Search

Tuesday, January 20, 2009

মা হাতি

মা হাতি আকাশের দিকে শুঁড় তুলে সজোরে নিঃশ্বাস টেনে নিশ্চিত হলো, আসছে ফাজিলটা। সে তার অসম্ভব ছোট চোখ কিঞ্চিত বড় করে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করল, নাহ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তাদের এত অল্প দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীতে কেন পাঠানো হয়েছে, কেন শুকুনের দৃষ্টি দিয়ে কেন পাঠানো হলো না!

মা হাতিটার বাচ্চা ঝড়ের গতিতে এলো। পেছনে রেখে এসেছে দোমড়ানো-মোচড়ানো শিশু বৃক্ষ, ঘন ধুলোর মেঘ।
মা হাতি শুঁড় ঝেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করল, ‘এভাবে দৌড়ায় পাগল। তুই কি পাগলু?’
হাতির বাচ্চা থমকে দাঁড়াল। রাগ চেপে কর্কশ গলায় বলল, ‘সবার তো দেখি দুটা কান একটা মুখ। তোমার কি একটা কান দুটা মুখ? তুমি শুনো কম, বল বেশী!’
মা হাতি বেয়াদব সন্তানকে শাসন করার জন্য শুঁড় দিয়ে চড় দিতে এগিয়ে এলো। চড় দেয়া হল না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। তার প্রিয়জনের সমস্ত শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। খোকা কোত্থেকে রক্তারক্তি কান্ড করে এলো!

মা হাতি (ছলছল চোখে), ‘খোকা, আবার ঝগড়া বাধিয়েছিস?’
বাচ্চা হাতি, ‘আমার খেয়ে দেয়ে আর কাজ নাই, আমি কি ইচ্ছা করে ঝগড়া করি?’
মা হাতি, ‘নিশ্চয়ই বাইরের পচা-আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করেছিস?’
বাচ্চা হাতি (বেয়াদব সন্তানের মতো), ‘আহ কি যন্ত্রণা। কানের পাশে কটকট না করে ওষুধ বানিয়ে নিয়ে এসো তো। ’
মা হাতি, ‘তোর এ অবস্থা হলো কি করে?’
বাচ্চা হাতি এবার গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ম্যামি-ম্যামি, আমি না...।’
মা হাতি ধমক দিল, ‘কয় লাখবার বলতে হয় একটা কথা। বলিনি, ম্যামি, মম এইসব সম্বোধন আমার পছন্দ না। মা বললে কি হয়, জিব খসে পড়ে!’
বাচ্চা হাতি শুঁড় দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘মা-মা, অ মা, আমি না রেললাইন পার হচ্ছিলাম। তাড়াহুড়োয় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে একটা রেলগাড়ি ধাক্কা দিয়ে এ অবস্থা করেছে। কী নিষ্ঠুর মা, চেষ্টা করে দাঁড়ানো দূরের কথা একবার ফিরেও তাকায়নি!’

মা হাতির পা থেকে শুঁড় পর্যন্ত অসহ্য রাগে জ্বলে গেল। মানুষ পেয়েছেটা কী! দিন দিন এরা কী অমানুষই না হচ্ছে। তাদের দাঁত (আইভরী) কেটে নেয়। এটা-ওটা ঘোড়ার ডিম বানায়। আরে বদ, বদের হাড্ডি, দাঁত দিয়ে শখের জিনিস বানালে নিজেদের দাঁত খুলে বানা, নিষেধ করছে কে! জঙ্গলের জমিদার হাতি অথচ গাধার পর্যায়ে নামিয়ে আনে। টনকে টন কাঠ টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। ধরে ধরে চিড়িয়াখানায় আটকে রাখে। কী দুঃসাহস, হাতিদের বলে শুঁড় উঠিয়ে মানুষকে সালাম দাও- চার পা তুলে ছোট কাঠের টুকরায় উঠে দাঁড়াও। কী কষ্ট, কী কষ্ট!
মা হাতি (শুঁড় শক্ত করে), ‘ট্রেনটার নাম্বার কত?’
বাচ্চা হাতি (আমতা আমতা করে), ‘না মানে, ইয়ে...আমি ঠিক...।’
মা হাতি(রাগী স্বরে), ‘তোকে বলে বলে আমার সাদা আইভরী হলদেটে হয়ে গেল, লেখাপড়া কর-লেখাপড়া কর। তুই কী চিরকাল এরকম বাউন্ডুলেই থাকবি রে, খোকা। লেখাপড়া করে না যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে।’
বাচ্চা হাতি, ‘সব সময় বকাবকি করো। এ জীবন আর ভাল্লাগে না।’

মা হাতি, ‘দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। আসুক আজ রেলগাড়ি। হাতি চেনে না, হাউ মেনি কলা গাছ, হাউ মেনি ব্যানানা।’
বাচ্চা হাতি(ভীত গলায়), ‘মা-মা, দোহাই তোমার ওকাজ করো না। রেলগাড়ির কি শক্তি তুমি জান না, স্রেফ কলাগাছের ভর্তা হয়ে যাবে।’
মা হাতি এর উত্তর দিল না। বিড়বিড় করে বলল, যে মা তার সন্তানের জন্যে প্রতিশোধ নিতে জানে না তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নাই! এ জীবন কোন দিনের জন্যে? খোকা জানে না ওর জন্যে রয়েছে কী অসম্ভব মমতা। এটা বলা হয় না। হাতি তো আর মানুষ না যে দিনে একশবার বলবে, খোকা রে, তুই আমার চোখের মনি, কুনকুনি, ঠুনঠুনি, ভুনভুনি, ঝুনঝুনি। মাথায় কেমন ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে, চারপাশে এতো বাতাস অথচ ফুসফুসটা শূণ্য মনে হচ্ছে।
মা হাতি শুঁড় উঠিয়ে বুঝতে পারছে একটা ট্রেন আসছে, এখনও অবশ্য বহুদূরে। বাচ্চাকে হিমগলায় বলল,‘আয় আমার সঙ্গে।’

মা হাতি আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে ছুটে গেল। আজ মানুষের নাগাল পেলেই হয়, মাথায় পা তুলে স্রেফ কলার ভর্তা বানিয়ে ফেলবে। মোটাসোটা একটা গাছ ভেঙ্গে বনবন করে মাথার উপর ঘোরাল। রেললাইন জুড়ে আগুন চোখে দাঁড়িয়ে রইল। ইন্টারসিটি ট্রেনটা ঘনঘন হুইসেল বাজিয়ে আসছে। রেললাইনের উপর বিশাল গাছ দেখে দাড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল।
মা হাতি গাছটা শুঁড়ে পেঁচিয়ে ইঞ্জিনের গায়ে দমাদম পিটিয়ে ইঞ্জিন অচল করে ফেলল।

এই ট্রেনেই বুকিন ওর বাবা-মার সঙ্গে সিলেট থেকে ফিরছে। জোর ব্রেক কষে হঠাৎ ট্রেনটা থেমে যাওয়ায় বাবা সিট থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছেন। চশমা কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে। বাবা পাগলের মতো এদিক-ওদিক হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমার চশমা, আমার চশমা! ’
বুকিনের মা চেঁচিয়ে বললেন, ‘আল্লাগো কী হলো, হে মাবুদ...।’
বুকিনের বাবা আবার বললেন, ‘আমার চশমা!’
বুকিনের মা রেগে গেলেন, ‘আল্লা খোদার নাম নাই, খালি আমার চশমা, আমার চশমা। চশমা তোমায় বাঁচাবে!’
বুকিনের বাবা কাতর গলায় বললেন, ‘বুকিনের মা, চশমা ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সব কেমন ঝাপসা লাগছে।’

বুকিনের বুকটা ধ্বক করে উঠল। অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছে। বাবা চশমা পরেন জানত। বাবা যে চশমা ছাড়া প্রায় অন্ধ এটা আজ বুঝল। আহারে, মানুষটাকে কী অসহায়ই না দেখাচ্ছে!
বাবা সামলে নিয়ে বলল, ‘বুকিন, বাবা দেখ তো বাইরে কী হচ্ছে। খবরদার জানালা দিয়ে মাথা বেশি বের করবি না।’
বুকিন ভয়ে ভয়ে মাথা বের করে বলল, ‘বাবা লোকজন সব দৌড়াদৌড়ি করছে। হাতিরা নাকি গাড়ি আক্রমণ করেছে। ও বাবা, দেখ-দেখ, একটা হাতির বাচ্চার শরীর থেকে কলকল করে কী রক্তই না বেরুচ্ছে! ইস, বেচারা ইস-স। সরি বাবা, আমার খেয়াল ছিল না তুমি যে চশমা ছাড়া দেখতে পাও না।’
বাচ্চা হাতি (আর্দ্র গলায়), ‘মা, মা, ওই দেখ কী ফুটফুটে একটা মানুষের বাচ্চা! কী মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মা-মা দেখ, মানুষের বাচ্চাটা আমাকে দেখে কাঁদছে!
মা হাতি (আগুন চোখে), ‘এত কিছু দেখতে হয় না, মন নরম হয়ে যায়। আজ যাকে পাবো তাকেই ভর্তা করে ফেলব!’
বাচ্চা হাতি, ‘মা, তোমার চারটা পায়ে পড়ি এদের ক্ষমা করে দাও! মা, মাগো, আমার গা ছুঁয়ে বলো!’


মা হাতি শুঁড় দিয়ে বাচ্চাকে পেঁচিয়ে ধরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা হাতি তার বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে এগুতে এগুতে ভাবল, মানুষদের বড় মজা, এরা ইচ্ছা করলেই মানুষ থেকে চট থেকে অমানুষ হয়ে যায়। আফসোস, পশুদেরই কষ্টের শেষ নেই, এরা না হতে পারে মানুষ, না হতে পারে পুরোপুরি পশু!
 

(পত্রিকায় যেহেতু এসেছে ইঞ্জিন তাই ইঞ্জিন শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হবে লোকোমটিভ।)
*এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।
২১.০২.৯৩ পত্রিকার (ভোরের কাগজ) খবর ছিল এই রকম: “সিলেট লাইনে ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একটা হাতির বাচ্চা আহত হয়। পরে হাতি এসে অন্য একটা আখাউড়াগামী ট্রেনটা শুড় দিয়ে দমাদম পিটিয়ে, ইঞ্জিন অচল করে ফেলে।’
আসলে পৃথিবীর সব মা প্রায় অবিকল এক! কে জানে, এ জন্যই হয়তো এ কথাটা এসেছে: ঈশ্বর তাঁর মমতা বোঝাতে গিয়ে বলছেন, আমার পক্ষে তো সব জায়গায় থাকা সম্ভব না, তাই আমি অজস্র মা সৃষ্টি করেছি! (
শুভ'র ব্লগিং থেকে)
**ইংরাজি অনুবাদ: Mother Elephant: https://www.ali-mahmed.com/2010/05/mother-elephant.html

2 comments:

আবদুল্লাহ আল মাহবুব said...

যখন ছবিগুলো ( পেপার কাটিং ) সংগ্রহ করেছিলাম বয়স কতোই বা আমার, মনে নেই। দেশের সবগুলো পত্রিকা রাখা হতো বাসায় ( আসলে বাবার অফিসে )। সেখান থেকে কেটে কেটে রাখতাম। স্ক্যানার কি জিনিস জানতাম না, যখন প্রথম জানলাম তখন কেনার সাধ্য ছিলো না। যখন সাধ্য হলো তখন দেশ হতে অনেক দুরে।
শুভ ভাই, দারুন কাজ করছেন। আমার স্বপ্নগুলো আপনার কাছে ভালো আছে, সবাই দেখতে পারছে, এটা জানতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। খুবই। এসব জিনিস আপনার কাছেই মানায়, আমার মতো স্বার্থপর পলায়নবাদী মানুষের কাছে না। অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতগ্যতা। আমি এখানের ন্যাশনাল আর্কাইভে ঢুঁ মারা চিন্তা করছি, দেখি সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কিছু পাই কি না।

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

সুমন,
আমি সরি। পোস্টটার বিষয় বদলে যাওয়ায় আপনার মন্তব্যটা অন্য রকম অর্থ দাঁড়াচ্ছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা।