আমার খুব কাছের মানুষ সমস্যাটা চট করে ধরতে পারেন, আমার মধ্যে ঝামেলা আছে, বড়ো ধরনের ঝামেলা! নিজের সন্তানের প্রতি আকাশ-পাতাল মায়া আমার নাই, থাকার নাকি কথা! এই নিয়ে আমায় বিস্তর কথা শুনতে হয়, না-হক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। কখনও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। অহেতুক মায়ার বস্তা না-থাকলে কী করব, নিজেকে ধরে ধরে চাবকাব!
আমার সাফ কথা, অনর্থক নিজের সন্তানের প্রতি আকাশ-পাতাল মমতা থাকার অর্থ এই গ্রহের অন্য সন্তানদের প্রতি অন্যায় করা। তাই বলে আমি লেংটিপরা দেবতা না যে নিজের সন্তানদের ফেলে দিয়ে গাছে গাছে দোল খাব। বা বাংলাদেশের 'ন্যাতা' না যে প্রয়োজনে আরও রক্ত দোব।
এটা সত্য নিজের সন্তানদেরন জন্যও আমারও আছে উজাড় করে দেয়া ভালবাসা কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে না। আমার মনে আছে, আমার ছেলেকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলাম কারণ একদিন রাস্তায় দেখি, তার স্কুল ব্যাগ বুয়ার হাতে ছিল। এই বুয়া নামের মানুষটা আমার খালাসম কারণ ইনি শৈশবে আমাকেও পরম মমতায় লালন করেছেন। আমার ছেলেটা নিষেধ করেছিলাম, 'তোমার স্কুল ব্যাগ তুমি ক্যারি করবে'। সে তখন আমাকে উত্তর দিয়েছিল, 'বাবা, আমার স্কুল ব্যাগটা নিতে পারি না'।
আজকালকার বাচ্চাদেরকে গাট্টি-গাট্টি বই ধরিয়ে দেয়া হয় তবুও তার ব্যাগ খুলে দেখা গেল দেড় লিটারের পানির বোতল। স্বল্প দূরত্বে একটা বাচ্চার জন্য দেড় লিটার পানির বোতলের প্রয়োজন নাই। ঝেড়েঝুড়ে ব্যাগটা অনেকখানি হালকা করে দেয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এরপর থেকে তোমার ব্যাগ তুমি বহন করবে। তদুপরি...। এই বিষয়ে কোন ছাড় নাই, আমি চাই না এ রসিয়ে রসিয়ে তার বন্ধুদেরকে বলুক, এই জানিস, আমার ব্যাগ না আমার বুয়া আনানেওয়া করে। ওর বন্ধুরা তখন বলবে, ওই-ই মা, তাই!
আমার সন্তান বেয়াদব হয়ে বড়ো হোক এটা আমি চাই না। একটা বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে যখন জড়িত ছিলাম তখন আমি দেখেছি, এমবিএ করা চ্যাংড়া-চ্যাংড়া পোলাপানরা তাদের ল্যাপটপটা নিজে বহন করত না, করত তাদের গাড়ির চালক। আসলে এই কুত্তার বাচ্চাদের জুতিয়েও মানুষ করা সম্ভব না!
কিন্তু...। আমার সমস্ত হিসাব ওলটপালট করে দেয় আমার মেয়েটা। জানি-জানি, অনেকে ফ্রয়েডিয় বুলি কপচাবেন। বিষয়ট আসলে এমন না...।
এর হাতে একটা অপারেশনের প্রয়োজন হলো। একে যখন অপারেশন টেবিলে শোয়ানো হলো, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সিস্ট বের করার চেষ্টা করা হলো তখনও আমি স্বাভাবিক।
কিন্তু এই অপারেশনে অনেকখানি জটিলতা দেখা দিল- বেচারা ডাক্তারের কিছু করার ছিল না। ছাতার এই আখাউড়া হাসপাতালে এই সামান্য সার্জারি করার সুবিধাটুকুও নাই! দ্বিতীয়, তৃতীয়বার ড্রেসিং-এর নামে গায়ের জোরে এর হাত থেকে সিস্ট বের করার চেষ্টা।
চতুর্থবারের মাথায় যখন একে অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শোওয়াবার আয়োজন চলছে তখনও মেয়েটি আমার কথা অবিশ্বাস করছিল না। অথচ ইতিমধ্যে এ অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করেছে কেবল বাবার কথা বিশ্বাস করে।
বুকে হাত দিয়ে স্বীকার যাই, এদিন আমার নিজের আর মনের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি ছিল না। গত মঙ্গলবারের বিষণ্ণ বিকেলে আমি ঝাপসা মনিটরে ব্যানার পরিবর্তন করেছিলাম, "আজ আমার অসহ্য লাগছে, ভাল লাগছে না কিছুই! ক-দিন ধরেই আমার মেয়েটাকে ডাক্তাররা কাটাছেঁড়া করছে। এই কান্ডটা আজও হবে কিন্ত আজ আর আমার এক ফোঁটা শক্তি নাই! এই গ্রহের সব তুচ্ছ মনে হচ্ছে! আমার চেয়েও অনেকের বুকে জগদ্দল পাথর চেপে আছে কেবল তাঁদের কথা ভেবে খানিকটা শক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছি..."।
সত্যি সত্যি তখন আমার খানিকটা শক্তি নামের উষ্ণতার বড়ো প্রয়োজন। আমি মনে মনে কেবল ভাবছি, কাশেম ভাই নামের আরেক বাবার কথা [১]। পাশাপাশি তুলনা করলে আমার এই বেদনা কিছুই না!
এমনিতে অন্য একটা কারণেও আমার মেজাজ সপ্তমে কারণ আমি কাফরুল নামের যে জায়গায় ছিলাম ওখানে আসা-যাওয়ার জন্য আর্মিদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। গতবারের স্মৃতি এখনও দগদগে। সেই লেখার সূত্র ধরেই বলি, 'আমি ব্লাডি সিভিলিয়ান এখুনি মরতে চাই না' [২]।
আমি ঢাকার রাস্তা-ঘাট মনে রাখতে পারি না বিধায় একজন সহৃদয় মানুষ ড্রাইভারসহ একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গাড়ি যিনি চালান তাঁকে আমি শান্তমুখে আগেই বলে দিয়েছিলাম, আর্মিদের সঙ্গে আমি একটা বাক্যও ব্যয় করব না। যা বলার আপনি বলবেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলবেন, আমি বোবা, কথা বলতে পারি না।
অপারেশন থিয়েটারে সার্জন খানিকটা চিন্তিত। আমার মেয়েটার শ্বাসকষ্টের সমস্যার কারণে একে পুরোপুরি অজ্ঞান করা ঝুকিপূর্ণ কারণ জ্ঞান না-ও ফিরতে পারে তাই লোকালই ভরসা। তিনি অন্য ডাক্তারের সঙ্গে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন কেবল লোকালের উপর ভরসা করে এই অপারেশনটা যে করবেন বাচ্চা এইটুকুন মেয়ে এই তীব্র কষ্ট সহ্য করতে পারবে কিনা।
অপারেশন থিয়েটারে মেয়েটার সঙ্গে আমি অনবরত কথা বলে যাচ্ছিলাম। এ যখন বলল, 'বাবা, ডাক্তার আমায় কষ্ট দিচ্ছে', আমি বুঝে যাই কতটা কষ্ট সহ্য করে এ এই কথাটা বলেছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে এর অন্য হাতটা আমার মুখে রেখে বিড়বিড় করে বলি, 'তোমাকে ডাক্তার যতটা কষ্ট দেবে তুমি তারচেয়ে জোরে আমার গাল খামচে ধরবে, দেখবে তোমার ব্যথা কমে গেছে'।
আমার গাল ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল, হোক। আমি এটাও জানি না বিজ্ঞানের কোন কিতাবে এটা লেখা আছে কিনা একজন অন্যজনকে ব্যথা দিলে তার ব্যথা কমে যায়। আমার এতো জেনে কাজ নেই, আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, দ্যাটস অল।
ডাক্তাররা এই মেয়েটার সহ্য করার ক্ষমতা দেখে হতভম্ব হয়েছিলেন। কিন্তু আমার অদেখা রক্তক্ষরণ কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। আমার অদম্য কষ্টটা অন্য কারণে। কেন এই মেয়েটা অন্যদের মত আকাশ ফাটিয়ে কান্না করছিল না? কেন বাবা নামের মানুষটার সমস্ত কথা বিশ্বাস করে বসে আছে! বোকা মেয়ে, বড়োদের পুরোপুরি বিশ্বাস করতে নেই!
(সবিনয় অবগতি: এটা একটা নিছক ব্যক্তিগত লেখা। এখানে মন্তব্য প্রতিমন্তব্য করার কিছু নাই। রোগি এখন ভাল আছে এটা খানিকটা আঁচ করতে পারছি কারণ একটু আগে আঁকাআঁকির চেষ্টা করছিল। অবশ্য জিনিসটা লাউ নাকি রকেট এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত না)
সহায়ক সূত্র:
১. অপেক্ষা: http://www.ali-mahmed.com/2011/03/blog-post_13.html
২. ব্লাডি সিভিলিয়ান: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_15.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Sunday, March 20, 2011
নিছক ব্যক্তিগত
Subscribe to:
Posts (Atom)