প্রতিদিন সকালে জামির গা রাগে জ্বলে যায়। ব্যাপারটা ঘটে ঠিক তখনি যখন ওর টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। এই বিশাল বাড়ির সব ক-টাই হাই কমোড, একটাও লো-প্যান নেই। আধুনিকতার সমস্ত উপকরণের সঙ্গে ও মানিয়ে নিয়েছে কিন্তু হাই কমোড বড় ভোগাচ্ছে!
প্রথমবার হাই কমোড ব্যবহার করার কথা মনে পড়ে গেল। বেশ আগের কথা তখন বয়স কতই বা! মাঝারি ধরনের হোটেল। রিসেপশনিষ্ট জানতে চেয়েছিল: এ্যাটাচ বাথ কী নিবেন, বাংলা না ইংলিশ?
জামি একরাশ আলগা গাম্ভীর্য এনে অবজ্ঞা ভরে বলেছিল: ইংলিশ-ইংলিশ।
হোটেল রুমে ঢুকে ইংলিশ জিনিসটা দেখে জামির বুক কেঁপে উঠেছিল। সকাল বেলায় চোখ ফেটে কান্না আসছিল। শুরু হল অসামান্য কসরত। স্পঞ্জের স্যান্ডেল নিয়ে পিচ্ছিল কমোডের সরু দু’ধারে বসার চেষ্টা। আপ্রাণ চেষ্টার ফল দু-মিনিটেই মিলল। পিছলে পড়ে এক পা বেকায়দা ভঙ্গিতে কমোডে আটকে গেল। বিশ মিনিটের মাথায় জামি অসাধ্য সাধন করল। স্বস্তিতে বিড়বিড় করেছিল, ওয়াট আ রিলিফ-ওয়াট আ রিলিফ।
আজ বিরস মুখে বেরিয়ে বাবাকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। জামির বাবা মন্তাজ মিয়া এখন লেখেন, এম. এইচ. মেন্টাজ। এই এম. এইচ-এর অর্থ কী মেল্টাজ সাহেব নিজেও জানেন ন। আড়ালে আনেকে তাঁকে তিমিঙ্গিল বলে। টাকার গন্ধ পেলে ইনি নাকি তিমিকেও গিলে ফেলতে পারেন! খুব অল্প সময়ে ধাঁ করে বেশ ক-কোটি টাকা বানিয়ে ফেললেন, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট করে। জামি খুব ভাল একটা জানে না ইনি আসলেই কী করেন! তবে এটা বেশ জানে, ওর বাবা আপাদমস্তক একজন অসৎ লোক। নীতি-ফীতি প্রতিবার নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের করে দেন। সততা এঁর কাছে খোলামকুচি।
অবশেষে খাবার ঘরে পাওয়া বাবাকে গেল। মন্তাজ সাহেবের শালপ্রাংশু দেহ, রগরগে একটা গাউন গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। কারিগরী ফলানো রুপার চামচ দিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদার মতো জাউ খাচ্ছেন। জামি ভাবল, আহ আফসোস, এসব অসাধু লোকগুলো প্রচুর ভালো ভালো খাবার থাকার পরও খেতে পারে না। এরকম একজন মন্দ লোকের মন্দ সন্তান না হয়ে উপায় কী!
জামি মুখ কালো করে বলল, ‘বাবা, তোমার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে একটা কথা বলব। কথাটা জরুরী।’
মেন্টাজ সাহেবের নিষ্প্রভ চোখ, এ পাথরের চোখ, স্বাভাবিক মানুষের হতে পারে না, আশ্চর্য! এ মুহূর্তে ভয় পেলে চলবে না। বাবার সামনে একবার ভেঙ্গে পড়লেই হয়েছে।
‘বাবা বলছ কেন স্টুপিডের মতো, বিশ্রী শোনাচ্ছে, ‘মেন্টাজ সাহেব বললেন, যথাসম্ভব কম মুখ নাড়িয়ে।
‘ড্যাড-ফ্যাড বলতে আমার ইচ্ছা করে না। তো, বাবা, যা বলতে চাচ্ছিলাম, মানুষের আবিষ্কার একটা কুৎসিত এবং একটা চমৎকার জিনিসের নাম বলতে পারো? দুটা জিনিসই কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণের প্রথম অক্ষর দিয়ে?’
মেন্টাজ সাহেব এ নিয়ে মাথা ঘামানো দূরের কথা, উত্তরই দিলেন না। ওঁর ধারণা ছেলেটার মাথায় গন্ডগোল আছে। এ দেশে মাথার সমস্যার চিকিৎসা কি হয়, নাকি বিদেশে কোথাও চেষ্টা করে দেখবেন! এ ছেলে দিনে দিনে জটিল সমস্যা সৃষ্টি করবে এটা চোখ বুজে বলে দেয়া যায়। আঠালো জিনিসটা বেশ কায়দা করে মুখের ভেতর নাড়াচাড়া করছেন। গলায় আটকাচ্ছে, গিলে ফেলা যাচ্ছে না।
কল্লোল মুখ আরও অন্ধকার করে বলল, ‘অসাধারণ জিনিসটা হলো কম্পিউটার আর কুৎসিত জিনিসটা হলো হাই কমোড। হাই ড্যাড, হাই কমোড।’
মেন্টাজ সাহেব মেঘ গর্জনে বললেন, ‘তুমি কী আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছ!’
‘তুমি কি রসিক লোক, যে তোমার সঙ্গে রসিকতা করব। আমি ঘুরিয়ে যেটা বলতে চাচ্ছি, কমোডে বসে আরাম পাই না। প্রতিদিন এ যন্ত্রণা ভালো লাগে না।’
‘তোমার কী ধারণা, এ কথায় খুব প্রভাবিত হয়ে কমোডগুলো সব ভেঙে বাঁশের টাট্টি বানিয়ে দেব?’
‘বাঁশের টাট্টি একবার ট্রাই করে দেখো, সেটা কমোডের চেয়ে আরাম।’
‘হাউ ডেয়ার য়্যু! তোমার অবাধ্যতা দেখে বিস্মিত হচ্ছি। কী পড়াশোনা করেছ, কে কী পছন্দ-অপছন্দ করছে এই জ্ঞানটুকুও তোমার নাই।’
‘তোমার অনেক কিছুতে আমরাও অবাক হই, বাবা। ম্যানেজার জলিল কাকু, যে লোক চল্লিশ বছর বিশ্বস্ততার সঙ্গে তোমার সেবা করেছে, তাকে তুমি লাথি মেরে বিদায় করে দিলে।’
মেন্টাজ সাহেব আঠালো জিনিসটা চিবানো বন্ধ করে খরখরে চোখে বললেন, ‘মুখ সামলে কথা বলো। বানিয়ে বানিয়ে বলছ কেন, তুমি দেখেছ জলিলকে লাথি মেরেছি!’
ওই এক কথাই হল। সরকার কাকু, কাকীমা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে হররোজ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তুমি দেখা করো না। দারোয়ানকে বলে দিলে ভেতরে ঢুকলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। তোমার মতো একজন অমানুষের সন্তান আমি, ভাবতে খুব কষ্ট হয়।’
মেন্টাজ সাহেব দূর্দান্ত রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, ‘ফাজিল, তোকে জুতিয়ে লম্বা করে দেব।’
জামি সহজ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। সমস্ত শরীর অজান্তেই ঋজু-টানটান হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে মোটেও বাবাকে ভয় পাচ্ছে না। প্রলয়ংকরী রাগ ফুঁসে উঠছে। জলিল কাকু, কাকীমা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কী নিদারুণ লজ্জার মাথা খেয়ে ফি রোজ অপেক্ষা, একটুখানি দয়ার জন্যে!
ছোটবেলায় ও কাকীমার গলা ধরে ঝুলে পড়ত: কাকীমা আরেকটা গল্প বলো। ওর শত অত্যাচারেও কাকীমার হাসি মলিন হতো না।
এখন বাসা থেকে বের হলেই কাকীমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মুখ নিমিষে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। কাকীমা বরাবরের মতো স্নেহ ভরা নরম গলায় বলেন: খোকা, ভালো আছিস? দিনে-দিনে তুই কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস রে।
জামির কী ইচ্ছাই না করে কাকীমাকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে কাঁদে। জামি চোখ তুলে তাকাতে পারে না। অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের পানি গোপন করে। দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে সরে পড়ে। একদিন খুব সাহস করে বলেছিল: কাকীমা তোমাকে কিছু টাকা দেই?
তীব্র বেদনায় কাকীমা কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। কান্না ভেজা গলায় বলেছিলেন: ছি জামি, ছি!
জামি বাবার চোখে চোখ রেখে ভাবছিল, বাবা কী ওর গায়ে হাত তুলবেন? সমস্ত জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা কী এ মুহূর্তে করতে যাচ্ছেন?
জামির মা হাত মুছতে মুছতে ভেতরে না ঢুকলে হুলস্থূল কান্ড একটা হয়েই যেত। এই অসাধারণ মহিলা এক পলকে অনেকটা আঁচ করে ফেললেন। অসম্ভব শান্ত গলায় বললেন, ‘জামি, তোমার রুমে যাও।’
জামি টুঁ-শব্দ না করে মাথা নুইয়ে হাঁটা ধরল। বেরিয়ে যেতে যেতে অবাক হচ্ছিল, ভদ্রলোক যেভাবে লাফাচ্ছেন ছাদে না মাথা ঠুকে যায়।
জামি তিতিবিরক্ত। বেরিয়েই তিতলীর সামনে পড়ে গেল। ওর ইচ্ছা করছে চোঁচা দৌড়ে এর সামনে থেকে পালিয়ে যেতে। তিতলীর পাশ কাটিয়ে এটা এখন সম্ভব না। এ মেয়েটা বাবার দ্বিতীয় সংস্করণ। ক’দিন পর পর সাপের খোলসের মতো বয়ফ্রেন্ড বদলায়। তিতলীর চোখে বিদ্রুপ উপচে পড়ছে, ‘হ্যালো বদ, কিসের হইচই?’
জামি রাগ চেপে বলল, ‘বড় ভাইয়ের সঙ্গে এসব কী ফাজলামো।’
‘আহা চটচিস কেন; বাবা-মা, ড্যাড-মম হলে ব্রাদার বদ হবে না? বল, ভুল বললাম? হি হি হি। আর তুই তো নিরেট বদ।’
জামি দাঁতে দাঁত ঘসে বলল, ‘বদ আমি, না তুই। তুই-তুই, তুই বদের হাড্ডি। ইউ ব্লাডি নোংরা মেয়ে, কাল তোর রুমে ক্যাসেট খুঁজতে গিয়ে তোষকের নিচে কন্ট্রাসেপটিভ পিল পেয়েছি, ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে।’
তিতলী বিপন্ন চোখে তাকিয়ে রইল। হায়-হায়, এ ভুল ও কী করে করল, তোষকের নিচে আহাম্মকের মতো রাখল!
সামলে নিয়ে রাগে জ্বলতে জ্বলতে বলল, ‘কেন তুই আমার রুমে ঢুকলি?’
‘বেশ করেছি, দাঁড়া বাবাকে বলছি।’
তিতলী ঠোঁট উল্টে নির্লজ্জের মতো বলল, ‘যা-যা, বলে দে, এসবে আমার প্রেজুডিস নাই। আর তুই কী ধোয়া তুলসী পাতা? তোর মানিব্যাগে খুঁজলে কনডম পাওয়া যাবে।’
জামির দু-কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাথায় কেমন ঝিমঝিম ভাব। কখন তিতলীর গালে ঠাস করে চড় মেরেছে বলতেও পারবে না। সত্য-মিথ্যা যাই থাকুক কোনো মেয়ে কী তার বড় ভাই সম্বন্ধে এমন বলতে পারে!
তিতলী গালে দুহাত চেপে আগুন চেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুই কী ভাবিস, পুরুষেদের বেলায় সাত খুন মাপ, না?’
জামি স্তব্ধ মুখে পা টেনে টেনে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে থাকল, ‘কী কুৎসিত একটা দিন, কী কুৎসিত একটা পরিবার!
দরজা ধাক্কানোর শব্দে কর্কশ গলায় বলল, ‘কে-কে?’
জামির মা পৃথিবীর সমস্ত মমতা ঢেলে বললেন, ‘আমি, দরজা খোল।’
জামি দরজার দিকে এগুতে এগুতে ভাবল, এই পরিবারের সব কুৎসিত যে মহিলা স্বর্গীয় ডানা দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন, এই মুহূর্তে তাঁকে এড়াবার কী কোন উপায় নেই!
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Sunday, June 20, 2010
পিতা ও পুত্র: অন্য পিঠ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
Ali Bhai,
Probably you are going to Germany today. Your mobile is out of network from yesterday.
My little request.....pl bring for me a small showpiece or like this from there which i can keep with me as a memory....
আপনি তো কয়েন জমান, কয়েন হলে কেমন হয়? :)@Dr. Rumi
Post a Comment