
মাহবুব ভাই।
হয়তো অন্যদের চোখে আপনি খুব সাধারণ (!) একজন মানুষ।
কিন্তু, আমার কাছে...! এমনিতে আমার যে বছরে জন্ম সে বছরে আপনি এয়ারফোর্সে জয়েন করেন। আপনার সময়কার কৃতি একজন ফুটবলার, আজাদ স্পোর্টিংয়ে জাতীয় দলে খেলে আপনি মাঠ কাঁপিয়েছেন।
আমার জীবনে যতো সব সু বা ভাল প্রত্যেকটার সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন-না-কোনও একটা সংযোগ আছেই! আমি বারবার গর্তে পড়েছি, আপনি আমাকে টেনে তুলেছেন। আমার প্রতি অপার্থিব মমতা দেখাতে গিয়ে আপনি অন্যায় করেছেন আপনার পরিবারের প্রতি, নিজের প্রতি।
আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে, যখন ভাবি আপনি এই বয়সেও প্রবাসে পড়ে থাকতে হয়! কয়েকটা নোংরা কাগজের জন্য আপনাকে দেশে আনতে পারি না। অথচ দেখেন, আমি যখন ধোঁয়া ওঠা গরম-গরম ভাত খাই, নিজের বিছানায় গড়াগড়ি খাই, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ঝগড়া করি—তখন, আপনি প্রবাসে একাকী, নিঃসঙ্গ।
আমার বুঝি ইচ্ছে করে না, আপনাকে ঈদে এক চামচ সেমাই খাওয়াই...।
প্রায়শ ভাবি, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আসলে কি, কেমন? পিতা- পুত্রের, বড়ো ভাইয়ের, বন্ধুত্বের? আমি কনফিউজড, বিভ্রান্ত! এমনিতে আপনার সামনে ধুমসে সিগারেট খাই, যা তা রসিকতা করি—এডাল্ট জোকস কোন ছার!
এই আমি যে টুকটাক লেখালেখি করেছি এর পেছনেও আপনার অবদানই প্রবল। ভুলে গেছেন বুঝি, কানের পাশে সেই যে অনবরত ঘেনঘেন করতেন, 'কিছু একটা লেখেন'—'কিছু একটা লেখেন'। আপনার যন্ত্রণায় এক সময় লিখতে শুরু করলাম। অথচ, আপনি কখনও আমার লেখার এক লাইনও পড়ে দেখেছেন বলে আমার ঘোর সন্দেহ আছে! অনেক লেখা আপনাকে আমি উৎসর্গও করেছি! এসবে কি আসলেই আপনার কিছু যায় আসে?
কিন্তু... কী একটা জীবনে আপনি আমাকে আটকে দিলেন! কী ক্ষতিটাই না করে দিলেন—আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল! আমার প্রিয় মানুষ হাসপাতালে অথচ আমি আমার লেখার বানান সংশোধন করছি! আহা, উপায় ছিল না যে তখন। বইমেলায় বই বেরুবে, প্রকাশকের তাড়া—দ্য শো মাস্ট গো অন!
ছি, এটা একটা জীবন হলো! অথচ এই সুতীব্র বেদনার কথাগুলো আমার সেই সময়কার লেখাগুলো যিনি পড়বেন, তাঁরা কখনোই জানবেন না, আসলে তাঁর জানার প্রয়োজনও নেই!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই লেখাগুলো ছিল 'ফানি টাইপ' লেখা। পরে অনেকেই বলেছেন, আপনি যে একটা ভাঁড়, এতে অন্তত আমাদের আর কোন সন্দেহ নাই।
হাসপাতালে ভর্তি ওই প্রিয় মানুষটার সঙ্গে চোখ মেলাবার ক্ষমতা আমার কই? অথচ তিনি রাগারাগি করলে ভাল হতো। বড়ো-বড়ো চোখের নির্বাক সেই ভঙ্গি আমি ষ্পষ্ট পড়তে পারছিলাম, আমার প্রাণের চেয়ে তোমার লেখালেখি বড়ো হলো কোন যুক্তিতে...!
ইশ্বর, ওই সময় নিরুপায় আমি, যখন বানানগুলো সংশোধন করছিলাম, আমার চোখের জলে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল। এটা বললেও আজ আর কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না...।
যাই হোক, সেই যে আপনি আমার ঘাড়ে লেখালেখির সিন্দবাদের ভূতটাকে আয়েশ করে বসিয়ে আলগোছে সরে পড়েছিলেন, এই সিন্দবাদের ভূতটাকে আমি তীব্র অনীহায়, অনিচ্ছায় দিনের-পর-দিন বয়ে বেড়াচ্ছি। কতোবার চেষ্টা করেছি লেখালেখির এই ভূতটাকে ঝেড়ে ফেলতে। মাহবুব ভাই, আপনি আমার বড় ক্ষতি করে দিলেন, জীবনটাকে এলোমেলো করে দিলেন।
তবুও আমাকে যদি অপশন দেয়া হয়, আমি কি এই গ্রহের সবচে পবিত্র স্থান স্পর্শ করতে চাইবো, নাকি আপনাকে...?
মাহবুব ভাই, দ্বিতীয়বার চিন্তা না-করে আমি আপনাকে স্পর্শ করার সুযোগ বেছে নেব, বারবার।
এ কেবল আমার বিশ্বাস না, আমি জানি, আপনি শুধু একবার আমার মাথায় হাত রেখে দিলে, আমি পরম নিশ্চিন্তে মরতে পারবো, আই বেট...।
* এটা মৃত্যুর (**) কিছু দিন পূর্বের ছবি:
**মৃত্যু'র আড়ালে কেউ-কেউ খোলস বদলান মাত্র...!
No comments:
Post a Comment