Search

Friday, February 10, 2012

বাংলা ভাষার লড়াইয়ে উর্দুভাষী একজন তাজুল!

আজকের অতিথি লেখক, সমীর চক্রবর্তী। তিনি লিখেছেন অসাধারণ একজন মানুষকে নিয়ে। যে মানুষটা বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছিলেন, তিনি উর্দুভাষী একজন মানুষ তাজুল ইসলাম!

সমীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন:
"ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি আসার পর থেকেই খুব করে চাচ্ছিলাম এ নিয়ে বিশেষ কোনো প্রতিবেদন করতে। কিন্তু গতানুগতিকের বাইরে কোনো বিষয় পাচ্ছিলাম না।
বরাবরের মত এবারও দ্বারস্থ হলাম জেলার কৃতি সাংবাদিক বিশ্বজিৎ পাল বাবু ভাইয়ের। তিনি এমন একটা বিষয়ের কথা বললেন যাতে শিহরিত হবে যে কেউ। জানতে পারি, একজন উর্দুভাষী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাজুল ইসলাম লড়াই করেছিলেন বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে! তাঁর মত একজনের সাথে আলাপ করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলাম না।

এক দুপুরে বের হয়েছিলাম তাঁর খোঁজে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের হালদার পাড়ার বাসায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে আসলেন যে মানুষটি তার বয়স হবে আশির উপরে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইলে বেশ কিছুক্ষণ দরজায়ই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
আমি বলি, স্যার, আপনিই কি তাজুল ইসলাম?
এমন প্রশ্নে ঘোর কাটে তাঁর। বললেন, 'আমিই তাজুল কিন্তু আমার সাথে তো কেউ কথা বলতে আসে না'! পরে অবশ্য দীর্ঘক্ষণ কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, বেশিরভাগ মানুষের মুখের ভাষাকে অস্বীকার করছিল পাকিস্তানিরা। বীর বাঙ্গালীর আন্দোলনে ঘি ঢালে জিন্নাহর সেই ঘোষণা। তারপর থেকেই বন্ধুরা নেমে পড়ে রাস্তায়। আর কি বসে থাকা যায়? তিনি নিজেও নেমে পড়লেন রাস্তায়। মুষ্টিবদ্ধ হাতে দীপ্ত কন্ঠে শ্লোগান ওঠে, রাষ্ট ভাষা বাংলা চাই

বয়সের ভারের সাথে সাথে বিভিন্ন রোগে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের কথা উঠতেই তিনি যেন ফিরে গেলেন সেই বায়ান্ন সালে। চোখে যেন জ্বল জ্বল করে ভাসতে থাকে সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা। তখন তাঁকে মনে হচ্ছিল একজন সদ্য তরুণ।
তাজুল ইসলাম জানান, তখন তিনি কলেজিয়েট স্কুলের (বর্তমানে নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণীর ছাত্র। সেই সময়টায় তিনি অনেকের কাছ থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিটি শুনেন। উজ্জীবিত হন নিজেও। তাঁর মতে লাখো বাঙালির এটা ছিল প্রাণের দাবি। এ রাষ্ট্রে বাংলাভাষী ছিল বেশি। কিন্তু সরকার অন্যায়ভাবে তাদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আরবি হরফে বাংলা লেখা হবে এমন কথাও বলা হচ্ছিল। কিন্তু তা তো অন্যায়।


তাজুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের বাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশে হওয়ায় আমাকে কেউ সন্দেহ করত না। বাসার সবাই তখনও উর্দুতে কথা বলত। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলাম জুবলি প্রেস থেকে পোস্টার আনার কাজে। মিছিলের জন্য লোক জমায়েত করাসহ নানা কাজ করতাম আমি। যোগ দিতাম মিটিং মিছিলে। অবশ্য এ কাজে পরিবারের সদস্যরাও আমাকে সমর্থন করত।
জনমত গড়ে তুলতে আমাকে দিয়ে বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করা হতো। ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে আসলে হঠাৎ ভোঁ-দৌড়ে বগিতে বগিতে বাংলার পক্ষে ছাপানো লিফলেট ছিটিয়ে দিয়ে আসা। একাজ করতে গিয়ে অনেকবার পুলিশের ধাওয়াও খেয়েছি। অনেকদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছি। একবার এক পুলিশ অফিসার বুঝতে পেরে আমাকে ভয়ভীতিও দেখান, কিন্তু আমি দমে যাইনি।
স্মৃতি হাতড়ে তাজুল ইসলাম বলছিলেন, একবার সিআইডি ইনস্পেক্টর মো: বশির আমার কার্যক্রম বুঝে ফেলে বলেছিলেন, তুম ইয়ে কিয়া করতা হে? আপনা পাওমে কুলাড়ি মারতাহে। ইয়ে তুম ঠিক নেহি করতা হে
তার এমন বক্তব্যের পর তখন আমি তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করি। পরে তিনিও বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের তার হাত পা বাঁধা এও বলেছিলেন। 

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি ছিলাম মৌলভী টাইপের। আন্দোলনরতদের মধ্যে উকিল আব্দুল বারী আমাকে মসজিদে মসজিদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। মসজিদে গিয়ে মুসলিদের বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে বলি। কবি আল মাহমুদ, মুহম্মদ মুসাসহ আরো অনেক সহপাঠী আমাকে এ কাজে সাহায্য করেছেন'।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'এখন প্রায় সময়ই বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার দেখি। তাছাড়া বানানেও রয়েছে ভিন্নতা। যা ভাষা সংগ্রামী হিসেবে অন্য সবার মত আমাকেও পীড়া দেয়। ফেব্রুয়ারি আসলে সবাই বাংলা বাংলা বলে পাগল হয়ে যায়। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির পর সবার মাথায় যেন বরফ পড়ে যায়। এরপর কেউ আর বাংলার জন্য কথা বলেন না। ফলশ্রুতিতে এখনও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন করতে পারিনি আমরা। ঠেকাতে পারিনি ভাষার বিকৃত ব্যবহার। তিনি ভাষার বিকৃত ব্যবহার ঠেকাতে বাংলা একাডেমিকে আরো শক্তিশালী করার দাবি জানান।

ব্যক্তিগত জীবনে তাজুল ইসলাম ছিলেন একজন শিক্ষক। নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় তিনি শিক্ষকতা করেছেন ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে। তিনি চার মেয়ে এবং এক ছেলে সন্তানের জনক। ইতিমধ্যে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলেও উচ্চ শিক্ষিত হয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন। বর্তমানে তাঁর বাড়ির সবাই বাংলা ভাষাভাষী। বাংলাকে তিনি লালন করেন মাতৃ স্নেহেই।
তাঁর সহপাঠী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসাও বলেন,‘তাজুলের মত উর্দু ভাষার কেউ বাংলার জন্য লড়বে এটা ভাবতেও অবাক লাগত। তার দেখাদেখি আরো অনেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তখন সোচ্চার হয়েছিলেন'।


তাজুল ইসলামের মত এমন একজন মানুষকে নিয়ে মিডিয়াতে তেমন একটা লেখালেখি হয়নি! কেন? এটা যেমন মাথায় ঘুরপাক খায় তেমনি তাঁর সেই অভিমানের কথা, আমার সাথে তো কেউ কথা বলতে আসে না...।"

সমীর চক্রবর্তী কথা বলছেন জনাব তাজুল ইসলামের সঙ্গে



2 comments:

Anonymous said...

লেখায় পিলাচ

রাশেদ said...

চমৎকার একটা প্রতিবেদন,এরকম আর ও লেখায় অন্যরা ও এগিয়ে আসুক