প্রিয় মানুষের শব নিয়ে ভোরের অপেক্ষা কেমন হয় এটা আমি জানি [১]। সেই রাতের আর ভোর হয় না! আসলে ভোর হয়, ভোরকে কেউ আটকাতে পারে না। অবশ্য কেউ কেউ ভোর হওয়ার আগেই হাল ছেড়ে দেন। কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ান, হেমিংওয়ের বুড়ো সান্তিয়াগোর [২] মত অশক্ত হাতে শক্ত করে হাল ধরে রাখেন। আজ এমনই একজন মানুষের কথা।
একটা ক্লিনিক থেকে জানতে পারি, একজন মানুষ এসেছিলেন এই খোঁজে কিডনি কোথায় বিক্রি হয়, এবং ভাল দাম পাওয়া যায়। এই মানুষটা কেন কিডনি বিক্রি করতে চান এর সদুত্তর এদের কাছে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল কেবল একটা ফোন নাম্বার, যে নাম্বারে ওই মানুষটার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব।
কখনও কখনও আমার ব্রেনে শর্ট সার্কিট হয়ে যায়। অনেকটা সময় পর খানিকটা ধাতস্ত হয়ে ফোন করলাম কিন্তু ওই মানুষটা আমার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হলেন না। তখন কেন রাজি হননি এটা এখন অনুমান করতে পারি।
প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত এমন একজনের সাহায্য নিলাম এবং খানিকটা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো। অবশেষে মানুষটার কাছ থেকে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া শুরু করলাম। মানুষটা চান না তাঁর পরিবার এবং আশেপাশের কেউ কিডনি বিক্রি করা সম্বন্ধে ভুলেও জানুক। মানুষ নামের এই ভদ্রমহিলার স্বামী নেই, একটাই সন্তান। কি একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়ান, মাসে বেতন পান ৮০০ টাকা। দারিদ্রতাকে মোকাবেলা করার মত বিন্দুমাত্র শক্তি তাঁর মধ্যে এখন আর অবশিষ্ট নেই।
এই মানুষটাকে আমি কথা দিয়েছি তাঁর নাম, ঠিকানা, কোন ধরনের ছবি কোথাও আমি প্রকাশ করব না। এটা প্রিন্ট মিডয়ার মানুষটার বেলায়ও প্রযোজ্য। তিনি ইচ্ছা করলে এটা নিয়ে লিখতে পারবেন কিন্তু ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছুই লিখবেন না।
এই ভদ্রমহিলা, লেখার সুবিধার কারণে তাঁর নাম দিলাম মিসেস এক্স। মিসেস এক্স যখন আমাদের সম্বন্ধে খানিকটা আশ্বস্ত হলেন তখন ফোনে যোগাযোগ শুরু করলাম আমি নিজে। ঠিক কিভাবে কি করব আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যেহেতু ইনি শিক্ষকতা করেন, ছাত্রদের প্রাইভেট পড়াবার পরামর্শ দিলে সমস্যাটা যেটা জানলাম, জানুয়ারি ছাড়া এটা হবে না, এখানকার এমনই দস্তুর। হুট করে ভাঙ্গা বছরে এখন কোন ছাত্র পাওয়া যাবে না। জানুয়ারি, সে তো অনেক দূর...!
আমার মাথা ভাল কাজ করছিল না। ভেবে ভেবে কোন উপায় বের করতে পারছিলাম না। কি মনে করে আমি মিসেস এক্সকে বলি, আপনি কি সেলাইয়ের কাজ জানেন?
তিনি বললেন, না।
চেষ্টা করলে আপনি কি শিখতে পারবেন?
তিনি চট করে বলেন, পারব।
আমি বললাম, না, ভেবে বলেন। আপনি যদি সেলাই শিখতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি একটা সেলাই মেশিনের ব্যবস্থা করে দেব। এমনিতে কত দিন লাগবে আপনার শিখতে?
তিনি এবার ভেবে-টেবে বলেন, ১০/১৫ দিনের মধ্যে পারব।
আমি আপাতত এটুকু বলেই শেষ করি, এমনিতে আপনার স্কুলের চাকরি তো চলছে। জানুয়ারি আসলে ছাত্রদের ব্যাচে পড়াবেন। সেলাইয়ের কাজ শিখলে এখান থেকে অর্থ আয় করতে পারবেন। কিছু হাস-মুরগি পোষার ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। আশা করছি, আপনাকে কিডনি বিক্রি করার প্রয়োজন পড়বে না। যেদিন আপনার মোটামুটি সেলাই শেখা শেষ হবে সেদিন আমাকে ফোন করবেন। বাকী কথা পরে হবে।
আমি আমার হাবিজাবি কাজে-অকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলাম। ১০/১৫ দিন লাগে না, মাত্র সাত দিনের মাথায়, পরশু সকাল-সকাল ফোন।
ফোনের ওপাশে মিসেস এক্স, আমার মোটামুটি শেখা শেষ হয়েছে।
আমার ঘোর খানিকটা কেটে আসে, আমি যে ঝোঁকের মাথায় বলে বসলাম, এখন সেলাই মেশিনের কি গতি হবে? সেলাই মেশিন কিনে দেয়ার মত আলাদা ফান্ড তো এখন আমার কাছে নাই। নিজের উপরই আমি খানিকটা বিরক্ত। বাস্তবতা বিবর্জিত একজন মানুষ- ঝোঁকের মাথায় দুম করে একটা কাজ করে ফেলা এটা একটা নির্বোধ আচরণ! নিজেকে মিথ্যা প্রবোধও দেই, সবার বুদ্ধিমান হয়ে কাজ নেই।
মিসেস এক্সের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কেবল ফোনেই কথা হয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। আমি জটিল একজন মানুষ, খানিকটা অবিশ্বাস যে আমার মধ্যে কাজ করে না এই মিথ্যাচার করব না। আমার যা অভ্যাস, পরশু দিনই প্রিন্ট মিডিয়ার মানুষটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মটর সাইকেলেও বেশ অনেকটা পথ! ছোট্ট একটা টিনের ঘরে ঢুকে একটা ধাক্কার মত লাগে। মিসেস এক্স নামের যে মানুষটা, বাচ্চা একটা মেয়ে! হা ঈশ্বর, এই বয়সেই এর বিয়েও হয়েছে, স্বামীও ফেলে গেছে, এর আবার একটা বাচ্চাও আছে!
আমার সামনে ছোটখাটো যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, এই মেয়েটির এই মুহূর্তে কেবল চোখভরা স্বপ্নই না। ভঙ্গিটা অবিকল একজন গ্লাডিয়েটরের- রুখে দাঁড়াবার জন্য, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে প্রস্তুত। আমার কেবল দৃঢ় বিশ্বাস না, চোখ বন্ধ করেও বলে দিতে পারি, এ পারবে।
আমি খানিকটা থমকে যাই এর প্রশ্ন শুনে, সেলাই মেশিন কবে নাগাদ পাওয়া যাবে?
আমি খানিকটা বিভ্রান্ত, ঠিক কবে এটা তো এখনই বলতে পারছি না। তবে কথা যখন দিয়েছি...।
এবার মেয়েটা অসম্ভব সংকোচ নিয়ে বলে, যদি দেনই, ঈদের আগে হলে ভাল হয়। নিজের মেশিনে ঈদের ছুটিতে কাজ করতে পারতাম। কিছু ঈদে মেয়েদের জামা সেলাই করে কিছু টাকাও পাওয়া যেত।
আমি সংকুচিত হয়ে বলি, আচ্ছা দেখি।
মেয়েটি এবার বলে, আমাকে কি কি কাগজে সই করতে হবে?
তোমাকে কোন কাগজেই সই করতে হবে না। আমরা কেবল চাইব, কেবল তুমি এই লড়াইয়ে হেরে যাবে না। কারণ তোমার পরাজয় মানে আমাদের পরাজয়।
ফিরে আসতে আসতে আমার মাথায় কেবল ঘুরপাক খায় আমার এখন একটা সেলাই মেশিনের প্রয়োজন। কোথায় পাই? একজন স্কুলের জন্য টাকা দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এমন না স্কুলের জন্য টাকার প্রয়োজন নেই কিন্তু আমার এখন মনে হয়, স্কুলের চেয়ে এটা জরুরি। মোটা দাগে চিন্তা করলে, শিক্ষারও আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে একজন মানুষের বেঁচে থাকা। একজন মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে তার শরীরের অতি প্রয়োজনীয় একটা অংশ, কিডনি বিক্রি করে দেয়ার জন্য চেষ্টা করে।
অবশেষে এই সিদ্ধান্ত হয়, স্কুলের জন্য এই টাকায় সেলাই মেশিন কেনা হবে। আজই। আমার ভাষায়, কাল কে দেখেছে? কে দেখেছে সামার...?
আজ সেই সেলাই মেশিন, হাতের কাজ করার ফ্রেম, আনুষঙ্গিক যাবতীয় জিনিসপত্র ওই লড়াকু মানুষের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হলো। বড়ো নির্ভার লাগছে নিজেকে। আমার সুতীব্র বিশ্বাস এই লড়াকু মানুষটা পারবে, পারতে তাকে হবেই...।
*আমি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মানুষটার কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, যিনি সমস্ত ব্যয় বহন করেছেন। এই মানুষটা হয়তো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবেন না, কী অসাধারণ একটা কাজই না তিনি করেছেন! এটা কেবল একটা সেলাই মেশিন না- তিনি হাত থেকে মরচেধরা অস্ত্র ফেলে দেয়া মাটিতে পড়ে থাকা লড়াকু একজন মানুষকে কেবল ব্যাটল ফিল্ডেই ফিরিয়ে নিয়ে আসেননি; তার হাতে তুলে দিয়েছেন ঝাঁ চকচকে এক তরবারি।
**কৃতজ্ঞতা প্রিন্ট মিডিয়ার সেই মানুষটার প্রতিও যিনি আমায় লজেস্টিক সাপোর্ট এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়েছেন।
সহায়ক লিংক
১. ভোরের অপেক্ষা...: http://www.ali-mahmed.com/2009/06/blog-post_21.html
২. সান্তিয়াগো: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_31.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Friday, November 12, 2010
এক লড়াকু মানুষের গল্প
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment