Search

Friday, September 13, 2019

একটি ডিভোর্স এবং 'ওথেলো সিনড্রম'।

লেখক: Jobayer Ahmed
"সত্য ঘটনা অবলম্বনে
বৃষ্টিস্নাত মন খারাপের বিকেলে জানালা দিয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টির নেমে আসা দেখছি। কেমন একটা করুণ কান্নার মত লাগছে আজকের বৃষ্টি পড়ার শব্দ। আকাশের মনে হয় আজ মন খারাপ।সকাল থেকে অজোরে ঝরে যাচ্ছে।
তবে মন খারাপ আমার। একটু আগে ফোন দিয়ে আমার বন্ধু সোফিয়া বললো, 'হারামজাদারে ডিভোর্স দিছি গতকাল আর সহ্য হচ্ছিল না এই পোকামাকডের জীবন'

আমি চুপ করে আছি দেখে বললো, 'তুই আমার বাচ্চাদের জন্য মন খারাপ করিস না। আমি নিজ পায়ে দাঁড়াবো। জব পেলে বাচ্চাদের আমার কাছে নিয়ে আসব'।
সে ফোনে বিভিন্ন প্ল্যানিং বলে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। সে আমাকে বলে, আমি ন্যাশনাল ভার্সিটিতে আমার সাবজেক্টে সারা দেশে তৃতীয় হয়েছি। তোর মত ব্রিলিয়্যান্ট না তবে একবারে খারাপও তো না।
সোফিয়ার আত্মবিশ্বাস দেখে ভাল লাগছে মনে মনে। আমাকে ব্রিলিয়্যান্ট বলাতে বিব্রত লাগছিল।

সোফিয়া আমার খুব ভাল বন্ধু। অনেক দিনের জানাশোনা। বন্ধুদের আড্ডায় সে গল্পবাজ মেয়ে। সবাইকে সুন্দর করে কথার বাঁশ দেওয়াতে সে নাম্বার ওয়ান। বন্ধু পঁচানোর রানী হিসেবে সে যথেষ্ট সুনাম পেয়েছে। অনেক মজা করে কথা বলে। অথচ চোখ দেখে বুঝার উপায় নেই কতটা বিষাদে ভরপুর সোফিয়ার জীবন।
ক্লাস ফাইভে ওর বাবা মারা যান। ক্লাস সিক্সে মামার বাসা থেকে লেখাপড়া শুরু। সাথে মামীর অত্যাচার-অনাদর ও অবহেলা ফ্রি। এই মেয়ের অসীম সহ্য ক্ষমতা। মামী এত বাজে ব্যবহার করতো কিন্ত কোনদিন কাউকে কিছু বলত না।

অনার্সে ইডেনে ভর্তি হয়ে হলে উঠে। নতুন জীবন শুরু। মাস্টার্সে পড়ার সময়
বান্ধবী অনির বোনের বিয়েতে পরিচয় রাশেদের সাথে। রাশেদ রাজশাহী ইউনির্ভারসিটি তে পড়তো। সে তখনই প্রচন্ড পাগলামি শুরু করে সোফিয়াকে বিয়ে করার জন্য। এদিকে সোফিয়াকে ফাইনাল দিয়ে হল ছাড়তে হবে একটা আশ্রয় তারও বড় দরকার। রাশেদ এর ভালবাসার তীব্র পাগলাটে প্রকাশ সোফিয়া কে দূর্বল করে ফেলে। অবশেষে ফাইনাল এক্সাম এর আগে বিয়ে হয় তাদের।

বিয়ের তিন মাসের মাথায় সোফিয়া প্রেগন্যান্ট হয়। ৬ মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে ফাইনাল এক্সাম দেয় সে। প্রথম ছেলেটি জন্মদিতে গিয়ে মরতে বসে ছিল সে। সিজারিয়ান সেকশন-এর পর শকে চলে যায় সোফিয়া। ডাক্তার আজরাইলের টানাটানিতে অনেক ধকল সামাল দিয়ে প্রথম যেদিন বাচ্চাকে কোলে নিল সে, সেদিন আনন্দ অশ্রুতে চোখ ভিজে ছিল তার।
বেকার স্বামী যখন রীতিমত বেকারত্বের অজুহাতে বাচ্চাটি এবরশনের জন্য ওর গায়ে হাত তুলে সেদিনই বুঝেছিল ভুল মানুষ এর হাত ধরে জীবন নদী পাড়ি দেওয়া সহজ হবে না তার জন্য।

পরের বছর সে আবার প্রেগন্যান্ট। আবার পেট কাটা। এবার মেয়ে। সংসারের হাল ধরতে ও নিজ পায়ে দাঁড়াতে সোফিয়া একটি চাকুরী নেয়। রাশেদ এরও চাকুরী হয়। বিয়ের তিন বছর পর তারা স্বচ্ছল হয়। আস্তে আস্তে সুখ আসা শুরু করছিল কিন্ত সুখ বেশিদিন সইল না।
রাশেদ জড়িয়ে গেল মাদকে। সোফিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। বাচ্চা ও সংসার এর খবর নেই। একদিন অফিস এর নাম করে বের হয়ে তিন দিন বাসায় ফিরল না। মাদক এর ভয়াল ছোবলে সোফিয়ার সুখ উড়ে গেল জানালা দিয়ে। আস্তে আস্তে সোফিয়ার দুঃখ-গাথা উপন্যাসে রূপ নিচ্ছিল।

রাশেদ একদিন অফিস থেকে বাসায় এসে বললো, তার ট্রান্সফার হয়েছে সিলেটে। ব্যাগ গুছিয়ে রাতেই সিলেট রওয়ানা দিলো। সোফিয়া দুইটা ছোট্টছোট্ট বাচ্চা নিয়ে কিভাবে থাকবে তা নিয়ে কোন চিন্তাই করল না। সিলেট গিয়ে রাশেদ তিন মাসের জন্য লাপাত্তা হয়ে গেল। ফোনে পাওয়া যায়না। মোবাইল বন্ধ রাখে। সপ্তাহ ১৫ দিন পর দোকান থেকে ফোন দিয়ে ১/২ মিনিট কথা বলে লাইন কেটে দিত। এই তিন মাসে সংসারে এক টাকাও দিলো না। এই দিকে মেয়ে হওয়ার পর দুই বাচ্চা নিয়ে কুলাতে পারছিল না সোফিয়া,তাই চাকুরী ছেড়ে দিল।

চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার আরো কারন নাকি ছিল সোফিয়া বললো, পরে জানাবে। রাশেদ জানতেও চাইল না কিভাবে চলছে সংসার। সিলেট থেকে তিন মাস পর বাসায় ফিরল রাশেদ। দরজা খুলে দিলো সোফিয়া। রাশেদ এর চেহারা দেখে আৎকে উঠল। পুরোদস্তুর নেশাগ্রস্থ একজন মানুষের রূপ নিয়ে বাসায় ফিরছে রাশেদ। সারাটা বিকেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো সোফিয়া।
রাতে রাশেদ সোফিয়ার সাথে সেক্স করতে চাইলো। সোফিয়া আগ্রহ না দেখালে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইলো। রাশেদ চেঁচামেচি করল। বললো, 'মাগী, আমি ছিলাম না তিন মাস। কার কার সাথে শুইছিস তুই আমার লগে শুইতে চাস না'?
রাশেদের মুখের ভাষা শুনে সোফিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।

রাশেদ এর চিকিৎসা চললো।  সোফিয়ার বড় ভাইয়ের সহায়তায় সংসার চললো কয়েক মাস। সোফিয়া রাশেদকে সব মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল। সংসারের হাল ধরতে নিজে আবার চাকুরী নিলো। অনেক দিন মাদক নেওয়ার কারণে রাশেদ এর ইরেক্টাইল ডিসফাংশন দেখা দিল। সে প্রতিরাতে সোফিয়াকে সেক্সুয়ালি জাগাতো কিন্ত কিচ্ছু করতে পারত না। রাশেদ ঘুমিয়ে যেত, সোফিয়ার শুরু হতো তীব্র পেট ব্যাথা। সারা রাত সেই ব্যাথায় নীরবে অশ্রু ফেলত সোফিয়া। রাতের পর রাত এই অত্যাচার সয়ে গেল মেয়েটি।

রাশেদ সুস্থ হয়ে অফিস শুরু করল। কয়েক মাস ভাল ছিল। এই কয়েক মাস সোফিয়াকে জ্বালাতন করেনি। একদিন রাতে রাশেদ সেক্স করতে চাইল কিন্ত পারলো না নিজের উইকনেস এর জন্য। হঠাৎ সে সোফিয়াকে চড় থাপ্পড় মারা শুরু করলো। সোফিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
রাশেদ চিৎকার করে বললো, 'তুই নিশ্চয় অন্য ব্যাটার সাথে শুইছস নইলে আমি কাছে আসলে আগ্রহ দেখাস না কেন? সোফিয়া কান্না করতে করতে বললো, 'প্লিজ রাশেদ থামো। আমিও তো একটা মানুষ। তুমি ডাক্তার দেখাও। তুমি নিজে কিছু করতে পারো না আবার আমার সাথে এ কেমন ব্যবহার'!

রাশেদ সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেল। এই অলীক সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগলো।
ফেসবুকে সোফিয়া কোন ছবি পোস্ট দিলে রাশেদ গালিগালাজ করত। বলত: কোন নাগর এর জন্য ছবি দিছ। তুই তুকারী করতো। একবার সোফিয়ার ছবিতে এক স্কুল ফ্রেন্ড কমেন্ট করল 'মায়াবিনী'। এই কমেন্ট দেখে রাশেদ সোফিয়ার সাথে ঝগড়া শুরু করল, কেন এই কমেন্ট? নিশ্চয় তুই ওই ছেলের সাথে প্রেম করিস নইলে মায়াবিনী বলবে কেন তোরে।
সোফিয়া মেজাজ হারিয়ে রাগ করে বললো, 'আমি শুধু প্রেম করিনা, শুইছি ওই পোলার লগে', এটা বলার সাথে-সাথে ঠাস-ঠাস করে সোফিয়াকে চড় মারা শুরু করলো রাশেদ।

রাশেদের সন্দেহটা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেল। ওর অফিস শেষ রাত ৮ টায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে ৯ টা। সোফিয়ার অফিস ৪ টায় শেষ হলে ৫ টায় পৌঁছে যেত বাসায়। মাঝে মাঝে সোফিয়া বাসায় এসে দেখত রাশেদ তার আগেই বাসায় এসে বসে থাকত। এত তাড়াতাড়ি বাসায় কেন আসলো জানতে চাইলে রাশেদ রিয়েক্ট করত। সোফিয়া বুঝত সবই। প্রথম প্রথম সোফিয়া বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও রাশেদ এর আচরণ দিন-দিন অসহনীয় হয়ে পড়ল।
রাশেদ এর মনে বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মে গেল যে, সোফিয়া অন্য কারো সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করে বা পরকীয়া করে। কিন্ত সোফিয়া এইসব থেকে যোজন-যোজন মাইল দূরে। সোফিয়া মোবাইলে কথা বললে, রাশেদ সতর্ক ভাবে শোনার চেষ্টা করতো কার সাথে কথা বলছে। আর অল্পতেই রেগে যেতো রাশেদ। কথায় কথায় বাচ্চাদের সামনেই গায়ে হাত তুলতো। অপমানজনক কথা শুনাতো।

অফিসে শাড়ি পড়ে গেলে খোঁচা মেরে কথা বলতো, বসের লগে শুইবি নাকি? মাঝে মাঝে দুপুরে বাসায় ফোন দিয়ে বাচ্চাদের জিজ্ঞাস করত তোমাদের আম্মুর সাথে বাসায় কেউ আসে নাকি। ১০ বছর সংসার করে নিঃস্ব হয়ে এই পোকামাকডের জীবন থেকে গতকাল নিজের একক সিদ্ধান্তে বের হয়ে গেল সোফিয়া। ভালবেসে বিয়ে করে ভালবাসার ছিটেফোঁটাও পেলো না বেচারি!

আমাকে যখন বললো, সব শুনে আমি বুঝে গেছি সোফিয়ার স্বামী রাশেদ 'ওথেলো সিনড্রোম' বা প্যাথলজিকাল জেলাসিতে আক্রান্ত। এটা একটা মানসিক রোগ যেখানে স্বামী তার স্ত্রীকে বা স্ত্রী তার স্বামীকে অবিশ্বাস ও তীব্র সন্দেহ করে এবং এদের মনে বদ্ধমূল ধারনা জন্মে তাদের সঙ্গী পরকীয়া করছে।
শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি নাটক 'ওথেলোতে' ওথেলো তার সৎ ও সুন্দরী স্ত্রী ডেসডিমোনাকে পরকীয়ার অমূলক সন্দেহ থেকে হত্যা করে। এই ঘটনার সাথে মিল রেখেই এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও সন্দেহপ্রবণ মানসিক ব্যাধির নাম রাখা হয় 'ওথেলো সিন্ড্রোম'। ওথেলো সিন্ড্রোম এ আক্রান্তরা নিজের সঙ্গীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না।

আমার বন্ধু সোফিয়া। হয়ত এই একটি ডিভোর্স বাঁচিয়ে দিল সোফিয়ার প্রাণ।"

No comments: