Search

Thursday, January 28, 2010

নৃশংসতা-ক্রূরতা-নিষ্ঠুরতা!

পাঁচ জন খুনিকে চরম শাস্তি দেয়া হয়েছে। দলবাজের বাইরে সাধারণ একজন মানুষ হিসাবে এতে কারও দ্বিমত থাকার কথা না। মৃত্যুদন্ড থাকা উচিৎ কি উচিৎ না, সে অন্য প্রসঙ্গ। আমি যেটা বারবার বলে এসেছি, "রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না। ৩৪ বছর গেল নাকি ৩৪০ বছর তাতে কী আসে যায়!"
এই বিচারটা যথা সময়ে হলে আমরা কতিপয় দাম্ভিক এইসব মানুষদের পেছনের মূল হোতাদের পেয়ে যেতাম। এমন অনেকের নামই পর্দার পেছনেই পড়ে থাকবে। হয়তো জানা হবে না কখনও!
যথা সময়ে বিচারটা হলে খন্দকার মোশতাকের মত মহা বিশ্বাসঘাতক আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মরে যেতে পারতেন না। কাপুরুষ সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত, পেট চিরে আত্মহত্যা না করে ফেললে। অন্তত কর্নেল জামিলকে দেখে তাঁর লজ্জায় মরে যাওয়া উচিৎ ছিল।

এই ফাঁসিকে ঘিরে যেসব দেখলাম এতে নিজের মনুষ্যত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ি। আমি যেটা বলে আসছি, "আমাদের ভেতরের পশুটা বেরিয়ে আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। এ গ্রহের তাবৎ বড়ো মাপের মানুষদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকে এই পশুটিকে আটকাবার চেষ্টা করা।"
আফসোস, আমাদের ভেতরের পশুটাকে আমরা কেমন অবলীলায় বার করে ফেলি। আমি তো বলব, পশুটাকে বার হয়ে আসার জন্য উসকে দিচ্ছি। মিডিয়া নামের বিবেক এক পা এগিয়ে। ধরা যাক, আজকের (২৮ জানুয়ারি) প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠা। ঢাউস আকারে দুই জল্লাদের ছবি ছাপা হয়েছে। প্রথম পাতায় বিপুল আকারের এ ছবি কেন? এটা কী এতই জরুরী? আমরা কি এই খবরটার জন্য মুখিয়ে আছি কোন জল্লাদ ফাঁসি দিল, তার চেহারা মোবারক কেমন ছিল, তার পায়ে স্যান্ডেল ছিল নাকি স্যান্ডেল স্যু, সে ভেতরে আন্ডারওয়্যার পরেছিল নাকি লেংটি?
আজকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতা কি খুব শস্তা হয়ে গেছে? খবরের আকাল পড়েছে বুঝি! শহীদুল ইসলাম লালুর মৃত্যুর খবরটা দেখি ছাপা হয় বিজ্ঞপ্তি আকারে! ভাষাসৈনিক গাজীউর রহমানের চিরবিদায়ের খবর প্রথম পাতায় আসে না। সেখানে প্রথম পাতা কী এতটাই ফাঁকা যে এমন গার্বেজ দিয়ে ভরিয়ে দিতে হবে? আগামীতে হয়তো পড়ব, ডানের জল্লাদটার একটা ইয়ে অন্যটার চেয়ে এক ইঞ্চি নিচে ঝুলে থাকে...।

আহ, আমাদের উৎসুক জনতা! ভেতরের পশুটাকে কাঁধে নিয়ে এরা বেরিয়ে পড়েন তামাশা দেখতে। আগুনে সব পুড়ছে, কাছ থেকে দেখা চাই,
দেখা চাই ফাঁসিটাও। উৎসুক জনতার জন্য ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এগুতে পারে না, এম্বুলেন্স আটকে যায়। এ দেশেও সৌদির মত বর্বর দেশগুলোর মত উম্মুক্ত ফাঁসির আয়োজন হলে এদের অনেক উল্লাস হতো।
লাঠি-চার্জের পাশাপাশি এই সব ফাজিলদের হঠাতে জল-কামান ব্যবহার করা যেতে পারে। ভেজা কাপড়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে মজা দ্যাখ।

এখন স্যাটেলাইট টিভি এদের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে দেখছিলাম, এই ফাঁসিকে ঘিরে লাইভ অনুষ্ঠান প্রচারে একেকজনের কী হুড়াহুড়ি! কাঁপা কাঁপা গলায় ননস্টপ একেকজন বকে যাচ্ছেন, "তো যেটা বলছিলাম, আমরা আপনাদের পাঁচটা কফিন দেখিয়েছি। তো যেটা বলছিলাম চৌকিও আপনাদের দেখিয়েছি। এই চৌকিতে লাশগুলোকে গোসল করানো হবে। আপনারা জানেন তবুও বলি এই ফাঁসির রশি ম্যানিলা থেকে আনা হয়, এটাতে সবরি কলা দিয়ে মাখানো হয়। তো যেটা বলছিলাম, এম্বুলেন্স চলে এসেছে পাঁচটা। আপনার এম্বুলেন্সগুলো দেখতে পাচ্ছেন টিভি পর্দায়। তো যেটা বলছিলাম, একেক করে এই এম্বুলেন্স বের হয়ে যাবে এই গেটটা দিয়ে, গেটটা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন...।"
ভাগ্যিস, বলেনি, আপনারা যে এম্বুলেন্সগুলো দেখতে পাচ্ছেন এগুলোর প্রত্যেকটার চারটা করে চাকা। এবং আমাদের শেষ খবর অনুযায়ী এই চাকাগুলো স্টার্ট দিলেই ঘোরে।
আল্লা জানে মিডিয়ার কত শত লোক ওখানে গিয়েছিলেন? উৎসুক জনতার সঙ্গে এরা যোগ হলে মাছ বাজার হওয়ার আর অপেক্ষা করতে হয় না!

এভাবে ক্যামেরার চোখ একবার জেলগেইটে, কখনও ৩২ নম্বরে, কখনও-বা স্টুডিওতে ছুটাছুটি করছে। টক-শো চলছে। মন্ত্রী সাহেব পর্যায়ের লোকজন বক্তব্য রাখছেন। টক-শোর টক থামিয়ে ক্যামেরার চোখ ছুটে যাচ্ছে জেল গেটে বেরিয়ে আসা প্রথম এম্বুলেন্স দেখাতে। আবার টক-শো শুরু হলে তা থামিয়ে ক্যামেরা ছুটে যায় জেলগেটে। আবারও টক-শো শুরু হয়, থামে। একে একে বেরিয়ে আসা
পাঁচটা এম্বুলেন্স না দেখালে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে যেন।

এরপর আমার দেখা ভয়ংকর এক ঘটনা। মিডিয়ায় দেখাচ্ছে, কিছু লোকজন লাশবাহী এম্বুলেন্সকে লক্ষ করে জুতা ছুঁড়ছে, আবর্জনা ছুড়ছে। এটা আবার ঘটা করে টিভি পর্দায় দেখাচ্ছে। টক-শোতে থাকা সাবেক মন্ত্রী সাহেব এই জুতা ছোঁড়া নিয়ে খুব শাবাসীও দিচ্ছেন। কাজটা যে খুবই ভাল হচ্ছে এটা নিয়ে রসালো মন্তব্যও করলেন।

বেঁচে থাকতে এমন কুৎসিত দৃশ্য আর কখনও দেখব এমনটা আমি আশা করি না। জেলগেটে, এই লাশগুলো সরকারের কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় জুতা ছোঁড়া হয়েছে। লাশগুলোর মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকার ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। তাও আবার মিডিয়া ঘটা করে দেখায়! আবদুল মতিন খসরুর মত দায়িত্বশীল একজন মানুষ আবার এটার উপর শাবাসী-মন্তব্যও করেন!
আমি যেটা বলেছিলাম, ৪ জন জাতীয় নেতাকে জেলে হত্যা অন্য কোন হত্যার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কেননা ওই চার জন মানুষ সরকারের কাস্টডিতে ছিলেন তেমনি সরকারের কাস্টডিতে থাকা এই পাঁচটি লাশও।

লাশের প্রতি এমন আচরণ ভয়াবহ এক অন্যায়। এই শিক্ষাটা আমরা পাইনি কারণ আমাদের দেশের বড়ো বড়ো মানুষরা এসব নিয়ে গা করেন না। অথচ একটা লাশ সাধুর নাকি খুনির তাতে কী! লাশকে অসম্মান করলে ওই লাশের কিছুই যায় আসে না, জীবিত সমস্ত মানুষ নগ্ন-দিগম্বর হয়ে পড়ে।

*এক্ষণ প্রথম আলোয় এই খবরটা চোখে পড়ল, "দুই শিশুকে দেখা যায় ফাঁসির দাবির ব্যানার হাতে শীতের রাতে কারা ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।"
কোন নির্বোধের মাথা থেকে এই আইডিয়া বেরিয়েছে আল্লা মালুম। এই শিশুদের বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে কী বানাতে চাইছেন তাঁরাই জানেন। একটা চলমান বিষবৃক্ষ!

**আমার ধারণা ছিল, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যেহেতু লাইভ দেখানো হয় তাই এই দৃশ্যটা দেখানো হয়ে গেছে। কিন্তু যখন কালের কন্ঠ প্রথম পাতায় আয়োজন করে এই ছবি ছাপে তখন আমার ইচ্ছা করে, নিজেই নিজের মুখে থুথু দেই।

3 comments:

আবদুল্লাহ আল ইমরান said...

এই দেশের মিডিয়ার উপর কিছুদিন আগে যখন ক্রমাগত হামলা হচ্ছিল,তখন দেখে বেশ খারাপ লাগছিলো।কিন্তু এই খবরটা দেখার পর মনে হচ্ছে মাইর আরও দুইটা বেশি দেওয়া উচিত।চুতিয়াগিরি আর কত!
http://new.ittefaq.com.bd/news/view/127013/2012-08-14/2

আবদুল্লাহ আল ইমরান said...

আসল কথাটা লেখতেই ভুলে গেছি।হিজবুত তাহরীর সদস্যরা ধরা পড়েছে সেটা ব্যাপার না।নিউজের মধ্যে উল্লেখিত আটক ব্যাক্তিদের সাথে তাদের বাবা মার নাম উল্লেখপূর্বক কর্মস্থলের বর্ণনা কোন সাংবাদিকতার মধ্যে পড়ে আমি জানি না।সাংবাদিক কি একবারও ভাবেন নি,কর্মস্থলে কিংবা ব্যবহারিক জীবনে কি পরিমাণ হেনস্থার কিংবা লজ্জার শিকার হতে হবে বাবা মা গুলোকে?

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

আসলে মিডিয়ার লোকজনের উপর রাগ করে লাভ নাই। সমস্যাটা অন্যত্র...।
এই দেশের সমস্ত মিডিয়াগুলোর মালিকানা ব্যবসায়িদের হাতে। ফল যা হওয়ার তাই হয়। মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষকে যেভাবে নাচবে বলা হয় এঁরা সেভাবেই নাচেন, পেটের দায়ে...@আবদুল্লাহ আল ইমরান