Search

Sunday, August 12, 2018

শুয়ে আছেন এখানে, দুর্দান্ত এক অভিমানে।

আমাদের সব গেছে বানের জলে ভেসে। গেছে ছিনতাই হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আবেগও! নইলে কী আর ১৯৭১ সালের অনেক পরে জন্ম নিয়েও দিব্যি একালের মুক্তিযোদ্ধারা ঘুরে বেড়ায়। একজন বীর বিক্রম শহীদ সিরাজের মত অগ্নিপুরুষেরা থেকে যান এই প্রজন্মের অনেকটা চোখের আড়ালে। কিন্তু আমাদের মধ্যে থেকে থেকে কেউ-কেউ ঠিকই মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে এঁদেরকে নিয়ে আসেন ঠিক আমাদের চোখের সামনে।

সেই কেউ কেউ-এর একজন Apu Nazrul (link)।  লিখেছেন বীর বিক্রম শহীদ সিরাজকে নিয়ে:
"যাদের চোখের জ্যোতি ভালো তারা পড়ার চেষ্টা করুন। আর যাদের চোখ ভালো না তাদের জন্য সিমেন্টের ফলকে কোনরকমে লেখা লেখাটা লিখে দিচ্ছি:
শহীদ মো: সিরাজুল ইসলাম
গ্রাম: চিলনী
থানা: ইটনা
জিলা: ময়মনসিংহ বাংলাদেশ
২২শে শ্রাবণ, ১৩৭৮।

১৯৭১ সাল থেকে ২০১৭। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় ইটনা এখন আর ময়মনসিংহ জেলার থানা নয়, বরং কিশোরগঞ্জ মহাকুমাই এখন জেলা। পুরো ময়মনসিংহ অঞ্চলে একমাত্র বেসামরিক বীর বিক্রম শহীদ সিরাজের কবর আজো পড়ে আছে টেকেরঘাটের ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে!

শহীদ সিরাজ ছিলেন আরেক কিংবদন্তী যোদ্ধা শহীদ বীর উত্তম (প্রথম ঘোষিত বীরশ্রেষ্ঠ) জগৎজ্যোতি দাসের বিখ্যাত দাসপার্টির সদস্য। ১৯৭১ সালের ৮ই আগষ্ট সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার মুক্ত করতে গিয়ে সম্মুখ সমরে শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজ। যুদ্ধের সময় সিরাজ ছিলেন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত ছাত্রনেতা ও তৎকালীন ভিপি পদপ্রার্থী।
(কলেজ প্রাঙ্গণে সিরাজের একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে)
যুদ্ধের শুরুতেই সিরাজ এলাকার যুবকদের সংগঠিত করেন এবং তাঁর গ্রামের ৭ জন যুবককে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। শহীদ সিরাজ মূলত বিখ্যাত তার মৃত্যুর ৮ দিন আগে বাবার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিটির জন্য। অত্যন্ত আবেগময় এ চিঠিতে একজন মুক্তিকামী তরুণের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের আকাঙ্ক্ষা, আকুলতা-ব্যাকুলতা ও নিষ্ঠার স্বরূপ ফুটে উঠেছে। তাঁর মৃত্যুর পর চিঠিটি সংগ্রহ করে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠ করা হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার হতেও এ চিঠিটি বেশ কয়েকবার পাঠ করা হয়।
চিঠিটি নিম্নরূপ:
'টেকেরঘাট হইতে                                                               তাং- ৩০/৭/৭১
প্রিয় আব্বাজান, আমার সালাম নিবেন। আশাকরি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেণীমত সালাম ও স্নেহ রইলো। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলীরাজা, মাহতাব, রওশন, রুনু, ফুলমিয়া, ইব্রাহিম সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করবেন। 
আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি, কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবেনা। তাই যুদ্ধকে জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদের ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে।
চাচা-মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যোগ দিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছি।
দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পূত্র হারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নাই। 
আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী ! স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীরজাফরী করিওনা, কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদেরকে ক্ষমা করিবেনা এবং এই বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবেনা। সালাম ! দেশবাসী সালাম!
ইতি মোঃ সিরাজুল ইসলাম                                                      ৩০-৭-৭১ ইং'

হয়তো কোন সামরিক বাহিনীর সদস্য না হওয়ার কারণেই কিংবদন্তীতুল্য যোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যোতি দাসকে সর্বপ্রথম বীরশ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেও পরে যেহেতু সে জনযোদ্ধা তাই বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়। (আমাদের সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের তিনজন সেনাবাহিনীর, দুজন ইপিআরের, একজন নৌ ও একজন বিমান বাহিনীর। কোন বেসামরিক বীরশ্রেষ্ঠ নেই।) (জগৎজ্যোতি দাসকে নিয়ে ব্লগে লিখেছিলাম ২০১২ সালে। আগ্রহীরা খুঁজলে পাবেন)

আর তাঁরই 'দাসপার্টি'র শহীদ সিরাজ একজন বীরবিক্রম হওয়ার পরও তার কবর পড়ে আছে অনাদরে, অবহেলায়! গত সপ্তায় যখন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কবরস্থানে পৌছাই তখন সেখানে আক্ষরিক অর্থেই কবরের নির্জনতা। পেছনে মেঘালয়ের পাহাড়, গড়ানো বিশাল সব পাথরখন্ডে ঠাসা চারপাশ। তারই মাঝে ঝোপঝাড় গজিয়ে পুরো জায়গাটাই জঙ্গল হয়ে আছে। সাপের ভয়ে জোরে জোরে পা ফেলে কবরস্থানে প্রবেশ করি।
চারপাশে সুনশান নির্জনতা তার মাঝে আরো অনেক কবরের মাঝে চিহ্নিত দুটি কবর। একটি নাম না জানা এক বীর শহীদের, আরেকটি শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমের!

পাশেই নীল জলের দৃষ্টিনন্দন বিশাল এক লেক। সাবেক হয়ে যাওয়া খনির লাইমস্টোন এখান থেকেই ডিনামাইট ফাটিয়ে উত্তোলন করা হতো। অধুনা ট্যুরিষ্টরা এর নাম দিয়েছে নীলাদ্রি, যদিও স্থানীয়রা বলেন কোয়ারি লেক। এসব নীলাদ্রি ছাড়িয়ে দিনশেষে আমার মনে দাগ রেখে গেলো বিস্মৃত বীর বিক্রম শহীদ সিরাজ। আমার কাছে কোয়ারি লেক তাই শহীদ সিরাজ লেক হিসেবেই বেশি স্মরণীয় থাকবে!" Apu nazrul (link)

2 comments:

Anik Khandokar said...

ধণ্যবাদ জানাই কারণ এই লেখার মাধ্যমে জানতে পারলাম একজন বেসামরিক শহীদের কথা। নয়তো অজানাই থেকে যেতো।

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

আপনাকেও ধন্যবাদ :)