Search

Wednesday, November 21, 2007

সঞ্জীব চৌধুরী, একজন লেখক বানাবার মেশিন!


সঞ্জীব চৌধুরী।

সঞ্জীব চৌধুরীকে কেউ বলেন গায়ক, কেউ বলেন লেখক, কেউ বা বলেন পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক- আমি বলি, লেখক বানাবার মেশিন!
এঁরা নিজেরা কতটা লেখালেখি করেন, লেখার মান কেমন এসব কুতর্কে আমি যাবো না। অল্প কথায় বলব, আমাদের দেশে এমন লেখক বানাবার মেশিনের বড়ো প্রয়োজন। আফসোস, এদেশে লেখক বানাবার মেশিনের বড্ডো আকাল!

আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, এ দেশে টানা ২২ দিন পরিবহন ধর্মঘট ছিল। সব ধরনের মুভমেন্ট বন্ধ! কল্পনা করুন, এক দুই দিন না, ২২ দিন! মধ্যে শুধু একদিন ২৬ শে মার্চ ধর্মঘটের আওতার বাইরে ছিল। রপ্তানীযোগ্য চিংড়ি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল, গার্মেন্টেসের মেশিনে এক ইঞ্চি সুতা খরচ হয়নি, একের পর এক রপ্তানীর অর্ডার বাতিল। গোটা দেশ অচল। কেউ টুঁ-শব্দও করছেন না, গণতন্ত্রের জন্য এর নাকি প্রয়োজন আছে। হায় গণতন্ত্র, হায়!

এ দেশের সেরা সন্তানরা হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে ছিলেন, যেন বৃষ্টির মতো সমাধান ঝরে পড়বে! আর আমার মতো নপুংসকের তো করার কিছু ছিল না। তিন টাকা দামের কলমবাজ, এই-ই তো লোটাকম্বল!

`পরিবহন ধর্মঘট' নামে একটা লেখা লিখে 'ভোরের কাগজ'-এ পাঠিয়েছিলাম। তখন প্রথম আলোর জন্ম হয়নি। সম্পাদক মতিউর রহমান। ভোরের কাগজে কি বিচিত্র কারণে এই লেখাটা ছাপা হয়েছিল জানি না। অনুমান করি, এর পেছনে নিশ্চিত সঞ্জীব চৌধুরীর হাত ছিল, নইলে মুক্তচিন্তার দৈনিক আমার মতো অগাবগার লেখা ছাপাবে কেন!
তখনও আমি মানুষটাকে চিনি না।
ক-দিন বাদে কোন এক কাজে ওই পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্ভবত কারও খোঁজে! কোত্থেকে এসেছি শুনে আড্ডা ছেড়ে ঝাকড়া চুলের, টিংটিং, হাসিমুখের যে মানুষটা এগিয়ে এলেন তিনিই সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব দা।

তিনি এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন, 'আচ্ছা, আপনিই কি ওই লেখাটা পাঠিয়েছিলেন? আরে বসেন-বসেন। বেশ আড্ডা দেয়া যাবে'।
আমি মনে মনে বললাম, বাহ বেশ তো, আমি দেখি বেশ আড্ডাবাজ টাইপের লোক! আমার মত একজন লোক যার সঙ্গে নিজের মানুষরাই অল্পক্ষণেই বিরক্ত হয়ে উঠে অথচ এই মানুষটা আমার সঙ্গে আড্ডা দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।
মানুষটা চা-সিগারেট আনালেন। আমি চুকচুক করে চা খাই, আয়েস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ি। অ্যাসট্রে নাই। সিগারেটের ছাই কোথায় ফেলব বললে তিনি হা হা করে হেসে বললেন, গোটা ফ্লোরটাই অ্যাসট্রে। ফেলে দেন যেখানে খুশি।
তিনি বললেন, 'এ ধরনের লেখা আরো লিখেন, আমি ছাপাবো'।
আমি বিনীতভাবে বলেছিলাম, 'আসলে আমি তো ঠিক এ ধরনের লেখা লিখি না, আমি অপন্যাস লেখার অপচেষ্টা করি'।
তিনি টেবিলে আঙ্গুল ঠুকে বললেন, 'আপনি আপনার মতো করে যে প্রসঙ্গ নিয়ে ভালো লাগে লেখেন, সমস্যা নাই'।
আমার এই স্বাধীনতাটা ভাল লাগল। পরে কখনই তিনি বিষয় নির্দিষ্ট করে দিতেন না এবং লেখা কাটাছেঁড়া করতেন না। কদাচিৎ কোন প্রসঙ্গ গুরুতর সমস্যা মনে হলে অমায়িক ভঙ্গিতে বলতেন, আচ্ছা এই জায়গাটায় কি এভাবে করা যায়? মানুষটার এইসব সহৃদয়তার কথা আমি ভুলব না।

পরেও যখন বিভিন্ন সময় গিয়েছি, কখনো শত ব্যস্ততায়ও আমি তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি, সদা হাস্যময়। এই লেখা দেখছেন, এই গুনগুন করে গান গাইছেন, এই টেবিলে তবলা ঠুকছেন।
আমাকে যেটা আকৃষ্ট করত, তাঁর মধ্যে ভান জিনিসটার বড়ো অভাব; সহজিয়া একটা ভাব! অনেক সময় তুমুল আড্ডা ছেড়ে উঠে এসেছেন আমাকে সময় দেয়ার জন্য, অফিসের আঁতেল টাইপের অন্যদের কপালের ভাঁজ উপেক্ষা করে। আমি সলাজে বিব্রত হতাম।
আসলে ঢাকার নাগরিক মানুষদের আমার মত মফঃস্বলের মানুষদের প্রতি দারুণ অবজ্ঞা, সম্ভবত ভক করে আমার শরীর থেকে সরষে তেলের গন্ধ লাগত! এদের দোষ দেই না, এঁরা কী মননশীল মানুষ একেকজন, কপাকপ সাহিত্য চিবিয়ে খান! হাঁটেন পা ফাঁক করে। 

`একালের রুপকথা' নামে ওখানে প্রায় টানা দেড় বছর লিখলাম। উপভোগ্য একটা সময়- বিচিত্রসব বিষয় নিয়ে লেখা ফি হপ্তায়। একবার সঞ্জীব চৌধুরী নামের মানুষটা লজ্জায় নুয়ে পড়েছিলেন।
হয়েছিল এমন, এই দেড় বছরে সব লেখাই ছাপা হলো কেবল একটা লেখা আটকে দেয়া হলো। 'শিশু কাঠগড়ায় দাড়াও' নামের একটি লেখা। লেখাটার মূল উপজীব্য ছিল, ১৪ দিন বয়সী এক শিশুর, যার জানাজা পড়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, তার বাবা নামাজ পড়েন না এই অজুহাতে।
ঘটনাটা আমার নিজের চোখে দেখা। এটা নিয়েই লেখাটা লিখেছিলাম। সব লেখা ছাপা হলো কেবল হলো না এটা!

সঞ্জীব চৌধুরী নামের মানুষটা অসম্ভব বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, 'আপনার লেখাটা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে বলে লেখাটা ছাপানো যাচ্ছে না। সম্পাদকের আপত্তি আছে'।
আমি রাগ গোপন করে বলেছিলাম, 'এটা কি আপনিও বিশ্বাস করেন'?
তিনি কাতর হয়ে বললেন, 'না-না। অমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মতি ভাইকে বোঝাতে, লাভ হয়নি। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! আপনি সম্পাদকের সংগে দেখা করে কথা বলেন।

মতি ভাই নামের সম্পাদক মানুষটার সংগে দেখা করা বা কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমি এ দেশের এমন কোন 'কলমচী-কলমবাজ' না যে পাঠকরা হাঁ করে বসে থাকেন আমার লেখা পড়ার জন্য। এই সর্বনাশ থেকে বাঁচার জন্য সম্পাদকের সংগে দহরম-মহরম থাকাটা আবশ্যক! আমি সঞ্জীবদাকে কঠিন কিছু কথা বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, তাহলে ইনকিলাব পত্রিকা কী দোষ করল! কিন্তু সঞ্জীবদার বিমর্ষ মুখ দেখে কথাগুলো বলা হলো না। আমি মানুষটাকে বইয়ের খোলা পাতার মতো পড়তে পারছিলাম। চাকরির শেকলে বাঁধা একজন প্রবলপুরুষ!

এরিমধ্যে এই পত্রিকার ইন-হাউজে কি কি যেন ভজকট হল,  কেউ-কেউ কি-কি যেন কলকাঠিতে ঘুটা দিচ্ছিলেন। সঞ্জীব চৌধুরী আর ওই পাতার দায়িত্বে নাই। পরে এই পত্রিকা তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল। সত্যটা হচ্ছে কিছু চালবাজ মানুষ চাল করে এই পত্রিকা থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসব চালবাজ মানুষরাই আজ বেশ্যার মত নগ্ন ভঙ্গিতে, নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন নিজেরাই দেন, প্রথম মুদ্রণ শ্যাষ দ্বিতীয় মুদ্রণ চলিতেছে লিখে দেন। 
আমারও আর ওখানে লিখতে ইচ্ছা করল না, চালবাজদের সংগে তাল মেলাতে পারছিলাম না। এক চোট্টা-চালবাজ তো এই পত্রিকাতেই আমার একটা লেখার থিম অন্য নামে আমার অনুমতি ছাড়াই ছাপিয়ে দিলেন । আজ ওই চালবাজের নাম বললে অনেকে রে-রে করে তেড়ে আসবেন। ওই অন্ধকার দিক নিয়ে এখন আর বলতে ইচ্ছা করছে না।

বারবার যেটা বলতে ইচ্ছা করছে, সঞ্জীব চৌধুরী, এদেশে আপনার মত লেখক বানাবার মেশিনের বড্ডো আকাল! কাজটা আপনি ঠিক করলেন না! এভাবে চলে যাওয়া কোন কাজের কাজ না!

সহায়ক সূত্র:
১. পরিবহন ধর্মঘট: http://www.ali-mahmed.com/2010/09/blog-post_02.html 

7 comments:

আবদুল্লাহ আল মাহবুব said...
This comment has been removed by a blog administrator.
আবদুল্লাহ আল মাহবুব said...

আফসোস, এ রকম এক মানুষের সাথে আমার পরিচয়তো দূরের কথা দেখাও হলো না।
সারাটি জীবন শুধু মানুষ খুঁজে বেড়াই, বেশীরভাগ সময় শুধু পুতুলের সাথে পরিচয় হয় অথবা মুখোশের সাথে।
লেখাটি স্পর্শ করেছে অন্যরকম ভাবে।

নজমুল আলবাব said...

লোকটা বড় কস্ট দিয়ে গেল।

নিঘাত সুলতানা তিথি said...

অনেক দিন পর শুভর ব্লগিং পড়লাম। সেই ভালো লাগা, আর সাথে সঞ্জীব'দাকে নিয়ে কষ্ট মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো।

Anonymous said...

স্যরি, শুভ ভাই। "মিশন পসিবল" শব্দগুলো দেখে প্রায়ই ফিরে গেছি, ভেবেছি নতুন লেখা নেই। অন্য একটা লিংক থেকে এটা খুঁজে পেলাম। সঞ্জীব চৌধুরীর জন্য শ্রদ্ধা।

মুরাদুল ইসলাম said...

সঞ্জিব চৌধুরী সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

এই সব মানুষ অন্যায় করেন, দুম করে মরে গিয়ে...@মুরাদুল ইসলাম