Search

Thursday, August 17, 2023

পছন্দের ১০টি বই!

ছবিস্বত্ব: লেখক

লেখক, হিমাংশু কর (https://www.facebook.com/himangsu.kar)

"ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝামাঝি রয়েছে বিশাল এক ঘাসি জমি। এই অঞ্চলটাকে বলা হয় স্তেপ। শুধুমাত্র নদীর পাড়গুলো ছাড়া এই বিশাল অঞ্চলে বড় কোন গাছ নেই।
এই ঘাসি জমিতে আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে ঘুরে বেরাত একদল লোক। ওরা যে ভাষাটায় কথা বলত তাকে বলা হয় পাই ল্যাংগুয়েজ (PIE) বা প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। বাংলা করলে দাঁড়াবে প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। অর্থাৎ এটা হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার আদিরূপ। আমাদের ভারত উপমহাদেশের বাংলা, হিন্দি থেকে শুরু করে ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মান বা রাশিয়ান; পার্সিয়ান বা গুজরাটি, ইউরোপ এবং এশিয়ার অধিকাংশ ভাষার জন্ম হয়েছে এই প্রাচীন ভাষা থেকে। আজকের পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ কথা বলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায়।
Tripod শব্দটিকে যদি একটু ভালমতো খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন বাংলা আর ইংরেজির মধ্য কি অস্বাভাবিক মিল। এই Tri কে চাইলেই 'ত্রি' আর 'ট্রাই' দুইভাবেই উচ্চারণ করা যায়। ত্রি মানে তিন, যেমন ত্রিভুজের তিন। আর ইংরেজিতে ট্রাইপড মানে তিন-পা বিশিষ্ট। এই 'পদ' আর 'পড' দুইটার অর্থই পা। অর্থাৎ ইংরেজি ট্রাইপডকে চাইলে বাংলায় ত্রিপদ বলা যায়। অনুবাদও করতে হচ্ছে না। শুধু একটু উচ্চারণের পার্থক্য! এমন শত-শত শব্দ বের করা যাবে যেগুলো ইংরেজি এবং বাংলাতে খুবই কাছাকাছি। এই যে দুই প্রান্তের দুই ভাষার মিল, এর কারণ, এই দুইটি ভাষাই মূলত একটি আদি ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। আর সেই ভাষা হলো প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বা পাই (PIE) ল্যাংগুয়েজ।
প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা লোকগুলো থাকত কাস্পিয়ান সাগর আর কৃষ্ন-সাগরের তীরবর্তী স্তেপ অঞ্চলে। আজকে আমরা যে আধুনিক পৃথিবী দেখি, এক অর্থে সেই পৃথিবীর কারিগর হলো এই মানুষগুলো। ভাবলে অবাক হতে হয়, আজকের দিনের জার্মানি বা নরওয়ের ভাষা-সংস্কৃতির মূল বিষয়গুলো যেমন এসেছে ইন্দো-ইউরোপীয় কালচার থেকে, তেমনি এই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের ভাষা-সংস্কৃতির কোর বিষয়গুলোও এসেছে সেই সাত হাজার বছর আগে স্তেপে বাস করা একই মানুষগুলোর কালচার থেকে।
এই মানুষগুলো চাকা তৈরি করেছিল, পোষ মানিয়েছিল ঘোড়াকে, আর ব্রোঞ্জ যুগের কারিগরি জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়া জুড়ে। এই মানুষগুলো যখন সমগ্র ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার ছড়িয়ে পরে, তখন তারা সাথে করে নিয়ে যায় তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি। ওদের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ওরা যেসব অঞ্চলে গিয়েছিল সেসব অঞ্চলের মানুষকে ওরা তাদের নিজেরদের সংস্কৃতি দিয়ে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। আর তৈরি করেছিল আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি। তাই আধুনিক সভ্যতার শেকড় জানতে হলে প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয়দের ইতিহাস না-জেনে উপায় নেই।
ইন্দো-ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষদের উৎপত্তি ঘটেছিল মূলত বর্তমান ইউক্রেন এবং রাশিয়ার কিছু অংশে। এই জায়গাটা কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত। এই প্রাচীন মানুষগুলো প্রথমে শিকার ও খাবার সংগ্রহ করে জীবনযাপন করলেও পরে তারা বলকান সংস্কৃতির প্রভাবে পশুপালনে অভ্যস্ত হয়। এরা ধীরে ধীরে গবাদি পশু পালন শুরু করে এবং ঘোড়াকে পোষ মানায়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ব্রোঞ্জ যুগের হাতিয়ার এবং ব্রোঞ্জ যুগের প্রযুক্তি আয়ত্ত করে। তৈরি করে চাকা। এরপর ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে হঠাৎ করে এই অঞ্চলের আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
পুরো স্তেপ অঞ্চল আরও শুষ্ক এবং ঠাণ্ডা হয়ে পরে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের কারণে এই মানুষগুলো তখন তাদের ঘোড়া এবং পশুপাল নিয়ে স্তেপের মধ্যে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। আর এর ফলে এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের সংস্কৃতির জন্ম দেয়।
এই ধরনের সংস্কৃতিকে ইংরেজিতে বলা হয় পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক। পেট্রন হলো সামাজিকভাবে, ধনসম্পদের দিক থেকে বা শক্তির দিক থেকে উপরের শ্রেণীর লোক, আর ক্লায়েন্ট হলো দুর্বল বা গরীব শ্রেণীর কেউ। এই দুই শ্রেণী সামাজিকভাবে সমান না হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন জিনিস লেনদেনের মাধ্যমে দুই শ্রেণীই লাভবান হতে পারে। এই পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা সম্পূর্ণ নতুন এক সামাজিক সংগঠন তৈরি করতে পেরেছিল। এই নতুন সামাজিক সংগঠন, শক্তিশালী ভাষা, ঘোড়াকে পোষ মানানো, চাকার ব্যবহার ইত্যাদির ফলে ওরা চূড়ান্ত সফল হয়েছিল। ওরা ছড়িয়ে গিয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়ার হাজার হাজার কিলোমিটারের বিশাল অঞ্চল জুড়ে। তৈরি করেছিল আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি।

নৃবিজ্ঞানী ডেভিড এন্থনি তার হর্স, হুইল এ্যান্ড লাংগুয়েজ 'The Horse, the Wheel, and Language: How Bronze-Age Riders from the Eurasian Steppes Shaped the Modern World', বইতে দেখিয়েছেন যে, কারা এই ইন্দো-ইউরোপীয়, কীভাবেই বা তাদের উৎপত্তি; আর কীভাবেই বা এই একদল লোক আজকের আধুনিক পৃথিবীতে এত প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। ইন্দো-ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষ কারা বা কোথায় ওদের উৎপত্তি এই বিষয়ে বেশকিছু তত্ত্ব থাকলেও, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হলো কুরগান থিওরি বা কুরগান হাইপোথিসিস। ভাষাতত্ত্ব এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বইতে লেখক মূলত কুরগান থিওরির একটা নতুন রিভাইজড ভার্শন তৈরি করেছেন। 
মানবজাতি এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতি বা ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য বই। অনেক দিন ধরেই আমি দশটা বইয়ের একটা তালিকা তৈরি করতে চাচ্ছিলাম। যেখানে মানব জাতির অগ্রগতি এবং ইতিহাস নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো জায়গা পাবে। এই লেখাটার উদ্দেশ্য সেই দশটি বইকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এখানে সেই দশটা বই এবং লেখকের নামের পাশাপাশি বইগুলো কি বিষয়ে তা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি। বইগুলো হলো:

১. The Horse, the Wheel, and Language by David W. Anthony
২. Guns, Germs, and Steel by Jared Diamond
৩. Why Nations Fail by Daron Acemoglu and James A. Robinson
৪. 100 Million Years of Food by Stephen Le
৫. The Anglo-Saxons by Marc Morris
৬. Palestine- A Four Thousand Year History- Nur Masalha
৭. Sapiens by Yuval Noah Harari
৮. Pathfinders by Jim Al-Khalili
৯. Genghis Khan and the Making of the Modern World by Jack Weatherford
১০. The Power of Geography- Tim Marshall


হর্স হুইল ল্যাঙ্গুয়েজের পর এখন একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব জ্যারেড ডায়মন্ডের 'Guns, Germs, and Steel: Short History of Everybody for the Last 13,000 Years' এই বইটি নিয়ে। জ্যারেড ডায়মন্ড একজন জিওগ্রাফার, ইতিহাসবিদ এবং পক্ষিবিদ। তিনি বিজ্ঞানী হলেও লেখক হিসেবে বিখ্যাত। তার কিছু বিশ্লেষণ খুবই আকর্ষণীয়। বিশেষ করে তার এই বইটি খুবই বিখ্যাত। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই বইয়ের জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। পেয়েছে পুলিৎজার পুরষ্কার এবং এভেন্তিস পুরষ্কার। বলা হয় হারারির 'সেপিয়েন্স' বইটি রচনার পেছনে এই বইটির অনুপ্রেরণা রয়েছে। আসলে এই বইটি বিগ হিস্টরি জনরার একটি পথপ্রদর্শক বই।

এই 'গান, জার্মস এ্যন্ড স্টিল', বইটির পেছনে একটি ছোট্ট গল্প আছে। ডায়মন্ড তার গবেষণার কাজে একবার পাপুয়া নিউগিনিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সাথে আলাপ হয় স্থানীয় পলিটিশিয়ান ইয়ালির সাথে। কথায় কথায় ইয়ালি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা ইউরোপিয়ানরা এত-এত প্রযুক্তি তৈরি করেছ, আর আমরা সেগুলো ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা কেন নিজেরা তেমন কোন প্রযুক্তি তৈরি করতে পারিনি?
তাহলে ইউরোপিয়ানরা কি আমাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান? জ্যারেড ডায়মন্ড একজন জিওগ্রাফার, পাশাপাশি তিনি একজন ইতিহাসবিদ। তাই এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই তিনি দেখলেন, এখানে চলে আসছে ইউরেশিয়ান মানুষদের উৎপত্তি, তাদের আধিপত্য, ইতিহাসের বিভিন্ন মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা।
ডায়মন্ড হয়ত ইয়ালির এই প্রশ্নের উত্তর সেদিন বিস্তারিত দিতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এই প্রশ্নের জুতসই জবাব দিতে গিয়ে আস্ত একটা বই লিখে বসেন। এই প্রশ্নটা শুনতে সহজ হলেও এর সঠিক উত্তর খুজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মানবজাতির সুদূর অতীতে। বিগত ১৩ হাজার বছরে মানবজাতি কিভাবে আজকের অবস্থায় আসল সেই ইতিহাসটাই দেখানো হয়েছে এই বইতে। 
ইউরোপ-এশিয়ার মানুষেরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের পশুপালনের সাথে অভ্যস্ত। এই পশু তাদের জীবনযাপনকে একদিকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি তার পাশাপাশি পশুর শরীর থেকে যুগ-যুগ ধরে অনেক রোগের জীবাণু এই অঞ্চলের মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে।
ফলে হাজার বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের লাখ-লাখ মানুষ মারাও গেছে। কোন জীবাণুর দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হলে, হয় সে মানুষটি মারা যায়, আর যদি-না মারা যায়, তবে তার শরীরে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নিতে পারে। সব ক্ষেত্রে না-হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়। ফলে পশুপালনের অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলের মানুষের শরীরে এইসব রোগ জীবাণুর প্রতি এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইম্যুনিটি তৈরি হয়েছে।
অ্যামেরিকা মহাদেশে যে সাম্রাজ্যগুলো গড়ে উঠেছিল যেমন, অ্যাজটেক, মায়া বা ইনকা সভ্যতা, তারা পশুপালনে অভ্যস্ত ছিল না। অন্য কোন কারণেও তাদের সাথে পশুদের কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। এর ফলে প্রাণী শরীর থেকে খুব বেশি রোগ তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেও পারেনি, আর এর ফলে তাদের শরীরেও তেমন কোন ইম্যুনিটি তৈরি হয়নি। ইউরোপীয়রা যখন অ্যাজটেক বা এই ধরনের প্রাচীন আমেরিকান সাম্রাজ্য দখল করতে গিয়েছিল তখন ইউরোপীয়দের সংখ্যা স্থানীয়দের তুলনায় এতই কম ছিল যে আধুনিক অস্ত্র দিয়েও ওদের দেশটা দখল করা সম্ভব হতো না।
ইউরোপীয়দের আমেরিকা জয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি হলো, তাদের রোগ। ইউরোপীয়দের শরীর থেকে যে রোগগুলো আমেরিকানদের শরীরে প্রবেশ করেছিল সেটা তাদের এতই কাবু করে ফেলেছিল যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের জনসংখ্যার ৯০% মানুষ শেষ হয়ে যায়।
মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে বিজ্ঞান এভাবেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু ইউরোপিয়ানরাই নয়, আফ্রিকার বান্তু জাতিগোষ্ঠীর লোকদেরও এমন দেশদখলের ইতিহাস আছে। এর একটি বড় কারণ হলো, এরাও ইউরেশিয়ানদের মত কৃষিকাজ এবং পশুপালন করা মানুষ। ফলে বান্তুদেরও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ভাল।
কিভাবে স্থানীয় সম্পদ আর ভৌগোলিক অবস্থান এক অঞ্চলের মানুষকে অন্য অঞ্চলের মানুষদের উপর প্রভুত্ব করতে সাহায্যে করে, ইস্পাত আর বন্দুকের ব্যবহার কিভাবে ইউরোপীয়দের আজকের অবস্থানে নিয়ে এলো কিংবা পশুপালনের ফলে ইউরেশিয়ান মানুষরা কিভাবে ভাইরাসজনিত রোগের বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি অর্জন করেছিল, আর কিভাবে সেই ইম্যুনিটি ইউরোপিয়ানদের অ্যামেরিকা জয় করতে সাহায্য করেছিল সেইসব প্রশ্নের উত্তর শুধু নয়, এই বই মানবজাতির বিগত ১৩ হাজার বছরের যাত্রাটাকেই তুলে ধরছে। মানবজাতির ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে চাইলে এই বইটি 'একটি মাস্ট রিড'।
 
এরপর আলোচনা করব 'Why Nations Fail: The Origins of Power, Prosperity, and Poverty' এই বইটি নিয়ে। এটা আসলে ইকোনমিক্স নিয়ে লেখা পৃথিবীর সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি। তবে এটি কোন কাঠখোট্টা একাডেমিক ইকোনোমিক্সের বই না। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব কিছু রাষ্ট্র উন্নত এবং সম্পদের ভরপুর, অন্যদিকে কিছু রাষ্ট্র চরম দারিদ্রতার শিকার! কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন? এই বইতে দেখানো হয়েছে, কেন কিছু জাতি বা কিছু রাষ্ট্র কোনভাবেই উন্নতি করতে পারে না, আর কেনই বা কিছু রাষ্ট্র অন্যসব রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
বইটি লিখেছেন এমআইটির প্রফেসর ড্যারন অ্যাসেমগলু এবং আরেক বিখ্যাত অর্থনীতিবীদ প্রফেসর জেমস এ. রবিনসন। এই বইটি ২০১২ সালে প্রকাশের পর থেকেই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই বইতে এই দুই অর্থনীতিবিদ পৃথিবীর বিখ্যাত সব গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবার তত্ত্বকেই বাতিল করতে চেয়েছেন।
এই দলে আছে জ্যারেন্ড ডায়মন্ড, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেভিড ফিশার, ম্যাক্স ওয়েবারের মত বাঘা-বাঘা সব গবেষক। তাহলে কি আছে এই দুই অর্থনীতিবিদের তত্ত্বে? যা কিনা এইসব বড়-বড় দিকপাল গবেষকদের সবার থেকে আলাদা? লেখা বেশি বড় হয়ে যাবে বলে এই আলোচনায় আর গেলাম না। বইটি পড়ে ফেললেই উত্তর পাওয়া যাবে। 
 
এরপর '100 Million Years of Food: What Our Ancestors Ate and Why It Matters Today', লেখক স্টিফেন লি।
১০০ মিলিয়ন বছরের ইতিহাস! তবে ইতিহাস শুরু হয়েছিল মাত্র ৫০০০ বছর আগে। এর আগে চলে গেলে লিখিত জিনিসের কোন অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই বইয়ের লেখক স্টিফেন লি একজন নৃতত্ত্ববিদ। তিনি দেখিয়েছেন যে, লক্ষ-লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষরা যেসব পোকামাকড় খেত সেগুলো একদিকে যেমন ছিল প্রোটিনে ভর্তি, অন্যদিকে ছিল মিনারেলের ভান্ডার। আজকের দিনেও বিভিন্ন আদিবাসী এবং শিকারি জাতি-গোষ্ঠী সাধারণ খাদ্য হিসেবেই এগুলো খেয়ে থাকে।
লেখক ভদ্রলোক একাডেমিক গবেষণার পাশাপাশি ভিয়েতনাম, কেনিয়া, ভারত, লাতিন অ্যামেরিকার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেরিয়েছেন মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নতুন সব তথ্য খুঁজে পেতে। এই বইতে আপনি দেখতে পাবেন আমাদের পূর্বপুরুষরা কী কী খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকত, আর এটাও দেখতে পাবেন যে সেই লক্ষ বছরের পুরনো খাদ্যাভ্যাসটাই আসলে আমাদের শরীরের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। মানবজাতির ইতিহাসকে এটা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।

এরপরের বই চেঙ্গিস খানকে নিয়ে 'Genghis Khan and the Making of the Modern World'।
চেঙ্গিস খান এবং মঙ্গলদের সারা দুনিয়ার মানুষ বর্বর হত্যাকারী হিসেবেই জানে। কিন্তু ৭০ এর দশকে দুইজন ইতিহাসবিদ তাদের গবেষণা থেকে মঙ্গলদের দুর্দান্ত দুটি দিক তুলে আনেন। প্রথমত, মঙ্গলরা সম্পদের ভাগবাটোয়ারার ক্ষেত্রে ছিল খুবই সৎ। এর পাশাপাশি তারা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং চীনের মধ্য ইন্টিলেকচুয়ার যোগাযোগ বৃদ্ধিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
দ্বিতীয়, মঙ্গলরা যে ট্যাক্স আদায় করত তার জন্য তারা তাদের অধীন রাজাদের চাপ দিত না, বরং এর বদলে তারা বিজ্ঞান গবেষণাকে উৎসাহিত করত, যাতে করে তারা আরও বেশি কর আদায় করতে পারে। এছাড়াও এমনসব বিষয়ে মঙ্গল সাম্রাজ্যের অবদান আছে যা শুনলে হয়ত আপনি হতবাক হয়ে যাবেন। যেমন কাগজের মুদ্রার প্রথম শুরু চাইনিজরা করলেও এর ব্যপক ব্যবহার প্রথম মঙ্গলরাই করে। এই বইতে ইতিহাসবিদ জ্যাক ওয়েদারফোর্ড দেখিয়েছেন যে, চেঙ্গিস খান এবং তার উত্তরসুরীরা আসলে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার বিকাশে অনেক বেশি প্রভাব রেখেছিল।
 
এর পরের বই 'Pathfinders: The Golden Age Of Arabic Science'। লেখক ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জিম আল খলিলি।  শুনতে আজব লাগলেও ইতিহাসের প্রায় ৭০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞান চর্চার জন্য যে আন্তর্জাতিক ভাষা ছিল, সেটা হলো আরবি! জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী আল হিথাম ফ্রান্সিস বেকনেরও প্রায় ৫০০ বছর আগে সায়েন্টিফিক মেথড জিনিসটা ডেভেলপ করেছিলেন। এ্যলজেব্রা শব্দটির উৎপত্তিই হয়েছে আরবি আল-জবর থেকে।
শুধু এ্যলজেব্রাই নয়, আল-খারেজমির লেখা পাটিগণিতের একটি বই ল্যটিন ভাষায় অনুবাদ হয়। আর সেই বইয়ের মাধ্যমেই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থা জিনিসটা পরিচিতি পায়। এরপর আছে আবু রায়হান আল বিরুনী। যাকে তুলনা করা যায় একমাত্র লিওনার্দো দ্য ভিঞ্জির সাথে। শুধু এই গুটিকয়েক বিজ্ঞানীই নয়। ইতিহাসের বিশাল একটা সময় জুড়ে আরব ও পারস্যের এই বিজ্ঞানীরাই ছিলেন তখন বিজ্ঞানের কাণ্ডারি। ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জিম আল খলিলি আরবের বিজ্ঞানচর্চার সেই স্বর্ণযুগকে নতুন করে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই 'পাথফাইন্ডার' বইতে।

এবার 'The Anglo-Saxons: A History of the Beginnings of England', এই বইটি।
আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে ব্রিটেনের ইতিহাস হঠাৎ করেই একটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রোমান সাম্রাজ্য ব্রিটেন থেকে তাদের সেনাবাহিনী তুলে নেয়। এর ফলে শুরু হয় অর্থনীতিক মন্দা। পাশাপাশি সেনাবাহিনী না-থাকায় বহিঃশত্রুর আক্রমনের থেকে কোন নিরাপত্তা নেই। শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী দেশটি হঠাৎ করেই মারাত্মক রকমের অনিরাপদ হয়ে ওঠে।
ধনী গরীব সবাই গাদাগাদি করে প্রাচীন পাহাড়ি দুর্গগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। যে দুর্গগুলো সেই লৈহযুগের পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে ছিল, সেগুলোই হয়ে উঠে মানুষের একমাত্র নিরপদ আশ্রয়। দেশে শিক্ষাদান পড়াশুনা সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটেনে নেমে আসে এক অন্ধকার যুগ।
এই পরিত্যক্ত রাজ্যে একদিন একদল নতুন মানুষ প্রবেশ করে। ওরা এসেছিল ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের যে উত্তর সীমান্ত, তারও বেশ খানিকটা বাইরে থেকে। সেই অর্থে ওরা ছিল একদমই ভিনদেশী। এই মানুষগুলোই এংলো-স্যাক্সন নামে পরিচিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল যোদ্ধা।
এরা ব্রিটেনের আদিবাসী রাজাদের সাথে মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে দেয়। তবে এই দলটার বেশিরভাগ লোকই এসেছিল নতুন আবাদী জমির খোঁজে। আশা ছিল নতুন অঞ্চলে গিয়ে খামার করে, কৃষিকাজ করে একটা সুখী জীবন পাবে। ওরা ব্রিটেনের দক্ষিণ এবং পূর্ব উপকূলে এসে নেমেছিল। এরপর ধীরে ধীরে দ্বীপের নিচু অঞ্চলগুলো দখল করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। আর এভাবে এরা তৈরি করে সম্পূর্ণ এক নতুন সভ্যতা।
এই আংলো স্যাক্সনরাই মূলত ইংল্যান্ডের গোড়া পত্তন করেছিল। প্রাচীন ব্রিটেনের দাস ব্যবস্থা, পুরনো মন্দির, ছোট-ছোট বাড়ি, কেল্টিকদের দ্রুইড যাদুকরের পরিবর্তে আজকের দিনে ব্রিটেনের যে পরিচিত চেহারা আমরা দেখি, তার ভিত্তি তৈরি করেছিল এই আংলো স্যাক্সনরা। ভাইকিংদের থর এবং ওডিনের পুজার বদলে নতুন যে বিশ্বাস আজকের দিনে আমরা দেখি, সেটার শুরুও হয়েছিল ওদের আমলের শেষের দিকেই। ওরা আসার আগে মানুষ কথা বলত ল্যাটিন এবং কেল্টিক ভাষায়।
আজকের দিনে সেই ভাষার কোন অস্তিত্ব আধুনিক ইংরেজির মধ্যে পাওয়া যাবে না। ওরা যে ভাষাটার প্রচলন করেছিল সেটাকে এখন আমরা ওল্ড ইংলিশ বা প্রাচীন ইংরেজি বলি। আজকের দিনে আমরা যে আধুনিক ইংরেজি দেখি সেই ইংরেজির প্রায় ২৬ শতাংশ এসেছে এ্যাংলো-স্যাক্সনদের ওল্ড ইংলিশ থেকে।
মার্ক মরিস তার এই বইতে অ্যাংলো স্যাক্সোনদের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করেছেন একদম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। ইংল্যান্ডের প্রাচীন কালের ইতিহাস নিয়ে যত বিরোধ আছে সেগুলো তিনি সমাধান করতে চেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং দলিলের উপর ভিত্তি করে।
ইতিহাস বিশ্লেষণের পাশাপাশি তিনি আরও আকর্ষণীয় একটি কাজ করেছেন, সেটি হলো, এই বিষয়ক লিজেন্ডগুলোকেও তিনি তার আলোচনায় এনেছেন। এইসব লিজেন্ডের কতটুক সঠিক আর কতটুক লিজেন্ড সেটাও এক কৌতূহলোদ্দীপক টপিক। যারা প্রাচীন ইংল্যান্ড এবং এর উৎপত্তি নিয়ে আগ্রহী তারা নিঃসন্দেহে শুরু করে দিতে পারেন বইটি।

প্রথমে এই লিস্টে সেপিয়েন্স বইটা রাখতে চাচ্ছিলাম না। কারণ হারারি যখন প্রচলিত তথ্যগুলোকে একটা গল্প বলার ন্যারেটিভে বর্ণনা করেছেন সেটা খুবই সুন্দর হয়েছে। কিন্তু তিনি তখন নিজে নতুন কোন ব্যাখ্যা দিতে গিয়েছেন ঠিক তখনই ভুল করেছেন। ভুল ব্যাখ্যাগুলো থাকলেও সেপিয়েন্স বইটা বিগ হিস্টরি জিনিসটাকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। তার গল্প বলার স্টাইলটা পুরো বইটা পড়ার একটা আগ্রহ তৈরি করে।
ফলে এই বইটাও লিস্টে থাকল। কারণ অল্পকিছু ভুল ব্যাখ্যা বাদ দিলে এই বইটি অসাধারণ একটি বই। এই বইতে হারারি মানবজাতির সাংস্কৃতিক বিবর্তনকে গল্প বলার ন্যারেটিভে খুব সাবলীলভাবে বলে গেছেন। পাশাপাশি রয়েছে হারারির গুড হিউমার।

এই লিস্টে রয়েছে প্যালেটাইনের বিগত ৪০০০ বছরের ইতিহাস নিয়ে একটি বই, 'Palestine: A Four Thousand Year History'। লেখক নিজে একজন প্যালেস্টাইনের ইতিহাসবিদ।
প্যালেস্টাইন শব্দটা বাংলাতে ফিলিস্তিন হিসেবেই বেশি পরিচিত। এই প্যালেস্টাইন নামটা এসেছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে। তবে প্যালেস্টাইন দেশটি কিন্তু বাইবেলের থেকেও পুরনো। আর এই বিষয়টিকেই জোর দিয়ে দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনি লেখক নুর মাসালহা। আমরা যদি ফিলিস্তিন জাতি এবং তাদের সংস্কৃতির আদি উৎসের খোঁজ করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে, বাইবেলেরও বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনি জাতির একটি নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পরিচয় রয়েছে।
সেই ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে। আমরা যদি বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখি তাহলে দেখা যাবে, বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার কারণে আসলে ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে কণফ্লিক্টও এর একটি বড় কারণ। তবে ফিলিস্তিনের ইতিহাস আসলে খুবই রোমাঞ্চকর এবং অনেক জটিল। এই বইয়ের পাতায় পাতায় সেই জট খোলা হয়েছে।

সব শেষে রয়েছে টিম মার্শালের 'পাওয়ার অফ জিওগ্রাফি'। এই বইটি নিয়ে আমি এর আগে একটি আলাদা পোস্ট লিখেছিলাম, তাই সেটি আর এই এখানে দিলাম না।
হ্যাপি রিডিং।"
*লেখক, হিমাংশু কর (লেখকের লিখিত সদয় অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত)
**ছবিস্বত্ব: লেখক

No comments: