Search

Thursday, November 27, 2025

তবলার ঠুকঠাক—গুমের আগমনী বার্তা!

লেখক: মিজানুর রহমান সোহেল (লেখকের লিখিত অনুমতিক্রমে প্রকাশিত)

"আলহামদুলিল্লাহ! বিনা অপরাধে প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা ডিবি হেফাজতে থাকার পর তারা আমাকে স্বসম্মানে মাত্র বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।

গত রাত ১২টার দিকে ডিবি প্রধান আমার সঙ্গে কথা বলবেন, এই অজুহাতে ৫/৬ জন ডিবি সদস্য জোর করে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ডিবিতে নিয়ে আসামীর খাতায় আমার নাম লেখা হয়। জুতা-বেল্ট খুলে রেখে গারদে আসামীদের সাথে আমাকে রাখা হয়। কিন্তু কেন আমাকে আটক করা হলো? তা আমি যেমন জানতাম না, তেমনি যারা আমাকে তুলে এনেছিলেন বা ডিবির উর্দ্ধতন কর্মকর্তারাও কিছু বলতে পারেননি!

দীর্ঘ সময় পর বুঝতে পারলাম, সরকারের একজন উপদেষ্টার ইশারায় মাত্র ৯ জন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ার জন্যই আমাকে আটক করা হয়েছিল। আমার সাথে সংগঠনের সেক্রেটারি আবু সাঈদ পিয়াসকেও আটক করা হয়। তিনি এখনও ডিবি কার্যালয়ে আছেন।

আজ (বুধবার) ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্টার (এনইআইআর) নিয়ে ডিআরইউতে মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ (এমবিসিবি)-এর প্রেস কনফারেন্স করার কথা ছিল। আমি সেখানে ছিলাম মিডিয়া পরামর্শক। সেই প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করাই তাদের প্রধান টার্গেট ছিল। কিন্তু তাদের জন্য আফসোস, যে উদ্দেশ্যে তারা প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করতে চাইলো সেটা দেশের সবাই জেনে গেলো।

দেশের মুক্ত বাণিজ্য নীতির সঙ্গে এনইআইআর স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে দেশে প্রতিযোগিতা কমিশনও রয়েছে। অথচ মাত্র ৯ জন ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে সারাদেশে ২৫ হাজার মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে পথে বসানোর গভীর চক্রান্ত চলছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, প্রবাসীসহ অনেকেই বিপদে পড়বেন। একটা চেইন ভেঙ্গে পড়বে। অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে যাবে। জেনে রাখা ভালো, এই ৯ জনের একজন ওই উপদেষ্টার স্কুল-বন্ধু।

একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বললে সরকার কেন ভয় পায়? শুধুমাত্র প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করতেই কি আমাকে গভীর রাতে জোর করে তুলে নিতে হলো? যারা মুখে ‘বাকস্বাধীনতা’র বুলি আওড়ান, তারাই কি আমাকে বাকরুদ্ধ করতে এই আয়োজন করলেন? মগের মুল্লুকে এই কি তবে বাকস্বাধীনতার বাস্তব চিত্র?

আমাকে আটক করার ঘটনা জানাজানি হতেই বহু শুভাকাঙ্ক্ষী, ভাই, বন্ধু, সহকর্মী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অনেকেই খবর নিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়েছেন, বিবৃতি দিয়েছেন, সংবাদ প্রকাশ করেছেন। তাদের এই সমর্থন ও আওয়াজের কারণেই আমি দ্রুত মুক্তি পেয়েছি বলে বিশ্বাস করি। যারা আমার পাশে ছিলেন তাদের সবার প্রতি আমার অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।

...

ডিবিতে আমার খাবার মেন্যুতে কী ছিল?


১৯ নভেম্বরের গভীর রাত। শীত ঠিক পুরোপুরি নামেনি, তবু বাতাসে একটা ঠান্ডা খচখচে ভাব। শহরটা যেন ঘুমের ভিতরেও ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। এমন সময় হঠাৎ আমার দরজায় অচেনা কড়া। প্রথমে ভাবলাম হয়ত ভুল দরজা। কিন্তু দ্বিতীয় কড়া আরো কঠিন, আরো স্পষ্ট। বুঝিয়ে দিল, এ রাতের ছন্দ বদলে গেছে। দরজা খুলতেই দেখি কয়েকজন অপরিচিত মুখ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ডিবি পরিচয়ে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের কঠোর নির্দেশ ও নিয়ম অনুযায়ী কাউকে আটক করতে হলে স্থানীয় থানাকে জানানো বা আইডি কার্ড প্রদর্শনের যে বিধান রয়েছে, তার কোনোটিই মানা হয়নি। উল্টো ডিবির প্রধান শফিকুল ইসলাম আমার সঙ্গে কথা বলবেন, এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘড়ির কাঁটা এক জায়গায় আটকে থাকার মতো সময় যেন থমকে গেল। প্রশ্ন, নীরবতা, অপেক্ষা সবকিছু মিশে প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা ডিবি হেফাজতে স্তব্ধ থাকলাম।

এসব গল্প এখন পুরনো। তবে ডিবি থেকে বাসায় ফেরার পর একটি অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলাম। সবার মুখে একটাই কৌতূহলী প্রশ্ন, ‘ডিবিতে আপনার খাবার মেন্যুতে কী ছিল'? বিদেশি একটি গণমাধ্যম আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়ও এই প্রশ্ন করেছে। গতকাল একটি টেলিভিশনের টক-শোতেও দেখলাম আমার খাবার মেন্যু নিয়ে বিজ্ঞজনরা আলোকপাত করছেন!

এমনকি ফেসবুকের জনপ্রিয় পেজ ‘ইয়ার্কি’ পর্যন্ত রসিকতা করে লিখেছে ‘ভাতের হোটেল সার্ভিস বন্ধ, ডিবি এখন 'উঠাও' সার্ভিস চালু করেছে।’ আসলে আমরা বাঙালিরা বড্ড ভোজনরসিক। সুখে খাই, দুঃখে খাই, প্রেমে পড়লে খাই, ছ্যাঁকা খেলে খাই, কেউ জন্ম নিলে খাই, মারা গেলেও খাই... শুধু খাই আর খাই। হয়তো এই সাইকোলজি বুঝেই ডিবি হারুন ‘ভাতের হোটেল’ খুলেছিলেন। তাই আমার আটকের পর সবার আগ্রহ ছিল, হারুনের হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার পর নতুন মেন্যুতে কী যোগ হলো?

মেন্যু আইটেম ১, পানি:

বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ের দূরত্ব খুব বেশি না, কিন্তু অনুভূতিতে সেটা যেন একটা যুগ। কারণ অন্ধকার রাতে অজানা যাত্রা সবসময় বুকের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি করে। আমাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর পরই ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। তড়িঘড়ি করে আসামির খাতায় নাম তুলে, বেল্ট-জুতা খুলে শরীর তল্লাশি করে আসামিদের গারদে ঢোকানো হয়। ডিবির লোকজনের রুক্ষ ব্যবহার আর ধমকে আমি তখন রীতিমতো চোখে সরষে ফুল দেখছি। গারদের ভেতরে অচেনা মুখ। কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, কী মামলায় আইছেন?’ আমি তো জানিই না কেন এসেছি!

আমার অজ্ঞতা দেখে আরেক বন্দি রায় দিলেন, ‘তাইলে নিশ্চিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হবে আপনার নামে।’

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, কথা বের হচ্ছে না। আমি পানি চাইলাম। কেউ একজন পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। ডিবিতে আমার প্রথম খাবার, এক চুমুক পানি।

কিছুক্ষণ পর ডিবির প্রধান এসে আমার সঙ্গে কথা বললেন। এরপর আবার আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। দ্বিতীয়তলায় তার রুমে যাওয়ার পর আমাকে দাঁড় করিয়ে পরেরদিন প্রেস কনফারেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলেন। তখন আমি আসল কারণ জানতে পারলাম কেন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আমন্ত্রণপত্রে আমার নাম্বার নাকি ভুলভাবে দেয়া হয়েছে এ জন্য আমাকে ডেকেছেন।

ডিএমপি মিডিয়া সেল থেকে আরো একধাপ এগিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আমার নাম্বার নাকি সংবেদনশীল জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছিল বলে আমাকে রাতের অন্ধকারে উঠিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও আমি তাদের বলেছিলাম, ভুল করে আমার নাম্বার ব্যবহার হয়নি, আমি জেনে, বুঝে, সুস্থ মস্তিষ্কে এই নাম্বার আমন্ত্রণপত্রে দিয়েছিলাম, যাতে কোনো সাংবাদিক চাইলে প্রেস কনফারেন্স ইস্যুতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এটা যে আমার পাবলিক রিলেশনস এজেন্সি টাইমস পিআর-এর ইনভাইটেশন সেটা আমন্ত্রণপত্রের উপরে আমার প্রতিষ্ঠানের লোগো থাকার পরেও হয়তো তারা বুঝতে পারেনি।  

মূলত তারা এই প্রেস কনফারেন্স করতে দিতে চান না। একটি সিন্ডিকেটকে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ার জন্য নীতিগত যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে বিরাট সংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাবেন। যারা দেশের আইন মেনে, লাইসেন্স নিয়ে, সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে প্রকাশ্যে ব্যবসা করেন। এমনকি সরকারি ব্যাংক তাদের ব্যবসার বৈধতা যাচাই-বাছাই করে ঋণও দেয়। তারা ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্টার (এনইআইআর)-এর বিরুদ্ধে না। শুধু এনইআইআর বাস্তবায়নে অন্য বড় ব্যবসায়ীদের মতো নিজেদের ব্যবসা করার সমান সুযোগ চান।

এ বিষয়ে নিজেদের মতামত, প্রস্তাবনা ও দাবির কথা সাংবাদিকদের বলবেন, সেটা উপর মহল নিতে পারবেন না কেন? এ দেশের মানুষকে কথা বলার অধিকার তো সংবিধানই দিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করে এই কথা বলার অধিকার হরণ করেছিল। সেটা এই সরকার বাতিল করেছে বলে দাবি করলেও একই কায়দায় কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা কার স্বার্থে করা হচ্ছে? শুধু মতামত দিবে বলে তাদের মুখ চেপে ধরতে হবে? তাদের কথা বলতে দেয়া যাবে না? এই যে ডিবির নতুন প্রধান বা যে বিশেষ সহকারীর দিকে অভিযোগের তীর যাচ্ছে, তারাও এসব পদে এসেছেন আগের সরকারের সময়ে কেউ কথা বলতে চাইলে তাদের মুখ চেপে ধরতো বলে। অথচ গদিতে বসেই তারা সব ভুলে গেলেন! 

ডিবির প্রধানের সঙ্গে আমার কথা বলা শেষ হওয়ার পর তিনি একজন ডিসিকে বললেন, ‘উনাকে ভাত-টাত খাওয়ায়ে ছেড়ে দিয়েন।’ এটা শুনে আমার মাথায় সঙ্গে সঙ্গে ডিবি হারুনের সেই ‘ভাতের হোটেল’ ভর করল। ডিবি হারুনের ভাতের হোটেল কি তাহলে এখনও খোলা? ভাতের হোটেলে মেন্যুতে কি কি আছে? এত রাতেও কি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত পাওয়া যাবে? এসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে ডিসির রুমে পৌঁছে গেলাম। ডিসি আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। কী খাবেন? জানতে চাইলেন তিনি। আমার গলা তখনও শুকনো। শুধু পানি চাইলাম। আরেক দফা পানি খেলাম। তবে আমি ডিনার করতে একদম আগ্রহ দেখালাম না। 

মেন্যু আইটেম ২, চীনা বাদাম:  

ডিসি আমাকে জানালেন তিনি অনেক ক্ষুধার্ত। একজনকে ডেকে ভাত আনতে বললেন। সে বললো, ‘স্যার এখন তো ভাত পাওয়া যাবে না। তবে মগবাজারে খিচুড়ি পাওয়া যাবে।’

ডিসি তাকে দুই প্যাকেট খিচুড়ি আনতে বললেন। আমার ক্ষুধা থাকলেও একদম খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল না বলে বিনয়ের সাথে আমার খাবার আনতে না করলাম। খাবার এলো। ডিসি ডিনার করলেন। অনেকটা সময় ধরে আমার সঙ্গে নানান বিষয়ে গল্প করলেন। তিনি আগের রাতেও নাকি ঘুমান নাই। খুবই ক্লান্ত, কিন্তু আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ভোর রাত পর্যন্ত আমার পাশে ছিলেন। রাত তিনটার দিকে একটা চীনা বাদামের কৌটা ধরিয়ে দিলেন। তিনি কয়েকবার বলার পর কিছুটা বাদাম নিলাম। 

এই সময়ে আমি মনে করিয়ে দিলাম আমাকে ছাড়া হবে কখন? তিনি একবার বললেন, ‘মোবাইল ব্যবসায়ীদের একজনকে ধরতে পারলে আপনাকে ছেড়ে দিবো।’ কিছুক্ষণ পর স্মার্টফোন ও গ্যাজেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ (এমবিসিবি)-এর সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ পিয়াসকে ডিবি নিয়ে আসলো। আমি বললাম এবার আমাকে ছাড়ুন। তিনি বললেন, ‘সংগঠনের সভাপতি মো. আসলামকে পাওয়া যায়নি। উনি হলে আপনাকে ছাড়তে পারতাম।’

এর আধা ঘণ্টা পর তিনি আবার বললেন, ‘আপনাকে একটা মুচলেকায় স্বাক্ষর করিয়ে ছেড়ে দিবো। সেখানে লেখা থাকবে আপনাকে কোনো টর্চার করা হয়নি, ভুল বোঝাবুঝির কারণে আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছিল।’

একজনকে ডেকে এই মুচলেকা লিখতে বললেন। আরো আধা ঘণ্টা পর মুচলেকা এলো। কিন্তু এবার ডিবির প্রধান ফোন ধরছেন না। ঘুমিয়ে গেছেন বলে এটা সম্ভব হচ্ছে না। এরপর তিনি আমাকে অন্য একজনের জিম্মায় দিয়ে ফজর আজানের পর বাড়ি গেলেন।

মেন্যু আইটেম ৩, কফি:

সারা রাত নানা নাটকীয়তা শেষে দিনের আলো ফুটে গেল। আশরাফুল নামের যে পুলিশ সদস্য আমাকে তুলে এনেছিলেন, তিনি বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে এখন ডিবি কার্যালয়ে আসলেন। ততক্ষণে অনেক গণমাধ্যমে আমাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আশরাফুলের নামও এসেছে। তার মুখে অস্বস্তির ছাপ। তিনি বললেন, ‘আমি তো শুধু অর্ডার পালন করেছি, কিন্তু আমার নামও চলে এলো’, সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

‘কিছু খাবেন কিনা? কফি খাওয়াই?’ ক্লান্ত লাগছিল, তাই আমি আর না করলাম না। সে নিজের হাতে ধোঁয়া-ওঠা কফি বানিয়ে আনলো। সে ভালো কফি বানাতে পারে এটা স্বীকার করতেই হবে। 

এরপর দেখলাম আশরাফুলের কাছে একের-পর-এক কল আসছে তার ঊর্ধ্বতন থেকে। আমাকে দ্রুত ছাড়ার তাগিদ দিচ্ছে। তবে সেটা ফর্মালিটি মেনে মুচলেকা লিখে আমার স্বাক্ষর করে এরপর ছাড়তে হবে। এই মুচলেকা রেডি করতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগলো। একবার মুচলেকায় একটা লাইন যোগ করতে বলে তো আবার পরের কলে সেটা ফেলে দিতে বলে। এভাবে অনেক সময় নিয়ে মুচলেকা রেডি করলো। আমাকে আটকের সময় কোনো স্থানীয় থানাকে জানানো বা আইডি কার্ড প্রদর্শনের যে বিধান রয়েছে, তার কোনোটিই মানা হয়নি। কিন্তু আমাকে ছাড়ার সময় ফর্মালিটি মানতে দুটি মুচলেকায় (একটি আমার, অন্যটি জিম্মাদারের) বাধ্যতামূলক স্বাক্ষর করতে হয়েছে। 

এবার গাড়ি দরকার। কিন্তু গাড়ি চাওয়ার পরেও আশরাফুল ঠিক মতো সাপোর্ট পাচ্ছে না। দেরিও হয়ে যাচ্ছে। পরে সে ডিবি প্রধানকে ফোন করে বললে তাৎক্ষণিক বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা হয়। এরপর দ্রুত কালো গ্লাসের গাড়ি রেডি হলো। আমি যদিও এখান থেকে নিজে থেকেই বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাইরে অনেক সাংবাদিক দাঁড়িয়েছিলেন বলে সেই রিস্ক তারা নিতে চায়নি। খুব তাড়াহুড়ো করে আমাকে গেট থেকে বের করা হয়। আমার বন্ধু তানভীর খন্দকার ও সাবেক সহকর্মী শুভ সারারাত গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল, তাদের সাথে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম।

সাড়ে ১০ ঘণ্টার এই রুদ্ধশ্বাস জার্নিতে আমার পেটে পড়েছিল শুধুই পানি, চীনা বাদাম আর এক কাপ কফি। বাকি গল্প না হয় আরেকদিন হবে। ডিবিতে ভাতের হোটেল বন্ধ হয়েছে কি না জানি না, তবে আমার কপালে জুটেছিল এটুকুই!

লেখক: মিজানুর রহমান সোহেল https://www.facebook.com/share/1AGVQikgYB/ (শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫)"

...

* ক্রমশ, শেখ হাসিনার ক্ষমতা পরির্বতনের পর কুশাসনের সমস্ত পর্বই ফিরে এসেছে! বাকী ছিল 'গুম-পর্ব'—কেবল এই একটা কারণে আমরা বড়ই আনন্দিত ছিলাম। কিন্তু তবলার ঠুকঠাক শুরু হয়ে গেছে, এবার গান গাওয়ার পালা! এটা হচ্ছে, গুমের প্রাথমিক পর্ব!

Monday, November 10, 2025

ডাক্তার নামের এক প্রতারক!

লেখক: ডা. মো: মারুফুর রহমান (লেখকের লিখিত অনুমতিক্রমে প্রকাশিত)

"এটি একজন সেলিব্রিটি ইনফ্লুয়েন্সার চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন। সবাই তাকে চেনেন, 'অর্গানিক জাহাঙ্গীর', 'কিটো জাহাঙ্গীর', 'জেকে', ইত্যাদি অনেক নামে। সেই চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের এই অবস্থা!

ন্যুনতম স্ট্যান্ডার্ডে প্রেসক্রিপশনে অবশ্যই সম্ভাব্য রোগের নাম, রোগীর সমস্যা, ভাইটাল সাইন, জেনারেল ফাইন্ডিং এগুলো থাকতে হয়। এই প্রেসক্রিপশন দেখে বোঝার উপায় নেই কি সমস্যায় এসব ওষুধ দেয়া হয়েছে। ফলে ওষুধগুলো আসলেই প্রয়োজনীয় কিনা তা যাচাই করার সুযোগ নেই।

তারচেয়ে বড় কথা এখানের ৭টি ওষুধের মাঝে ৭টিই নানা ধরনের ভিটামিন/ফুড সাপ্লিমেন্ট যা উপযুক্ত খাবারের মাধ্যমেই পুরণ করা সম্ভব। মুলত এই প্রেসক্রিপশনটি ফুড সাপ্লিমেন্ট-এর ব্যবসা বর্ধক ফর্মুলা ছাড়া কিছুই না এবং এ কারণেই ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে চিকিৎসকদের ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখা নিষেধ।

চলুন দেখি কি কি 'ওষুধ' লেখা হয়েছে।

১. প্রথমটি Cap Acteria, এটি একটি প্রোবায়োটিক। এতে মূলত কয়েক ধরণের উপকারী বাক্টেরিয়া থাকে যার অধিকাংশ ল্যাক্টোব্যাসিলাস গ্রুপের, যা প্রচুর পরিমাণে থাকে দইয়ে। এই ওষুধের প্রতি ক্যাপসুলে ৪ বিলিয়ন ব্যাটেরিয়া আছে।

যার প্রতিটার দাম ৪৫ টাকা, দিনে ২টা করে ৩ মাসে মোট খরচ ৮ হাজার টাকা। অন্যদিকে ১ চামচ দইয়ে গড়ে ১-১০ বিলিয়ন বাক্টেরিয়া থাকে। এবার হিসাব করুন এ চামচ দই এর দাম কত?

উল্লেখ্য কোন নির্দিষ্ট রোগ সারাতে এর সরাসরি ব্যবহার উপযোগীতা নেই বরং স্বাস্থ্যকর খাদ্যভ্যাস-এর অংশ হিসেবে নানাবিধ রোগের ঝুঁকি ও উপসর্গ কমাতে নিয়মিত এ ধরণের উপকারী ব্যাক্টেরিয়া খাবারের সংগে গ্রহন করা বেশি উপকারী।

২. ২য় ওষুধ 'ভিটামিন ডি'। সূর্যের আলোর ভিটামিন অর্থাৎ আমাদের চামড়ায় সূর্য্যের আলো পড়লে এই ভিটামিন শরীরে তৈরি হয়। এছাড়াও নানাবিধ খাবারে ভিটামিন ডি থাকে যেমন তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, কলিজা ইত্যাদি।

তবে বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষেরই শরীরে ভিটামিন ডি কম। তাই এই সাপ্লিমেন্ট এর অনেকের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হতে পারে যদি খাবার ও সূর্যের আলোর মাধ্যমে পুরণ না হয়। দাম হিসাব করলে প্রতি  ক্যাপসুল ৩৫ টাকা, সপ্তাহে ১টা করে ৬ সপ্তাহে ২১০ টাকা।

৩. ৩য় ওষুধ Santogen A-Z, মাল্টিভিটামিন, ১১টাকা পিস, দিনে ১টা করে ৬ মাসে, প্রায় ২০০০ টাকা। মানুষের কোন রোগের জন্যই মাল্টিভিটামিন খাওয়ার কথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন বই বা গবেষণাপত্রে লেখা নেই। মানুষের শরীরে একই সাথে সব ভিটামিন এর অভাব কখনোই হয় না।

যেগুলোর অভাব নেই সেগুলো খেলে মল মুত্রের সাথে বেরিয়ে যায় (কিছু কিছু লিভারে জমা হয়)। ফলে এই ওষুধের বেশিরভাগ উপাদানই শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে। কারও যদি কোন একটি দুটি ভিটামিন বা মিনারেলের অভাব থেকেও থাকে তারও উপকার হবে না কেননা এই মাল্টিভিটামিন এর বড়িতে সব ভিটামিন এত কম মাত্রায় যা অভাবজনিত প্রয়োজনীয় ডোজ এর তুলনায় অনেক কম।

৪. ৪র্থ ওষুধ, Carniten, এটি মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া একটি এমাইনো এসিড এবং প্রায় সব ধরনের প্রাণিজ খাবারে এটি পাওয়া যায়। যাদের লিভার বা কিডনি মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা খিচুনী রোগের কারণে বিশেষ ওষুধ খাচ্ছেন বা রেয়ার কিছু জেনেটিক রোগ ব্যতীত এই জিনিসের অভাব মানবদেহে হয় না।

কিডনি ড্যামেজ হওয়া ডায়ালাইসিস রোগীদের ক্ষেত্রে এটি সাধারনত ব্যবহার হতে দেখা যায়। প্রেসক্রিপশনটি যে রোগি বা যার নামে করা হয়েছে তার এ ধরনের রোগ আছে কিনা তা জানা যায়নি। কারণ রোগের বিবরন লেখা নেই প্রেসক্রিপশনে। আর যদি কিডনি বা লিভার ড্যামেজ থাকে তাহলে অন্য যেসব ডিব্বা খাওয়ানো হচ্ছে সেগুলো তার জন্য আরও ক্ষতিকর হবে। প্রতি পিস ৫ টাকা করে ৩মাসে এর পেছনে খরচ ৯০০ টাকা। 

৫. পরের ওষুধ Algecal Dx, ক্যালসিয়াম (600g)+ভিটামিন ডি। অর্থাৎ উচ্চমাত্রার ভিটামিন ডি ক্যাপসুল আলাদা করে দেয়ার পরেও এই ক্যালসিয়ামের সাথে ভিটামিন ডি আবারও দেয়া হচ্ছে। বড়ি প্রতি ১৬ টাকা করে ৬ মাসে খরচ ২৮৮০ টাকা। এই স্পেসিফিক ক্যালসিয়াম বড়ির বিশেষত্ব হলো এটি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট যা সামুদ্রিক শেওলা থেকে বের করা।

ক্যালসিয়াম বড়ি কম খরচে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট রূপে পাওয়া যায় ৫০০ গ্রাম ৫ টাকায়। ওষুধ কোম্পানি কিছুদিন পর-পর নতুন নতুন ক্যালসিয়াম বড়ি নিয়ে আসে শেওলার ক্যালসিয়াম, ঝিনুকের ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি। দাবী করে এগুলো সাধারন ক্যালসিয়াম এর চেয়ে বেশি শোষণ হয় শরীরে অথচ এর পক্ষে শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, যেটুকু আছে তাতে শোষনের পার্থক্য খুব বেশি নয়। সুতরাং ৫ টাকার স্থলে ১৬ টাকার বড়ির কোন মানে নেই। এছাড়ায় দুধ, ডিম, হাড়, গাঢ় সবুজ শাক, কলিজা, মাছ, মাংশ ইত্যাদিতেও ক্যালসিয়াম থাকে। বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব জনিত রোগের প্রকোপ বেশি, তাই এটি জরুরী। 

৬. ৬ নাম্বার ওষুধ, Ubi Q, এটি একটি এনজাইম CoQ10 এর একটি রূপ যা আমাদের শরীর নিজেই তৈরি করে। একবারে সুনির্দিষ্ট কিছু হৃদরোগ ছাড়া বাইরে থেকে এই সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পক্ষে কোন শক্ত ক্লিনিক্যাল এভিডেন্স নেই। ওষুধ কোম্পানি এটাকে 'দুর্বলতা কমানো, 'বয়স ধরে রাখা', 'ইমিউনিটি বুস্টার' ইত্যাসি চটকদার উপায়ে প্রমোট করে।

এসবের পক্ষে শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। শরীর এটাকে নিজেই তৈরি করে। এই প্রেসক্রিপশনে ১০০ মিলিগ্রাম Ubi Q, ৪৫ টাকা পিস দরে, দিনে ২টা করে ৬ মাসে খরচ ১৬,২০০ টাকা! ওদিকে গরুর হার্টে প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ মিলিগ্রাম, মাংসে ৩-৪ মিলিগ্রাম, মুরগিতে ২-৩ মিলিগ্রাম, তৈলাক্ত মাছে ৪-৮ মিলিগ্রাম, ডিমের কুসুমে ১-২ মিলিগ্রাম এই এনজাইম থাকে। 

৭. ফাইনালি, ৭ নাম্বার হলো ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ১০০০ মিলিগ্রাম। মাছের তেল ও ভেষজ তেল (সরিষা, সয়াবিন, চিয়া সিড, বাদাম)-এ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম সরিষা তেলে ৫০০০ মিলিগ্রামের বেশি ওমেগা-৩ থাকে। ১০০ গ্রাম রুই মাছে ৬০০ মিগ্রা, ১০০ গ্রাম পাঙ্গাসে ১২০০ মিগ্রা ওমেগা-৩ পাওয়া যায়। এই বড়িতে ১১ টাকা প্রতি পিসে ৩মাসে ৩৩০ টাকা খরচ।

এই সাপ্লিমেন্টও ওষুধ কোম্পানি ইমিউনিটি বুস্টার, বলকারক, প্রদাহ নিবারক, হৃদরোগ থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি নানা দাবী করে বিক্রি করে। আপাত সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে এসব দাবীর পক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই। সুনির্দিষ্ট কিছু রোগ যেমন উচ্চ মাত্রার ট্রাউগ্লিসারাইড কমাতে এই সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের পক্ষে কিছু প্রমাণ আছে। 

সুতরাং সব মিলিয়ে এই প্রেসক্রিপশনে খরচ ৩০ হাজার টাকার বেশি! অথচ কি রোগ, কি বৃত্তান্ত কিছুই লেখা নেই। সব ক'টি ওষুধই ফুড সাপ্লিমেন্ট যা নিয়মিত খাবারের মাধ্যমেই অনেক অনেক কম খরচে গ্রহন করা সম্ভব আরও অনেক বেশি পুষ্টি উপাদান সহ। ওষুধ প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পুরো প্রেসক্রিপশন ভরে শুধুমাত্র ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে যাচ্ছে এই লোক! একদিকে অন্যান্য চিকিৎসকদের নিয়মিত বিষোদগার করছে আবার নিজেই ৩০ হাজার টাকার সাপ্লিমেন্ট ধরিয়ে দিচ্ছে।

এই প্রতারণা নিয়ে অনেকে অনেকবার লিখেছেন কিন্তু তার সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস তাকে ইমিউন করে রাখে আইনের হাত থেকে। সম্ভবত এই রোগীর কাছ থেকে তিনি কোন ভিজিট রাখেন নি, কোন টেস্ট দেননি, ৩০ হাজার টাকা ধোঁকাবাজি বড়ি বিক্রি করেছেন শুধু। তাতেই রোগি শতভাগ খুশি হয়ে এই প্রেসক্রিপশন শেয়ার করেছেন ফেসবুকে।

পাঠক, আপনাকে প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে পারেন আপনি নিজেই। বাংলাদেশের কোন আইন আদালত এইসব সেলিব্রিটিদের কখনো স্পর্শ করে না। চটকদার প্রচারনায় বিভ্রান্ত না-হয়ে যাচাই করুন, প্রশ্ন করুন, উত্তর খুঁজুন উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ, বা গবেষণাপত্র অথবা সহজ উপায়ে চ্যাটজিপিটি থেকেও। শতভাগ না হলেও অন্তত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রতারণা ধরতে পারবেন ও সাবধান হতে পারবেন।"

লেখক: ডা. মো: মারুফুর রহমান

চিকিৎসক ও গবেষক 'দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড', যুক্তরাজ্য। (সিনিয়র পারফর্মেন্স মিজারমেন্ট স্পেশালিস্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সাস্কাচুয়ান, কানাডা)