Search

Sunday, June 21, 2009

বাবা দিবসে তোমায় চুপিচুপি বলি...

বাবা দিবসে তোমায় বলি, দুম করে চলে যাওয়া কোন কাজের কাজ না, বুঝলে!
"একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করূণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।"
(জীবনানন্দ দাশ)
দেখলে, সবারই, গল্প-কবিতার লোকজনের কী ইচ্ছাই না করে ফিরে আসতে, করে না কেবল তোমার! কী, ঠিক বলিনি? কালেভদ্রেও ফিরে আসতে বাঁধে বুঝি তোমার?
আচ্ছা ফাদার, কাজটা কী ঠিক হচ্ছে? তোমার সন্তানের সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে বুকটা ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছে, তোমার কী উচিৎ না এসে কানটা আচ্ছা করে কষে মলে দেয়া? লেখালেখির নাম করে সে যে উচ্ছন্নে গেল, এটা তুমি দেখবে না? আশ্চর্য, তুমি একটা কেমন মানুষ! তুমি একটা...একটা পাগলু!

জানো, আজ আমার কেবল মনে হয় একটা বটবৃক্ষের কথা। আমি এই অভাবটা বুঝতে পারি হাড়ে হাড়ে। কেবল মনে হয়, একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ, বিছানায় পড়ে থাকলেও আমার নিরাশ্রয়ের ছাদের অভাব বোধ হতো না। জীবন যুদ্ধে পরাজিত একজন সৈনিকের মতো হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে যখন, তখন আমার কাছে তোমার খানিকটা স্পর্শ কতটা জরুরী এটা তুমি কখনই বুঝবে না, কক্ষনই না। আসলে এটা বোঝার ক্ষমতাই নাই তোমার!

তোমার আঙ্গুল ধরে ধরে কেবলি শিখছিলাম। এরিমধ্যে আঙ্গুল ছেড়ে দেয়াটা কোন ধরনের বিচার হলো? তোমার কী মনে হয়? ইশ, বিরাট একটা কাজ হয়েছে! তিনি একটা বিরাট কাজের লোক হয়েছেন!

তবে বিশ্বাস করো, তোমার শেখাবার পদ্ধতি আমায় বড্ডো টানত। তোমাকে যতটা না বাবারূপে মনে রাখব তারচে’ অনেক বেশি মনে রাখব শিক্ষকরূপে। জীবনটাকে চেনাতে, বন্ধুর মতো! কী অপরূপ সব কর্মকান্ড তোমার!
মুচির ছেলের সঙ্গে আমায় একসঙ্গে পড়তে হবে। বিশ্বাস করো, ওইসময়, প্রথমদিকে, এটা আমার ভালো লাগত না। বাবা, তোমার কানে-কানে বলি, কাউকে বলবে না কিন্তু, ওসময় ক্ষেপে গিয়ে তোমায় গালিও দিতাম। কেন রে বাপু, এই অনাচার আমার উপর চাপিয়ে দেয়া! কিন্তু তখন তোমার সাত্বিক ইচ্ছাই ছিল প্রধান।
অথচ দেখো দিকি কান্ড, আজ আমি কেমন সগর্বে বলতে পারি, আমার শৈশবের বন্ধু একজন মুচির সন্তান ছিল এতে আমার কোন লাজ নাই। আমার শৈশবের অনেকখানি আমার সেই বন্ধুর কাছে ঋণী। কেমন করে আমি তাঁর ঋণ শোধ করি? আসলে এইসব ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কই!

আজ আমায় অবিরাম যুঝতে হয় আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কু ও সু, পশু এবং শিশুটির সঙ্গে। এই দেখ না, আমি যে কালেভদ্রে পশুটাকে অনায়াসে পরাজিত করতে পারি, এটা কিন্তু তোমারই অবদান!
তবে, কালে কালে যন্ত্রমানব হওয়াটা যে অপরিহার্য ছিল- আজও আমি যে পুরাপুরি যন্ত্রমানব হতে পারিনি, এই একটা বিপুল ক্ষতি কিন্তু তুমি আমার করে দিয়েছ; যা হোক।

চলে গেলে, বেশ। কিন্তু তোমার বিদায় নেয়ার ভঙ্গিটা আমার পছন্দ হয়নি। এভাবে দুম করে কেউ চলে যায় বুঝি? দূর-দূর, ফালতু, স্রেফ ফালতু।

তুমি যখন মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হলে তখন আমার বয়স কতো হবে আর, ষোল-সতেরো। ওই দিন তোমার শরীর খানিকটা ভালো থাকায় তোমার শয্যাপাশে কেবল আমিই ছিলাম। রাত দুইটা দিকে তোমার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।
আহা, পৃথিবীতে এতো বাতাস অথচ তুমি একফোঁটা বাতাসের জন্যে কেমন নির্লজ্জের মত তোমার কিশোর সন্তানের হাত খামচে ধরে আছো। কী হাহাকার করা ভঙ্গিতেই না বলছিলে, 'খোকা, বড় কষ্ট! একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা কর'। এ্যাহ, বললেই হলো আর কী, যেন কিশোরটি অক্সিজেন বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!

আমি পাগলের মতো হাসপাতালের এমাথা-ওমাথা ডাক্তার-নার্সের জন্যে ছুটাছুটি করছি। এ অভাগা দেশে যা হয়, কাউকে কী খুঁজে পাওয়া যায় শালার! মফস্বল থেকে আসা এই কিশোরটি কতটুকুই বা ক্ষমতা, চেনার শক্তি। এক সময় মনে হলো লাফ দেই চার তলা থেকে! আজও ভাবি ওদিন কেন লাফ দিলাম না? হায়রে মানুষ, প্রাণের কী মায়া!

জন্ম এবং মৃত্যুর সময় নাকি ডাক্তার আমাদের স্পর্শ করেন! ডাক্তার একসময় তোমাকে বড়ো অবহেলাভরে ছুঁয়ে জানালেন, আজ থেকে এটা একটা লাশ!
এরপর লাশ উঠাও, লাশ নামাও। এই-এই, এই লাশের সঙ্গে গার্জেন কে?

আমি একা। বরফঠান্ডা বাবা নামের লাশটার হাত ধরে বসে আছি, ভোরের অপেক্ষায়। ঢাকার সমস্ত মসজিদ থেকে একযোগে আজান ভেসে আসছে। অপার্থিব, অন্য ভুবনের এক অনুভূতি! কী রক্তশূণ্য-পান্ডুর তোমার মুখ। তোমার অতলস্পর্শী চোখটা কেমন স্থির!
কী বোকাই না ছিলাম, আমার বোকামী দেখে তুমি খুব হাসছিলে, না? তোমার ঠান্ডা, আড়ষ্ট হাতটা অহেতুক ঘষছিলাম, অলৌকিক-বিচিত্র কোন উপায়ে যদি আমার শরিরের খানিকটা উত্তাপ তোমার শরীরে ছড়িয়ে দেয়া যায়...।

কী দীর্ঘ একটা রাত! প্রিয়মানুষের শব নিয়ে ভোরের অপেক্ষা। ভোর তো আর হয় না! আসলে ভোর হয়, ভোরকে কেউ আটকাতে পারে না। কেউ কেউ ভোরের অপেক্ষায় হাল ছেড়ে অন্য ভুবনে যাত্রা করে...।

*সাদিক মোহাম্মদের ইংরাজি অনুবাদ:

1 comment:

Anonymous said...

ALI BHAI.
Onek dhonnabad. Babar botbrikkher chhaya khub onubhsb kori.