Search

Monday, January 16, 2012

একজন ভাগীরথী এবং অজ্ঞাতনামা রাজাকার

"অষ্টাদশী ভাগীরথী ছিল বরিশাল জেলার পিরোজপুর থানার বাঘমারা কদমতলীর এক বিধবা পল্লীবালা। বিয়ের এক বছর পর একটি পুত্র সন্তান কোলে নিয়েই তাকে বরণ করে নিতে হয় সুকঠিন বৈধব্য। স্বামীর বিয়োগ ব্যথা তার তখনও কাটেনি। এরই মধ্যে দেশে নেমে এল ইয়াহিয়ার ঝটিকা বাহিনী। গত মে মাসের এক বিকালে ওরা চড়াও হলো ভাগীরথীদের গ্রামে। হত্যা করলো অনেককে যাকে যেখানে যেভাবে পেলো।

এ নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ভাগীরথীকে
ওরা মারতে পারলো না। ওর দেহলাবণ্য দস্যুদের মনে যে লালসা জাগিয়েছিল তাতেই হার মানল তাদের রক্ত পিপাসা। ওকে ট্রাকে তুলে নিয়ে এল পিরোজপুরে। তারপর ক্যাম্পে তার উপর চালানো হলো হিংস্র পাশবিক অত্যাচার।

সতী নারী ভাগীরথী। এ পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে তিনি একমাত্র পরিত্রাণের উপায় বলে ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতেই এক সময় এল নতুন চিন্তা- হ্যাঁ মৃত্যুই যদি বরণ করতে হয় ওদেরই বা রেহাই দেব কেন? ভাগীরথী কৌশলের আশ্রয় নিল এবার।
এখন আর অবাধ্য মেয়ে নয় দস্তরমত খানদের খুশী করতে শুরু করল, ওদের আস্থা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলো। বেশীদিন লাগলো না, অল্প কদিনেই নারী লোলুপ ইয়াহিয়া বাহিনী ওর প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করল। আর এই সুযোগে ভাগীরথী ওদের কাছে থেকে জেনে নিতে শুরু করল পাক বাহিনীর সব গোপন তথ্য। এক পর্যায়ে বিশ্বাস ভাজন ভাগীরথীকে ওরা নিজের ঘরেও যেতে দিল। আর কোন বাঁধা নেই। ভাগীরথী এখন নিয়মিত সামরিক ক্যাম্পে যায় আবার ফিরে আসে নিজ গ্রামে।


এরই মধ্যে চতুরা ভাগীরথী তাঁর মূল লক্ষ্য অর্জনের পথেও এগিয়ে গেল অনেকখানি। গোপনে মুক্তি বাহিনীর সাথে গড়ে তুলল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এরপরই এল আসল সুযোগ। জুন মাসের একদিন ভাগীরথী খান সেনাদের নিমন্ত্রণ করলো তাঁর নিজ গ্রামে।
এদিকে মুক্তি বাহিনীকেও তৈরী রাখা হলো যথারীতি। ৪৫ জন খান সেনা হাসতে হাসতে বাগমার কদমতলা (ভাগীরথীর) নিমন্ত্রণ খেতে এসেছিল কিন্তু তার মধ্যে ৪/৫ জন ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছে বুলেটের ক্ষত নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। বাকিরা ভাগীরথীর গ্রামেই শিয়াল কুকুরের খোরাক হয়েছে।


এরপর আর ভাগীরথী ওদের ক্যাম্পে যায়নি। ওরাও বুঝেছে, এটা তারই কীর্তি। পাক আর্মিরা তাই হুকুম দিল জীবিত অথবা মৃত ভাগীরথীকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে নগত এক হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্ত ভাগীরথী তখনও জানতো না ওর জন্য আরও দুঃসহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একদিন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লো ভাগীরথী। তাকে নিয়ে এল পিরোজপুর সামরিক ক্যাম্পে।

খান সেনারা এবার ভাগীরথীর উপর তাদের হিংস্রতার পরীক্ষার আয়োজন করলো। এক হাটবারে তাকে শহরের রাস্তায় এনে দাঁড় করানো হলো জনবহুল চৌমাথায়। সেখানে প্রকাশ্যে তার অঙ্গাবরণ খুলে ফেলল কয়েকজন খান সেনা। তারপর দু’গাছি দড়ি ওর দু’পায়ে বেঁধে একটি জীপে বেঁধে জ্যান্ত শহরের রাস্তায় টেনে বেড়াল ওরা মহাউৎসবে।

ঘন্টাখানেক রাজপথ পরিক্রমার পর আবার যখন ফিরে এল সেই চৌমাথায় তখনও ওর দেহে প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। এবার তারা দুটি পা দুটি জীপের সাথে বেঁধে নিল এবং জীপ দুটিকে চালিয়ে দিল বিপরীত দিকে। ভাগীরথী দুভাগ হয়ে গেল।

সেই দুভাগে দু'জীপে আবার শহর পরিক্রমা শেষ করে জল্লাদ খানরা আবার ফিরে এল সেই চৌমাথায় এবং এখানেই ফেলে রেখে গেল ওর বিকৃত মাংসগুলো। একদিন দু’দিন করে সে মাংসগুলো ঐ রাস্তার মাটির সাথেই একাকার হয়ে গেল এক সময়। বাংলামায়ের ভাগীরথী এমনি ভাবে আবার মিশে গেল বাংলার ধুলিকণার সাথে…।"
সূত্র: বর্বরতার রেকর্ড, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, অষ্টম খন্ড (ভাষারীতি অবিকল রাখা হয়েছে)।

আমাদের দেশে ভাগিরথীদের মত মানুষদের আত্মত্যাগের কথা জানতে আমরা খুব একটা আগ্রহ বোধ করি না, মিডিয়াও না। এই দেশে স্বাধীন করে ফেলেছেন এমন গুটিকয়েক নাম বলে বলে সময় কোথায় আমাদের!
ভাগীরথীর সম্বন্ধে আমি জানতে পারি সম্ভবত ২০০৫ সালে। ২০০৬ সালে এই লেখাটা যখন আমি আমার কয়েদী বইয়ে উল্লেখ করেছিলাম তখন আমার বিপুল তথ্যের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিশেষ তথ্য হাতে ছিল না। এখনকার মত কয়েক বছর পূর্বেও ব্লগস্ফিয়ারে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত তেমন উল্লেখ করার মত তথ্য ছিল না।
এই এক অভাগা দেশ, এখানে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বইপত্রের দাম সুলভে থাকাটা যুক্তিযুক্ত অথচ একেকটা বইয়ের দাম আগুনসম।

আমার মনে আছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের এবং অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বইপত্রের প্রায় পনেরো হাজার ফটোকপি করেছিলাম। উপায় ছিল না। নৈতিকতা-অনৈতকতা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তখন আমার ছিল না। আগেই উল্লেখ করেছি, ব্লগস্ফিয়ারে তখন তেমন কোনো তথ্যই ছিল না, অন্তত বাংলা ভাষায়।
তো, গতকাল আমার মাথায় বিষয়টা আসে, ভাগিরথীকে রাজাকাররা ধরিয়ে দিয়েছিল, বেশ। কিন্তু আমরা কোথাও এই রাজাকারের নাম জানতে পাই না। কারণ আছে, তখন মুক্তিযুদ্ধের পর সঠিক ইতিহাসের কাজ শুরু হয়েছিল বটে কিন্তু পরে আর এগুতে পারেনি! তাছাড়া ওই সময় হয়তো এই রাজাকারদের নাম নিয়ে আসার বিষয়ে কেউ তেমন করে ভাবেননি।
এমন কি আমি নির্বোধের মাথায়ও কখনও আসেনি ভাগিরথীকে যারা ধরিয়ে দিয়েছিল, ওই রাজাকার কে-কারা ছিল। এই নিয়ে এখন নিজের প্রতিও আমার ক্ষোভ আছে। কেন বিষয়টা পূর্বে আমি লক্ষ করলাম না!

ভাগিরথীর ঘটনাটা পিরোজপুরে। যুদ্ধের সময় পিরোজপুরেই ছিলেন অতি সজ্জন (!) এক ব্যক্তি যিনি রাজাকারের সর্দার হিসাবে যথেষ্ঠ কুখ্যাত ছিলেন। আমরা সবাই জানি (কেবল আসিফ নজরুল ব্যতীত) তিনি হচ্ছেন, আমাদের মহান মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এহেন কোনো অপকর্ম নাই যা তিনি করেননি। ভাগিরথীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০০০ (তৎকালীন হিসাবে বিপুল টাকা) টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হবে আর মাওলানা সাহেব ঝিম মেরে বসে থাকবেন এ আমার বিশ্বাস হয় না। যে সাঈদী মানুষের ঘরের টিনটা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে।

আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি, কোনো এক সূত্রের কল্যাণে বের হয়ে আসবে সেই অজ্ঞাতনামা রাজাকারের নাম...।   

4 comments:

sameer world said...

রাজাকার সঈদীকে ভাগিরতীর মত মারতে পারলে আমার
প্রাণ শান্তি পেত।
আর আসিফ নজরুল স্যারকে আমি খোব শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু উনার এমন বক্তব্যে আমিও সেই রাজাকারকে খুজে ফিরি।
এমন একটি ঘটনা জানানোর জন্য আলি ভাইকে ধন্যবাদ।
সমীর চক্রবতী

Anonymous said...

এখন যেহেতু হরিণের বাচ্চাকে খেতে হবে তাই অযুহাতগুলো আবিস্কার করে নিতে হবে। হাহাহাহাহাহাহা। না হলে এমনকি ঐ বাচ্চার দাদাও হয়তো জল ঘোলা করেছিলো, খেতে পারলেই হলো। এই হলো সেরা ব্লগার মাহমেদের নৈতিকতা।

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

আমি বা আপনি, আমরা তো বাচ্চা না যে এখানে বাচ্চাদের গল্প এনে হাজির করেছেন!

আমি এই লেখায় কোথাও এটা বলিনি ভাগিরথীকে খুন করার পেছনে সাঈদীর হাত ছিল, ছিলই।
লেখায় কেবল সম্ভাবনার কথা বলেছি। এর পেছনে কারণ আছে, সাঈদী সাহেবের কর্মকান্ড যে কেবল এখনই জানা যাচ্ছে এমন না। আগেও জানার অভাব ছিল না।
তাছাড়া উর্দুভাষী পাকআর্মি ভাষার সুবিধার কারণেও সাঈদীকে প্রাধান্য দিত। যুদ্ধের সময় সাঈদী পিরোজপুরে ছিলেন বিধায় ভাগিরথী খুনের সঙ্গে তার জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ আমার সংশয়, যা প্রকাশ করেছি লেখার মাধ্যমে।

আর আমার সম্বন্ধে যে সংশয় আপনি ব্যক্ত করেছেন আমার নৈতিকতা নিয়ে...। সেরা ব্লগারের প্রসঙ্গ টেনে এনে শ্লেষ প্রকাশও করেছেন। নৈতিকতা কোনো পুরষ্কার-খেতাব শিখিয়ে দেয় না, নিজেকেই শিখতে হয়। @Anonymous

Unknown said...

মাহমেদ ভাই, ছাগুদের ম্যতকারে চারদিকে এমনিতেই আকটা ত্রাহি অবস্থা। তারপর গোআ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের এখন গোচনা বিসর্জন চলছে। ব্লগ, এফবি যেখানেই যাবেন, তাদের সর্বশক্তির প্রচেষ্টার নমুনা পাবেন। আপনার এখানে ও দু'একটা ম্যতকার চলে আসছে। মাইন্ড কইরেন না। আর Anonymous রা একটি বিশেষ শেণীর সারমেয়, এদের ignore করাই উত্তম!