Search

Monday, December 20, 2010

মাস্টার শিশু এবং মিস্টার পশু!

আমি আগেও কোথাও লিখেছিলাম, আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, পাশাপাশি, একটা শিশু এবং একটা পশু; এদের মধ্যে মারামারি লেগেই আছে, হরদম। কখন কে জেতে এটা আগাম বলা মুশকিল'।
এরা যে কেবল লুকিয়ে থাকে, সবিরাম মারামারি চালিয়ে যায় এমন না; পাশাপাশি বসবাস করলেও একজনের আছে অন্যজনের প্রতি সীমাহীন ঘৃণা! যুদ্ধটা অসম। মাস্টার শিশুর হাতে গুলতি, মিস্টার পশুর আছে মারণাস্ত্র লেজার গান। তবুও মাস্টার শিশুর লড়াই চালিয়ে যেতে অনীহা নেই।

এই মানুষটাকে সকালে স্টেশনে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাই এই আশায় কেউ-না-কেউ এর সমস্যাটা দেখবে নিশ্চয়ই। আহা, আমার ভেতরের মিস্টার পশু তার অস্ত্রটা ঠিক তাক করে রেখেছে যে!
আমি যখন ফিরে আসছি তখনও এই মানুষটাকে দেখি একই ভঙ্গিতে, নিশ্চল। আজকাল তেমন অবাক হই না তবুও একটা ধাক্কার মত খেলাম, একটা মানুষ পড়ে আছে শত-শত মানুষ এখান দিয়ে যাচ্ছে, এই নিয়ে কারও কোন বিকার নেই। স্টেশন কর্তৃপক্ষ এমনকি মিডিয়ার লোকজনেরও। এটা কি পত্রিকায় আসার মত কোন খবর না? এই মানুষটার জন্য অপেক্ষায় আছে এমন কোন মানুষ এই গ্রহে নাই? আমাদের দেশে একজন মানুষের হারিয়ে যাওয়া কত্তো সোজা। মরে গেলে অজ্ঞাত হিসাবে [১] মাটি চাপা দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে গেল।
আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও কোন সুরাহা হলো না, এ কখন থেকে এখানে পড়ে আছে এটাও কেউ জানে না। এদের ঠোঁট উল্টানো সাফ জবাব, 'নেশা-টেশা কইরা পইড়া আছে'। কিন্তু কাছ থেকে দেখে আমার মনে হলো সমস্যা অন্যত্র। এর শরীরের বেশ কিছু স্থানে চামড়া ছড়ে গেছে, রক্ত জমাট বেঁধে আছে। অনুমান করি, কেউ কিছু খাইয়ে টাকা-পয়সা সব লুটে নিয়েছে।

মনে মনে আমি নিজের উপর অনেকখানি বিরক্ত, কী যন্ত্রণা! আমার যে এখন হাবিজাবি দুনিয়ার কাজ, একে নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়? লম্বা লম্বা পা ফেলে এখান থেকে চলে গেলে বেশ হয়। অন্যরা যেমন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, দেখা শেষ হলে সটকে পড়ছে এমনটা করলে আমাকে আটকায় কোন শালা!
ওদিকে তুমুল মারপিট। মাস্টার শিশুটা কি কি করেছে, কোন প্যাচ খেলেছে আমি জানি না কিন্তু মিস্টার পশু উবু হয়ে মাটি পড়ে আছে। অবশ্য এটা ক্ষণিকের জন্য। মিস্টার পশু অবিলম্বে উঠে দাঁড়াবে এতে কোন সন্দেহ নেই। দাঁড়াবার আগেই কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। আমি একজনের সঙ্গে কথা বললে ওই মানুষটা ভাল একটা বুদ্ধি দেন, 'অন্য কেউ হাত দেবে না। এটা জিআরপি কেস। এক কাজ করেন, একজন জিআরপিকে সঙ্গে নিয়ে যান। ও দেখুক, সমস্যাটা কি'।

হাঁটতে হাঁটতে জিআরপি নামের মানুষটাকে আমি পটাতে থাকি, 'একটু দেখেন না কি করা যায়। এমন অবস্থা তো আপনার আমারও হতে পারে, পারে না? আপনার এই পোশাক খুলে ফেললে আপনাকে কে চিনবে। ধরেন, আপনি নোয়াখালি স্টেশনে পড়ে আছেন জিআরপি অফিসের সাথেই...হতে পারে না এমন'? জিআরপি মানুষটা মাথা ঝাঁকান, 'আলবত, হতে পারে'।
হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে তিনি দেখে নিশ্চিত হন, একে কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে। দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো আবশ্যক। 
এরিমধ্যে তিনি দুঃখের কাহিনীও বলেন। 'দেখেন, আমরা কাজ কিভাবে করব। এই যে হাসপাতালে পাঠাব, পাঠাতে যে খরচ এটা তো আর সরকার দেবে না। আপনিই বলেন'।
আমি হড়বড় করে বলি, 'আপনি হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। যা খরচ লাগে... আমি এর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি'।

যাই হোক, এই ব্যবস্থা করে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। পরে এই খোঁজও পাই একটা ভ্যান দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এই সময়টা পশুদের, পশুরাজত্ব। আমিও তো এই সময়ের একটা অংশ। আমার ভেতরের পশুটা বসে থাকবে বুঝি! হাসপাতালে গিয়ে আর খোঁজ নেয়া হয় না। এদিকে সারাটা দিনের কাজে-অকাজে আমার সূর্যটা উধাও।
অনেকে সূর্য ডুবলে বোতল-টোতল নিয়ে বসে যান, আবোল-তাবোল বকেন। আমিও বোতল টাইপের একটা জিনিস নিয়ে বসে যাই। চোখের সামনে নয় ইঞ্চি মনিটর- আবোল তাবোল লিখে যাই। এই সময়ে কেউ ফোন করলে পারতপক্ষে আমি ধরি না, এমনকি খেতে ডাকলেও আমি বিরক্ত হই। ছাতাফাতা লেখালেখি নামের আমার হাবিজাবি কর্মকান্ডের সুর কেটে যায় যে!
আজও একই রুটিন। কিন্তু মাস্টার শিশু কি চাল দেয় আমি জানি না, বিস্মিত আমি নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালে। মানুষটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। হাসপাতালের চিকিৎসা চলছে। অন্যভাবে খোঁজ নিয়ে যেটা জেনেছি, যথার্থ ওষুধপত্রও দেয়া হয়েছে। পুরোপুরি জ্ঞান ফিরতে সম্ভবত দু-দিন লাগবে। আপাতত আমার কিছু করার নাই।

দায়িত্বে থাকা লোকজনকে আমার ফোন নাম্বার দিয়েছে, এ সুস্থ হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে কারণ এর বাড়িতে ফেরার সময় টাকা-পয়সার প্রয়োজন হবে।
এটা বোঝার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার  প্রয়োজন নেই, এই মানুষটার নিশ্চয়ই একটা ছাদ আছে, সেই ছাদের নীচে পরিবার নামের কিছু লোকজন এর অপেক্ষায় আছেন। কে জানে, হয়তো এই মানুষটাই ওই পরিবার নামের বেশ কিছু লোকজনের একমাত্র ভরসাস্থল। বিস্তারিত মানুষটার জ্ঞান ফিরলে, সুস্থ হলে জানা যাবে।

এই যে ফোন নাম্বার দেয়া হলো আমার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করার জন্য, এর মানে হচ্ছে বাড়তি ঝামেলা। ফোন করলে আমাকে এই নিয়ে..। আসলে হাসপাতালে ফোন নাম্বার আমি দেইনি। এটা মাস্টার শিশুর কাজ। এই হারামজাদা বড়ো বিরক্ত করে। রাস্কেলটাকে খুঁজছি, পেলে এক থাপ্পড়ে এর কানপট্টি ফাটিয়ে ফেলব। শ্লা, বড়ো যন্ত্রণা করে...।

সহায়ক সূত্র:
১. অজ্ঞাত...: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_22.html        

6 comments:

Anonymous said...

ধন্যবাদ আপনাকে। "এই মানুষটার নিশ্চয়ই একটা ছাদ আছে, সেই ছাদের নীচে পরিবার নামের কিছু লোকজন এর অপেক্ষায় আছেন" - আশ্চর্য, অন্য কারোর অসহায়ত্ব অনুধাবন করার জন্য নিজের অসহায়ভাবটাও হয়তো কাজে লাগে। হয়তো তা দিয়েই হবে, কিন্তু কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখলে, আগেতো নিজেকে ও অবস্থায় কল্পনা করেই হোক, খারাপ লাগতো, আজ আমি বা আমরা সবাই এতটা নিস্পৃহ কি করে হয়ে উঠতে পেরেছি তা সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে। এখন অসহায়ত্বতো কমেনি, বরং অনেকখানি বেড়েছে। যখন বয়স একেবারে কম ছিল, হয়তো বিশ বছর আগে, মানুষ এতটা খারাপ ছিলনা, যেকোনো মানুষের মুখোমুখি হলেই সম্ভাব্য সংঘাতের প্রস্তুতি নিতে হতনা, মানুষ একে অপরকে এভাবে কামড়ানোর জন্য সবসময় দাঁত খিঁচোতনা, বেশ ইচ্ছে করে ও সময়টাতে কোনোভাবে ফিরে নিজেকে আটকে ফেলি ওই সময়ের মধ্যে। হতে পারে কম বুঝতাম বলেই এমন মনে হত, কিন্তু দরিদ্রতর হলেও আগেই ভাল ছিলাম, অনেক কম ভয়াবহ জগতে, বেশ অনেকটা শান্তি আর আশা নিয়ে থাকার সুযোগ ছিল। কেন জানি মনে হয় ওই সময়ে হলে রাস্তায় কেউ কোনোদিন পড়ে থাকলে, কেউ না কেউ এসে ঠিকই সাহায্য করত। আজ আপনি যেমন করলেন। আল্লাহ আপনার ভাল করবেন।

মুকুল said...

:-(

RIGAN said...

চমৎকার

Loginbd said...

Khub vhalo likhechen...Sotti e jodi manush take sahajjo kore thaken tobe apnak akta dhonnobad na dia r upay thak na.....

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

"...আজ আমি বা আমরা সবাই এতোটা নিস্পৃহ কি করে হয়ে উঠতে পেরেছি তা সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে..."
সত্যি বলতে কি এটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে! আমরা তো এতোটা নিস্পৃহ ছিলাম না। কখন থেকে আমাদের এই পরিবর্তনটা শুরু হলো? আমাদেরকে রোবট-মানব বানাবার পেছনে, এই পরিবর্তনের পেছনে ঠিক কো্ন বিষয়গুলো কাজ করছে এটা জানার বড়ো ইচ্ছা...। @Anonymous

:( @মুকুল

:) @Masum

"...Sotti e jodi manush take sahajjo kore thaken...
আরে নাহ, মিথ্যা-মিথ্যা-মিথ্যা, তিন মিথ্যা @Loginbd

Anonymous said...

কারণ একটা বলতে পারি এখনইঃ ভয়, ত্রাস। লোকটা যে পড়ে আছে, তুলে নিয়ে হাসপাতালে দিতে গেলেও যদি "কোনো কেসে পড়ে যাই" এই ভাবনাটা যে কোনো ভাল কাজ করতে বাধা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমনও তো হতে পারে আসলে মলম পার্টি, কাছে গেলেই, সর্বস্ব ছিনিয়েতো নেবেই, আবার চোখটাও কানা করে দিবে। এই ত্রাস একদিনে গড়ে ওঠেনি, দশকের পর দশক ধরে প্রতিরোধহীন অপরাধ ক্রমাগত প্রশ্রয় পেয়ে মানুষকে এরকম করে দিয়েছে। ইভ টিজিং করে যে সন্ত্রাসী তাকে যদি আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া হয় সমাজ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে, রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি, নিরাপত্তা বাহিনী থেকে যদি সে বেঁচে যেতে পারে, প্রশ্রয় পায়, তাহলে সবচেয়ে প্রথমে যে কর্তব্য মনে আসে, তা হল, মাথা নামিয়ে গর্তের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। ওই গর্ত খুঁজতে গিয়ে আসলে নিজেদের কবরই আমরা খুঁড়েছি এতদিন। আবার আমরা অনেকেই এমনিতেও খুব খারাপ, তাও একটা ব্যাপার। অবস্থা এত খারাপ কেন? সব মানুষ (যারা চলে ফিরে বেড়ায়) খারাপ বলে। সবাই কি করে একসাথে খারাপ হল? এর উত্তর জানিনা। যেমন জানিনা, কি করে ঘুষ বৈধ হল তার উত্তর। এবং এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর।