Search

Thursday, March 6, 2025

গুম: একজন আদর্শ বাবা, আদর্শ স্বামী মহিউদ্দিন ফারুকী

লেখক: Enamul Haque Mony. লেখক তখন দ. কোরিয়ার কিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিলেন।

"র‍্যাব-২, বসিলা, মোহাম্মাদপুরে আমাকে যে রুমে গুম করে রাখা হয়েছিলো, টয়লেট সাইজ একটা ছোট্ট রুমের মধ্যেই টয়লেট করার জায়গা। বাকী ফাঁকা জায়গায় একটা স্বাভাবিক মানুষ পা মেলে দিয়ে শুয়ে থাকতে পারে না। অসম্ভব!

আয়নাঘরের রুমগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটার ডাবল লেয়ারের দরজা। প্রথমটা লোহার শিকের, পরেরটা সলিড।
এখন আয়নাঘরের যে সকল আলামত নষ্ট করা হয়েছে, তারমধ্যে বেশি দেখা গেছে ম্যাক্সিমাম দরজাগুলা ভেঙ্গে খুলে ফেলা হয়েছে। সামনের সলিড দরজাতে চোখ বরাবর একটা বড় ফুটা থাকত যেটা দিয়ে গার্ডদের সাথে কথা বলা যেত।

র‍্যাব-২, বসিলা, মোহাম্মদপুরে আমাকে প্রথমে যে রুমে গুম করে রাখা হয়েছিলো, সেই রুম থেকে সামনের হাইওয়ে রাস্তার গাড়ি স্পষ্ট দেখা যেতো। মাঝে মাঝে এমন হতো যে শুধু লোহার শিকের দরজা লাগানো, তখন ক্যাম্পের বাইরে থেকে কিছু কর্মকর্তা পরিদর্শনে এসেছে, তখন গার্ডরা আস্তে করে সলিড দরজাটা লাগিয়ে দিতো যাতে বাহির থেকে দেখলে মনে হয় যে এটা একটা সাধারণ রুম। 

এভাবেই লোহার শিক আর সলিড দরজার কম্বিনেশনে একদিকে সহজে গুম করে রাখতো, অন্যদিকে গুমবাহিনী যেকোন দেশী/বিদেশী পরিদর্শন টিমকেও ধোঁকা দিতো যাতে বাহির থেকে দেখলে এটা অন্যান্য সাধারণ রুমের দরজা মনে হয়।
অবশ্য দরজার ফাঁকা জায়গা দিয়ে গার্ডদের সাথে প্রয়োজনে কথা বলা যেতো।

র‍্যাব-২ এর আয়নাঘর বা গুমঘরের টয়লেটে  আমি নিজে ইটের টুকরা দিয়ে আমার স্ত্রীর মোবাইল নাম্বার লিখে রেখেছিলাম, যাতে পরবর্তীতে কেউ কোনদিন সুযোগ পেলে সেই নাম্বারে কল দিয়ে জানায় যে আমার নাম্বারটা এখানে পাওয়া গিয়েছে। আরও অনেকের অনেক কথা লেখা ছিলো।

গত ৬ মাসে আয়নাঘরের অনেক আলামতই ধংস করা হয়েছে। গুমঘরের ভয়াবহতা বর্ণনাতীত। এতদিন পরে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তা কোনভাবেই গুমঘরের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে পারে না। তবুও সবাই দেখুক, ফ্যাসিবাদের গুমঘর সম্বন্ধে জানুক।

ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে গুম করার পরে আমার অনেকগুলো ক্ষতির মধ্যে অন্যতম ছিলো আমার ল্যাপটপটা নিয়ে নেয়া। কোরিয়াতে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডিতে যাওয়ার পরে প্রথম মাসের স্যালারি পেয়েই ওই DELL ল্যাপটপটা কিনেছিলাম।

দিনরাত একাকার করে ৫-৬ বছরের পিএইচডি গবেষণার ডেটাগুলো সব আমার ল্যাপটপে ছিলো। বায়োমেডিকেলের মলিউকুলার ইমেজসহ অনেক ফাইল,  ডেটা যেগুলো তৈরি করতে স্বাভাবিকভাবেই আমার দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়েছে তার সবই আমার ল্যাপটপে ছিলো, অবশ্য সামান্য কিছু ব্যাকআপ রাখা ছিলো।

আমাকে গুম করার পরে র‍্যাব-২ এর মহিউদ্দিন ফারুকী আমার মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে নেয় যেগুলো আজও আমি আর পাইনি! দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি করা আমার পিএইচডি গবেষণা ডেটাগুলো সে নষ্ট করে ফেলে। ল্যাপটপে হারিয়ে ফেলা রিসার্চ ডেটাগুলোর কিছু ব্যাপআপের মাধ্যমে পেলেও বেশিরভাগই আমি আর কখনোই পাইনি।

এছাড়া র‍্যাবের কুখ্যাত মহিউদ্দিন ফারুকী আমার কোরিয়ান প্রফেসরকে ইমেইল করে জানায় যে, আমি সন্ত্রাসী!  ফ্যাসিবাদবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক লেখালেখি করি। আমাকে যেন পিএইচডি ডিগ্রী দেয়া না-হয়! আমার পিএইচডি সুপারভাইজার তখন আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিলেন। রিপ্লাইতে বলেছিলেন, এনামুল আমার স্টুডেন্ট। আমার কাজ তার রিসার্চ দেখা। দেশে সে কোন মতাদর্শের সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। সে আমার এখানে ভালোভাবে রিসার্চ করেছে, আমি তাকে পিএইচডি ডিগ্রী দিতে বাধ্য।

উচ্চশিক্ষার প্রতি র‍্যাবের কসাইখ্যাত মহিউদ্দিন ফারুকীর একটা ক্ষোভ ছিলো। আমাকে গালি দিয়ে বলেছিলো: তুই পিএইচডি করে কি হবে? তুইতো হাসিনার বিরুদ্ধে লেখিস!
হাসিনার গোলামিতে মত্ত র‍্যাব-২ এর তৎকালীন কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকীর কখনো বোঝা হয়নি পিএইচডি ডেটা তৈরির পেছনের গল্প, পেছনের পরিশ্রম। 
...
আচ্ছা,গুম-ক্রসফায়ারের মাষ্টারমাইন্ড খুনিরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সমাজে কিভাবে চলেন এটা জানার বড় ইচ্ছা?
আমাকে গুম রাখা অবস্থায় র‍্যাবের কুখ্যাত এই মহিউদ্দিন ফারুকী তার বউয়ের জন্মদিন সেলিব্রেট করে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়। অথচ একই সময়ে আমার বউ তার গুম হওয়া স্বামীর খোঁজে পাগলপ্রায়।
মহিউদ্দিন ফারুকী এবং তার স্ত্রী আফরুনা পারভীন ঝুমুর
ফারুকীর বউ, আফরুনা পারভীন ঝুমুরের কাছে তার স্বামী হয়তো একজন অসম্ভব কেয়ারিং হাসব্যান্ড। যে কিনা শত ব্যস্ততার মাঝেও তার বউয়ের জন্মদিনের কথা ভুলে যায়নি। অথচ শত-শত মানুষের বউকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেয়াই ছিলো তার কুখ্যাত স্বামীর ব্যস্ততা। 
ফারুকী হয়তো একজন আদর্শ স্বামী ছিলো যে কিনা তার বউয়ের সকল বিলাসী আবদার নিমিষেই পূরণ করে দিতো। আমাকে গুম করে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ নেয় ফারুকী। গুম-ক্রসফায়ারের অবৈধ টাকায় ফারুকী খুব সহজেই তার স্ত্রীর মনের সকল আবদার পূরণ করে দিতো।
ফারুকীর ১ ছেলে, ১ মেয়ে। বাচ্চাদের কথা বিবেচনায় তাদের ছবি পাবলিকালি দিচ্ছি না। বাচ্চাদের কাছে তাদের কুখ্যাত বাবা হয়তো এই গ্রহের একজন শ্রেষ্ঠ বাবা। যে কিনা তাদের সকল আবদার পূরন করতো। অথচ আমাকে গুম করা অবস্থায় ফারুকী জানতো আমারো আড়াই বছরের একটা ছেলে সন্তান আছে। এভাবে শত-শত সন্তানকে এতিম করে দেয়া ফারুকীরা নিজের সন্তানদের কাছে বেষ্ট ফাদার! 

ফারুকীর একজন ক্লোজ রিলেটিভ আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। তার তথ্যমতে ফারুকী এলাকায় সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত। এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা করে দিয়েছে। গুম-ক্রসফায়ারের অবৈধ টাকায় এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে ফারুকীরা নিজ এলাকাতেও সমাজসেবকের তকমা লাগিয়ে থাকে।
এভাবেই মহিউদ্দিন ফারুকীর মতো গুম-ক্রসফায়ারের মাষ্টারমাইন্ড খুনিরা পরিবার-সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে মিশে থাকে। কিছুক্ষণ আগেই কাউকে ক্রসফায়ারে খুন করে বাসায় এসে নিজের স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে বেষ্ট হাজবেন্ড, বেষ্ট ফাদার হিসেবে অবলীলায় অভিনয় করতে পারে।
অথচ আমাদের শ্বাস কেড়ে নেওয়ার সময় এই ফারুকীরা একটিবারও চিন্তা করে না যে আমরা তারই মত মানুষ- আমাদেরও আছে একটা পরিবার, আছে প্রিয়মানুষ যারা আমাদেরকে হারিয়ে সব হারিয়ে ফেলে...!"

No comments: