জার্মানি যাত্রায় কিছু বিষয় আমাকে বেশ খানিকটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। প্রথমটা হচ্ছে, ওখানে যাওয়ার পূর্ব থেকেই আমাকে বলা হচ্ছিল, ওখানে আমার পরিচিত কারা কারা আছে তাদের নাম দেয়ার জন্য- তাদের জন্য আমন্ত্রণপত্র তৈরি করার কারণে এটা প্রয়োজন। এদের এটাও জানা ছিল, আমি যাদের সঙ্গে লেখালেখির নামে ব্লগিং করেছি- সহযোদ্ধা; জার্মানিতে থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা কম না। কিন্তু আমি অনেকখানি বিভ্রান্ত ছিলাম কারণ বলার মত এমন কোন নাম আমার মাথায় আসছিল না।
কেন? আমার যাওয়া নিয়ে অনেক ধরনের নাটক-জটিলতা হয়েছিল, এর বিশদে যেতে এখন আর ইচ্ছা করছে না। আমি কোন এক লেখায় লিখেছিলাম, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও দলবাজি করেন [১] আমরা কোন ছার! এদেরই তো ছাত্র আমরা- যেমন গুরু তেমনি তাঁদের শিষ্য। আমাদের দেশে দলবাজি করেন না এমন মানুষের প্রায় নাই-ই বললে চলে। যারা আছেন এদের মত অভাগা আর কেউ নাই। এখানেও দলবাজি হবে না এমনটা কী হয়, পাগল! মানুষ যেমন বাজার থেকে সদাই কেনার পূর্বে টিপেটুপে দেখে কেনেন তেমনি লোকজনরাও তখন আমাকে পরখ করা শুরু করলেন, আমি কোন দিকে কাত হয়ে আছি। জনে জনে আমাকে জ্ঞান দিলে লাগলেন আমার কি করা উচিত, কি করা উচিত না!
বিভিন্ন শ্রেণী, মিডিয়া এরা নিশ্চিত হলেন আমি তাদের কাতারে পড়ি না। অতএব 'বুশ স্টাইল'- হয় তুমি আমার দলে নইলে আমার ঘোর শত্রু! আমাদের দেশ থেকে দল বড়ো, দল থেকে ব্যক্তি! এখনও আমার যাওয়ার অপরাধে থিসিস করা চালু আছে- বেশ কিছু ডক্টর প্রসব হবে!
অল্প সময়ে কত নাটক যে দেখলাম, যে মানুষটা লিখে জানান, বস, আসার সময় ইংল্যান্ড হয়া আইসেন আপনাকে নিয়া ব্যাপক...ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মানুষটাকেই যখন দেখি এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কারণে আমাকে নিয়ে কুৎসিত লেখা দেয়া হয়, ওখানে সদর্পে পঞ্চতারকা প্রদান করেন, উল্লাস করেন। আমি জেনে সুখি হই, কত ধরনের মুখোশ থাকে এদের ড্রয়ারে!
মুখোশ নিয়ে নিশ্চয়ই তাক লাগানো একটা নাটক লিখবেন আশা করি। সেই নাটক টিভিতে প্রচারিত হলে শত কাজেও মিস করব না এটা নিজেই নিজেকে কথা দিচ্ছি।
তারপরও জার্মানিতে থাকেন এমন দু-চারজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কারও মধ্যে পেছনটা উত্তোলন করার মত শক্তির আভাষ পাওয়া গেল না। মেইলে আমার হোটেলের ঠিকানা-ফোন নাম্বারও ছিল। যদিও আমি নিজের সুবিধা এবং সময়ের স্বল্পতার কারণে হোটেলে থাকতাম না কিন্তু হোটেলের ডেস্কে ঠিকই খোঁজ নিয়েছি আমার জন্য কোন ম্যাসেজ আছে কি না? উত্তর নেগেটিভ।
আমার ধারণা ছিল, আমার তরফ থেকে সাড়া না পেয়ে কর্তৃপক্ষ হয়তো ভুলে গেছে কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর আবারও একই প্রসঙ্গ। আমার কাছে বারবার জানতে চাওয়া হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে কেউ যোগ দেবেন কি না? অন্য ভাষার অনেকেই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজ দেশ থেকে উড়ে চলে এসেছেন অথচ জার্মানি থেকেও বাংলা ভাষায় কথা বলা কোন মানুষ আসবেন না এটা সম্ভবত এরা মানতে পারছিলেন না! একই প্রসঙ্গ বারবার আসায় আমার বিরক্তি লাগে।
কী বিচিত্র আমরা- ততোধিক বিচিত্র আমাদের আচরণ! বাংলা ভাষার জন্য বিশেষ দিনে কাঁদতে কাঁদতে কপাল (!) ভিজিয়ে ফেলি! এমনিতে প্রবাসে যারা থাকেন এঁদের অনেকের আবেগ আবার খানিক বেশি। এরা 'মহুয়া মঞ্জুলী ফেরদৌসের আমি বীরাঙ্গনা বলছি' [২] নামে বাংলা ভাষা উদ্ধার করেন। কেউ কেউ বারোটা বাজিয়ে, দেশের বিস্তর দুর্নাম করে, দেশটাকে নগ্ন করে প্রবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে প্রার্থনা করেন; সাদা চামড়ার দক্ষিণায় বেঁচে-বর্তে থাকেন। ওখান থেকে পারলে দেশটাকে বঙ্গোপসাগরে চুবিয়ে শুদ্ধ করে ফেলেন!
কেউ কেউ চমৎকার ডকুমেন্টারি বানান, ওখানে দেখান মাদ্রাসা, দেখান বন্যায় জবুথুবু এই দেশের অসহায় মানুষগুলোকে; রিলিফের এক প্যাকেট বিস্কিটের জন্য শত-শত হাত উঠে আছে। এরা দেখান এ দেশের মাকে- নগ্ন পা, দুই কোলে দুইটা অপুষ্ট বাচ্চা। এতে প্রবাসীদের কাছে আমাদের শির বড়ো উঁচু হয়! কী একেকজন দেশপ্রেমিক! দেশের ঝান্ডা তো এদেরই হাতে!
আমার জানা মতে, অন-লাইনে লেখালেখি নিয়ে এতো বড়ো পরিসরে বাংলা ভাষা আর কোথাও যায়নি এবং এখানে এই প্রথম বাংলা ভাষা যুক্ত হয়েছিল। ওখানে, বিভিন্ন ভাষা-ভাষী মানুষদের কাছে কোন মানুষটা গিয়েছিল এটা মূখ্য ছিল না, ছিল বাংলাদেশ-বাংলা ভাষা। একটা দেশের পতাকা কোন বাঁশে লাগানো হলো এই নিয়ে কুতর্ক চলে কিন্তু এতে পতাকার কিছু যায় আসে না, পতাকা সগর্বে পতপত করে উড়তে থাকে। যেমন ওখানে উড়ছিল বাংলাদেশের পতাকাটা। ওখানে পতাকার বাঁশটা কে ধরে রেখেছে তাতে কী আসে যায়!
সামহোয়্যারে এটা নিয়ে যে পোস্টটা দেয়া হয়েছিল [৩], ওখানে আমি লিখেছিলাম:
"ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ছয় হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। লাটভিয়ায় ‘লিভোনিয়ান’ ভাষায় কথা বলেন এমন একজনই মাত্র জীবিত ছিলেন, তিনি মারা গেলে সেই ভাষারও মৃত্যু হবে। এটা ২০০৯ সালের কথা, এরিমধ্যে তিনি মারা গেছেন কিনা আমি জানি না।
আলাস্কার ‘আইয়াক’ ভাষা জানা শেষ ব্যক্তিটি মারা যান ২০০৮ সালে। তাঁর সঙ্গেই মৃত্যু হয় ‘আইয়াক’ ভাষার।
৮৫ বছর বয়সী 'বার সর' ছিলেন ভারতীয় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ৮০টি আদিবাস গোষ্ঠীর সবচেয়ে বৃদ্ধ সদস্য এবং ২০১০ সালের জানুয়ারিতে মৃত্যুর আগে তিনি ছিলেন এই আদি ভাষা জানা সর্বশেষ ব্যাক্তি!
যে আড়াই হাজার ভাষা এই গ্রহ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে আমাদের বাংলা ভাষাও থাকতে পারত কিন্তু আমাদের অপার সৌভাগ্য, আমাদের বাংলা ভাষা যে কেবল টিকেই আছে এমন না, আছে সদর্পে, সীমাহীন গৌরবে!
বাংলা নামের আমাদের মায়ের ভাষা- এটা তো আর আমরা এমনি এমনি পাইনি, কেউ আমাদেরকে এটা মুফতে-দানে দেয়নি। এর জন্য আমরা কেবল দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর-বছর ধরেই লড়াই করিনি; লড়াই করেছি যুগের-পর-যুগ ধরে!
এই দেশের অসংখ্য সেরা সন্তান তাঁদের রক্ত অকাতরে বিলিয়ে গেছেন আমাদের ভাষার জন্য। আমাদের লেখার কালির সঙ্গে মিশে আছে তাঁদের স্বর্গীয় রক্ত। জান্তব স্বপ্ন নামের সেই মানুষগুলোর অনেকেই আজ নেই কিন্তু তাঁদের মায়াভরা সুশীতল ছায়া ছড়িয়ে আছে আমাদের মাথার উপর। তাঁদের ছায়ার পাশে যখন আমার মত অভাজন দাঁড়াই তখন নিজেকে কী ক্ষুদ্র, লজ্জিতই না মনে হয়। নতচোখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে তখন কোন উপায় থাকে না- তাঁদের চোখে চোখ রাখি কেমন করে?
আমরা যারা ওয়েবসাইটে লেখালেখি করি তাঁদের প্রতি প্রিন্ট মিডিয়ায় কী তাচ্ছিল্য! যেন এরা একেকজন চলমান জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে বসে আছেন। এঁরা হাঁটেন পা ফাঁক করে, বড়ো সাবধানে- জ্ঞান গড়িয়ে পড়বে এই ভয়ে।
আজ এটা আমাদের সবার বিজয়, ওয়েবসাইটে আমাদের লেখালেখির সুবাদে আন্তর্জাতিক একটা পরিমন্ডলে এই প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষা দাঁড়িয়েছে দানবীয় শক্তি নিয়ে।
এই বিজয় মিছিলে আমার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আমিও একজন, তাঁদের পাশে থাকতে পারার এই ভাললাগা আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না, কক্ষণও না।
আমি হয়তো ভাল করে আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি কিন্তু আমার আন্তরিক বিশ্বাস, অন্য একজন অসাধারণ-চমৎকার করে পারবেন। আমি স্বপ্ন দেখি, আমি হয়তো থাকব না কিন্তু আমার স্বপ্নটা থেকে যাবে। আমার গলিত শব থেকে জন্ম নেবে সত্যিকারের একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। যে যোদ্ধা বাংলা ভাষা নামের তরবারী দিয়ে সমস্ত অন্ধকার ফালাফালা করবে, কাঁপিয়ে দেবে এই গ্রহটাকে।
আমি সেই মানুষটার অপেক্ষায় আছি...।"
*বৈদেশ পর্ব...: http://tinyurl.com/29zswc5
সহায়ক লিংক:
১. দলবাজি: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_19.html
২. আবেগ-বিবেক: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_21.html
৩. সামহোয়্যার...: http://www.somewhereinblog.net/blog/noticeblog/29183988
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Tuesday, October 19, 2010
বৈদেশ পর্ব: পনেরো
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
হুম, বাংলার এই বিজয়যাত্রা টিকিয়ে রাখতে হলে অনেক বেশী বেশী ভালো ভালো লেখা ছড়িয়ে দিতে হবে অন্তর্জালে।
সহমত @রাতমজুর
Post a Comment