Search

Saturday, July 31, 2010

রামায়ন:অযোধ্যাকান্ড

রাজা দশরথের বয়স হয়েছে।  ষাট ছাড়িয়ে গেছেন। তাই তিনি মনস্থির করলেন, রামকে রাজ্যের ভার দিবেন। সভা ডেকে পরামর্শ চাইলে সবাই একবাক্যে বললেন, এর চেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত আর হয় না। স্থির হলো, পরদিন রামকে রাজায় অভিষিক্ত করা হবে। এই সংবাদে অযোধ্যায় হুলস্থূল পড়ে গেল। রামের মাতা কৌশল্যারও আনন্দের শেষ রইল না। সীমাহীন আনন্দে তিনি জনে জনে দান করতে লাগলেন।

রানি কৈকেয়ীর এক দাসি ছিল, মন্থরা। এই দাসিটির পিঠে কুঁজ ছিল বলে সবাই তাকে মন্থরার বদলে কুঁজি বলে ডাকত। এই দাসিটি দেখতে যেমন কদাকার তার মনটাও ততোধিক কুটিল। কিন্তু কেউ মন্থরাকে ঘাটাত না কারণ কৈকেয়ী এই দাসিটিকে তাঁর বাপের বাড়ি থেকে এনেছিলেন।
মন্থরার এই সব দেখে আর সহ্য হলো না। সে কৈকেয়ীর কানের পাশে তোতা পাখির মত অনবরত বকে যেতে লাগল, যেন রামের বদলে কৈকেয়ীর সন্তান ভরতকে রাজা করা হয়। মন্থরা কৈকেয়ীকে বুদ্ধিও শিখিয়ে দিল।

'দন্ডকবন'-এর ভেতরে বৈজয়ন্ত নগরে এক ভয়ংকর সম্বর নামের অসুর ছিল, দেবতাদের সঙ্গে সম্বরের ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে দশরথ দেবতাদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন এবং আহত হলে কৈকেয়ী সেবা করে দশরথকে বাঁচিয়েছিলেন। দশরথ খুশি হয়ে কৈকেয়ীকে দুইটা বর দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তখন কৈকেয়ী বলেছিলেন, আচ্ছা, যখন প্রয়োজন হয় তখন চেয়ে নেব।
মন্থরা শিখিয়ে দিলেন, সেই বরটা এখন চাওয়ার জন্য।

দশরথ অন্দরমহলে এলে মন্থরার শিখিয়ে দেয়া কথায় কৈকেয়ী দশরথকে প্রতিজ্ঞা করার জন্য বললে, দশরথ বলেন, 'এই পৃথিবীতে রামের মত আর কাউকে আমি ভালবাসি না। সেই রামের নামে শপথ করে বলছি, তুমি যা চাইবে তাই দেব'।
কৈকেয়ী ভাল করেই জানেন, রাজা একবার কথা দিলে তা আর ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। কৈকেয়ী তখন তার পাওনা বরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, 'রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য সন্ন্যাসী সাজে দন্ডক বনে পাঠাতে হবে এবং ভরতকে রাজা করতে হবে'।
কৈকেয়ীর এই কথা শুনে রাজা দশরথ জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি বিলাপ করতে লাগলেন, 'কৈকেয়ী তোমার পায়ে পড়ি, এই বর আমার কাছে চেয়ো না। রাম তোমার যেমন সেবা করে তেমনটা ভরতও করে না। এটা অন্যায়, ঘোর অন্যায়'। 
কৈকেয়ী তার সিদ্ধান্তে অনঢ়। তখন দশরথ কাতর হয়ে বলতে লাগলেন, 'কৈকেয়ী আমার বয়স হয়েছে আর ক-দিনই বা বাঁচব। আমাকে দয়া করো। আমার যার আছে সব নিয়ে যাও কিন্তু আমাকে এই মহা অন্যায় করতে বলো না'।
কৈকেয়ী তার সিদ্ধান্তে অবিচল। দশরথ ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারাতে লাগলেন। তিনি এই ঘোর অন্যায় সহ্য করতে পারছিলেন না। কিন্তু কৈকেয়ীর দয়া হলো না। তিনি বললেন, 'মহারাজ, একবার বর দিয়ে আবার কান্নাকাটি করছ; লোকে শুনলে হাসবে। আমি আমার পাওনা বর ছাড়ব না। তুমি রামকে রাজা করলে আমি বিষ খেয়ে মরব'।
অসহায় দশরথ রাতভর বিলাপ করতে লাগলেন কিন্তু কৈকেয়ী তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

সকালে দশরথ নিতান্ত বাধ্য হয়ে রামকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু অতি বেদনায় দশরথের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। যা বলার কৈকেয়ীই বললেন, 'রাম, মহারাজ আমাকে দুইটা বর দিয়েছিলেন, সেই বর আমি এখন চেয়ে নিয়েছি। একটা বর হলো তুমি মাথায় জটা নিয়ে গাছের ছাল পরে চৌদ্দ বছরের জন্য দন্ডক বনে যাবে, আরেকটা বর হচ্ছে ভরতকে রাজা করা হবে'। 
রাম একটুও দুঃখিত না হয়ে বললেন, 'তাই হবে। বাবা যা বলবেন তাই হবে। তাঁর উপর কোন কথা নাই। আমি আজই বনে চলে যাব'।

সব শুনে রামের মাতা কৌশল্যা তীব্র বেদনায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। লক্ষ্ণণও কিছুতেই এই অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলেন না। রাম না থামালে তাঁকে কেউ থামাতে পারত না।
রামকে অনেক বেগ পেতে হলো লক্ষ্ণণ এবং কৌশল্যাকে প্রবোধ দিতে। কিন্তু সীতা এবং লক্ষ্ণণকে তাঁর সাথে বনে যাওয়াটা আটকাতে পারলেন না।

রাম তাঁর সব কিছু বিলিয়ে দিলেন। একটা নমুনা এমন: ত্রিজট নামে এক ব্রাক্ষণ ছিলেন। ত্রিজট রামের দানের কথা শুনে এসে হাজির হলেন। রাম তাঁকে দেখে হেসে বললেন, 'ঠাকুর, আপনি এই লাঠিটা যতদূর ছুঁড়ে ফেলতে পারবেন ততদূর পর্যন্ত আমার যত গরু আছে তা সব আপনার।
ত্রিজট বামুনের গায়ে জোরের অভাব ছিল না। তিনি কোমর কষে হেইয়ো বলে লাঠিটা সরযু পার করে দিলেন। এ পর্যন্ত গুণে দেখা গেল রামের এক লক্ষ গরু আছে। রাম সেই এক লক্ষ গরুর সঙ্গে উপরি হিসাবে আরও সম্পদ দিলেন।
সব বিলিয়ে রাম, লক্ষ্ণণ, সীতাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। সবাই বিলাপ করে বলতে লাগল, দশরথ নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছেন নইলে এমন অন্যায় করেন কেমন করে? এই অনাচারের দেশে আমরা থাকব না, রামের সঙ্গে চলে যাব। থাকুক কৈকেয়ী তার ছেলে ভরতকে নিয়ে।
রাম সবাইকে হাতজোড় করে নিষেধ করলেন। কে শোনে কার কথা, সবাই রামের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। রথ চলা শুরু করলে সবাই পাগলের মতো রথের সঙ্গে ছুটতে আরম্ভ করল, বুড়া, যুবা কেউ বাকি রইল না। রথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন আর পারা যাচ্ছিল না তখন তাঁরা রথ-চালক সুমন্ত্রকে বলতে লাগলেন, 'ও সুমন্ত্র, একটু আস্তে যাও না, বাবা। আমরা যে আর পারি না'।

রাম সহ্য করতে পারছিলেন না কারণ রথের পেছন পেছন রাজা দশরথ, রানিরা (কৈকেয়ী ব্যতীত) পর্যন্ত ছুটে আসছেন। রাম অস্থির হয়ে সুমন্ত্রকে বলতে লাগলেন, 'জোরে চালাও, আরও জোরে'।
এদিকে দশরথ কাতর হয়ে বলছেন, 'রথ থামাও'।
সুমন্ত্র যখন দেখলেন রামের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তখন তিনি রথের গতি বাড়িয়ে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলেন। রথ বিকেলে শৃঙ্গব নগরে থামল। সুমন্ত্রকে জোর করে ফিরিয়ে রাম, লক্ষ্ণণ, সীতা গঙ্গা পার হলেন।

রাজা দশরথ তীব্র ঘৃণায় কৈকেয়ীর ওখানে না গিয়ে কৌশল্যার ওখানে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন তিনি আর অধিক কাল বেঁচে থাকবেন না। তাঁর মনে পড়ল, তাঁর যখন বয়স অল্প ছিল তখন একবার অন্ধকার রাতে হাতি মনে করে অন্ধ মুনির ছেলেকে তীর দিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। ছেলে শোকে সেই অন্ধ মুনিও মারা যান কিন্তু মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি দশরথকে অভিশাপ দিয়ে যান, তুমিও এমন করে পুত্র শোকে মারা যাবে।
রামকে বনে পাঠাবার পর ছয়দিন মাত্র দশরথ বেঁচে ছিলেন।

যে ভরতের জন্য কৈকেয়ী এমনটা করেছিলেন, সেই ভরত যখন এসে এই কান্ড শুনলেন তখন প্রচন্ড ক্রোধে তাঁর মাকে বললেন, 'তুমি আমার মা না-হলে তোমাকে আমি মেরে ফেলতাম। দাদা, তোমাকে এত মান্য না-করলে আমি তোমাকে এখনই তাড়িয়ে দিতাম। তোমার মত দুষ্ট স্ত্রীলোক এই পৃথিবীতে আর নাই। তুমি আগুনে পুড়ে মরো, নাহয় গলায় দড়ি দিয়ে মরো। ইচ্ছা হলে বনে চলে যাও'।
ভরত সবাইকে ডেকে বললেন, 'দাদার রাজ্য আমি চাই না। আমি তাঁকে ফিরিয়ে আনব'।
ভরত অনেক ক্লেশ স্বীকার করে রামকে খুঁজে বের করলেন। কিন্তু রামকে কোন ভাবেই টলাতে পারলেন না। রামের এক কথা, তাঁর পিতাকে দেয়া কথা থেকে তিনি সরে আসতে পারেন না।

অবশেষে কোন উপায় না দেখে ভরত বললেন, 'দাদা, তাহলে তোমার পায়ের খড়ম দুখানা খুলে দাও। এখন হতে এই খড়মই রাজা। আমরা এর চাকর। তোমার এই খড়ম নিয়ে আমি চৌদ্দ বছর গাছের ছাল পরে, ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করব এবং তোমার অপেক্ষা করব। চৌদ্দ বছর পর তুমি যদি ফিরে না আসো তাহলে কিন্তু আমি আগুনে ঝাপ দেব'।
হাতির পিঠে করে ভরত খড়ম নিয়ে এলেন। অযোধ্যার কাছে নন্দীগ্রামে খড়মকে সিংহাসনের উপর রেখে নিজে গাছের ছাল পরিধান করে, খড়মের উপর ছাতা ধরে, চামরের বাতাস করে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। কিন্তু কোন কাজ আরম্ভ করার পূর্বে খড়মের কাছে না বলে হাত দিতেন না। 

('অযোধ্যাকান্ড'। এই পর্বে রামকে আমরা দেখতে পাই অসাধারণ একটা চরিত্র হিসাবে। রামের তুলনা রাম নিজেই- এ অভূতপূর্ব! 
কৈকেয়ী এবং মন্থরার কথা বাদ দিলে আরও অনেক চরিত্রকে আমরা দেখতে পাই অসাধারণ চরিত্র হিসাবে যেখানে একজন অন্যজনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।) 

*সংক্ষেপিত
**ঋণ:
The RAMAYAN of VALMIKI: Ralph T. H. Griffith
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী 

সহায়ক লিংক:
১. আদিকান্ড: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_07.html

2 comments:

সুব্রত said...

'রামায়ণবিষবৃক্ষম' নামে একটা বই পড়েছিলাম অনেক দিন আগে, যেখানে রামের নীচতার ভূরিভূরি উদাহরণ দেয়া হয়েছে। আমারও রামকে শোম্যান ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না, যাঁর কেবল ওপরটাই চকচকে; বরং রাবণের ক্যারেক্টার অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

Unknown said...

সুব্রতদা, আপনি কি বইটার লেখক ও প্রকাশকের নাম দিতে পারবেন? Plz contact me at nka.oseem@facebook.com