২৯ নম্বর পুরানা পল্টনের দোতলায় থাকতেন মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার আলীম চৌধুরী। তার নীচের তলায় থাকতেন মওলানা আব্দুল মান্নান।
নীচের তলায় আগে ডাক্তার আলীমের ক্লিনিক ছিল। কিন্তু মাওলানা সাহেব একবার বিপদে পড়ে প্রাক্তন স্পীকার এ.টি.এম.মতিনকে ধরে বসেন আশ্রয়ের জন্যে। মতিন সাহেব আলীম সাহেবকে বললেন, 'ডাক্তার চৌধুরী, আপনি ক্লিনিক উঠিয়ে মওলানাকে আশ্রয় দিন'।
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তখন ভারতীয় বিমান হরোদমে বোমা বর্ষণ করছে। কার্ফু ও চলছে। শুধু সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কার্ফু ওঠান হল।
আলীম চৌধুরী ভাবছিলেন, এ ফাঁকে একবার অন্য কোন জায়গায় আশ্রয় নেয়া যায় কিনা দেখে আসবেন এবং একবার হাসপাতালটাও ঘুরে আসবেন। তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল না তখন তিনি বের হন। আলীম চৌধুরী বেরুবেনই।
স্ত্রীকে বললেন, 'আমাকে তো একবার হাসপাতালে যেতেই হবে। ডাক্তার মানুষ আমি যদি না যাই তো কে যাবে? তারপর বললেন, আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি ফিরবো। তুমি তৈরী থেকো। আমি ফিরলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো'।
আলীম চৌধুরীর স্ত্রী বললেন, 'তুমি ঠিক মতো ফিরবে- তাহলেই হয়েছে। তুমি কার্ফুর সময় পার করে দিয়ে আসবে আর আমাদেরও যাওয়া হবে না'!
আলীম চৌধুরী স্ত্রীকে বারবার কথা দিলেন যে কার্ফুর অনেক আগেই তিনি ফিরবেন।
তারপর কোরোসিনের একটি টিন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। বাসায় তখন কেরোসিনের অভাব।
গাড়ি করে হাসপাতালে গেলেন ডাঃ চৌধুরী। হাসপাতালে তার সহকর্মীরা তো তাঁকে দেখে অবাক। এই দুর্যোগ আর উনি কিনা এসেছেন হাসপাতালে।
...বাসায় ফিরলেন।
স্ত্রী সাথে সাথে ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, 'কি বলেছিলাম, কার্ফু পার করে দিয়েই তো ফিরলে'।
তিনি বললেন, 'ঠিক আছে ঠিক আছে। কাল একেবারে সক্কালেই চলে যাবো'।
...বিকেল সাড়ে চার। একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো বাসার নীচে। কয়েকজন আলবদর নামলো। ডাক্তার চৌধুরীর স্ত্রী একটু উঁকি দিয়ে দেখছিলেন তখন তিনি বললেন, 'অতো উঁকিঝুকি দিয়ো না। বোধহয় আর্মি এসেছে'। বলে তিনি বাথরুমে গেলেন। কারণ মাওলানা মান্নানের বাসায় হরদম এ ধরনের লোকজন আসা-যাওয়া করত।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ...তিনি নীচে নামার উদ্যোগ নিলেন। ডা. চৌধুরীর মা তখন বলে উঠলেন, 'আরে কোথায় যাচ্ছো'?
তিনি বললেন, 'নীচে, মওলানার কাছে (মওলানা আব্দুল মান্নান)। মওলানা বলছিল, এ ধরনের কোন ব্যাপার ঘটলে যেন তাকে খবর দেয়া হয়'।
নীচে নেমে তিনি মওলানার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন। এমনিতে মওলানার দরজা সব সময় খোলা থাকতো। কিন্তু সেদিন দরজা বন্ধ। এদিকে ডা. চৌধুরী দরজা ধাক্কাচ্ছেন, চীৎকার করে মওলানাকে দরজা খুলতে বলছেন। কিন্তু মওলানার কোন সাড়াশব্দ নেই। খানিক পর মওলানা ভিতর থেকে বললেন, 'ভয় পাবেন না। আপনি যান। আমি আছি'।
তিনি ফের উপরে উঠার জন্য পা বাড়ালেন এমন সময় আলবদরের আদেশ, 'হ্যান্ডস আপ, আমাদের সাথে এবার চলুন'।
'কি ব্যাপার কোথায় যাবো'? প্রশ্ন করলেন ডাঃ চৌধুরী।
'আমাদের সাথে চলুন'।
'প্যান্টটা পরে আসি'।
'কোন দরকার নেই'।
আলবদররা তাঁকে ঘিরে ধরলো। আস্তে আস্তে তিনি মাইক্রোবাসের দিকে অগ্রসর হলেন।
(সেই তাঁর শেষ যাওয়া)
*১৪ ডিসেম্বর '৭১-এ আল-বদরদের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রীদের সাক্ষাত্কারের ভিক্তিতে রচিত। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, জাতীয় দিবসের বিশেষ সংখ্যা/ ১৯৭৩)
**এখন দেখতে পাচ্ছি, এই লেখাটাই 'বিশ্বাসঘাতক' নামে এই সাইটেই পূর্বে পোস্ট করেছিলাম। রি-পোষ্ট হয়ে গেল, দুঃখজনক!
**মুক্তিযুদ্ধের কিছু ছবি: http://71photogun.blogspot.com/
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Saturday, October 2, 2010
নিধন: ডাক্তার আলীম এবং একজন মাওলানা মান্নান
বিভাগ
১৯৭১: প্রসব বেদনা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
বিনয়ের সাথে ট্যাগটার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। একে প্রসব বেদনা বলা যায় না, প্রসব বেদনা হতে পারে পাকি হানাদারদের সাথে যুদ্ধকে। কিন্তু এই সব?! এই সব তো নোংরা নরপশুদের কাজ। অন্য কোন দেশে এই রকমটা হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। প্রসব বেদনা টুকু সবাই সহ্য করে, এই নিয়ে আমাদের গর্বও হয়। আমরা রক্তের দামে স্বাধীনতা কিনেছি। কিন্তু আমাদের সেরা সন্তানদের হারানো?
ভালো থাকুন প্রিয় মাহমেদ ভাই।
ধন্যবাদ, আপনার কথায় যুক্তি আছে।
এই লেখাগুলো অন্য একটা ওয়েবসাইটে 'নিধন' ট্যাগে ছিল, যেটার কথা বিস্মৃত হয়েছিলাম, ভুলে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে এগুলো উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসছি।
এখানে মুক্তিযুদ্ধের একটাই ট্যাগ রাখতে চেয়েছি। ১৯৭১-এর যাবতীয় কর্মকান্ড্ একটাই ফ্রেমের আটকে রাখার চেষ্টা...। আবারও ধন্যবাদ বিষয়টা ধরিয়ে দেয়ার জন্যে।
আপনিও ভাল থাকুন, @বোহেমিয়ান
Post a Comment