Search

Friday, March 30, 2012

মিনার মাহমুদ, এটা আপনি কী করলেন!

­
"শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;...।"
মিনার মাহমুদ, লাশকাটা ঘরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়াটা, কাজটা কী ঠিক হলো? এটা তো কোনো কাজের কাজ হলো না! ওই মানুষটা আপনার কানে কানে কি বলে গেল? ...আরো এক বিপন্ন বিস্ময় রক্তের ভিতরে খেলা করে..."? ব্যস, আপনি বিশ্বাস করে বসলেন? ধুর বোকা!
আচ্ছা, বিপন্ন বিস্ময় কি কেবল আপনাদের রক্তের ভেতরেই খেলা করে? আহা, আমাদের করে না বুঝি? আমারো যে চলন্ত ট্রেন, ছাদে ঝোলানো পাখা বড়ো টানে! অদেখা ঘুমে যে চোখ জড়িয়ে আসে, ইচ্ছা করে না বুঝি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি? কে বলল আপনাকে, ইচ্ছা করে তো, কী করা- কপালের ফের! কেন করে, আমি জানি না!
আসলাম অনিচ্ছায়, যাবো অনিচ্ছায়; মাঝের দিনগুলোও অনিচ্ছাকৃত ভূমিকায় অভিনয়- সবিরাম অভিনয়। চেষ্টাকৃত অভিনয় করে করে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে মনে হয় না এমন, দূর-দূর, অসহ্য এক জীবন! এমন এক জীবন যখন নিজেকেই সহ্য হয় না। তখন মনে হয় না এমন অন্য একটা ভুবনে, নিদেনপক্ষে অন্য একটা ভূমিকার বড্ডো প্রয়োজন।

কেমন করে, বিশদ জানি না! আমি জানি না, জানি না আমি! কিন্তু আমার সৃষ্ট চরিত্র রাব্বি এটা বিলক্ষণ জানে। জানে বলেই অবলীলায় নিজের জীবনটা নিলামে তুলে দিতে তীব্র আগ্রহ বোধ করে। ফোন বন্ধ করে, সিম কার্ড আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। কোনো-না-কোনো প্রকারে ওকে খুঁজে বের করা সম্ভব এমন সমস্ত চিহ্ন এক এক করে নষ্ট করে, যত্নের সঙ্গে। চুপিসারে পেছনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে- পেছনে পড়ে থাকে ওর যাপিত এক জীবন...।
আহা, রাব্বি নামের ওই মানুষটাকে যে আমি ঈর্ষা করি।

মিনার মাহমুদ, আপনাকে নিয়ে কঠিন এক লেখা লিখেছিলাম আমি। এই নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ নাই- আপনার পাওনা ছিল সেটা। কিন্তু আজ ওই লেখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ওই লেখা চলে যাক ভাগাড়ে। কিন্তু এই বিশ্বাস থেকেও টলাতে পারবে না কেউ আমায়। সবাই মিনার মাহমুদ হতে পারে না- একজন 'স্বপ্নবাজ'! স্বপ্ন দেখে সবাই কিন্তু স্বপ্ন দেখাতে পারেন কেউ কেউ। আপনি সেই অল্প মানুষদের মধ্যে একজন। মিনার মাহমুদের মত মানুষদের ধারণ করার ক্ষমতা এই অভাগা দেশের নাই। এই দেশের এখন স্বপ্নবাজ মানুষের প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন তেলবাজ মানুষের। সেইসব তেলতেলে মানুষদের ঝোলায় সব থাকবে মায় বাংলা একাডেমির পুরস্কারও!

ফিরে এসে মিনার মাহমুদ আবারও বিচিন্তা চালু করেছিলেন কিন্তু হলো না...

আমি যে কেবল লাশকাটা ঘরে আপনার শীতল হাতটা ধরে আছি। বড়ো শীতল, বড়ো শীতল সে হাত! শরীরে অজানা এক কাঁপুনি শুরু হয়। থরথর করে সমস্ত শরীর কাঁপে, অজানা এক ভয়ে...!

*মিনার মাহমুদের শেষ চিঠি: http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/04/11/140468 

"লাজুক,
আমার এই ৫৩ বছর বয়সী জীবনে অনেক অনেক মেয়েকে দেখেছি। কিন্তু তোমার উদাহরণের বাস্তব ব্যক্তিকে দেখিনি। অবাক হই, সৃষ্টিকর্তা কেন তোমার মতো মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন।
সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমি জানতাম-কোথায় যাচ্ছি, কি করতে যাচ্ছি। বুক ভেঙে কান্না আসছিল। চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারলাম না। এতদিনের চেনাজানা এ বাড়িতে আর ফিরব না। আর দেখা হবে না তোমার সঙ্গে। চেপে রাখা মুখ ঠেলে কান্না এলো। নিজেকে খুন করে ফেলার এ আয়োজনে সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতা ছিলে তুমি।
আমার মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে তোমার কান্না-ভাবতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। আবার সিদ্ধান্ত নিই। লাজুক তুমি এখন নিঃসঙ্গ, একাকী।
তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন আসবে আমি কেন আত্মহত্যা করলাম? গতকাল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা থেকে রিজাইন করেছি বলে? মোটেও না, আসলে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ আছে আমার বাংলাদেশের সার্বিক সমাজব্যবস্থায়।
সাংবাদিকতা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও মাস্টার্স শেষ করতে পারিনি সাংবাদিকতা সূত্রে মাস্তানদের হুমকির কারণে। ক্যাম্পাস ছিল আমার জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পদত্যাগে বাধ্য করা হলো আমাকে দুর্নীতির অভিযোগে।
লতা হোসেন আমার জীবনের সবচেয়ে আত্মার বন্ধু। তার সহযোগিতায় বিচিন্তা বের করলাম। মোটামুটি সফল। নিষিদ্ধ হলো কিছুদিন পরে। জেলজীবন। তিন বছর বেকার। এরপর এলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একমাত্র সোলএজেন্ট খালেদা জিয়া। বিচিন্তা সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা। তখন সাপ্তাহিক কার্যদিবসের প্রতিটি দিনই হাজির থাকতে হতো কোর্টপাড়ায়। বুঝতে পারছিলাম স্থায়ীভাবে জেলজীবন দেখানোর পরিকল্পনা আছে গণতান্ত্রিক সরকারের। উপায়হীন আমি পালিয়ে গেলাম আমেরিকায়। বিচিন্তা সংশ্লিষ্ট কর্মীরা যাতে বেকার না হয়, বিচিন্তা হস্তান্তর করে গেলাম ইউএনবি এনায়েতুল্লাহ খানের কাছে।
১৮ বছর দাসত্বের জীবন কাটিয়েছি আমেরিকায়। ১৮ হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, কত কোটি টাকায় বিক্রি করেছ বিচিন্তা? সবাই শুধু বিকৃত মানসিকতার একটি বিষয়ই বিবেচনা করেছে। কিন্তু দেশে ফিরে ২০১০ সালে যখন এনায়েতুল্লাহ খানের কাছ থেকে বিচিন্তা ফিরিয়ে নিই একজনও প্রশ্ন করেনি কত টাকায় ফেরত নিলাম।
লাজুক, সাংবাদিকতা পেশায় মেধাহীন আমি শ্রমই দিয়েছি। নিউজপ্রিন্টের ওপর বলপয়েন্ট দিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া—হাত ফুলে উঠত, লাইট বাল্বের উত্তাপ দিয়ে সেঁক দেয়া। আবার লেখা। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সাংবাদিকতা পেশার নাম বিনিয়োগ করে কখনও আমি কি কোনো সুবিধা নিয়েছি? নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন চার হাজার টাকা। কোনো বাড়ি অথবা দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি নেই। আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা। একটা সময়ে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি পর্বতের উচ্চতা থেকে। নিজের জন্য সম্পদ মাথায় আসেনি।
যে কথাটা বলতে চাইনি—নিউইয়র্কে আমার জীবন-যাপন ছিল আত্মকেন্দ্রিক। বিচ্ছিন্ন ছিলাম দেশ এবং বাংলাভাষা থেকে। নেটলাইনে কৃষ্ণকলির গানগুলো শুনতাম, এমন স্থির, কনফিডেন্স। বাংলাদেশ আবার বিজয় হয়ে আসে জীবনে। আর ঠিক এই সময়ে তুমি অপরাজিতা। নেটলাইনে পরিচয়, শুনি তোমার অসাধারণ জীবন্ত গান। সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশে আমার মৃতদেহও যাবে না। তাই শরীরের সবকিছু অগ্রিম দান করে রেখেছিলাম হাসপাতালে। তুমি বদলে দিলে সবকিছু।
লাজুক, আমি সিদ্ধান্ত নিই, ফিরে যাব দেশে। প্রথম দেখা হয় তোমার সঙ্গে বিমানবন্দরে। দীর্ঘদেহী, শ্যামলা। আশ্চর্য চোখ তোমার। কথা বলে চোখের ভাষায়। তোমার আমার প্রথম দেখা, বিয়েসহ সব সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে আমরা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। তুমি দাঁড়িয়েছিলে চেনা অথবা অচেনা মানুষটার জন্য। আমি তোমাকে দেখি সবটুকু। চারদিকে কোনো কিছু কেয়ার না করে কাছে টেনে বুকে নেয়ার ইচ্ছে হয় তোমাকে।
এখন শোনো লাজুক। আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই একজন মানুষ। বিচিন্তা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকরা নেয়নি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা-অচেনা পত্রিকা, মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি কেউ নেয়নি। অবাক হয়েছেন নিয়মিত লেখা এক সাংবাদিক। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি।
লাজুক, বেশকয়েক দিন ধরে চিন্তা করেছি—মৃত্যু। তারপর কোথায়? এরপর কী জীবনের আর কোনো ফিরে পাওয়া! খুব অবাক হয়েছি, বাংলাদেশের কোনো দৈনিক পত্রিকায় আমার স্থান হলো না।
বিচিন্তা শুরু করেছিলাম একদল তরুণ নিয়ে। বিরাট এক ঝুঁকি। কোনো পত্রিকা নেয় না। আমি নিয়ে নিয়েছিলাম। কারণ নতুন সাংবাদিক আনতে। খুব, খুব কষ্ট পেয়েছি, অপমানিত হয়েছি। যুগকে জিজ্ঞাসা করো, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নতুন ধারা যারা তৈরি করেছে তাদের একজন আমিও।
আমি মিনার, যখন আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই, শুনে সবাই অবাক। প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে কেন ফিরে যাচ্ছি। আমি অবাক হই, নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি—এটা নিয়ে প্রশ্ন কেন? কোথায় যাব আমি তাহলে?
লাজুক আমি নিজেকে খুন করে ফেললাম। কোনো বিকল্প না পেয়ে। কাগজপত্রে আমি একজন আমেরিকাবাসী এখন। তুমি যেতে চাও না। বিদায় তোমাকে। তুমি চাওনি আমি আমেরিকা যাইনি। দয়া করে বেঁচে থেকো লাজুক। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, আমি এখন ট্যাবলেট খাচ্ছি...।
"  

3 comments:

আবদুল্লাহ said...

মিনার মাহমুদের মৃত্যুটা সত্যি অকল্পনীয়।আপনি মিনার মাহমুদকে নিয়ে আগের লেখাটা সরিয়ে ফেলেছেন দেখে ভাল লাগলো

lopa said...

lekhata pore bukta dhok kore utlo,

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

"...আগের লেখাটা সরিয়ে ফেলেছেন দেখে ভাল লাগলো...।
এটা করে আমারও ভাল লাগছে...। @আবদুল্লাহ