(শুরু হলো এক অন্য রকম দিন! যথারীতি আজও সূর্য উঠেছে। ঝকঝকে গাঢ় একটা নীল আকাশ। আজ ৫৬ হাজার বর্গমাইল নামের এই গ্রহের সবচেয়ে বড়ো কারাগারে আটকা পড়েছে, সাকিব-লুবাবা-রাফা নামের তিনজন মানুষ। অন্য ১৫ কোটি কয়েদীর সঙ্গে। একটা রেলগাড়িতে।
আটকা পড়ে আছে সাকিবের মার দুর্বল হৃদপিন্ড, যেটা এখনো চলছে ধুকধুক করে, প্রিয় মানুষের অপেক্ষায়। প্রিয় মানুষের স্পর্শ কী মৃত্যুযন্ত্রণা কমিয়ে দেয়? কে জানে, হয়তো দেয়, হয়তো দেয় না। জানা নেই।)
‘বাবা- বাবা, এটাই কি আমাদের দাদাবাড়ি?’
‘না’, সাকিব অসংখ্যবার এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। ওর এই মেয়ে এমন অবুঝ হয়েছে কেন? অবশ্য এর বয়সই বা-কি, পাঁচ শুরু হল।
‘বাবা-বাবা, ও বাবা, ঠিক করে বলোই না ছাই, এটাই কি আমাদের দাদাবাড়ি না?’
সাকিব ধমক দিতে গিয়েও সামলে নিল, ‘বললাম তো মা এটা আমাদের দাদাবাড়ি না, তোমাকে তো আগেও অনেকবার বলেছি, বলিনি?’
রাফা ওর রেশমের মতো চুল নাড়িয়ে বলল, ‘হুঁ-উ।’
‘এই তো লক্ষ্মী মেয়ে, যাও খেলা কোরো গে।’
রাফা খানিকক্ষণ লক্ষ্মী মেয়ের মতো নিজে নিজে খেলল।
‘বাবা-বাবা, ও বাবা।’
‘আবার কি মা!’
‘এটা তাহলে কাদের বাড়ি? আমরা কি এখানে বেড়াতে এসেছি?’
‘রাফা বকবক করো না তো, চড় খাবে।’
এমন শক্ত কথায় কাজ হল না। রাফা বাবার মার দেওয়ার ব্যাপারটা এখনও দেখেনি, মা হলে অন্যকথা। রাফা সাকিবের গলা ধরে ঝুলে পড়ল, ‘বলতে হবে-বলতে হবে, এটা কাদের বাড়ি?'
‘এটা সরকারের বাড়ি, রেলবাড়ি, হলো তো।’
‘রেলবাড়ি কি, বাবা?’
‘রেলগাড়িই রেলবাড়ি, খবরদার আর একটা কথা না।’
‘আচ্ছা বাবা।’
‘রাফা, আর একটা কথাও না, লুবাবা প্লিজ রাফাকে সামলাও তো বড্ড বিরক্ত করছে। শেষে মেরে-টেরে বসব।’
লুবাবা পুরনো একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। শঙ্কিত দৃষ্টিতে সাকিবের দিকে তাকিয়ে ছোঁ মেরে রাফাকে একেবারে বুকের মাঝে নিয়ে এল। সাকিবকে কেমন উম্মাদ-উম্মাদ মনে হচ্ছে। মুখে ক-দিনের না-কামানো দাড়ি, টকটকে লাল চোখ, এই ক-দিন সম্ভবত চুলে চিরুনিও পড়েনি। সাকিব যখন খুব রেগে থাকে তখনই ওকে লুবাবা ডাকে নয়তো সুর করে বলে বাবা-লু-লু-লু। লুবাবা প্রথম প্রথম রাগ করে বলেছিল: খবরদার নাম নিয়ে ফাজলামো করবে না।
বেশ, তুমি আমায় বলো কোন শালা লুবাবা নাম রাখে।
লুবাবা রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিল। সাকিব সমস্তটা দিন রাগ ভাঙাতে পারেনি অবশেষে রাতে-।
সাকিব নরোম গলায় বলেছিল: পাগল নাকি, ঠাট্টা করলাম আর তুমি কি-না!
লুবাবার গলাও নরোম: কেন তুমি এমন রসিকতা করবে। তুমি তো খোকা না, জানো না নাম-ধাম রাখে গুরুজন। তোমার কি একেবারেই লঘুগুরুজ্ঞান নেই।
সাকিব হাসতে হাসতে বলেছিল: আমি খোকাই তো, এই দেখ খোকার গায়ে কোন কাপড় নাই।
ছি!
ছি কেন, খোকার গায়ে কাপড় নেই এটা বললে, ‘নজ-জা’ আর খোকার সঙ্গে ওইসব-।
লুবাবা সাকিবের মুখ চেপে ধরেছিল। অন্যভাবে ওকে থামানো যেত না।
এখন রাফা দুহাতে মাকে জাপটে ধরে আছে। বাবার কাছ থেকে মার ওকে সরিয়ে নেয়ার ভঙ্গি দেখে রাফা তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝতে পারছে কোন একটা সমস্যা আছে। রাফা সর্বক্ষণ মাকে লক্ষ করে। মা হাসি-হাসি মুখ করে থাকলে তার আনন্দ হয়। মা মুখ অন্ধকার করে রাখলে ওর কিচ্ছু ভাল লাগে না, এমনকি কাঁদতেও না। মার শরীরে যেমন একটা মা-মা গন্ধ বাবার ঠিক উল্টোটা। বাবার শরীরে সবসময় সিগারেটের বিশ্রি গন্ধ। ওয়াক!
বাবা বাবাই, অন্য কিছু কখনো মনে হয়নি। তবে বাবার সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করে। বাবাও তো ওর সঙ্গে বকবক করে বিরক্ত করে ফেলে কিন্তু আজ যে বাবা এমন করল?
লুবাবা সহজ গলায় বলল, ‘সাকিব, রাফাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।’
সাকিব চেঁচিয়ে বলল, ‘বেশ করেছি।’
‘আঃ, চেঁচাচ্ছ কেন?’
‘বেশ করছি।’
‘আঃ সাকিব’।
‘বেশ করছি।’
লুবাবা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, সাকিবের মধ্যে এখন পাগলামীর লক্ষণ স্পষ্ট। কেবলমাত্র পাগল এবং মাতালই ক্রমাগত একই কথা আউড়ে যায়। নাকি সত্যি সত্যি মদ খেয়েছে, তা কি করে সম্ভব? অবশ্য ওরা যেভাবে জীবন যাপন করছে বদ্ধউম্মাদ হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু না। ওরা দু-দিন ধরে যেখানে বাস করছে, এটা আসলে একটা রেলগাড়ির কামরা। চারদিকের জানালা বন্ধ, ফাঁক-ফোকর দিয়ে আলো বাতাস আসে। দিনেই দমবন্ধ হয়ে আসে রাতে তো, লূবাবা খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
সেদিন একনাগাড়ে টেলিফোনের রিং বাজছিল। লুবাবা শাওয়ারের নিচে ভিজতে ভিজতে ভাবছিল কখন রিং থেমে যাবে। নিরুপায় হয়ে প্রায় নগ্ন লুবাবাকে ফোন ধরতে হয়েছিল। রাফা গেছে পাশের বাড়ি। ‘জুলাপাতি’ খেলতে। সাকিব বাসায় থাকলেও ফোন ধরবে না। ও নির্ঘাত ঘুমাচ্ছে। ছুটির দিনে ওর কাজ একটাই মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমানো। ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ছুটির দিনে কেউ বিরক্ত করলে, ঘুম ভাঙিয়ে দিলে তার মৃত্যু অবধারিত। জনে-জনে এটা বলে রেখেছে। টেলিফোনের রিং তো মাছি-মশা, কামান দাগালেও সাকিবের ঘুমের কোন সমস্যা হয় না, লুবাবা রাগ চেপে বলেছিল: হ্যালো।
কে ভাবি, ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এসেছিল।
হুঁ, কে?
ওপাশ থেকে ফোপানোর শব্দ এল: ভাবি, আমি, ভাইয়াকে ফোন দাও, ভাইয়া বাসায় আছে তো?
তুমি কে?
আমি রায়হান।
লুবাবা নাম বলায় চিনতে পারল। রায়হান ওর দেবর। আশ্চর্য ওর গলা শুনে একদম বুঝতে পারছিল না।
হ্যালো ভাবি, হ্যালো শুনতে পাচ্ছ না, ভাইয়া কি বাসায় নেই?
আছে, সমস্যাটা কি আমাকে বলো?
তুমি ভাইয়াকে দাও।
শোনো রায়হান, ও ঘুমাচ্ছে। ওকে এখন ডেকে তোলা যাবে না। আর এক্ষণ ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিলে কি অনর্থ করবে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
প্লিজ ভাবি, প্লিজ।
লুবাবা এবার রাগ করে বলল, সমস্যাটা আমাকে বলতে অসুবিধা আছে?
ভাবি, তুমি ভাইয়াকে বল মা কথা বলতে চান।
লুবাবার গা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে তবুও ঘেমে গোসল হয়ে গেল। অবশেষে সাকিব দয়া করে সিকিভাগ চোখ খুলে পাশ ফিরে বলল, এখন না রাতে।
লুবাবা ভাবল ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকছে। গা ধরে এবার ঝাঁকাতেই সাকিব বলল: তুমি নিমফোম্যানিয়াক নাকি!
সাকিবের কথার অর্থ এতক্ষণে বুঝল। কী লজ্জা-কী লজ্জা! পাশাপাশি রাগে গা জ্বলে গেল। ওর এখন ইচ্ছা হয়ে থাকলেও নিমফোম্যানিয়াক হয়ে গেল, বাহ! অথচ সাকিব যখন খুশি যেভাবে খুশি-।
লুবাবা হিসহিস করে বলল: আমি তোমার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করতে আসিনি। তোমার মা টেলিফোনে কথা বলতে চাচ্ছেন।
সাকিব যে ভঙ্গিতে ছুটে ফোন ধরল এই গতির সঙ্গে কেবল তুলনা চলে সপাং করে পড়া একটা চাবুকের সঙ্গে।
সাকিব টেলিফোন ধরেই ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, হ্যালো মা।
ভাইয়া-ভাইয়া, হ্যালো ভাইয়া।
ও রায়হান তুই, ফোন দে মাকে।
এরপর রায়হান কি সব বলছিল সাকিব গুছিয়ে কিছুই বুঝতে পারছিল না। রায়হান কথা বলতে গুলিয়ে ফেলছে কেন, গাধা নাকি!
সাকিব চেঁচাচ্ছিল: রায়হান পরিষ্কার করে বল কি হয়েছে! আগের মত উল্টাপাল্টা বলে দেখ, এমন মার দেব জনমের মত টেলিফোন করা ভুলিয়ে দেব।
রায়হান থেমে থেমে বলেছিল: ভাইয়া, তোরা চলে আয়, মার অসুখ। মা-মা, মা, তোদের দেখতে চেয়েছে।
আবার বল।
সাকিব এবার রিসিভার কানে চেপে গভীর মনোযোগ নিয়ে মোনার চেষ্টা করছিল। রায়হান হুবহু আগের বলা কথাগুল্ই আউড়ে গেল। সাকিবের পায়ে জোর নেই। ভাঙা গলায় বলল: কাল থেকে হরতাল শুরু হচ্ছে এটা জেনেও বলছিস চলে আসতে?
ওপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই লাইন কেটে গেল নাকি, রায়হান কি ফোন রেখে দিল!
হ্যালো রায়হান, হ্যালো।
হ্যা ভাইয়া, চলে আয়।
লুবাবা গা মুছে ফিরে এসে ভারী অবাক হয়েছিল। সাকিব রিসিভার হাতে ঠায় বসে আছে। অভিমান ভুলে ছুটে এসে সাকিবকে ধরে অবাক হয়ে বলেছিল: কি হয়েছে?
সাকিব শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মা, আমার মা মারা যাচ্ছে।
*রেল-বাড়ি, ২: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_23.html
সহায়ক লিংক:
কয়েদী, ৪: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_22.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Saturday, May 22, 2010
কয়েদী: রেল-বাড়ি: ১
বিভাগ
‘কয়েদি’ বই থেকে অংশবিশেষ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
অসাধারন
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগছে। ধন্যবাদ আপনাকে। @Shaqlain Shayon
Post a Comment