Search

Wednesday, September 2, 2009

এক গোয়াল ঘরের পাঠকের আনন্দ বেদনার অপকিচ্ছা!

আমার শৈশব এতো বেশী তুচ্ছ যেটা কহতব্য- বলার মত না! অনেকের দেখি শৈশবের বাল্যবন্ধুদের মধ্যে কেউ সচীবের ছেলে তো কেউ মন্ত্রীর পুলা। আমার শৈশবের বন্ধুদের অনেকের মধ্যে একজন ছিল ধোপার ছেলে, একজন মুচির। কী মাখামাখি, কী-সব সোনালী দিন!

মুচির ছেলে 'গাদুরার' ছিল ডাং-গুলিতে দুর্দান্ত হাত, এড়ি-দুড়ি-তেলকা, চুড়ি, চম্পা, ডেগ, সুতেগ (আমরা এভাবেই বলতাম)। গাদুরার কাছে প্রায়শ না অবধারিত ছিল আমার হার। খেলার নিয়ম অনুযায়ী 'এক লালে' কেনা যেত আস্ত একটা গুদাম, 'দুই লালে' নদী। গাদুরা বদটা কীভাবে-কীভাবে যেন গুদাম-টুদাম, খাল-বিল, তিতাস নদী সব কিনে ফেলত। বাপের অজান্তে তাঁর বাড়িটা... ওটাও হেরেছিলাম। এক প্রকারে দেখলে আমি যে বাড়িতে বসবাস করি এই বাড়িটা আমার শৈশবের বন্ধু গাদুরার। যাই হোক, ফলাফল, '... লইয়া যা'- তখন আমার পিঠে দুমাদুম করে কিল। ইস, বদের হাড্ডি শুয়োরটা 'কিল' নামের জিনিসটা কী জোরেই না মারত!

অনেক পরে, একদিন, আমি গাদুরা বদমাইশটাকে মারতে গিয়েছিলাম। ব্যাটা ফাজিলের ফাজিল, আমাকে তুই না-বলে, আপনি-আপনি করে বলার চেষ্টা করছিল! আমি তাকে হিমশীতল গলায় বলেছিলাম, 'তুই আমাকে আপনি বলে গালি দিচ্ছিস কেন রে, কুত্তা'?
নিমিষেই তার চোখের পানিতে আটকে গেল গোটা সূর্যটা, যেন চোখের পাতা ফেললেই হারিয়ে যাবে আস্ত সুর্যটা! গাদুরাটা শেষ পর্যন্ত পচাই খেতে খেতে মরেই গেল। আমার শৈশবের একটা স্তম্ভ হারিয়ে গেল!
ওহ, আরেকটা খেলা ছিল খুব মারামারির, রস-কস-শিংগা-বুলবুল- মালেক-মোস্তাক। এভাবেই আমরা বলতাম 'শুদ্ধ-মুদ্ধ' জানি না!
 
অনেকেই বালকবেলায় কী অবলীলায়ই না পড়ে ফেলে মম, হার্ডি, মায়াকোভস্কি। তখন আমার তো আর সে সুযোগ ছিল না, যা পেতাম তাই পড়তাম। দস্যু বনহুর, কুয়াশা, কোনও-একটা অনুবাদ পেলে তাই সই। বিভিন্ন ভাষার গল্পের অনুবাদ, আহা! আমার পরিবারের ধারণা ছিল, এইসব 'আউট বই' পড়ে-পড়ে ক্রমশ আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারী হলো, এইসব বই আর পড়া যাবে না। এ তো দেখি মহা এক যন্ত্রণা হলো! বই পড়তে না-পরলে আমি যে মরে যাব। পরে এক বুদ্ধি বার করলাম...!

আমার বাসার পাশেই একজন রাখাল থাকতেন। বয়সে বড়- আমার বন্ধু, সিনিয়র বন্ধু। তাঁর নাম আজ ভুলে গেছি, মনে থাকা উচিৎ ছিল। তাঁর নামটা মনে না-থাকার কারণে নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছা করছে-নিজের প্রতি জুতা ছুঁড়ে মারতে পারলে খানিকটা আরাম পেতাম।
তো, আমি স্কুলের নাম করে বই খাতা নিয়ে বের হতাম, সঙ্গে যথারীতি দু-চারটা আউট বই। সোজা গোয়াল ঘরে! সেই সদাশয় রাখাল বন্ধু, তিনি ভেতরে আমাকে রেখে গোয়াল ঘরের তালা বন্ধ করে গরু চড়াতে বেরিয়ে যেতেন। আমি আরাম করে, মহা আনন্দে তখনকার বুড়াদের ভাষায় 'আউট বই' গোগ্রাসে গিলতাম। বিকালে এসে তিনি তালা খুলে দিলে আমি স্কুলের বই-খাতা নিয়ে সোজা বাসায়।

স্কুল থেকে পুত্রধন বিদ্যার জাহাজ হয়ে এসেছে, মা’র সে কী আপ্যায়ন! এটা খা, ওটা খা বলে মাথা নষ্ট করে দিতেন। আমি হাসি গোপন করতাম। ভাগ্যিস, মমতায় অন্ধ মা এই হাসি দেখতে পেতেন না!
এর পরিণাম হয়েছিল এমন, এসএসসিতে (আমরা বলতাম মেট্রিক) আমার সায়েন্স ছিল। সবগুলো পরীক্ষাই খুব ভাল হল কিন্তু অংকে আমি পেলাম বিশ। তেরো গ্রেস দিয়ে অংকে পাশমার্ক উঠেছিল। তখনকার সময়ে তেরোর উপরে গ্রেস দেওয়ার নিয়ম ছিল না। ইন্টামিডিয়েটে দেখলাম সায়েন্স নিলে নিয়মিত ক্লাশ না-করে উপায় নেই। তো, নিলাম, কমার্স। গ্রাজুয়েশন করার সময় আরেক যন্ত্রণা! কমার্সের ক্লাশও নিয়মিত না-করে উপায় নেই। কী আর করা, নিলাম, আর্টস। 
গ্রাজুয়েশন করার সময়, সবাই পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছে থাকে। আমি বাসা থেকে গিয়ে পরীক্ষা দেই। ইশ-শ, শালার এই অভিশপ্ত বাসাটা আমায় আটকে ফেলেছে। একদিন পৌঁছলাম আধ ঘন্টা পর। তখন নৌকা-বাসে করে যেতে হত। বাস নষ্ট হয়ে গেল। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি চট করে একটা ট্রাকের পেছনে উঠে পড়লেন। আমি একটু স্টাইল করতে গিয়ে ট্রাক ধরতে পারলাম না। আমার তখন মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। রাস্তার মাঝখানে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওই রাস্তাটা তখন খুব একটা চালু না। কিচ্ছু পাই না। যাও একটা 'বেবি-টেক্সি' পেলাম ভেতরে জায়গা নেই। চালককে বললাম, 'ভাইরে, আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি কেবল দুই পা ভেতরে রাখছি। আমার বাকী শরীর বাইরে থাকুক। আমাকে একটু নিয়া যান'। ওই সদাশয় চালক কেবল পৌঁছেই দেননি আমার কাছ থেকে ভাড়াও রাখেননি! 
তো, এরিমধ্যে প্রায় ত্রিশ মিনিট চলে গেছে। টিচার বললেন, 'এইটা পরীক্ষা, খেলা না। পরীক্ষা দিয়া কি করবা, বাসায় চইলা যাও'!
আমি কাতর হয়ে বলি, 'স্যার, বাস নস্ট হয়া গেছিল। আসছি যখন পরীক্ষাটা দিয়াই যাই'।
টিচার নামের মানুষটা রক্তচক্ষু মেলে আমাকে খাতা দিলেন। চোখ দিয়ে পারলে ভষ্ম করে ফেলেন! অবশ্য কোন-এক বিচিত্র কারণে ইসলামি হিস্ট্রির ওই পার্টটার নাম্বার খারাপ উঠেনি!
ওই যে, ইশকুলে সবাই পরীক্ষার খাতায় লিখল, ইঞ্জিনিয়ার হবো, ডাক্তার হবো। আমি লিখেছিলাম, রাখাল হব। কসম, আমার তো রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। মাস্টার মশাই খুবই আনন্দিত(!) হয়ে বিরাট একটা গোল্লা দিয়েছিলেন যার চালু নাম 'লাডডু' বা 'খাতালাড্ডু'। যে মাস্টারমশাই খাতায় এরশাদের মাথার সমান লাড্ডু দিয়েছিলেন সুবৎ বণিক নামের সেই মাস্টার মশাই এখনো বেঁচে। কখনও দেখা হলে গাঢ় স্বরে বলেন, 'তুমার কিতা হইছে, মুখ এমুন শুকনা ক্যান'? তাঁর মমতায় আমার চোখ ভরে আসে।
কথার ফাঁকে একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম:
স্যার আমাকে গোল্লা কেন দিয়েছিলেন আমি কি ভুল লিখেছিলাম? স্যার আমি তো কখনও বড়-কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। আমি কি তাহলে মিথ্যা লিখতাম, এটা হব-সেটা হব?
এবার স্যারের চোখ ভরে আসে। থেমে-থেমে অন্য রকম কিছু অতি  উঁচুমার্গের সদাশয় কথা বলেন। লজ্জা-লজ্জা, এখানে শেয়ার করা বড় লজ্জার। টেনেটুনে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর বছরখানেক আইন নিয়ে পড়লাম। ধুর, ভাল লাগল না...। 

আর হাই-স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে আমার একটা ঘটনা দাগ কেটে আছে। বন্ধুদের মধ্যে একজন, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল প্রদীপ। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেখা-সাক্ষাৎ কঠিন হয়ে পড়ল। পুজার ছুটিতে আসলে দেখা হয়, আনন্দ-মাস্তি হয়। একবার ও পুজার ছুটিতে আসল না। বিষয় কী!
বিষয় শুনে তো আমার মাথায় হাত। কি যেন একটা হাতে-কলমের কাজ আছে, ওটা বাদ দিয়ে চলে আসলে আধা নাম্বার কাটা যাবে। আমি হাসতে হাসতে শেষ- মাত্র আধা নাম্বার, বলে কী! আমি তো কত-কত নাম্বার অবলীলায় ছেড়ে দেই।
ফল যা হওয়ার তাই হলো! প্রদীপ ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হয়ে তাক লাগিয়ে দিল, সিনেমা-টিনেমায় আমরা যে-রকম দেখি আর কী! আর এদিকে কালে-কালে আমি হলাম গিয়ে, জিরো []!  

যাই হোক, যখন কলেজে পড়ি তখন মাহবুব ভাই নামের এক অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি বয়সে আমার অনেক বড়ো ছিলেন, আমার যে বছর জন্ম সেই বছর তিনি এয়ারফোর্সে জয়েন করেন! আমার জীবনে যতো সব সু বা ভালো কিছু আছে, কোন-না-কোন ভাবে তাঁর স্নেহের হাত আছে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আসলে কি, পিতা পুত্রের, ভাইয়ের, বন্ধুত্বের? আমি কনফিউজ, বিভ্রান্ত এখনও! এমনিতে অবলীলায় তাঁর সঙ্গে যা-তা রসিকতা করি, ধুমসে সিগারেট খাই। (সিগারেট সম্ভবত খাওয়া যায় না পান করারই নিয়ম। পান করার ওই নিয়মটা আবার আমি জানি না!)

তো, তিনি আমার এই পড়ার অদম্য আগ্রহ দেখে কানের কাছে অনবরত মন্ত্রের মতো জপে যেতেন, আপনি এতো বই পড়েন, কিছু লেখেন না কেন। তিনি নিজে বই ছুঁয়ে দেখতেন না বলেই হয়তো তাঁর বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গিয়েছিল পড়লেই বুঝি লেখা যায়। এহ, বললেই হলো আর কি!

এক সময় তাঁর যন্ত্রণায় লেখা শুরু করলাম। গাধার মতো লিখে ফেললাম আস্ত এক উপন্যাসসম লেখা। টানা রুল করা কাগজের বাইন্ডিং খাতায় অসংখ্য ভুলভাল শব্দ-বাক্যে ভরা! লিখে তো ফেললাম, সো, হোয়াট নেক্সট? এখন এই আবর্জনা নিয়ে কি করি! নিজের লেখা, ফেলে তো আর দিতে পারি না। হোক আবর্জনা, নিজের লেখার প্রতি আছে আমার সন্তানসম মমতা! সেই উপন্যাসটা অবশ্য বাংলা একাডেমিতে ছাপা হয়েছিল। সে ভিন্ন গল্প... []!
 
* বহু বছর পর সেই সদাশয় রাখাল বন্ধুর নামটা পেয়েছিলাম। ওঁর নাম, আলীম।
১. জিরো

No comments: