Search

Tuesday, June 29, 2010

বৈদেশ পর্ব: ছয়

শেষ পর্যন্ত আমার জার্মানি যাওয়াটাই স্থির হলো। এর পূর্বে তিতাসের পানি কোথায় কোথায় গড়িয়েছে সেটা খোদ তিতাসেরও জানা নেই!
আমি জানতেও পারিনি কখন অপরাধটা করে ফেলেছি, আস্ত এক অপরাধি হয়ে বসে আছি। ববসের প্রতিযোগিতায় আমার সাইটটা নির্বাচিত হয়ে গেছে।
আমি নিরিবিলিতে দু-কলম লিখতাম, সেই বেশ ছিলাম। হঠাৎ করে পেছনের কাতারের মানুষটা সামনের কাতারে চলে এসে বড়ো একটা ভজকট হয়ে গেল! এরপর শুরু হলো একের পর এক নাটক। নাটকের একেক কুশীলবের কী দুর্ধর্ষ সব অভিনয়। যিনি সকালে ফোন করে অভিনন্দন জানান তিনি অন্য নামে বিকালে আমার বাপান্ত করেন। কী একেকজনের নসিহত- আমাকে কেমন করে বসতে হবে, হাঁটতে হবে এই সব এরা শেখাবার চেষ্টা করেন।

এরিমধ্যে জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে আমার ভয়াবহ ঝামেলা হলো [১]। যারা গ্রে-মেটার নিয়মিত সাবান দিয়ে ধৌত করেন তারা মূল সুরটাই ধরতে পারলেন না। ঘটা করে আমাকে জানাতে লাগলেন, তিনি কয়টা দূতাবাসে দাঁড়িয়েছেন। যেন এই ভদ্রলোকের মত আমার বিদেশে চাকরির বড়ো শখ যে আমি দূতাবাসে দূতাবাসে লাটিমের মত ঘুরপাক খেতে থাকব।
একজন গভীর সন্দেহ পোষণ করলেন, এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর তাই আমার ধারণা নেই ইত্যাদি। ইনার কাছেও আমাকে প্রমাণ দিতে হবে ইনি যখন ডায়াপার ভিজিয়ে ফেলেন তখন আমি বিমানে ব্লাডার হালকা করি।

তিতিবিরক্ত হলেও এই সব নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না। তবে দূতাবাসের বিষয়টা আমি কোন অবস্থাতেই সহজ ভাবে নিতে পারছিলাম না। অশালীন, অভদ্র, অমার্জিত আচরণ করার কোন অধিকার কোন দূতাবাসের নাই। এই অধিকার অন্তত আমি কাউকে দেই না। একটা স্বাধীন দেশে একটা দূতাবাসের এই আচরণ ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। আমার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, দূতাবাস প্রয়োজন মনে করলে ভিসা দেবে না এই নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার একটা শব্দও ব্যয় করব না। 
কিন্তু এখানে আমার ব্যক্তিগত অপমান ছাড়িয়ে যাচ্ছিল আমার নিজের দেশের প্রতি তাচ্ছিল্য। এদিকে বাক স্বাধীনতার নামে অতি কুৎসিত ছবি, ততোধিক কুৎসিত কথা লেখা হতে থাকে আমার নামে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এই বাক স্বাধীনতাটা নিজের উপর পড়লে কেমন লাগে- হিস্ট্রি রিপিট! 

আমি আয়োজকদের আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দিলাম আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটা কোন ঝোকের মাথার সিদ্ধান্ত ছিল না। আমার সমস্ত জীবনে ঠান্ডা মাথার কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি এমন উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে। 
আমার আপন একমাত্র মামা সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতোটাই শীতল আজও তাঁর সঙ্গে কথা বলি না। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স কেবল সতেরো। মামা নামের মানুষটার অপরাধ ছিল এটাই তিনি তখন আমাদের হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই দিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই মানুষটাকে আমার প্রয়োজন নাই। মানুষটা পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন কিন্তু আজও তাঁকে আমি ক্ষমা করিনি। প্রবাসী এই মানুষটা অনেক চেষ্টা করেও আমার সেল নাম্বারটা এখনও যোগাড় করতে পারেননি, সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি।

তো, সিদ্ধান্তটা জানিয়ে নিজেকে নির্ভার মনে হলো। কারণ আমার হাতে আছে প্রতিজ্ঞার ভয়াবহ অস্ত্র। আমার প্রতিপক্ষের সংখ্যা এবং তাদের আস্তিনে লুকানো ভালবাসার অস্ত্রগুলো সম্ভবত খাটো করে দেখেছিলাম। এঁরা সবাই মিলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমি গা করি না, প্রতিজ্ঞা নামের আমার অতি চেনা এই অস্ত্রটা নিয়ে অতীতে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অভাব নেই।
প্রতিপক্ষের লোকজন একের পর এক অস্ত্র ছুঁড়তেই থাকেন, অপমানিত হয়েছে বলে তুমি যে কেবল তোমার দেশ দেশ করছ, এটা আমাদের ভারতীয়দের গায়ে লাগছে না? বাংলা ভাষায় কি কেবল বাংলাদেশের লোকজনই কথা বলে? আমরা বলি না?
শেষে এঁরা ব্রক্ষ্মাস্ত্র ছুঁড়ে দেন। কে কবে ব্রক্ষ্মাস্ত্র ফেরাতে পেরেছে? এঁরা গাঢ় স্বরে বলেন, কই, হিন্দি ভাষায় তো বাংলায় চেয়ে অনেক বেশি মানুষ কথা বলে কিন্তু হিন্দি তো এখানে নাই। আমরা এবারই প্রথম বাংলা ভাষাটাকে অনেক ভাষার সঙ্গে এখানে যোগ করতে যুদ্ধ করেছি। তুমি যদি না আসো তাহলে এই সব জটিলতায় হয়তো আগামিতে বাংলা ভাষাটা এখান থেকে বাদ পড়বে। তুমি কি চাও তোমার কারণে এটা হোক?

আমি আমার হাত থেকে অস্ত্রটা ফেলে দিলাম। পরাজিত আমি কিন্তু কিছু পরাজয়েও সুখ। আমি অনেক কিছুই হয়তো ভুলে যাব কিন্তু এই মানুষদের মমতার কথা বিস্মৃত হবো না। আমার যখন মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হবে তখন কি এই সুখ-স্মৃতিগুলো মনে পড়বে, মস্তিষ্ক কি তখন সচল থাকবে? থাকলে বেশ হতো, যন্ত্রণাটা খানিকটা হয়তো কমত।

আমি নিস্তেজ হয়ে বলি, আচ্ছা যাও, আমি যাব। এঁরা অতি উঁচু পর্যায় থেকে দূতাবাসের জন্য জার্মান ভাষায় বিশদ লিখে চিঠি পাঠান। যেখানে লেখা, হের আলী মাহমেদকে এখানে কেন থাকা প্রয়োজন ইত্যাদি। সঙ্গে ই-টিকেট [২]
অবশেষে জার্মান দূতাবাস ভিসা দেয়।

২০ জুন রাত সাড়ে নটায় আমি দেশ ত্যাগ করি, অনেকটা চোরের মত। কারণ বাংলা ভাষার জন্য কেবল দায় পড়েছে ডয়চে ভেলের এবং আমার। সাহেবরা একটা লাড্ডু ডয়চে ভেলের হাতে ধরিয়ে দেবে, অন্যটা আমার হাতে। আমাদের যে লাড্ডু খাওয়ার বড়ো শখ...।

*বৈদেশ পর্ব, সাত: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_3252.html

সহায়ক লিংক: 
১. বৈদেশ পর্ব: চার: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/this-is-my-land.html
২. বৈদেশ পর্ব: পাঁচ: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_04.html  

No comments: