িয়ে দিয়েছে ছেলেটাকে কিন্তু সব দেখে যত দূর বুঝলাম গুম প্রমাণ করা হয়ত অতটা কঠিন হবে না। তবে প্রমাণ করতে আমাদের অনেক কাগজ পত্র লাগে তাই দালিলিক প্রমাণ কালেক্ট করতে উকিলের সঙ্গে কিভাবে কন্ট্যাক্ট করব জিজ্ঞেস করলাম। জানালেন উকিল নেই! এতো জটিল মামলা, উকিল নাই মানে কী! কেন নাই? শুরুতে উকিল নিয়েছিলেন কিন্তু মামলার সংখ্যার সঙ্গে আনুপাতিক হারে উকিলের খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় এক পর্যায় উকিল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
বিজয়ের পরে গুম কমিশন খুলেছে যেহেতু, তাই অনেক আশা নিয়ে এসেছেন। অনেক বছর পরে সাহস করে কোথাও কথা বলতে পারছেন। ছেলেটা গুম হওয়ার সময় সদ্য বিবাহিত ছিল, স্ত্রী দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাচ্চাটা এত বছরেও বাবাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

১৭. সকালে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন যিনি ওনার গুমের কাহিনী বলতে এখনও এত ভয় পান যে আমার সাথেই ফিসফিস করে কথা বলছিলেন আর বারবার রেকর্ডার বন্ধ করাচ্ছিলেন। কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কাস্টোডিয়াল টর্চারের চোটে ভয়টা ওনার মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে!

মাত্র পাঁচ মাস আগে স্বৈরাচার পালিয়েছে। সেই জুলুমের ক্ষত এখনও ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়। যদি আপনার ঘরে না-থেকে থাকে, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আগেই ভাল ছিলাম, স্বাধীনতা দিয়ে কী কচুটা হল, সব তো আগের মতই আছে, এগুলো প্লিজ বলবেন না। সব আগের মত নাই। গুমের ভয় না-পেয়ে এই যে চোখে চোখ রেখে কমপ্লেন করতে পারছেন, এটাই প্রমাণ।  যদিও অনেক কিছু জরুরী মেরামত হওয়া বাকি, সব মোটেও আগের মত নেই। এই রেকগনিশনটা জরুরী। নাহলে স্বৈরাচারের চামচাগুলো আবার মাথায় উঠবে।

১৮. ঘটনা এক: সাদা পোশাকধারী কয়েকজন ব্যক্তি ধানমন্ডি এলাকা থেকে এক যুবককে তুলে নিয়ে তার ঠোঁট অবশ করা ছাড়াই সেলাই করে দেয়।
ঘটনা দুই: একটি ব্যক্তিকে আটক করে যৌনাঙ্গ এবং কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়।
ঘটনা তিন: এক ভিকটিম নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করে সেখানেই হত্যা করা হয়।

… ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের অনেক জানিয়েছেন যে, গুম নির্যাতন ও বন্দী রাখার পর তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্র আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে বিভিন্ন মামলা।
আবার গণমাধ্যমে নেতিবাচক খবরের কারণে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার সমাজে চরম অবমাননার শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
… কমিশনের দাবি, র‍্যাব গোয়েন্দা শাখা যারা এ ধরনের অভিযানে সক্রিয় ছিল তারা জানিয়েছে যে ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বন্দি বিনিময় করত।

১৯. গত ষোল বছরে লিগাল সিস্টেমকে গুম কালচারের একটা নেসেসারি অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল। যদি কাউকে গুমের সময় খুন না-করার সিদ্ধান্ত হত, তাকে অবধারিত মামলা দেয়া হত। এরপর আরম্ভ হত জেল-জামিন-হাজিরা-উকিল অন্য আরেক গজব। লিগাল সিস্টেমের ভিক্টিম এক লেবার ভদ্রলোক আমার ডেস্কে বসেছিলেন (নিজেই এ পরিচয় দিলেন)। কয়েক বছর আগে শীতের রাতে ওনার একজন সহকর্মী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়।
বাস থেকে নামিয়ে কে বা কারা তাকে গায়েব করে দেয়। হন্য হয়ে খুঁজেও পাওয়া না গেলে, ওনারা থানায় জিডি করতে যান। কিন্তু অবাক ব্যাপার কোন থানাই জিডি নিতে রাজি হয় না। এই শক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তার গোডাউনের আরেক সহকর্মী হারিয়ে যায়। কদিন পর আরেকজন। তারপর আরেকজন... আরেকজন... এবং আরেকজন। হরর মুভিতে সিরিয়াল কিলার যেমন একজন একজন করে টার্গেট করে, ঠিক তেমন করে দেখতে দেখতে ১৪ জন সহকর্মী পৃথিবীর বুক থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে যায়।

স্বাভাবিক ভাবেই সবাইকে একে একে নিরুদ্দেশ হতে দেখে এই ভদ্রলোক প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান। ভয়কে সত্য করে, শীঘ্রই ওনাকেও নাই করে দেয়া হয়। চোখ বেঁধে, নানা হাত ঘুরে, হাজির করা হয় এক বাহিনীর আস্তানায়। গোপন সেলে ঢুকে পেয়ে গেলেন রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়া সহকর্মীদের, সাথে বোনাস কিছু রাজনৈতিক কর্মী। এরপর শুরু হল চিরাচরিত টর্চার ইত্যাদি।
কোন অপরাধ বের না-করতে পেরে, তাদের অপহরণকৃত বসের কাছে এক কোটি টাকা দাবি করে। সেটাও না পেয়ে, গুমের শেষের দিকে বাহিনীর বড় স্যার জানান ওনার বাচ্চা হচ্ছে না বলে বউ ক্রসফায়ার করতে নিষেধ করেছে, তাই এ যাত্রা সবাই বেঁচে যাবে। শুধু তাদের সবাইকে মামলা দেয়া হবে, নাহলে তো মনে হবে এতগুলো মানুষকে শুধু-শুধু ধরে এনেছে- তা তো হতে পারে না, তাই না? তো কর নাটক, লাগা মামলা।
সন্ত্রাসী দল ধরার নাটক করতে তাদেরকে যে বাসায় নিয়ে যায়, গুণধর বাহিনী খেয়াল করে নাই সেখানে সিসিটিভি ছিল। একজন ভিক্টিমের ভাইকে সেই ফুটেজ যোগার করার গুরুতর অপরাধেও তৎক্ষণাৎ তাকেও ছয়টা মামলা উপহার দেয়া হয়।

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একজনকে হাজির করা হলে উনি গুমের ব্যাপারটা জানান। ম্যাজিইস্ট্রেট তাকে শুধু কাগজে সই করতে বলেন, সই করলেই তিন মাসের মাথায় বাড়ী যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। না-হলে তো মৃত্যু অবধারিত।
উনি কি মরতে চান? না। তাই তিনি ১৬৪ ধারার কাগজ সই করে স্বঘোষিত অপরাধী বনে যান। এই ভদ্রলোক সাড়ে তিন বছর জেল খাটেন। বর্তমানে জামিনে আছেন, মামলা চলমান। জামিন পেতে এত সময় লাগল কারণ ওনাকে যেই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল, তা এতই গুরুতর ছিল যে বিচারক ফাইল দেখা মাত্রই ডিস্কার্ড করতেন, কিছু শুনতেন না।
 
একদিন লেবার ভদ্রলোকের উকিল কোর্টে আসে নাই। তখন উনি নিজেই কথা বলতে চান।  আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অনুরোধ করেন এবং সাড়ে তিন বছর পর অবশেষে বিচারকের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পান। বিচারককে উনি জানান যে, যে কয়েদীর একমপ্লিস হিসেবে ওনাকে বলা হচ্ছে, এ সত্য বাস্তবে সেই কয়েদী এতই সিরিয়াস কয়েদী যে ওর সংশ্লিষ্টতার কারণে জামিন আবেদন মুহুর্তেই ডিস্কার্ড হয়ে যায়।
তিনি বলেন: যে কয়েদী হিসাবে আমাকে বলা হচ্ছে ওই কয়েদী আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়- এটা কেমন করে সম্ভব! আসলে সত্যটা হচ্ছে, সেই কয়েদী যখন জেলখানায় ঢোকে যখন লেবার ভদ্রলোকের বয়স মাত্র ৮!
 
আট বছর বয়সে উনি কিভাবে একমপ্লিস হলেন? এছাড়া আরেক যে অস্ত্র মামলায় ওনাকে আসামী করা হয়েছে, তার প্রধান আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অলরেডি ডিসমিসড, তাহলে ওনারটা কেন বজায় থাকবে? আর এই যে বলা হচ্ছে উনি বোমা সাপ্লাই দিয়েছেন কিন্তু বাহিনীর রিপোর্টেই তো দেখা যাচ্ছে ওখানে কোন বোমা ছিল না। তাহলে জজ স্যার, আমি কী অপরাধে জামিন পাচ্ছি না?

জজ স্যার জামিন দেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আপনি এই যুক্তিগুলো কোথা থেকে শিখেছিলেন'?
'অন্যান্য কয়েদী থেকে', লেবার ভদ্রলোক জানান। জেলে বসে উনি আইন নিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছেন এবং মামলার কাগজ অন্য কয়েদীদের দেখিয়েছেন। তাদেরই কয়েকজন মামলার এই ভয়াবহ দুর্বলতাগুলো ধরিয়ে দেয়।
আমি জানতে চাই, 'উকিল সাহায্য করে নাই'? 
'আরে না। উকিলকে যখন বোঝাতে গিয়েছিলাম তিনি আমাকে নিজের কলার টেনে-টেনে বলেছেন, 'আমি কোথায় পড়েছি জানিস? তুই  আমাকে আইন বুঝাইতে আসছোস'!
এখনও এই উকিলই ওনাকে রিপ্রেজেন্ট করে। কারণ পরিবার নিঃস্ব করে দুই লাখ টাকা ফি দেয়া সত্ত্বেও, উকিল সাহেব আরেক লাখ টাকা থেকে স্বপ্রণোদিত বিশ হাজার টাকা ডিস্কাউন্টের পর আশি হাজার টাকা দাবি করে আছেন। এটা না দিতে পারায়, নো অবজেকশান চিঠি দিচ্ছেন না। মামলা চলমান; যাবজ্জীবন অপেক্ষমাণ।
 
২০. করোনাকালীন সময়ে কেম্ব্রিজের সব কলেজ খালি করার নির্দেশ থাকলেও, আমি বিশেষ অনুমতিতে আমার কলেজে থাকার সুযোগ পাই। চার্চিলের মতো বিশাল কলেজেও তখন মাত্র হাতেগোণা ক'জনই ছিল। কিন্তু লকডাউনের নিয়মানুযায়ী তাদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ছিল। ফলে মাসের-পর-মাস একাই থাকতাম। এই একাকীত্বে আমার সঙ্গী হয়ে ওঠে এলাকার পশুপাখি। 

অবস্থা এমন হয় যে প্রতি সকালে পাখিরা জানালায় ঠোকর মেরে-মেরে আন্দোলন করে আমার ঘুম ভাঙ্গাত। একদিন তো আমিআমার বাসার বাগানের দিকের কাঁচের দরজার পাশে বসে পড়াশোনা করছি, হঠাৎ এক কাঠবিড়ালি এসে নিজের হাতে কাঁচে নক করতে থাকে, আমি জবাব না-দেয়া পর্যন্ত! এত্তো চমৎকৃত হয়েছিলাম! 

তবে লকডাউন শিথিল হওয়ার পর একাকীত্ব যখন কেটে গেল, দেখলাম আমার এনিমেল ফ্রেন্ডসরা কেমন যেন 'ফেইডেড ইনটু দ্য ব্যাকগ্রাঊন্ড'। অর্থাৎ বন্ধুত্বটা একটা এনোমালি ছিল, আমার নিঃসঙ্গতারই প্রতিফলন।

গুম কমিশনে কাজ আরম্ভ করার পর থেকে দৈনন্দিন ক্রিমিনাল ইস্যু ছাড়াও অন্যান্য নানা বিষয় আমাকে ভাবায়, যার একটা হল একাকীত্ব। গোপন বন্দিশালায় সলিটারি কনফাইনমেন্টে বন্দীরা প্রচণ্ড একাকী থাকতেন। এতে অনেকের মাঝে যে পার্মানেন্ট মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি হয়েছে তা আমরা কথা বললেই বুঝতে পারি। 

যেমন কিছু বন্দীর 'মেমোরি ব্লক' করেন! ধরুন, এমন বন্দী আছে যার বিষয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট উইটনেস বলছে যে তাঁকে প্রচণ্ড টর্চার করা হয়েছে, এমনকি টর্চারের ভিজিবল সাইনও দেহে আছে, কিন্তু তিনি বলছেন, 'না, আমি ভাল ছিলাম'।
বিস্তারিত বোঝার জন্য আমি বিশেষজ্ঞ সাইকায়াট্রিস্টদের স্গে ঘটনাগুলো শেয়ার করেছি। তাঁরা বলেছেন পিটিএসডি পেশেন্টদের মাঝে এমন 'কোপিং মেকানিজম' কমন। 

একজন বন্দী আমাকে বলেছিলেন, তাঁর সেলের তেলাপোকা সঙ্গীদের কথা। 
অন্য একজন বন্দী জানিয়েছিলেন, তাঁর সেলে একটা টিকটিকি ছিল যেটার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা জন্মায়। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন, ঘুমের ঘোরে অজান্তে পিচ্চি টিকটিকটা তার পিঠের নিচে পড়ে মারা গিয়েছে। সেই বেদনা এত বছর পরও উনি মনে রেখে আমাকে জানিয়েছেন। 

একজন বন্দীকে আমরা শনাক্ত করেছিলাম যাকে প্রায় আট মাস হাত বেঁধে দিনে-রাতে চব্বিশ ঘণ্টা শুইয়ে রাখা হয়েছিল। (কোথায় কখন এটা হয়েছে আমরা ভালো ভাবে আইডেন্টিফাই করেছি; জায়গাটা একটা দোজখ ছিল।)
যতদিনে ওনাকে খানিকটা আরামদায়ক সেলে আনা হয়, ততদিনে উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে এই দ্বিতীয় সেলে থাকতে-থাকতে এক পর্যায় তিনি খানিকটা সুস্থ হন। তিনি এই ঘোরে থাকতেন, যদি কোন দিন ছাড়া পান তাহলে কোন ভাল লাগার মেয়েটাকে বিয়ে করবেন, মেয়েটার বাসায় কেমন করে প্রস্তাব পাঠাবেন, লাজুক হেসে ইত্যাদি শেয়ার করতেন অপজিট সেলের বন্দীদের সাথে। পরে অবশ্য ধারণা করি, ওঁকে মেরে ফেলা হয় কারণ উনি আর কখনও বাড়ি ফেরেননি। 

মানসিক বেদনা শুধু বন্দীদের একার হত তা বলা ভুল হবে। কিছু পারপেট্রেটরদেরও হত। একজন প্রহরী আমাকে বলেছিলেন, একদিন তার ভাগের খাবার এক বন্দীকে দেয়ায় সেই বন্দী অনেকদিন পর পেট পুরে খেতে পেরে খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এতে প্রহরীর এত কান্না পায় যে তিনি দূরে গিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেন। যখন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রশ্ন করে কেন কাঁদছে, তিনি মিথ্যে বলে পাশ কাটিয়ে যান। এত বছর পরও তিনি এত লম্বা কাহিনীর কিছুই ভোলেননি, এমনকি কোন মিথ্যেটা বলেছিলেন এটাও ভোলেননি; বরং পুরোটুকু আমাকে বলে এক ধরনের মেন্টাল ক্লোজার খুঁজেছেন। 
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে যে ভয়াবহতা চালিয়েছে, তার প্রকৃত মাত্রা বোঝা সত্যিই কঠিন। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, বাস্তবতা তার বহুগুণ বেশি ভয়ংকর। Our nation needs healing from this সর্বগ্রাসী illness- there is no other alternative.

২১. ছেলেদের থেকে সংখ্যায় কম হলেও, এনেকডোটালি আমরা জানি অনেক নারীও গুমের শিকার হয়েছিলেন। অনেক গোপন আটক কেন্দ্রে শুধুমাত্র নারীদের জন্য নির্ধারিত সেল ছিল, যা প্রমাণ করে দেশব্যাপী গুমের জন্য নারীদের গুম করার অবকাঠামোও প্রস্তুত করেছিল। তারপরও খুব অল্পসংখ্যক নারী ভিক্টিমই বিজয়ের পরে এগিয়ে এসেছেন! হয়ত ভয়ে, হয়ত ট্রমায়, হয়ত আমাদের সম্পর্কে জানেন না-বিধায়। কিন্তু যারা এসেছেন, তারা এমন সব অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন যা তাদের পুরুষ কাউন্টারপার্টদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও, নারী-কেন্দ্রিক কিছু বিশেষত্ব থাকে। 

যেমন শুধু মায়েদেরই তাদের ছোট সন্তানসহ গুম করা হত, বাবাদের না।
আমার কাছে এমন একজন নারী এসেছিলেন যাকে তার ছয় বছরের সন্তানসহ কিডন্যাপ করা হয়েছিল। বয়স কম হওয়ার কারণে বাচ্চাটি পুরো ঘটনার ভয়াবহতা বুঝে উঠতে পারেনি, যদিও আম্মুকে যে টুপি পরিয়ে নিয়ে যেত এবং ফেরার পর যে আম্মুর অনেক ব্যথা লাগত এইটা ও মনে রেখেছে। যখন ওর সাস্পেক্টেড ডিটেনশন রুমের ভিডিও আমার ফোনে দেখাই, সে চিনতে পারে।
'ওখানের কোন আঙ্কেলকে মনে আছে, আপু, জানতে চাই?
'হ্যাঁ, আছে', ও বলেছিল, 'আঙ্কেলের মুখটা পেঁপের মতো'!
আমি আর ওর আম্মু দুইজনই হেসে ফেলি। কিন্তু অফিসার পেঁপেকে আমি মনে রেখেছি।
(সত্যি বলতে বাচ্চাদের গুমের বিষয়টি আসলে অনেক অফিসাররাও সহজভাবে নিতে পারেননি! শিশুরাও যে গুম হত এর এভিডেন্স পাওয়ার পূর্বেই এক অফিসার আমাকে এমন এক সেলের সন্ধান দেন যেখানে এক সময় এক বাচ্চা আটক ছিল বলে উনি সন্দেহ করতেন। তার তথ্য পরবর্তীতে ভিকটিমের ডিটেনশন লোকেশান মেলাতে সহায়তা করে।)
একজন নারী বলেছিলেন, তাঁর স্বামী একদিন সকালে সে-ই যে বেরিয়ে যান আর কখনও ফেরেননি! নির্ঘাত তাকে মেরে ফেলা হয়। এদিকে সেদিন রাতে ভদ্রমহিলাকে তার দেড় ও তিন বছরের সন্তানসহ গুম করা হয়। তিনি তখন গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও একজন পুরুষ অফিসার তাকে লাঠি দিয়ে মারধর করেন। আরেকজন মহিলা বলেন তাকে দিনের-পর-দিন দাঁড় করিয়ে হাতে হাতকড়া পরিয়ে গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রাখার সময় তার ওড়না কেড়ে নিয়ে পুরুষ অফিসাররা উপহাস করে বলে, 'খুব তো পর্দা করত, এখন তো গায়ে একটা ওড়নাও নাই'।
আরেকজন মেয়ে নিকাব খুলতে অস্বীকার করায় তাঁকে তিনদিন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখার পানিশমেন্ট দেয়া হয়। কিছু গার্ড অবশ্য চুপিচুপি তার বাঁধন খুলে দেন এই শর্তে যে অফিসারের পায়ের আওয়াজ শুনলেই আবার বেঁধে ফেলবেন। এমনকি নামাজ পড়ার সময়ও ওড়না ফেরত দেওয়া হয়নি কাউকে-কাউকে। ওড়না চাইলে বলা হতো:
'তোদের নামাজ আল্লাহ এমনিই কবুল করবে না; ওড়না দিলেই কি, না দিলেই কি'।
সবচেয়ে কষ্টকর যে জবানবন্দিটি আমি নিয়েছি তা হলো, একজন আপুর টর্চারের ভয়াবহতায় নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই মাসিক শুরু হয়ে যায়। তিনি নারী প্রহরীদের ব্যাপারটা জানিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চাইলে তারা বলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পুরুষ অফিসারদের জানানো বাধ্যতামূলক। অতঃপর পুরুষ অফিসাররা এসে তাকে ঘিরে ধরে হাসাহাসি করে অপমান করে।
এই ছিল শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। কমিশনে আমরা শত ইন্টিমিডেশান উপেক্ষা করে এসব নিষ্ঠুরতার কাহিনী নথিভুক্ত করি, রহস্যগুলো সমাধান করি, দোষীদের সনাক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। অস্বীকার করব না, বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কাটা কঠিন বটে। তবে ভিক্টিমদের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের প্রতি নিয়ত মনে করিয়ে দেয়, 'ইফ নট আস, দেন হু? ইফ নট নাও, দেন ওয়েন'?"
 
* আপনি যদি গুমের শিকার নারী হন, অথবা এমন কাউকে চেনেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমরা সহানুভূতির সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে আপনাদের কথা শুনব। কথা দিচ্ছি, যতটুকু পারি সাহায্য করব। এবং প্রতিজ্ঞা করছি, সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করব। 
 
যোগাযোগ: রবি-বৃহঃ, ১০.৩০-৪.০০, 017 0166 2120-তে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইতে পারেন; ফিমেল ভিক্টিমরা সর্বদা প্রায়োরিটি পাবেন।
ইমেইলও করতে পারেন/ ফেসবুকে মেসেজ করতে পারেন।
রেলেভ্যান্ট হলে রেস্পন্সিভ - edcommission.bd[at]gmail.com)

No comments: