Search

Thursday, October 1, 2009

ছোট-ছোট সুখ, সারায় অসুখ...

অখ্যাত হয়েও আমার কুখ্যাত স্মরণশক্তির জন্য আমি বিখ্যাত। বাচ্চাদের বয়স, আমার অতি প্রিয়মানুষের জন্মদিন, তৎসঙ্গে নিজের অনুষ্ঠানও মনে রাখতে পারি না। অন্যের হাসাহাসি, আমার যায় প্রাণ! এই নিয়ে কম হেনেস্তাও হতে হয়নি আমায়। এও সত্য, খানিকটা হৃদয়হীন হলে এরা কবেই আমাকে ছেড়ে যেতেন এতে সন্দেহ নাই।
কেউ যখন আমার বাচ্চাদের বয়স জিজ্ঞেস করেন, বিরক্তিতে আমি বিড়বিড় করি, পৃথিবীতে এতো প্রসঙ্গ থাকতে এদের বয়স আবার কেন বাপু! আমি আকাশ-পাতাল হাতড়ে বেড়াই, দু-বাচ্চার বয়সের ফারাকটা দিয়ে প্রকৃত বয়সটা বের করার চেষ্টা করি। কাছাকাছি একটা ধারণা দাঁড় করিয়ে আরামের শ্বাস ফেলে যখন বলতে যাই ততক্ষণে প্রশ্নকর্তা অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।

সমস্যাটা হয়ে যায় বাচ্চাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে। এটা নাকি ­ডাক্তার সাহেবদের জন্য জানাটা অতি জরুরি! আরে বাপু, ওষুধের সঙ্গে বয়সের সম্পর্ক কী- কে জানে, এঁরা বলেন বয়স দিয়ে ওষুধের মাত্রার হিসাব বের করতে হয়। কে জানে, হবে হয়তো বা! তো, ডাক্তারের কাছে গেলেও আমার বিখ্যাত হিসাব মিলিয়ে ওদের বয়স বের করার চেষ্টা করি। ডাক্তার সাহেবের এতো সময় কই, তাগাদার উপর তাগাদা দিতে থাকেন।

আমি চিঁ চিঁ করে বলি, সম্ভবত এর বয়স এতো।
আমি বলার পরই বড়টা নিজেই বলে দেয় ওর বয়স কত, ছোটটা পারে না। ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন, 'আপনি বাবা হিসাবে বড়ো ক্যালাস তো, একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে...', ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাচ্চাদের চোখ এড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে শলা করি, বাচ্চাদের কী ঘুষ দিলে এরা এটা নিয়ে বাসায় আলোচনা করবে না। লাভ হয় না, আম ছালা দুইই যায়! এরা আমার পয়সায় কিনে দেয়া চকলেটের রসে মুখ মাখামাখি করে রসিয়ে রসিয়ে বলতে থাকে, 'মা জানো, আজ না ডাক্তার আঙ্কেল বাবাকে আচ্ছা করে বকা দিয়েছে। কেন জানো...হি হি হি'।
আমি রাগে চিড়বিড় করে বাচ্চাদের বলি, 'এখন থেকে যার যার বয়স নিজেরাই মনে রাখবা। এটা লাস্ট ওয়ানিং'। বাচ্চারা সুবোধ বাচ্চাদের মত মাথা দোলায়। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এরা আবারও আমাকে অপদস্ত করে, মজা করে দু-গালে চকলেট নিয়ে...।


স্মরণশক্তি নিয়ে তবলার ঠুকঠাক যে কারণে: সেই কবে অন্য কোথাও অসাধারণ এই গল্পটা পড়েছিলাম:
"...লাফ দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বাবা বললেন,‘‘দাঁড়া, আমার পায়ের জুতাগুলো একেবারে নতুন, ভেবেছিলাম কমসেকম দশবছর পরবো,’’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন,‘‘দেখিস তুই এগুলো আবার পরিস না যেন, মরা মানুষের জুতা পরতে নেই। তুই জুতাজোড়া বেচে দিস কারো কাছে।’’ জুতাজোড়া খুলে গাড়ির ভেতরে ছুঁড়ে মারলেন বাবা। তারপর লাফ দিয়ে পড়লেন গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ুতে থাকা নেকড়েগুলোর একেবারে মাঝখানে...।
(মূল অনুবাদ এখানে: নেকড়ে)।

যথারীতি আমার কুখ্যাত মস্তিষ্ক লেখকের নাম, অনুবাদকের নাম ভুলে গেল কেবল মাথায় ঘুরপাক খায় এটা; বাবার জুতা ছুড়ে দেয়ার বিষয়টা। তুচ্ছসব বিষয়ে মানুষের অতৃপ্তি থেকে যায়- আহা, ওইটা যদি আবার খেতে পারতাম, ওই পোশাকটা পরতে পারতাম। আহা, ওই লেখাটা পড়তে পারতাম! হায়রে, আমাদের এইসব ছোট-ছোট সুখ...এইসবের স্মৃতিই সম্ভবত আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
গল্পটা আবারও পড়লাম মোসতাকিম রাহীর কল্যাণে। প্রায় অদেখা ছোট্ট সুখটার জন্য তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ। ভুবনেশ্বর প্রসাদ। এমন একজন লেখকের নাম ভুলে যাওয়ার জন্য কেউ আমায় চাবুক মারলে টুঁ-শব্দ করারও উপায় নেই! তাঁর অসাধারণ গল্প ভেড়িয়া-নেকড়ে। কিছু লেখা পড়ে বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসে। কেন-কেন-কেন, কেন একজন এমন অসাধারণ লেখা লেখবে? ছোটলোকের মত ঈর্ষা করতে ইচ্ছা করে, ওই মানুষটার মধ্যে কী আছে যা আমার নাই? পশু-দস্যুর মত ভাবনা খেলা করে, মানুষটা হাত কেটে সোনা দিয়ে বাঁধাই করে সযতনে রেখে দেই!


আফসোস, সাহিত্য বলতে আমরা বুঝি ইংরাজী সাহিত্য- সব এরা গুলে খেয়ে বসে আছেন। অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে মনে হয়েছে, কি আছে এই লেখায়, কেন এটা আমাকে পড়তে হবে? না-পড়লে শেষ নি:শ্বাস আটকে থাকবে বলে তো আমার মনে হয় না। এইসব আংরেজি সাহিত্যিক মহাশয়গণ ভুবনেশ্বর প্রসাদের মত লেখকদের লেখা পড়তে পারেন না। আফসোস, বড়ই আফসোস! জনান্তিকে বলি, 'শের কে খালমে ভেড়িয়া'।
ভেড়িয়া গল্পটায়, একজন মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে এমন বৈষয়িক-নগ্ন সত্যের মুখোমুখি হয়! মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আমি আজ খানিকটা বুঝতে পারি। হাম হেন কাভি নেহি কারেঙ্গা, হাম তেন কাভি নাহি কারেঙ্গা, এইসব যারা বুক চিতিয়ে বলেন; সময়ে, পেছনটা চুপসে অবলীলায় কাজটা করবেন।

সময়ের দাবীর চেয়ে নির্মম আর কিছু নাই!
"পানিতে আটকে পড়া মা এবং তার সন্তান। মার তার সন্তানকে রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। ক্রমশ পানি বাড়ে। মা তার শিশুটিকে দু-হাতে উপরে তুলে ধরেন। একসময় পানি বেড়ে মা-র শ্বাস আটকে দমবন্ধ হয়ে আসে। আর খানিকটা উচু হলেই প্রাণ বাঁচে।মা তার সন্তানের উপর দাঁড়িয়ে উঁচু হয়ে..."। সময়ের মত বদমাশ কেউ নাই। সময় আমাদের নিয়ে কী খেলা খেলবে এটা আগাম জানার কোন উপায় নাই! হায় সময়...।

3 comments:

মোসতাকিম রাহী said...

শুভ ভাই, মূল গল্পটার শিরোনাম 'ভেড়িয়ে', ভেড়িয়া নয়। ভুবনেশ্বর বহুবচন ব্যবহার করেছিলেন, অনুবাদে আমি 'নেকড়ে' ব্যবহার করেছি।

ভুবনেশ্বরের আর কোনো গল্প কি আপনার পড়া আছে? কিংবা তাঁর কোনো বই কি আপনার সংগ্রহে আছে?
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মানুষটা এখন বিস্মৃত! অনলাইনে হিন্দি সাইটগুলোতে অগাবগা সাহিত্যিকদের লেখা আছে, কিন্তু এই শক্তিধর লেখকের কোনো লেখা আমি পাইনি। রাতদিন খুঁজেছি, প্রায় পাগলের মতো হয়ে ইন্ডিয়ান বন্ধুদের অনুরোধ করেছি্ ভুবনেশ্বরর বই পাঠানোর জন্যে। কোনো সাড়া পাই নি!
এই বহু আলোচিত, সমালোচিত, অসাধারণ গল্পটি আমি পাই হিন্দি মাসিক "কাদম্বিনী"তে।যতোদূর মনে পড়ে ২০০৫ এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। এরপর গল্পটি অনুবাদ করে পাঠাই "দৈনিক সমকালের" সাহিত্য সাময়িকী "কালের খেয়া"তে। কালের খেয়ার "অন্যভাষার গল্প" বিভাগটি যাত্রা শুরু এই গল্প দিয়ে।

হাজার চেষ্টা করেও এরপর ভুবনেশ্বরের আর কোনো লেখা আমি সংগ্রহ করতে পারি নি। পরিচিত প্রায় সব ইন্ডিয়ানকেই জিজ্ঞেস করেছি, কেউ শুনে নি এই মানুষটার নাম!
হায়!!! করুণা! করুণা! তোমাদের জন্যে!

এই মন্তব্যের মাধ্যমে আলী মাহমদের সকল পাঠকের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ: ভুবনেশ্বরের কোনো লেখা,গল্প-কবিতা কিংবা নাটক, যদি থাকে; দয়া করে শুভ ভাইয়ের কাছে কিংবা আমার কাছে পাঠালে অশেষ কৃতজ্ঞ রইবো!
mustakim78@gmail.clom

মোসতাকিম রাহী said...
This comment has been removed by a blog administrator.
আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

রাহী,
"...মূল গল্পটার শিরোনাম 'ভেড়িয়ে', ভেড়িয়া নয়। ভুবনেশ্বর বহুবচন ব্যবহার করেছিলেন...।"
আমি লজ্জিত!
আপনি ঠিকই বলেছেন বহুবচনে 'ভেড়িয়ে'-ই হবে। ধন্যবাদ ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য।

"আলী মাহমেদের সকল পাঠকের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ..."
আমার আবার পাঠক! মোসতাকিম রাহী, মোরসালিন রাহী এই দু-জনকে জানি, আরেকজনকে জানি সে আমি নিজে। হা হা হা।