Search

Thursday, May 26, 2011

একজন আউটসাইডার, মজিবর রহমান দেবদাস

­*মজিবর রহমানদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায়...: http://www.ali-mahmed.com/2011/05/blog-post_28.html

আজকের অতিথি লেখক আবারও Gulzar Hossain Ujjal, তিনি লিখেছেন আমাদের অন্ধকার এক ভুবন নিয়ে। অথচ এই অন্ধকারের পেছনেই ছিল থইথই জ্যোৎস্না:

"পর্দায় দেখতে পাচ্ছি কাঁদছেন এই গল্পের কথকও। একটা ধাক্কার মত লাগলো যেন। আমি দুর্বল চিত্তের মানুষ। যা ভেবেছিলাম তাই হলো, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কান্না আসলেই সংক্রামক।
ভেবেছিলাম আর লিখবনা। কি হয় এই সব লিখে টিখে? কিন্তু অবরুদ্ধ কষ্ট আরো ভয়াবহ। এই কষ্টের ভার সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে বরং কিছুটা আরাম হয়। একটু নির্ভার লাগে। এটা এরকমই একটা প্রয়াস। দেখছিলাম অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসকে নিয়ে মফিদুল হকের বানানো একটা ডকুমেন্টারি 'আমি কান পেতে রই'। আসুন একজন দেবদাসের, একজন আউটসাইডারের গল্প শুনি।



ঋণ: "কান পেতে রই"
মজিবর রহমানের জন্ম ১৯২৮ সালে। জয়পুরহাটের মহুরুল গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। কৃতি ছাত্র ছিলেন। বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে আইএসসিতে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বগুড়া ও কুমিল্লায় দুটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। এরপর যান মেলবোর্নে, গণিতে উচ্চতর পড়াশুনা করতে। ফিরে এসে যোগ দেন করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। প্রচন্ড মেধাবী আর নিভৃতচারী আত্মমগ্ন এই মানুষটির দিন কাটতে থাকে পড়াশুনা, অধ্যাপনা আর ফ্লুইড ডিনামিক্সের জটিল তত্ত্ব নিয়ে।

এরপর এলো ১৯৭১। একাত্তরের মার্চের শেষের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে ঘাঁটি গাড়ে পাকিস্তানী সামরিক লোকজন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে হিংস্র পাকিস্তানী সেনাদের নির্মম নৃশংসতার কেন্দ্র। ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র। এপ্রিলের মাঝামঝি অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে যান। সহকর্মীরা পরামর্শ দেন মজিবর রহমানকেও তাদের সাথে ইন্ডিয়া পালিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি যাননি।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন চলছে সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। অধ্যাপক মজিবর রহমান থেকে গেলেন জুবেরী হাউসে। তিনি ইন্ডিয়া গেলেন না।

মে মাসের ১০ তারিখে তিনি সেনা অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখলেন । ইংরেজী তে টাইপ করা তাঁর সেই চিঠির সারমর্ম হলো,
'এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি মিলিটারী ক্যাম্পে পরিণত হওয়ায় তিনি এই ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে চান। অবরুদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন মুক্ত হবে, যখন এটি তার স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফিরে যাবে তখন তিনি আবার ফিরে আসবেন। দু্র্যোগ আর গণহত্যার (চিঠির ভাষায় CALAMITY AND GENOCIDE) এই সময়টি তিনি তাঁর নিজ গ্রামে কাটাতে চান, অফিসিয়ালি যেটি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা' 


চিঠির শেষে তিনি লিখলেন, আজ থেকে তিনি নতুন নামে পরিচিত হতে চান। আজ থেকে তাঁর নাম ‘দেবদাস’। এই নামেই তাঁর সাথে চলবে পরবর্তী যোগাযোগ। এরপর নিজের নাম সাইন করেন, ডি.দাস। নিচে লেখেন DEVDAS, PREVIOUS NAME MOJIBOR RAHMAN

একজন নিভৃতচারী আপাত নির্লিপ্ত মানুষের কী সাংঘাতিক সরব এক প্রতিবাদ! হিংস্র আর রক্তাক্ত সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কী অসাধারণ দৃপ্ত অবস্থান নেন নিঃসঙ্গ মজিবর রহমান অথবা দেবদাস! প্রশ্ন জাগে কেন এই নাম পরিবর্তন? তবে কি ধর্মের নামে করা সেই সব অমানুষিক নৃশংতার কারণে তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর মুসলমানী পরিচয়ে?
অধ্যাপক দেবদাসকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সেনারা তুলে নিয়ে যায় শহীদ জোহা হলে। মিলিটারী ক্যাপ্টেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন 'WHAT DO YO MEAN BY GENOCIDE?'। অধ্যাপক উত্তর দিলেন 'THAT WHICH YOU ARE COMMITING IN THIS STAGE...' 

(এই সাহসিকতা যেন এপিকের মত, মিথের মত। মনে পড়ে পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’র কথা। অবরুদ্ধ প্যরিসে পিকাসোর স্টুডিওতে অনুপ্রবেশকারী জার্মান সেনার মুখোমুখি শিল্পী পিকাসো। গণহত্যায় ব্যথিত পিকাসোর আঁকা ছবি ‘গোয়ের্নিকা’ দেখে বিস্মিত সেনা প্রশ্ন করল 'তুমি এটা করেছ'? পিকাসোর উত্তর, না তুমি করেছ'।) 

এর পরের গল্পটা আমরা অনুমান করতে পারি কি? না, সেইসব নৃশংসতা আমাদের অনুমেয় বাস্তবতার চেয়েও, আমাদের ভাবনার মাত্রা থেকেও অনেক বেশী। রাজশাহী থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় নাটোর জেলে।
দীর্ঘ অকথ্য নির্যাতন শেষে ৫ সেপ্টেম্বর তিনি নাটোর কারাগার থেকে মুক্তি পান। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে তিনি ফিরে আসেন তাঁর ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যোগ দিতে চাইলেন। তবে দেবদাস নাম পরিত্যাগ করতে চাইলেন না। স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন পাকিস্তানীদের মতই অসহিষ্ণু। দেবদাস নামে কোন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে নেই এই অযুহাতে চলল টাল বাহানা। অধ্যাপক দেবদাস তার জায়গায় অটল। তিনি এফিডেভিট করালেন, নাম পরিবর্তনকে আইন সিদ্ধ করলেন। এরপর স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তোলে তার মানসিক স্থিরতা নিয়ে। এ যেন পাকিস্তানীদের অসমাপ্ত নির্যাতনের ষোলকলা পূরণ করা। 


বীতশ্রদ্ধ অধ্যাপক কাজে ইস্তফা দিয়ে পদত্যাগ পত্র লিখলেন। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে দাখিল করা পত্রে গভীর বেদনা আর অভিমান থেকে তিনি চাইলেন পদত্যাগ কার্যকর করা হোক ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে। বিস্ময়কর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ! সহজেই সম্মতি দিলেন তাঁর এই ইচ্ছায়। 

এরপর ফিরে গেলেন অধ্যাপক তাঁর নিজস্ব ঠিকানায়, জয়পুরহাটের মহুরুল গ্রামে। ক্রমেই হারিয়ে গেলেন তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে, তাঁর পরিচিত মানুষের বৃত্ত থেকে। হারিয়ে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। মহুরুল গ্রামে কাটে তার নিঃসঙ্গ জীবন, দিনের পর দিন। কারো সাথে কথা বলেন না তেমন একটা। শুধু এক নাতনী তার দেখভাল করেন, তার সাথে দু’একটা কথা বলেন। সকালে গ্রামের একটা চায়ের দোকানে যান, পরটা-ডিম-মিষ্টি খান। নেহাত কেউ প্রশ্ন করলে দু একটা কথা বলেন। তার কিছু বোঝা যায়, কিছু যায়না। যেন এক দুর্বোধ্য আলো আঁধারী, তাঁর জীবনের মতই। গ্রামের মানুষ জানে একজন অত্যধিক মেধাবী শিক্ষকের ‘ব্রেন নষ্ট’ হওয়ার গল্প। সবার কাছে তিনি ‘বুড়া দাদু’। এভাবেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেন অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস।

দীর্ঘ দিন পর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক দেবদাসকে খুঁজে বের করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র ও সাংবাদিক (বর্তমানে এর শিক্ষক) হাসিবুল আলম প্রধান।১৯৯৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ওই বছর ২রা আগস্ট তাঁর সম্মানে (!) আয়োজন করা হয় একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। সেসময় অধ্যাপক দেবদাস কিছুদিন ছিলেন তাঁর প্রিয় জুবেরী ভবনে। তিনি যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেলেন। প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে অনেকটাই স্বভাবিক আর প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় একরকম জোর করে ওঠাতে হল তাঁকে গাড়ীতে। আবার দেবদাস ফিরে যান তাঁর মহুরুল গ্রামে। সেখানে কাটে তাঁর গতানুগতিক নিঃসঙ্গ দিন। আবারো স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতার দোলাচলে দুলতে থাকেন নিভৃতচারী সাহসী এক প্রতিবাদী মানুষ। 

এই হল একজন দেবদাসের গল্প। এই গল্পে চিরকালের দেবদাসের মতই যেন তিনি এক ট্র্যাজিক হিরো। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের আপোষকামী, সদা পলায়নপর,স্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতার মূর্ত প্রতীক।
বছর কয়েক আগে অধ্যাপক দেবদাসকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী বানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক। অনেক খুঁজে পেতে যোগাড় করি এই ডকুমেন্টারির ডিভিডি। ছবিটির নাম 'আমি কান পেতে রই। ছবিটিতে দেখি অধ্যাপক দেবদাসকে। কিছুটা এলোমেলো, অপ্রকৃতিস্থ, সামাজিক সংযোগহীন। কথা বলেন কতকটা এলোমেলো, কতকটা অর্থবোধক। নাকি এর পুরোটাই অর্থবোধক? আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আমরা স্বার্থান্ধ মানুষ। তাই তাঁর কথা বুঝিনা। আমাদের এই প্রতিবাদহীন, ভোগ-সম্ভোগের সামাজিক বলয়ে তিনি একজন আউটসাইডার। তাই তিনি আমাদের কাছে দুর্বোধ্য।
একটা প্রশ্ন। তাঁকে দেখে আমরা কেউ কি বিব্রত হই? কই হই না তো! কারণ তিনি যে একজন আউটসাইডার...।"


* মজিবর রহমানকে নিয়ে আরও লেখা: http://www.ali-mahmed.com/2011/05/blog-post_28.html

7 comments:

Anonymous said...

?

gulzar said...

!!!!!!!!!!!!!!

Sabbir said...

Anonymous n gulzar, wht u mean by "?" n "!!!!!!!!!!!!!!"

Anonymous said...

সাব্বির বস, এই প্রম্ন সাইনটা দেয়ার জন্য কোন নিষেধ আছে নাকি?

sabbir said...

নাহ, সমস্যা নেই কিন্ত আমাদের মত ম্যাংগোপিপলদের বুঝতে অসুবিধা হয়

Ripon Majumder said...

"আমি কান পেতে রই" এর ডিভিডি কিভাবে পেতে পারি? ইউটিউবে খুঁজলাম, ভিমিওতে খুঁজলাম, আমি যেখান থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্টারির সিডি/ ডিভিডি কিনে থাকি সেখানে খুঁজলাম- কোথাও তো পাওয়া গেল না!

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

খুঁজতে খাকুন, পেয়ে যাবেন। একেবারেই না-পেলে আমার এখান থেকে কপি করে দেয়া যাবে নে...@Ripon Majumder