দানবীর নূতনচন্দ্র সিংহ:
তাঁর একমাত্র ইচ্ছে ছিল তিনি যেনো দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। সে ইচ্ছা তার পূরণ হয়েছে। দেশের মাটিতে তিনি মরতে পেরেছেন। তবে বড় নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে- কখনো কেউ যা কল্পনাও করেনি।
গত বছর এই ১৩ এপ্রিলে চট্টগ্রামের অদূরে নিজের হাতে গড়া কুন্ডেশ্বরী ভবনে তাঁকে হত্যা করা হয়। কুন্ডেশ্বরী বিদ্যাপিঠের প্রতিষ্ঠাতা বাবু নূতন সিংহের কথা বলছি। এপ্রিলের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরের পতন হয়েছিল। ১৩ তারিখে পাক বাহিনী কুন্ডেশ্বরী আক্রমণ করে। বাবু নুতন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৭ জন অধ্যাপক সস্ত্রীক আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ কোরাইশী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রাম থেকে আগরতলা যাওয়ার পথে জনাব এম, আর, সিদ্দিকীও কুন্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পাক বাহিনীর অগ্রগতির খবর শুনে সবাই কুন্ডেশ্বরী ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। বাবু নূতন সিংহকে যাওয়ার কথা বললে তিনি রাজী হননি। বলেছিলেন, যদি মরতে হয় দেশের মাটিতেই মরব। অনেক পীড়াপীড়ির পরও তাঁকে রাজী করান গেল না। এদিকে পাক বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছিল। ১৩ই এপ্রিল পাক বাহিনী কুন্ডেশ্বরী ভবনে প্রবেশ করে।
ছেলেরা আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। বাবু নূতন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। জনৈক সালাউদ্দিন তাঁকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এসেছিল। তাঁর চোখের সামনে মন্দিরটি উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। মেজর তিনটি গুলি করার পরও- সালাউদ্দিন রিভলবারের গুলি ছুঁড়েছিল নূতন বাবুর দিকে। তিনি লুটিয়ে পড়েছিলেন। তেমনি মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন তিন দিন।
নিজের মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি তিনি। সেজন্যে একটা ক্ষোভ ছিল মনে। তখন রাউজান থানায় কোন বিদ্যালয় ছিল না। রাউজান থানার মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন কুন্ডেশ্বরী বালিকা মন্দির। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিদ্যালয় ছিল এটি। শুধু রাউজান থানা নয় দেশের সব এলাকা থেকেই ছাত্রীরা যায় সেখানে লেখাপড়া করার জন্যে। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ডাকঘর, সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ, পানির পাম্প, জেনারেটর, বাস ইত্যাদি ছিল। মোট প্রায় ২ লাখ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে সেখানে।
*তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা ১৩ এপ্রিল, ১৯৭২ (ভাষারীতি অবিকল রাখা হয়েছে)।
** এই লেখাটাই ২০০৭ সালে একটা ওয়েব সাইটে লিখেছিলাম। তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওই সাইটে চুটিয়ে লিখছিলাম। তো, এই লেখাটা পরে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারণ বেশ ক-বছর হয়ে গেল ওই সাইটে আমি আর লেখালেখি করি না। আমার শত-শত লেখা মুছে ফেলে ওখান থেকে চলে এসেছিলাম।
পরবর্তীতে ওখানে আবারও লেখা শুরু করেছিলাম, যথারীতি বন্ধও করে দিয়েছিলাম। আমার খেয়াল ছিল না কিছু লেখা ড্রাফটও করা ছিল। ভাগ্যিস, ড্রাফট করেছিলাম নইলে এই লেখাটাও আর খুঁজে পেতাম না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিক্ষিপ্ত আকারে বিভিন্ন জায়গায় লিখেছিলাম। সবগুলোর হদিস বার করা এখনও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এটা আমার জন্য ভারী বেদনার! কারণ অন-লাইনে এখন মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত তথ্য পাওয়াটা যতোটা সহজ তখন এতোটা সহজ ছিল না। খুব কম তথ্যই ওয়েব-সাইটে পাওয়া যেত। তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করতে, একেকটা লেখা লিখতে গিয়ে কেটেছিল অনেক বিনিদ্র রজনী!
এখন আমার সাইটে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত [১] যেসব লেখা আছে, ভাল করে লক্ষ করে দেখলাম, অনেক লেখা নাই যা আমি ইতিপূর্বে লিখেছিলাম। এই বেদনার কথা কাকে বলি! তবুও মনটা অন্য রকম হচ্ছে, অন্তত কিছু লেখা তো উদ্ধার করা গেছে।
***নূতন সিংহের হত্যার জন্য দায়ী জনৈক সালাউদ্দিন...। এই জনৈক সালাউদ্দিন যে সাকা চৌধুরী এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। কারণ ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল রাউজানে গেলে, "নূতন চন্দ্রের ছেলে প্রফুল্ল সিংহ সাংবাদিকদের বলেন, '১৩ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সাকা চৌধুরী আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে মন্দির থেকে বের করেন। পরে তাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় বলে শুনেছি। পাকিস্তানি বাহিনী এর আগে দুবার এসে বাবার সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সাকা চৌধুরী এসে বলেন, 'তার বাবা (ফজলুল কাদের চৌধুরী) নূতন সিংহকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন'।'" [২] (প্রথম আলো, ২৫.০৯.১০)
****সো-কলড ইসলামের ধারক-বাহক পাকিস্তানিরা প্রার্থনারত অবস্থায় অবলীলায় একজন মানুষকে খুন করে, প্রার্থনাস্থল উড়িয়ে দেয়। আজ তাদের প্রার্থনাস্থলে বোমা ফাটে, প্রাণ বিনষ্ট হয়।
হিস্ট্রি রিপিট!
*****সাকা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, "...গঠিত ট্রাইব্যুনাল...হিন্দুপাড়ায়, শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে ফিরেছেন। সাইরেন বাজিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে গেছেন মনে হয়...। (কালের কন্ঠ, ২৯.০৯.১০)
শাবাশ, যোগ্য দেশের যোগ্য মরদ (!) বটে! আমাদের উচিত সাকার পদাম্বুজে চুমু খাওয়া।
******মুক্তিযুদ্ধের কিছু ছবি: http://71photogun.blogspot.com/
সহায়ক লিংক:
১. ১৯৭১, প্রসব বেদনা: http://tinyurl.com/37wksnh
২. প্রথম আলো: http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=1&date=2010-09-25
No comments:
Post a Comment