লেখক: মুহম্মদ নিজাম (লেখকের লিখিত অনুমতিক্রমে)
"একবার খুব মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নর্দমায় পড়ে গিয়ে বাজখাঁই গলায় কৈফিয়ত চেয়েছিল:
"আকাশ এত নোংরা কেন রে, বাঞ্চোৎ?"
গালিটা সে কাকে দিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেনি কেউ। উত্তরটা তাই অজানাই রয়ে গেলো!
"..মানুষ
যদিও বিরহকামী,
কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।"
আবুল হাসান মারা গিয়েছিল আমাদের চেয়েও কম বয়সে। বেঁচে থাকলে এখন নিশ্চয়ই কেউ তাঁকে পাকিস্তানের দালাল বলতাম; কেউ বলতাম, ভারতের দালাল।
ডানে গেলে বামের কামড়, বামে গেলে ডানের।
মরে গিয়ে বেঁচে গেলো 'মালটা'!
সেও হয়তো গুণের মতো পুরষ্কার ভিক্ষা চেয়ে নিন্দিত হতো, কিংবা 'তুই রাজাকার' শ্লোগান দিয়ে 'শাহবাগী তুই গোসল কর', জাতীয় উষ্মাভস্মে চাপা পড়ে যেতো।
কিংবা আমীর হামজার মতো রসময় সুরে 'রেশমিকা মান্দানা' বাজাইতো। হয়তো আগস্টের সেই দিনগুলিতে মেট্রো ভাঙার কিংবা বিটিভি পুড়ানো দুঃখে কাতর হয়ে উঠতো—কিংবা মাজারভাঙা এনার্কিস্টদের দিকে তাকিয়ে তীব্রস্বরে বলে উঠতো, 'আবার তোরা মানুষ হ'!
বেঁচে থাকলে কি হতো, আমরা জানি না। তবে যাই হতো, মন্দ-ই হতো এইটা নিশ্চিত জানি!
শুনেছি, লোকটা খুব সুর করে কোরআন পড়তে জানতো। প্রায়ই শোনাতো নাগিরক জলসায়, এখানে-সেখানে..., এমনকি ওর প্রিয়তম মেয়েটির বাবাকেও!
মানুষ যদিও জীবনেই অমরত্ব খোঁজে, কিন্তু একমাত্র মৃত্যুই তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
মরে গিয়ে বেঁচে গেলো লোকটা?
'যাই' শীর্ষক ওঁর একটা কবিতা ছিল। একাত্তরের কবিতা। দূরসঞ্চারী এক বিষাদের সুরে বলেছিল,
'যাই, এখন তাদের শরীরে শস্যের আভা ঝরে পড়ছে যাই...
মৃত্যু আর মৃত্যু আর মৃত্যুর আঁধারে যাই,
বিবর্ণ ঘাসের ঘরে ফিরে যাই, যাই
সেখানে বোনের লাশ, আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে নিতে হবে যাই,
আমি যাই-'
শুনেছি, একাত্তরের সেই ঘাতক-হানা রাতে ঢাকা মেডিকেলের কোন-একটা নোনাধরা কামরায় শুয়ে-শুয়ে অসুখের সাথে সংসার করছিল। কিন্তু অসুখটা সারে নাই। এই অসুখেই পঁচাত্তরে মারা গেলো। তখনই কতই বা ওর বয়স? মাত্র আটাশ!
আটাশে নিঃসঙ্গ যুবক জেনে গিয়েছিল,
"মানুষ একা
মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ একা!"
চেয়েছিল, পাখি হয়ে যাক প্রাণ।তারপর পাখি হয়েই উড়ে গেলো অনন্ত আলোকের দেশে।
গতকাল আমার এক বন্ধুকে ওঁর একটা ছবি দেখালাম। সে বললো, 'শাহাবাগীদের মতো লাগে'! তারপর ওঁর কিন্নরী সুরে কোরআন পাঠের কাহিনী শুনালাম, সে বললো, 'তাইলে, নিশ্চয়ই শাপলা ছিল'!"
চিন্তা করেন অবস্থা!
গতরাতে, অনেক রাতে, বৃষ্টিতে কাকভেজা, ভিজে-ভিজে ফেরার পথে পড়ছিলাম আবুল হাসানের অমৃত অসুখের কথা,
'ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সয়ে যাও
ভেতরে বিষের বালি
মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও!'
আর ভাবছিলাম, 'মরে গিয়ে বেঁচে গেলে, হে মহান প্রতিভা'!"
- লেখক: মুহম্মদ নিজাম
বাংলাভূমি, সেপ্টেম্বর ২০২৫"

No comments:
Post a Comment