জামির মেজাজ ফরটি নাইনের জায়গায় নাইনটি ফোর হয়ে আছে। রাত বাজে একটা দশ। চার পেগ হুইস্কি গিলে ফুরফুরে ভাব নিয়ে দাঁত ব্রাশ করে কুলি করতে বেসিনে যখন দাঁড়াল, ঘড়ির কাঁটা তখন বারটা চল্লিশ, ছুঁইছুঁই। এখনও জামি ঘোড়ার মত দাঁড়িয়ে আছে। বেসিনে বেশ ক’টা কালো পিপড়া। কুলি করতে পারছে না, পানি ঢেলে দিলেই সব ভেসে যাবে।
কে যেন বলতেন এটা, দাদি? যে কাল পিঁপড়া মুসলমান। তাহলে লাল পিঁপড়া কী হিন্দু! এ মুহূর্তে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। বেসিনে বেশ ক’বার টুথব্রাস দিয়ে ঠুকঠুক করল, বিশেষ কোন হেরফের হল না। শালার পিঁপড়া করছে কী, পায়চারি-টায়চারি করছে নাকি! আগুন চোখে তাকিয়ে রইল, ভস্ম করে দিলে বেশ হত। সমস্যা হচ্ছে, এই ক্ষমতা কেবল সাধু-টাধুদের দেয়া হত। কী যন্ত্রণা, ওর এই রুমটা আবার অ্যাটাচ বাথ না। এটাও সম্ভবত মন্তাজ মিয়ার কোন চাল। এই লোকটার কি ধারণা অ্যাটাচ বাথ হলে ওই কাজটা বেশি বেশি করা হবে। পুরনো ধাঁচের এ বাড়িটা কী বুদ্ধিতে কিনেছে কে জানে!
জামি পিঁপড়া এড়িয়ে মুখ ভরে পেস্ট ফেলল। পেস্ট শুকিয়ে মুখ কেমন চটচট করছে। বিরস মুখে সিগারেট ধরাল। কেমন ঝাল ঝাল লাগছে। তিতলি যে মোর সিগারেট খায় অনেকটা ওরকম। মেয়েটা কেমন যেন বদলে গেছে। খুবই সূক্ষ্ণ পরিবর্তন কিন্তু ওর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি! এই তো সেদিন পর্যন্ত, সারাটা দিন, নিশুত রাত অবধি টো টো করে ঘুরত। ঢাকা শহর ভাজাভাজা করে ফেলছিল। ওদিন তো জামির মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দশা, তিতলিকে পড়ার বই ঘাঁটতে দেখে। জামি কপালে ভাঁজ ফেলে বলতে বাধ্য হয়েছিল: কি তিতলি, ওরফে প্রজাপতি, কাম ফ্রম শুঁয়োপোকা, বিষয় কি!
ভাইয়া, ভাবছি অনার্সটা দিয়ে দেব।
হাহ, আপনার সংখ্যা বয়ফ্রেন্ডদের কী গতিটা হবে তাহলে!
তিতলি মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে নখের কোন খুঁটতে লাগল। জামির আর কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। নিঃশব্দে ওখান থেকে সরে এসেছিল। জামি উঠে এসে বেসিনে উঁকি দিল। মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, হারামজাদা পিঁপড়া, ব্লাডি সফটিজ, লাইফ ইজ গোয়িং টু বি হেল।
পিঁপড়ার সংখ্যা আরও বেড়েছে। হারামজাদারা বাচ্চাকাচ্চা-কাচ্চাবাচ্চা সব নিয়ে এসেছে। জামি দাঁতে দাঁত ঘষল, ভাই পিঁপড়া সকল, বিষয় কী, ঘুম নাই! যান ভাইসব, ঘুমান গিয়া। সকাল সকাল উঠিয়া বলিবেন, সকালে উঠিয়া আমি পিঁপড়া মনে মনে বলি...।
মহা মুসিবত। কি করা যায়, আচ্ছা, টেলিফোন করে কল্লোল ব্যাটার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে কেমন হয়। ওদের কি ফোন আছে এখনও, না কেটে দিয়েছে? অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো হেঁড়ে গলা ভেসে এলো, ‘কে-কে?’
‘কে কথা বলছেন, প্লিজ?’
‘আপনি কাকে চান?’
‘এটা কি ২৪০৪১...?’
ওপাশ থেকে টেলিফোনের রিসিভার সম্ভবত সশব্দে নামিয়ে রাখা হল। শালার রঙ নাম্বার। জামি আবার চেষ্টা করল। ওপাশ থেকে যে কান ফাটানো শব্দ ভেসে এলো, তা জোড়া দিলে হবে, ‘কে-এ-এ-এ?’
জামি কানের পাশ থেকে রিসিভার ইঞ্চি তিনেক সরিয়ে বলল, ‘এটা কি ২৪০-?’
‘হারামজাদা, এত রাতে ফাজলামি করার জায়গা পাস না। কুত্তার ছাও! ফোন তোর হো...।’
জামি স্তম্ভিত, এ কী কথা! চট করে সামলে নিয়ে যথাসম্ভব মোলায়েম গলায় বলল, ‘ভাইয়া প্লিজ, আমার কথা শুনুন। ভাইয়া কসম, আমি তো আর আপনার নাম্বার জানি না। অন্য নাম্বারে করছি, আপনার নাম্বারে চলে যাচ্ছে। এতে আমার কি দোষ বলুন ভাইয়া, আপনি অযথা রাগ করছেন। বড় ভাই, এক্সকিউজ করে দেন।’
ভদ্রলোক সম্ভবত খানিক লজ্জিত হলেন। প্রায় শোনা যায় না এরকম গলায় বললেন, ‘আপনার নাম্বার কত?’
জামি এবার অসম্ভব অমায়িক স্বরে বলল, ‘বড় ভাইয়া, আমার উপর রাগ নাই তো?’
‘আরে না, কী যে বলেন, হে হে হে!’
‘ভাই অনুমতি দিলে একটা কথা বলি?’
‘জ্বী-জ্বী, বলেন।’
জামি শান্ত গলায় বলল, ‘য়্যু ব্লাডি ফাকিন গাই, য়্যু ব্লাডি শিট অভ আ মিউল, নাউ বাজ অফ...।’
ওপাশে কবরের নিস্তব্ধতা।
‘ভাইজান রাখি?’
লাইন কেটে গেল। ও চোয়াল শক্ত করে আবারও চেষ্টা করল। রিং যাচ্ছে কেউ উঠাচ্ছে না। রেখে দেবে ভাবছে, মেয়েলি চিকন গলা ভেসে এলো, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আপনি কে বলছেন, প্লিজ?’
‘আমি মৌ।’
‘জিস, রাত বাজে দেড়টা, তুমি টেলিফোন ধরেছ! সরি মৌ, তোমার কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম।’
‘জামি ভাই! না-না, আমি তো পানি খেতে উঠেছিলাম।’
‘কী অবস্থা, তোমার গলা একদম বুঝতে পারিনি!’
‘ঘুম থেকে উঠেছি তো, তাই।’
‘ইয়ে মৌ, কল্লোল কি জেগে আছে?’
‘জামি ভাই, কী যে বলেন আপনি, এতরাতে জেগে থাকবে ভাইয়া! ও হল কুম্ভকর্ন, ঘুমের রাজা। আমি না রাতে ভাইয়ার খাটের পাশে একজগ পানি রেখে দেই। সকালে ওর মাথায় ঢেলে দেই। জামি ভাই, তখন যদি ভাইয়াকে দেখতেন। হি হি হি।’
‘তোমাদের টেলিফোন লাইন চালু আছে। গুড-গুড।’
‘টেলিফোনের কথা কেন বললেন, জামি ভাই।’
‘এমনি-এমনি। অ্যাঁ মৌ, তোমাকে টেলিফোন চালু আছে কিনা এটা জিজ্ঞেস করেছি, এটা কিন্তু তোমার ভাইয়াকে বলো না, ঠিক আছে?’
‘কেন, জামি ভাই?’
‘এমনি-এমনি, কোন কারণ নেই। তোমার ভাইয়ার সঙ্গে একটা বাজি ধরেছি, এই আর কী। তুমি কিন্তু বলো না, এ্যাঁ। কাল তোমার স্কুল আছে না, শুয়ে পড়ো। ইয়ে, কল্লোলকে একটু ডেকে দাও, বলবে আমি ফোন করেছি। খুব জরুরি দরকার।’
দীর্ঘ সময় পর কল্লোলের রাগী গলা ভেসে এলো, ‘আপনার কি সব গ্রে মেটারই আউট হয়ে গেছে। গেছে না, ঠিক ধরেছি। এবার টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে নিজের মাথায় বাড়ি দেন।’
‘খুব মৌজে আছি রে, ফুরফুরে ভাব। খানিকটা অলিপান, আ মীন মদ্যপান করেছি। বেশি না, চার পেগ। হা হা হা। ভাবলাম তোর সঙ্গে শেয়ার করা যাক।’
‘তুই আবার কি ছাতাফাতা শেয়ার করবি!’
‘আরে শুনলে তুই পাগল হয়ে যাবি।’
কল্লোল রাগ চেপে বলল, ‘আজ পর্যন্ত কোন পাগল কাউকে পাগল বানাতে পেরেছে বলে অন্তত আমার জানা নাই। তা টেলিফোন করেছিস কেন?’
‘দেখলাম তুই জেগে আছিস কিনা। তুই ঘুমুচ্ছিলি নাকি? আচ্ছা যা, শুয়ে পড়।’
‘ঘুম ভাঙ্গিয়ে এখন এটা বলছিস, তুই দেখি বিরাট ফাজিল! আর আমি কি তোর মত নিশাচর ড্রাকুলা রে, যে এই মধ্যরাতে জেগে থাকব!’
‘শোন, কাল তোকে জরুরী একটা কথা বলতে ভুলে গেছি-’ এটুকু বলে জামি হাসি একান ওকান করে চুপ মেরে গেল।
‘জরুরি কথাটা কি, অবশ্য আমার ধারণা জরুরী কথাটার অর্থ আপনার জানা নেই।’
‘তোর লাল চশমাটা দেখে ভাবছিলাম এই জঘন্য জিনিস কোত্থেকে জোগাড় করলি। জিজ্ঞেস করতে পরে আর মনে ছিল না। তা, কোম্পানী কি এই একটাই মাল বাজারে ছেড়েছে, বাপ!’
‘জামি, তোর মাথাটা জোরে ঝাঁকা তো, ঝাঁকিয়েছিস? শব্দ হচ্ছে না, হচ্ছে? ঠিক ধরেছিস, কয়েকটা নাট-বল্টু ছুটে গেছে। কাল ওগুলো টাইট দিয়ে ফোন করিস।’
জামি গলা ফাটিয়ে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল। কল্লোলের কানের পর্দা, সম্ভবত টেলিফোনের তারও কাঁপিয়ে। কল্লোল চট করে রিসিভারের কাছ থেকে কান সরিয়ে নিল। বদমাশটা দিয়েছিল কানের বারোটা বাজিয়ে। হিসহিস করে বলল, ‘জামি, এমন জঘন্য করে হাসতে আজ অবধি কাউকে দেখিনি।’
‘বাঁচা গেল-আজ তো দেখলি। অ, দেখবি কি করে, টেলিফোনে তো সে উপায় নেই! ইয়ে, বিশ্বকাপের খেলা দেখছিস না?’
‘না।’
‘আশ্চর্য, তুই একটা মানুষ!’
‘ব্যাটা গর্দভ, বিশ্বকাপের খেলা কী দেয়ালে দেখায়, টিভি থাকলে না দেখব!’
‘বলিস কী, তোদের টিভি কি হয়েছে?’
‘অ্যাকুরিয়াম বানিয়ে ফেলেছি। রং বেরং-এর মাছ ছেড়েছি।’
‘অ,’ জামি একটা জোর ধাক্কা খেল। টিভি বিক্রি করে ফেলেছে! এদের তাহলে চরম দুঃসময় যাচ্ছে। গলার ভাব গোপন করে বলল, ‘সৌদি আরব-হল্যান্ডের খেলা দেখছিলাম, বুঝলি। ক্যামেল টু ক্যাডিলাক ভাইজানরা কেমন খেলে এটাই ছিল কৌতুহল। খেলা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। তুই তো জানিস, খেলা-টেলায় আমার তেমন আগ্রহ নাই। আমি খেলা দেখা শুরু করলাম এখান থেকে, সৌদি এক, হল্যান্ড শূণ্য। আমার মনে হচ্ছিল সৌদি ভাইজানরা এক গোল খেয়ে ফেলছে। কিছুক্ষণ পর ভুল ভাঙ্গল, হল্যান্ড এক গোলে পিছিয়ে আছে। চিন্তা কর, কী বোকা আমি, ব্রেন হয়ে গেছে হালুয়া। হা হা হা।’
‘এই সত্যটা জানতে তোর এতটা সময় লাগল! তোর খুলির ভেতর বাতাস হুহু করে বয়, এটা সবাই জানে; কল্লোল রাগে গরগর করে উঠল। পাগলটার কতক্ষণে পাগলামি থামবে কে জানে! কল্লোলের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।
সহায়ক লিংক:
* তিতলি তুমিও: http://tinyurl.com/3y93om8
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Wednesday, November 24, 2010
ফিরে দেখা: ১
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
3 comments:
আপনার এই উপন্যাসটি লিখতে কতদিন লেগেছে ?
মনে নেই। @Anonymous
Post a Comment