র্যাবের মহাপরিচালক পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "...লিমন সন্ত্রাসী নয় ঘটনার শিকার..."। এখন পর্যন্ত লিমনের আশেপাশের কেউ, সাত গ্রামের কেউ বলেনি, লিমন সন্ত্রাসী। বরং আমজনতা চোখের জলে, ঘামে ভেজা টাকা দিয়েছে লিমনের চিকিৎসার জন্য।
![]() |
ছবি ঋণ: প্রথম আলো |
শেষপর্যন্ত তাঁকে ডান্ডাবেড়িপরা কয়েদিদের সঙ্গে হাসপাতাতোলে রাখা হয়েছিল, হাইকোর্টের নির্দেশ আসার আগপর্যন্ত! অথচ এরিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪২ দিন! এই অন্ধ রাষ্ট্র ৪২ দিনেও শুনতে পারেনি কিশোরটির জান্তব চিৎকার। যে চিৎকারে আকাশলোকের ঈশ্বরের চেয়ারের পায়া নড়বড়ে হয়ে যায় সেখানে জমিনের ঈশ্বর কোন ছার! আহা, নকল ঈশ্বরের নকল পা- সেই নকল পা নকল পায়ায়!
পত্র-পত্রিকায় এসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিমনের বিষয়ে বলেছেন, "...আমার কিছুই করার নাই..."। ইশ্বর, এটা কী একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য! কিছুই না-করার থাকলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ আঁকড়ে আছেন কেন? পদটা ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন? তিনি এখন দোহাই দিচ্ছেন আইনের। কিন্তু যে র্যাব এই কান্ড করল সেই র্যাব কি তাঁর আওতায় না? বা যে পুলিশ লিমনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিল সেই পুলিশ? নাকি এখন এটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত না!
তাই বুঝি, ভাল তো! লিমনের মার করা মামলা পুলিশ আমলেই নেয়নি! স্বয়ং আদালত মামলা নেয়ার নির্দেশ দিলেও পুলিশ তা অগ্রাহ্য করেছে। দ্বিতীয়বার আদালত নির্দেশ দেয়ার পর তা তামিল হয়। এই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি একবারও পুলিশকেকে জিজ্ঞাসা করেছেন কেন এমনটা করা হলো? আর আমাদের আদালত? আদালত জানতে চাইলেন না পুলিশ কেন এমনটা করল? কোত্থেকে এরা এই সাহসটা পেল!
সাপ্তাহিকের (৫ মে ২০১১) সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইন্সপেক্টর জেনারেল অভ পুলিশ বলেন, "...লিমনের ঘটনা তদন্ত, অনুসন্ধান চলছে বিভিন্ন পর্যায়ে। একটি ঘটনা ঘটার পর তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে থাকে। ...হাইকোর্টে একটা রিট করা হয়েছে।...তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হবে...।"
ভাল কিন্তু পুলিশের দেয়া চার্জশিটে আমরা কি লিমনের সম্পৃক্ত না-থাকার নমুনা খুঁজে পেলাম, ডিয়ার আইজি?
পুলিশদের কেবল দোষ দেই কেন? অসুস্থ লিমনকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন যে মানুষটি (!), তিনি? হাসপাতালের পরিচালক খন্দকার আবদুল আওয়াল রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, "...লিমন সুস্থ হয়ে উঠায় তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালে বিছানায় সমস্যা আছে..."। বাস্তবতা হচ্ছে হাসপাতালের বিছানার সমস্যা ছিল না। হায়, এই মানুষ (!) নামের অমানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার কী কোন আইনই নাই!
আর ঝালকাঠির মূখ্য বিচারিক হাকিম নুসরাত জাহান আদালত কক্ষের টেবিলে ব্যান্ডেজ ভেজা এক পা নিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা লিমনকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন! তিনি কি জানেন না, পত্রিকা পড়েন না? তিনি কি একবারও ভাবলেন না এই অভাগা কিশোরটির কথা।
ঈশ্বর, তোমার এই গ্রহের বাংলাদেশ নামের ছোট্ট একটা জায়গায় এখনও রোদ থাকে, বৃষ্টি হয়। ঈশ্বর, এ অনাচার তুমি করো কেমন করে!
ঈশ্বর তাঁর ভাবনা ভাবুন কিন্তু আমাকে যে ভাবনা কাবু করে ফেলেছে, এই দেশে ক্রমশ পা ফেলার জায়গা কমে আসছে। একজন নাগরিককে ন্যূনতম নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষমতা এ রাষ্ট্রের নাই!
অথচ যেটা অনায়াসেই করা যেত- ট্যাক্সদাতা আমরা সানন্দে গ্রহন করতাম। লিমনের কাটা পা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে এই ছেলেটির প্রতি করা অন্যায়ের খানিকটা অন্যরকম শোধ নেয়া যেত। ছেলেটা পরীক্ষা দিচ্ছিল, এরইমধ্যে এই বিপর্যয়! ভাল হতো যদি আমরা দেখতে পেতাম, একে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সরকার এর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে, দায়িত্ব নেয়া হয়েছে এর পরিবারের। আমাদের শিক্ষাবিভাগ বিশেষ ব্যবস্থায় এই ছেলের পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গাড়িতে করে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিচ্ছেন। আমরা সুখি হতাম, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সংস্থার লোকজন র্যাব-পুলিশ এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত মনে করে একে গাড়িতে করে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাচ্ছে।
'এটা কি খুব বড়ো চাওয়া ছিল মি. প্রেসিডেন্ট?' [১] লেখাটায় আমি লিখেছিলাম, "চারটি দুর্নীতি মামলায় ১৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি শাহাদাব আকবরের সাজা আপনি (প্রেসিডেন্ট) মওকুফ করে দিয়েছেন। অথচ শাহাদাব আকবর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে কখনো আদালতের ধারেকাছেও আসেননি, আত্মসমর্পণ করেননি!
মি. প্রেসিডেন্ট, আমি সবিনয়ে জানতে চাই, শাহাদাব আকবর দেশের জন্য এমন কোন সম্মানটা নিয়ে এসেছেন যার জন্য আপনি আপনার এই ব্রক্ষ্মাস্ত্রটা ব্যবহার করলেন? (তার জন্য আপনার অস্ত্রটা ব্যবহার করলেন)
শাহাদাব আকবরের এটাই কী একমাত্র যোগ্যতা তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর সন্তান?"
আমাদের এই প্রেসিডেন্ট সাহেবই শাহাদাব আকবরের জন্য তার ব্রক্ষ্ণাস্ত্রসম অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন অথচ আমরা দেশবাসি জানি না সত্যিই শাহাদাব আকবর নির্দোষ ছিলে কিনা অথচ কতিপয় লোক ব্যতীত গোটা দেশবাসি জানে লিমন নির্দোষ কিন্তু তাঁর জন্য কারও কিছু করার নাই। মায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীরও? আশ্চর্য বলতেও খেই হারিয়ে ফেলি!
র্যাব নামের 'জমিনের ঈশ্বর' [২] এবং কতিপয় মানুষ কেবল লিমনের একটা পা বগলদাবা করেনি প্রমাণ করেছে এরা সত্যিই জমিনের ঈশ্বর!
এই মুহূর্তে আমাকে যদি এই বিপুল ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলে আমি লিমনের জন্মটা আটকে দিতাম! লিমন এখন আর কেবল একজন মানুষ, একটা নাম, একটা সংখ্যা না; এক ভয়ানক বিপদের নাম! যে বিপদটা ক্রমশ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে! একজন লিমন এই দেশের কতিপয় মানুষ ব্যতীত প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে অরক্ষিত করে দিয়েছে। আমাকেও...।
লিমনের ভাগ্য ভাল। এমন ভাগ্য অন্যের বেলায় হবে এমনটা ভাবা দুরাশা! আজ কেন এমনটা মনে হচ্ছে এই দেশটা আমার না। এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। যাদের আমি করূণা করতাম তারা আজ আমায় করুণা করবে কী, আমি নিজেই নিজেকে করুণা করি। ভিনদেশে থিতু হওয়া, ভিনদেশের বোল বলা এই দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া অভাগা মানুষগুলোর কেলানো দাঁতে গদাম করে বসিয়ে দেয়া ঘুষির সেই জোর আজ কোথায়! অশক্ত হাত যে পেছনে লুকিয়ে ফেলারও সুযোগ নাই।
অদেখা ভয় প্রবাহিত হচ্ছে এখন শিরায় শিরায়- রাষ্ট্রের কাছে কারও কোন নিরাপত্তা নাই, সুবিচার নাই! যে আমি পরমকরূণাময়ের কাছে আবেদন জানিয়ে রেখেছি প্রয়োজনে আমার পাঁচ বছর আয়ু কমিয়ে দিক কিন্তু আমাকে যেন এ দেশ ছেড়ে না-থাকতে হয়। আজ সেই আমার মাথায় এ দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ভাবনা খেলা করছে! ছি! এরচেয়ে যে মরে যাওয়া ঢের কাজের!
কিন্তু নিজেকে যে বড়ো অরক্ষিত মনে হচ্ছে...।
সহায়ক লিংক:
১. এটা কি খুব বড়ো চাওয়া...: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_2646.html
২. জমিনের ঈশ্বর: http://www.ali-mahmed.com/2011/04/blog-post.html