Search

Thursday, September 2, 2010

পরিবহন ধর্মঘট

ছোট্ট মেয়েটা আজও কুড়িয়ে পাওয়া আজব জুতোটা পায়ে দিয়ে এক পাক ঘুরল।
মোলায়েম গলা ভেসে এলো, ‘খুকি, ভাল আছ?’
ছোট্ট মেয়েটা যার নাম, মৌ। মৌ কিন্তু মোটেও মিষ্টি করে হাসল না। মৌ রাগ রাগ গলায় বলল, ‘হেই ধৈত্য, তোমায় রোজ বলি আমায় খুকি বলবে না, তবু বলো, বিষয়টা কী, আমার নাম নাই?’

বিশাল দৈত্যটা মাথা নীচু করে রাখল, খুকি যে ওকে ‘ধৈত্য’ বলে এটা ওর একদম ভাল লাগে না। কেন, লম্বা আঙ্কেল বললে কি হয়? অনেক সাহস করে চোখ তুলে বলল, ‘মৌ, ধৈত্য বললে মনে কষ্ট হয়। দেও-দানবের মনে কষ্ট দেয়া ঠিক না।’

মৌ বালিশের সঙ্গে ঘুসাঘুসি খেলছিল। একতরফা খেলা, বালিশ বেচারা মার খেয়েই যাচ্ছিল, টুঁ-শব্দও করছিল না। সত্যি বলতে কী, বালিশদের পাল্টা মার দেয়ার নিয়ম নাই। বালিশের মাঝখানে মৌ প্রায় আধ হাত গর্ত করে ফেলেছে। মৌ ঝাকড়া চুল ঝাঁকিয়ে রাগী গলায় বলল, ‘আহ, কিছু জিজ্ঞেস না করলে কথা বলো কেন? তোমার মুখ থেকে বিশ্রী পচা গন্ধ বেরুচ্ছে। আজ আবারও মানুষ মেরেছ?’
অসম্ভব কষ্টে দৈত্যটার চোখ ভরে এল। ওর পায়ের কাছে মৌ’র গোসল করার ছোট্ট বাথটাবটা ছিল। পাঁচ নাম্বার ফুটবলের মতো একটাই চোখ টিপে গোপনে চোখের জল খালি বাথটাবে ফেলল। বাথটাব থেকে পানি একটুর জন্য উপচে পড়ল না। মনে মনে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। বাদশা সোলেয়মানের কৃপায় কী বাঁচাই না বেঁচে গেছে। মৌ দেখে ফেললে কী লজ্জাই না হতো! আড় চোখে তাকিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষের মাংস খাওয়া ছেড়েছে সেই কবে, যেদিন মৌ’র সঙ্গে দেখা হল, প্রতিজ্ঞা করল, সেই দিন থেকে।
এরপর থেকে কী কষ্ট! মরা জীব-জন্তুর মাংস খেয়ে ওর পেট নেমে গেল। একেকবার পাঁচশোটা করে পেট ধরার ওষুধ ‘এমোডিস’ খেতে হয়। এতগুলো ওষুধের দাম কী কম, যোগাড় করাও কী কম ঝামেলা!

দৈত্য অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ঘরটায় যেন ছোটখাট ঝড় বয়ে গেল। মৌ’র খেলনা সব উড়ে বেড়াতে লাগল। দৈত্য অসম্ভব লজ্জিত হয়ে খেলনাগুলো জড়ো করতে লাগল। কিছু খেলনা মোটা মোটা আঙুলের ফাঁক দিয়ে টুপটুপ করে পড়ে গেল। ভয়ে মৌ’র দিকে তাকাল না। কথা ঘুরাবার জন্য গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিন করে বলল, ‘আচ্ছা মৌ, তোমার তো অনেক বুদ্ধি, একটা বুদ্ধি দাও না।’
মৌ অবাক, ‘কী বুদ্ধি চাও?’
দৈত্যটা বলল, ‘এই যে আমার মুখে পচা গন্ধ হয়।’
‘অ-এইটা,’ মৌ মাথা এপাশ-ওপাশ করল, ‘এর তো কোন বুদ্ধি নাই।’
দৈত্য সাহস করে বলল, ‘তোমার মুখে গন্ধ হলে কি কর?’

মৌ বিরক্ত হল। থমথমে গলায় বলল, ‘কি যে বুদ্ধি তোমার! আমি কি তোমার মতো অচা-পচা জিনিস খাই, আর দিনে তিনবার ব্রাশ করি না!’
দৈত্যর চোখ চকচক করতে লাগল, ‘দাঁত ব্রাশ করলে দাঁত পরিষ্কার হয়, গন্ধ হয় না বলছ?’ দৈত্য স্বল্প পরিসরে অদ্ভুত কায়দায় ডিগবাজি খেয়ে আবার বলল, ‘ঠিক বলছ তো?’
‘হুঁ’
‘দাও না মৌ, তোমার একটা পুরনো ব্রাশ আমায়,’ দৈত্যর চোখে মিনতি ঝরে পড়ল।

মৌ হাসতে হাসতে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আমার ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার হবে তোমার দাঁত। হি-হি-হি, হিক-হিক-হিক, হো-হো-হো!’
‘হবে না তাহলে,’ দৈত্যর চোখ নিভে গেল।
‘উহুঁ, তোমার জন্য তো অনেক বড় ব্রাশ লাগবে। এত বড় ব্রাশ কোথায় পাওয়া যাবে। উম-ম, দাঁড়াও, ভাবতে দাও। ইউরেকা, পেয়েছি, টয়লেট পরিষ্কার করার যে বড় ব্রাশ, ওটা দিয়ে তোমার কাজ চলবে।’

দৈত্যর মনে হলো বুকটা ফেটে যাবে, কষ্টে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। এত বাতাস পৃথিবীতে অথচ ওর বুকটা মরুভূমি হয়ে আছে। মৌ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। আরে এ এরকম করছে কেন! মাথা খাটিয়ে কী দারুন একটা বুদ্ধিই না দিল।
মৌ দেবশিশুর মত হাসি দিয়ে বলল, ‘হয়েছে কি তোমার, এমন করছ কেন? বুদ্ধিটা পছন্দ হয়নি?’
‘না,’ দৈত্য রুদ্ধ গলায় বলল।
‘কেন-কেন?’
‘আমি টয়লেটের ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার ক্ক-র-ব,’ দৈত্য কথাটা শেষ করতে পারল না। ওর গলা ভেঙ্গে গেল।
‘অ, এই ব্যাপার! তোমার প্রেষ্টিজে লেগেছে। ধুর পাগলা, আমি তো তোমায় একদম নতুন একটা ব্রাশ কিনে দেব। পাগলু কোথাকার!’

এবার দৈত্যর মনের মেঘ কেটে গেল। কোদালের মতো আট-দশটা দাঁত বের করে দরাজ গলায় বলল, ‘মৌ, আমার মনে এখন বড় আনন্দ হইছে, আমি বড় খুশি হইছি। বল কি চাও আমার কাছে, যা চাইবে তাই পাবে।’

মৌ ভাবনায় তলিয়ে গেল। কি চাওয়া যেতে পারে? অনেকক্ষণ ভেবে বলল, ‘এই যে হরতাল হয়- মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না। ওদিন বাবা বলছিলেন, সারা দেশের মানুষ একটা বিশাল জেলখানায় আটকা পড়ে। মানুষের বড় কষ্ট-বড়ো কষ্ট। তুমি এই কষ্টের শেষ করো।’

দৈত্য লজ্জায় মিইয়ে গেল। প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বিড়বিড় করে বলল, ‘মৌ, এটা আমার ক্ষমতার বাইরে, তুমি অন্য কিছু চাও। সোনা-দানা, খাবার-দাবার, আকাশ ভ্রমণ- কি চাই বল?’
‘না, আমি অন্য কিছু চাই না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, হরতাল হলে দেশটার চাকা চারকোণা হলে হোক, হরতালের দিনে তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি তোমায় নিয়ে যাব, প্রমিজ।
‘না-না-না,’ মৌ’র জেদী গলায় বলল।
‘প্লিজ, মৌ, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মী-।’
‘না-না-না। আমি অন্য কিছু চাই না। হরতালে মানুষের কি কষ্ট হয় এটা আসলে তুমি বুঝতে পারছ না। তোমার কি, লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে মাইলের পর মাইল চলে যাও।’

দৈত্য টাক মাথা চুলকে বিব্রত গলায় বলল, ‘প্লিজ মৌ, প্লিজ, দয়া করো। তুমি অন্য কিছু চাও, বাদশা সেলেয়মানের কসম, আমি সঙ্গে সঙ্গে হাজির করব!’
‘না।’
‘আহ, তুমি কেন বড়দের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ। যারা এ দেশ চালায় তাদের মাথাব্যথা নাই যতো মাথা ব্যথা তোমার,’ এবার দৈত্যর গলায় উষ্মা প্রকাশ পেল।
মৌ গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল, ‘তুমি কোন কাজের না। আসলে তুমি মানুষের উপকার করতে চাও না। যাও, তুমি আমার সামনে থেকে। আর কখখনো আমার সামনে আসবে না, আজকের পর কখখনো আমি তোমাকে ডাকব না, আজ থেকে তোমার জন্য মৌ মরে গেছে।’
দৈত্য মিলিয়ে যেতে যেতে ছলছল চোখে ভাবল, ‘আহ, হরতাল থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতাটা থাকলে বেশ হতো!


*কেউ লেখাটা ভুলক্রমে পড়ে শেষ করে ফেললে সময় থাকতে এখন জানিয়ে দেই, এটা লিখেছিলাম ছোটদের জন্য। হা হা হা।
সঞ্জীব চৌধুরী [১] এটা কেন বড়দের পাতায় ছাপিয়েছিলেন আমি জানি না।

সহায়ক লিংক:
১. সঞ্জীব চৌধুরী: http://www.ali-mahmed.com/2007/11/blog-post.html

2 comments:

সুব্রত said...

এটা এই সাইটে আগেও পড়েছিলাম বলে মনে হচ্ছে।

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

রাইট!

ওটা ছিল বড়দের জন্যে, এটা ছোটদের। হা হা হা। @সুব্রত