Search

Wednesday, November 18, 2009

বিশ্বাসঘাতক!

অনেক অন্যায় মৃত্যুর বিচার হয়নি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও অনেক অন্যায় মৃত্যু হয়েছে, অন্যায়কারীরা এই ভুবন ত্যাগ করে অন্য ভুবনে যাত্রা করেছেন আইন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি! কিন্তু রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না, ছাপ থেকেই যায়!

মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনলেই আমরা হাঁ হয়ে থাকি। তিনি কলকাতায় 
'মজমাস্তি'-রঙ্গ করেছেন নাকি যুদ্ধ সে খবর কে রাখে!  আসল মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ঠেলা চালান, কেউ-বা চার দোকান চালাতে চালাতে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আমরা গোল হয়ে তামাশা দেখি, কী-বোর্ডে ঝড় তুলি! মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ক্রমশ পরিণত হয় বিক্রয়যোগ্য পণ্যে

আবার রাজাকারের কথা শুনলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি- সত্যতার লেশ আছে কি নাই, কোন পরিস্থিতিতে মানুষটা এ পথ মাড়িয়েছে সে খবর রাখার অবকাশ কই! ইচ্ছা হলো ফট করে একজনকে রাজাকার বলে দিলাম, বয়স বিবেচ্য না! আফসোস, প্রকৃত রাজাকাররা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাকিস্তানিদের কেউ-কেউ অন্তত তাদের ভুল স্বীকার করেছেন কিন্তু এরা মরে যাবে কিন্তু ভুল স্বীকার করবে না! 
কারও কারও অন্যায় আছে যা ক্ষমার অযোগ্য- এরা ঠান্ডা মাথায় খুব কাছ থেকে ছুঁরি চালিয়েছেন! গভীর বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছেন এমনই একজন মানুষ মওলানা আব্দুল মান্নান ডাক্তার আলীম চৌধুরী তাকে বিশ্বাস করে আশ্রয় দিয়েছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন কিন্তু এই মানুষটাই তার আশ্রয়দাতার সঙ্গে ছল করে প্রাণনাশে জড়িয়ে পড়েছিলেন মানুষটা বিশ্বাসঘাতক

মওলানা মান্নান, আমি জানি না আপনি ওখানে কেমন সমাদরে আছেন। কিন্তু আপনি যে ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে মওলানা টাইটেল লাগিয়েছেন, আমাদের বোকা বানিয়েছেন সেই ধর্ম কি বলে বিশ্বাসঘাতক সম্বন্ধে?
"...নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে ভালবাসেন না।"
(৪ সুরা নিসা: ১০৫-১০৭)

"...তিনি (আল্লাহ) কোনো বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞকে ভালোবাসেন না।"
(২২ সুরা হজ: ৩৮)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, অষ্টম খন্ড, (পৃ: ৬২৫-৬২৬) থেকে জানা যায়: "২৯ নম্বর পুরানা পল্টনের দোতলায় থাকতেন মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার আলীম চৌধুরীতার নীচের তলায় থাকতেন মওলানা আব্দুল মান্নান, নীচের তলায় আগে ডাক্তার আলীমের ক্লিনিক ছিলকিন্তু মাওলানা সাহেব একবার বিপদে পড়ে প্রাক্তন স্পীকার .টি.এম.মতিনকে ধরে বসেন আশ্রয়ের জন্যেমতিন সাহেব আলীম সাহেবকে বললেন, 'ডাক্তার চৌধুরী, ক্লিনিক উঠিয়ে মওলানাকে আশ্রয় দিন'
-->
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তখন ভারতীয় বিমান হরোদমে বোমা বর্ষণ করছেকার্ফু চলছেশুধু সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কার্ফু ওঠান হল আলীম চৌধুরী ভাবছিলেন, ফাঁকে একবার অন্য কোন জায়গায় আশ্রয় নেয়া যায় কিনা দেখে আসবেন এবং একবার হাসপাতালটাও ঘুরে আসবেন
তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল না তখন তিনি বের হনআলীম চৌধুরী বেরুবেনইস্ত্রীকে বললেন, 'আমাকে তো একবার হাসপাতালে যেতেই হবেডাক্তার মানুষ আমি যদি না যাই তো কে যাবে'? তারপর বললেন, 'আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি ফিরবোতুমি তৈরী থেকোআমি ফিরলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো'।
আলীম চৌধুরীর স্ত্রী বললেন, 'তুমি ঠিক ফিরবে, তাহলেই হয়েছেতুমি কার্ফুর সময় পার করে দিয়ে আসবে আর আমাদেরও যাওয়া হবে'!
আলীম চৌধুরী স্ত্রীকে বারবার কথা দিলেন যে কার্ফুর অনেক আগেই তিনি ফিরবেনতারপর কোরোসিনের একটি টিন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেনবাসায় তখন কেরোসিনের অভাব
গাড়ি করে হাসপাতালে গেলেন ডাঃ চৌধুরীহাসপাতালে তার সহকর্মীরা তো তাঁকে দেখে অবাকএই দুর্যোগ আর উনি কিনা এসেছেন হাসপাতালে
...বাসায় ফিরলেনস্ত্রী সাথে সাথে ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, 'কি বলেছিলাম, কার্ফু পার করে দিয়েই তো ফিরলে'।
তিনি বললেন, 'ঠিক আছে ঠিক আছেকাল একেবারে সক্কালেই চলে যাবো'।
...একটা মাইক্রোবাস এসে থামল বাসার নীচে... এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো ...তিনি নীচে নামার উদ্যোগ নিলেন 
ডা. চৌধুরীর মা তখন বলে উঠলেন, 'আরে কোথায় যাচ্ছো'?
তিনি বললেন, 'নীচে, মওলানার কাছেমওলানা বলছিল, ধরনের কোন ব্যাপার ঘটলে যেন তাকে খবর দেয়া হয়'।
নীচে নেমে তিনি মওলানার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেনএমনিতে মওলানার দরজা সব সময় খোলা থাকতোকিন্তু সেদিন দরজা বন্ধএদিকে ডা. চৌধুরী দরজা ধাক্কাচ্ছেন, চীৎকার করে মওলানাকে দরজা খুলতে বলছেনকিন্তু মওলানার কোন সাড়াশব্দ নেইখানিক পর মওলানা ভিতর থেকে বললেন, 'ভয় পাবেন নাআপনি যানআমি আছি'।
তিনি ের উপরে উঠার জন্য পা বাড়ালেন এমন সময় আলবদরের আদেশ, 'হ্যান্ডস আপ, আমাদের সাথে এবার চলুন'
'কি ব্যাপার কোথায় যাবো'?, প্রশ্ন করলেন ডাঃ চৌধুরী
'আমাদের সাথে চলুন'।
'প্যান্টটা পরে আসি'।
'কোন দরকার নেই'
আলবদররা তাঁকে ঘিরে ধরলোআস্তে আস্তে তিনি মাইক্রোবাসের দিকে অগ্রসর হলেন।"
(সেই শেষ যাওয়া। সাইবেরিয়ার পাখিরা ফিরে আসে কিন্তু এই মানুষটা আর কোনদিন ফেরেননি!)
*স্কেচ-স্বত্ব: সংরক্ষিত


No comments: